আসুন নাক গলাই by শামীমুল হক
নাক গলানো বাঙালির একটি ঐতিহ্যিক অভ্যাস।
জানুক আর না জানুক সব কিছুতেই তারা নাক গলাবেন। ভাবখানা এমন যেন তিনি
সবজান্তা। কি রাজনীতি, সমাজনীতি, দুর্নীতি কিংবা কূটনীতি সব নীতিতেই যেন
তারা সিদ্ধহস্ত। আড্ডায়, গল্পে, অনুষ্ঠানে, বাসে, হাটে, মাঠে, চা দোকানে
ক’জন এক হলেই হলো- শুরু হয়ে যাবে আলোচনা। রাজনীতি যেন সবার মুখস্থ। একজন
একটা লাইন বললো তো অন্যজন বলে ফেলবে দশ লাইন। আর এ নিয়ে হরহামেশা লেগে যায়
তর্ক। তর্ক থেকে কখনও কখনও বেধে যায় লঙ্কাকাণ্ড। বাঙালি অলস সময় কাটাতে খুব
বেশি পছন্দ করেন। আর অলসদের নাক গলানো ছাড়া কাজ কি? এদেশে একজন উপার্জন
করেন আর ১৪ জন তার ওপর ভরসা করে চলেন। ভিনদেশে ১৪ জনই উপার্জন করে সংসারকে
এগিয়ে নেন। গ্রামেগঞ্জে দেখা গেছে কোন বাড়ির এক ভাই মধ্যপ্রাচ্যে, আমেরিকা
কিংবা ইউরোপের কোন দেশে গেলে অন্য ভাইয়েরা সারা দিন টো টো করে ঘুরে বেড়ায়।
বিকালে জামা-কাপড়ে পারফিউম মাখিয়ে রাস্তায় বেরোয়। মানুষ তাদের তোয়াজ করে।
কারণ তারা টাকা খরচ করতে পারছে। কোন চা দোকানে বসলে সবাইকে চা খাওয়ায়। ফলে
তাদের কদর বেড়ে যায়। বিদেশে থাকা ওই ভাই-ই যখন দেশে এসে বিয়ে করে, সংসার
সাজায় তখন বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট। একদিন দেখা যায় ওই ভাই আর টাকা পাঠাচ্ছে
না। বউয়ের নামে টাকা পাঠাচ্ছে। আস্তে আস্তে তাদের চেহারা বদলে যেতে থাকে।
এখন আর মানুষকে চা খাওয়াতে পারে না। পারফিউম মেখে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্যও দেখা
যায় না। তখন বুঝতে পারে কি ভুলই না করেছে জীবনে। ছুটতে থাকে কাজের খোঁজে।
গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে এমন হাজারো চিত্র চোখের সামনে। আসলে সময়ের মূল্য নেই
এদেশে। আমরা সময়ের মূল্য দিতে জানি না। হিসাব করে প্রতিটি সেকেন্ড পার
করলে কেউ-ই চলতে গিয়ে হোঁচট খাবে না- এটা নিশ্চিত। আর এই নিশ্চিত বিষয়টাতে
অনিশ্চিত সবাই। কথায় বলে, যার নাই কোন গতি সে করে রাজনীতি। সত্যিই এখন
প্রতিটি ঘরেই রয়েছে নেতা। এই দল না হলে ওই দলের নেতা তিনি। এই নেতারা আরও
সমাজকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। সারা দিন এখানে ওখানে ঘুরে ধান্ধায়। কত যে
ধান্ধা তাদের। কেউ করে থানার দালালি, কেউ বা ছোটে গমের পেছনে। কেউ তদবিরে
থাকে ব্যস্ত। সকালে খালি পকেটে বের হয় রাতে, বাড়ি ফিরে পকেট ভর্তি করে। আর
নাক গলানোতেও তাদের জুড়ি নেই। কোথাও কোন আড্ডায় একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু
হলে সেখানে নাক গলাবেই। কারণ, তারাই তো নেতা। তাদের নাক গলাতেই হবে।
পৃথিবীতে নাকি পিঁপড়ার নাক সবচেয়ে বড়। কোথাও একটু গুড় লাগিয়ে দেখুন পিঁপড়ার
নাক কত বড়। কোত্থেকে যে পিঁপড়ার সারি ওই গুড়ের কাছে পৌঁছে যাবে তা খেয়ালই
করতে পারবেন না। তবে এই তথ্য এখন মুছে গেছে। এখন বাঙালির নাকই বড় হয়ে গেছে।
তারা গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে পৌঁছে যাবে জায়গায়। কেউ তাদের রুখতে পারবে না। সব
জায়গায় এখন নাক গলানোদের দাপট। এ দাপটে কত জীবন যে নষ্ট হচ্ছে এর কোন
ইয়ত্তা নেই। তারপরও নাক গলানো বন্ধ হচ্ছে না। আবার কেউ কেউ আছেন যারা
যেদিকে পাল্লা ভারি সেদিকেই ঝুঁকে পড়েন। ফলে সমাজের কোন উপকার হচ্ছে না।
নৈতিক অবক্ষয়ে ছেয়ে যাচ্ছে সমাজ। ভারতীয় ফেনসিডিল আর মিয়ানমারের ইয়াবায়
ছেয়ে গেছে গোটা দেশ। যুব সমাজ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এসবের দিকে। সীমান্তবর্তী
জেলাগুলোতে গেলে চোখে পড়ে কিভাবে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ভরে
দলে দলে যুবকরা ছুটছে। লক্ষ্য, ফেনসিডিল আর ইয়াবা আনা। কিভাবে যে দেশের যুব
সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এসব নেশা, তা না দেখলে বোঝা মুশকিল। কৌশলে দেশের
যুব সমাজকে ধ্বংসের লাইসেন্স নিয়েছে কেউ কেউ। তাইতো সীমান্তে বিএসএফ এত
গুলি ছোড়ে, এত মানুষ মারে। নিজের জমিতে কাজ করতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরে।
কিন্তু ফেনসিডিল পাচারকারীদের দিকে একটি গুলিও ছুড়তে শোনা যায়নি। আজ
পর্যন্ত একজন ফেনসিডিল পাচারকারীকে মরতে শুনিনি। ভারত সীমান্ত লাগোয়া
সহস্রাধিক ফেনসিডিল কারখানা রয়েছে যেখানে রাতদিন ফেনসিডিলের উৎপাদন হচ্ছে।
আর তা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। এসব সাবাড় হচ্ছে বাংলাদেশের যুব
সমাজের পেটে। এটা হলো যুব সমাজকে ধ্বংস করার ফন্দি। যুব সমাজ ধ্বংস হলেই
দেশ পেছনে ফিরে যাবে। এগোতে পারবে না। কিন্তু এ থেকে উত্তরণ ঘটাবে কে?
এতদিকে নাক গলায় সবাই এদিকে কেউ নাক গলায় না কেন? কি স্বার্থ এখানে? ইদানীং
আবার ফরমালিন নিয়ে আলোচনা সবখানে। ফরমালিনে নাক গলাতে শুরু করেছেন সবাই।
পচে যাওয়া রোধ করতে মাছ, ফলমূল, শাক সবজিসহ কাঁচা মালামালে ফরমালিন মেশায়
ব্যবসায়ীরা। এ ফরমালিন মানুষের দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। রোগ-বালাইয়ের
পাশাপাশি মারাত্মক ব্যাধি ক্যানসারও ছড়ায় এ ফরমালিন। এ ফরমালিন যে
রাজনীতিকে এত চাঙ্গা করে তুলবে কে জানতো? দেশের দুই দলের দুই শীর্ষ নেতৃত্ব
এখন ফরমালিন ব্যবহার নিয়ে নাক গলাচ্ছেন। বাজার থেকে ফরমালিন যখন এত উঁচুতে
গিয়ে ঠেকেছে নিশ্চয় এর মূল্য এখন অনেক বেশি। ফরমালিন ব্যবহারকারী
ব্যবসায়ীরাও সাহস পাবেন। তারা এখন বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন- আসুন আমার ফলে
ফরমালিন দেয়া আছে। মাসের পর মাস রাখুন। পচবে না। নষ্ট হবে না। এতদিন যারা
নাক গলানো থেকে দূরে ছিলেন তারাও এখন নাক গলাতে পারেন। তবে নাক গলানো যদি
ভাল’র জন্য হয় তাহলে সমাজ উপকৃত হবে। লাভবান হবে। নাক গলানো তাই ভাল’র জন্য
হোক- এটাই চাওয়া হোক সবার। সবশেষে বলবো- আসুন আমরা নাক গলাই। তবে সেটা যেন
হয় ভাল কাজে। শুভ কাজে। দেশের মঙ্গলে।
No comments