এডিপির সংস্কার কি অসম্ভব? by মাহফুজ কবীর
আগামী অর্থবছরে (২০১৪-১৫) বাজেটের আকার
আড়াই লাখ কোটি টাকা হতে পারে বলে মাননীয় অর্থমন্ত্রী এরই মধ্যে ইঙ্গিত
দিয়েছেন। তাই যদি হয়, তাহলে বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় এটি ১৩ দশমিক ৬
শতাংশের মতো বৃদ্ধি পাবে। আগের অর্থবছরের প্রস্তাবিত বরাদ্দের তুলনায় এ
বছরের বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছিল ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। অনেকেই আশা করেছিলেন, গত বছর
যেহেতু রাজনৈতিক কারণে অর্থনীতিতে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি
হয়েছে, তাই অর্থনীতিকে তার প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধির পথে রাখতে বাজেটে সরকারি
বিনিয়োগ ও রাজস্ব প্রণোদনা একটু বেশিই থাকবে। অবশ্য মাননীয় অর্থমন্ত্রী
বাজেটের আকার সম্পর্কে যে রকম ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাতে করে এটা মধ্যমেয়াদি
বাজেট কাঠামোর (এমটিবিএফ) প্রক্ষেপণ থেকে অনেকখানি কম হবে। এতে দুটো
মৌলিক প্রশ্নের উদয় হয়: এমটিবিএফের প্রক্ষেপণ কি নির্ভরযোগ্য? এমটিবিএফ
অনুযায়ী বাজেটের লক্ষ্যগুলো কি পূরণ হবে?
প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনীতির যে ক্ষতি গত বছর হয়ে গেছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারি বিনিয়োগ কর্মসূচিকে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে। এরই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম ফলদায়ক গতানুগতিক এডিপির কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের এমন একটি মধ্যমেয়াদি সরকারি বিনিয়োগ কর্মসূচির দিকে যেতে হবে, যা আমাদের টেকসই ও উঁচু প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করতে পারবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এডিপির মধ্যে যেহেতু প্রকল্পগুলো বেশ কয়েক বছরব্যাপী বিস্তৃত এবং এমটিবিএফে মন্ত্রণালয় ও বিভাগ অনুযায়ী প্রকল্পসমূহ দেখানো থাকলেও কেন এ রকম একটি মধ্যমেয়াদি সরকারি বিনিয়োগ কর্মসূচি প্রণয়ন করা দরকার? এরই মধ্যে অবশ্য আমরা এডিপির সম্পদ ব্যয়, ফলাফল ও কার্যকারিতা নিয়ে বেশ কিছু কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। এডিপিকে এমনিতে একটি ‘কৃষ্ণগহ্বর’ও বলা হয়েছে এটা বোঝানোর জন্য যে টাকা শুধু খরচই হয় কিন্তু তা কাজে আসে না।
দীর্ঘদিন ধরে এডিপির এ রকম হতাশাব্যঞ্জক ফলের কারণ কী? কারণ মূলত তিনটি। প্রথমত, দিন দিন এটি একটি বিরাট আকারের জাহাজে পরিণত হয়েছে, যার মধ্যে বিদায়ী অর্থবছরে এক হাজারটির মতো অনুমোদিত এবং প্রায় ৮০০ অনুমোদনহীন প্রকল্প রয়েছে। অনুমোদনহীন প্রকল্পগুলোকে ‘সবুজ পাতায়’ রাখা হয়েছে অর্থবছরের যেকোনো সময় একনেক থেকে ‘সবুজ সংকেত’ পাওয়ার আশায়। এর মধ্যে রয়েছে সংসদ সদস্যদের ব্যক্তিগত চেষ্টায় তৈরি হওয়া অনেক রাজনৈতিক প্রকল্প। আর তা হবেই না বা কেন? তাঁরা তো এডিপি প্রণয়ন–প্রক্রিয়ায় তাঁদের সংসদীয় এলাকার জন্য উন্নয়ন প্রকল্পের সুপারিশ করার আনুষ্ঠানিক সুযোগ পান না। তাই এডিপিকে আপাতদৃষ্টিতে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ মনে হলেও এতে এত বেশিসংখ্যক সরকারি বিনিয়োগ প্রকল্প থাকে যে এদের সঠিক ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা একটি দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
দ্বিতীয়ত, এডিপি প্রকৃত অর্থে ‘প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০-২০২১’ এবং ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যগুলোকে ধারণ করতে অনেকখানি ব্যর্থ হয়েছে৷ যদিও মুখে বলা হচ্ছে যে প্রেক্ষিত ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুসারে এডিপির প্রকল্পগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে।
তৃতীয়ত, সম্পদের ঊর্ধ্বসীমা ও ব্যয়ের লক্ষ্য অনুযায়ী বার্ষিক বরাদ্দের কারণে প্রতি অর্থবছরের শেষ দিকে অর্থ ব্যয়ের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, যাকে ‘চতুর্থ প্রািন্তক ব্যাধি’ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত তিন অর্থবছরে ৪০ শতাংশের ওপর এডিপির অর্থ ব্যয় হয়েছে চতুর্থ প্রািন্তকে, আর শুধু জুন মাসেই খরচ হয়েছে এক-চতুর্থাংশের মতো। আর ঘুষ-দুর্নীতির উপস্থিতির কারণে ফি বছর বিরাট আকারে সরকারি অর্থের অপচয় হয় বলে ধারণা করা হয়, যা কিনা মধ্যমেয়াদি সরকারি বিনিয়োগের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ব্যয় করলে অনেক ভালো ফল বয়ে আনতে পারত।
বর্তমানে বাংলাদেশে দ্বৈত বাজেটিং হচ্ছে, যার কারণ মূলত পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থ বিভাগের মধ্যে যথেষ্ট আলাপ-আলোচনার অভাবে এডিপি ও এমটিবিএফের মধ্যে সৃষ্ট দুর্বল সংযোগ। এডিপির প্রক্রিয়ায় মধ্যমেয়াদি কাঠামো না থাকার কারণে সম্পদ বরাদ্দে ও প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতা সৃষ্টি হচ্ছে। এমটিবিএফে যেহেতু খাতওয়ারি পরিকল্পনা নেই, তাই খাতওয়ারি বাজেট বলতে মূলত কতগুলো মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের সমষ্টিই বোঝায়, যেগুলো কিনা মন্ত্রণালয় বা বিভাগের পরিকল্পনা শাখা থেকে তৈরি করা হয়েছে। ফলে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উদ্দেশ্যগুলো বার্ষিক বাজেটের মাধ্যমে যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে বাস্তবায়িত হতে পারে না। আশ্চর্য হলেও সত্য, ‘দৃশ্যকল্প ২০২১’ অনুযায়ী দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে আমরা মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে চাইলেও উন্নয়ন কর্মসূচির কোনো গুণগত পরিবর্তন দেখা যায়নি। সেই সত্তরের দশকের ১৭টি খাতের যে কাঠামো এডিপিতে রাখা হয়েছিল, তার মধ্যেই আমরা আটকে আছি।
এডিপির প্রক্রিয়ায় এ ধরনের একটি বড় সংস্কার আনতে চাইলে শুরুটা আসতে হবে নীতিগত ঘোষণার মধ্য দিয়ে। অর্থমন্ত্রী তাঁর ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় শুধু কয়েকটি বাক্য যোগ করেই এটি করতে পারেন। অবশ্য সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে সিদ্ধান্তটি আসতে হবে।
বাংলাদেশের জন্মলগ্নে উন্নয়নের একটি ঐতিহাসিক গুরুদায়িত্ব নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের জন্ম হয়েছিল। বর্তমান বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠানটিকে জাতীয় পরিকল্পনার প্রাণকেন্দ্রে নিয়ে যেতে চাইলে এর কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস দরকার। এখন এর ভূমিকা হতে হবে মন্ত্রণালয়সমূহকে কৌশলগত দিকনির্দেশনা প্রদান এবং জাতীয় ও খাতওয়ারি অগ্রাধিকার অনুসারে নির্দেশনামূলক পরিকল্পনা প্রণয়ন। এ জন্য এর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বাড়াতে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। পাশাপাশি, মন্ত্রণালয়গুলোর পরিকল্পনা শাখার দক্ষতাও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে হবে, যাতে করে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে না আসতে পারে।
পরিশেষে, পরিকল্পনা এজেন্সিসমূহ এবং বাইরের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একটি মধ্যমেয়াদি অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যাতে করে সরকারি এজেন্সিগুলোর পরিকল্পনা প্রণয়নে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য দক্ষতা ও কৃৎকৌশল হস্তান্তর করা যায়। এতে করে একটি ফলপ্রসূ মধ্যমেয়াদি সরকারি বিনিয়োগ-কাঠামো প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
ড. মাহফুজ কবীর : অর্থনীতিবিদ; ঊর্ধ্বতন গবেষণা ফেলো, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ।
mahfuzkabir@yahoo.com
No comments