জিন্দেগানি মেঘের পানি ভাইস্যা যাবে দরিয়ায়... by মোকাম্মেল হোসেন
নৈঃশব্দের
একটা ভাষা আছে। সেই ভাষার মধ্যে কী আকুতি লুকিয়ে থাকে, তা বোঝা যায় যখন
পৃথিবীতে সন্ধ্যা নামে। আকুতি মেশানো সন্ধ্যা-কাব্যের সেই রূপ আমি
মৃত্যুপথযাত্রী আবদুর রশিদের চোখের ভাষায় ফুটে উঠতে দেখলাম। আবদুর রশিদ
আমার প্রতিবেশী। ভোরের নবীন সূর্য সকাল-দুপুর ও বিকালের পথ পাড়ি দিয়ে রাতের
আঁধারের কাছে যেভাবে নিজেকে সমর্পণ করে, আবদুর রশিদের জীবনও শৈশব-কৈশোর,
যৌবন ও বার্ধক্য পাড়ি দিয়ে এখন মৃত্যুর কাছে সমর্পিত হচ্ছে। ঈদের আগের দিন এ
ঘটনার সাক্ষী হতে গিয়ে মনটা বিষাদে ভরে উঠল। জিলহজ মাসের চাঁদ খুশির যে
বারতা নিয়ে এসেছে, বিশ্বের লাখো কোটি প্রাণে তার ছোঁয়া লেগেছে। এরকম
আনন্দময় একটা সময়ে একজন মানুষ মারা যাচ্ছে- মেনে নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছে
আমার। কিন্তু না মেনে উপায় কী? মৃত্যু অবধারিত। অমোঘ। এ অমোঘ নিয়তি এড়ানোর
সাধ্য কোনো জীবের নেই। জন্মিলে মরিতে হইবে- অমর কে কোথা ভবে!
আবদুর রশিদের জানাজা শেষ করে বাড়িতে এসেছি, লবণ বেগম বলল-
: তাসিনের আব্বা, একটা জিনিস ভুল হইয়া গেছে!
লবণ বেগমের মুখে ভুল শব্দটি উচ্চারিত হতে শুনে ছন্দ মেলানোর লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। সুর করে বললাম-
ভুলে ভুলে জীবন গেল-
কন্যা, প্রথম যেদিন তোমার সঙ্গে দেখা হল
সেটাও একটা ভুল ছিল।
ভুলে ভুলে জীবন গেল-
ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে
আবার তোমার ভুল হল।
ভুলে ভুলে জীবন গেল-
জীবনখাতার প্রতি পাতায়
ভুলের কাব্যই লেখা হল।
ভেবেছিলাম, ছন্দ শুনে লবণ বেগমের ঠোঁটের কোনায় হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠবে। তার বদলে সে নির্বাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। লবণ বেগমের দু’হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম-
: আরে পাগলি, ভুল মানুষেরই হয়। শয়তান কোনো ভুল করে না। এইবার বল- নতুন কইরা আবার কী ভুল করলা!
স্বাভাবিক হতে লবণ বেগমের আরও কিছুটা সময় লাগল। এক পর্যায়ে সে বলল-
: তোমারে মোরব্বা আনার কথা বলতে ভুইল্যা গেছিলাম।
- মোরব্বা দিয়া কী হবে?
: জর্দা রান্না করব।
- জর্দার প্রয়োজন কী? মিষ্টির আইটেম হিসেবে সেমাই আর পায়েস তো আছে!
: সেমাই-পায়েস আর কয়জনরে দেওয়া যাবে! মানুষ তো শুধু আমরা একলা না। পাড়া-প্রতিবেশী আছে, গরিব-মিসকিনরা আছে। ঈদের দিন তাদের সামনে একটা কিছু না দিলে কেমন দেখায়!
ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে আনন্দ। সবার সঙ্গে খুশি ও আনন্দ ভাগাভাগি করে নিলে তবেই ঈদ সার্থক হয়। কাজেই লবণ বেগমের কথা অগ্রাহ্য করি কী করে!
বাড়ি থেকে বের হচ্ছি- হঠাৎ আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির তেজ কিছুটা কমলে হেঁটে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে জয়বাংলা বাজারে পৌঁছার পর মুক্তাগাছার বাসে উঠে বসেছি, লবণ বেগম ফোন করে জিজ্ঞেস করল-
: তুমি কই?
- বাসে।
: বাসে কেন!
- মুক্তাগাছা যাইতেছি।
: এই কাদা-বৃষ্টির মধ্যে মুক্তাগাছা যাইতেছ কীজন্য!
- মোরব্বা আনতে।
: আরে পাগল! মোরব্বা আনতে তোমারে মুক্তাগাছা যাইতে বলছে কে! আমি আরও ভাইব্যা বইসা রইছি- অষ্টধার বাজারে গেছ তুমি!
- মোরব্বা হইল বেকারির আইটেম। অষ্টধার বাজারে তো কোনো বেকারি নাই। সেই জন্য মুক্তাগাছা যাইতেছি...
মুক্তাগাছা ঢোকার পথে হাতের ডানপাশে প্রাচীন জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মাত্র কয়েকঘণ্টা আগে মারা যাওয়া আবদুর রশিদের কথা মনে পড়ল। মৃত্যু এমনই এক ফয়সালা যে, বিশাল জমিদারিত্বও এর থাবা থেকে জমিদারকে রক্ষা করতে পারেনি। কপর্দকহীন আবদুর রশিদ যে পথের পথিক হয়েছে, প্রতাপশালী জমিদারকেও সেই একই পথের পথিক হতে হয়েছে।
ঈদের দিন আগেভাগে ঈদগাহ মাঠে পৌঁছে প্রথম কাতারে জায়নামাজ পেতে বসা আব্বার অনেক দিনের অভ্যাস। এ ঈদেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আব্বার সঙ্গে চাঁনপুর শের মাহমুদ সরকার ঈদগাহ মাঠে ঈদের নামাজ পড়তে গেছি। সবাই উঠে দাঁড়ানোর পর ইমাম সাহেব মাইকে ঈদের নামাজের নিয়ম বলে দিচ্ছেন। একটু পরেই নামাজ শুরু হবে। এমন সময় মহিষমারির ফরাজি বাড়ির একজন এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল-
: হুজুর! আমার আব্বা নামাজের জন্য উঠে দাঁড়ানোর পরপরই স্ট্রোক করেছেন। তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। আমি আমার আব্বার জন্য সবার কাছে দোয়া চাই...
পিতার বেঁচে থাকা নিয়ে সন্তানের এই যে আকুলতা- তা সর্বজনীন। কিন্তু মৃত্যু এমনই এক বিধান যে, সে ছেলেমেয়ের কাছ থেকে মা ও বাবাকে কিংবা মা-বাবার কাছ থেকে ছেলেমেয়েকে, স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে অথবা স্ত্রীর কাছ থেকে স্বামীকে, ভাইয়ের কাছ থেকে বোনকে বা বোনের কাছ থেকে ভাইকে কেড়ে নেয়। মায়ার বাঁধনে, স্নেহের সিন্দুকে, শ্রদ্ধার আসনে ও ভালোবাসার পিঞ্জরে বন্দি করেও মানুষ কোনোভাবেই আরেকজন মানুষকে ধরে রাখতে পারে না।
নামাজের পর বাড়িতে এসে চুপচাপ কোরবানির আয়োজন শুরু করলাম। কোরবানি নিয়ে আজকাল এ দেশে নানারকম মাতামাতি চলে। অনেকের কাছেই কোরবানি মানে ত্যাগ নয়, বরং তুমুল প্রতিযোগিতা। নামাজ শেষে ফেরার পথে দেখলাম, অনেকেই রাস্তার পাশে কোরবানির পশু বেঁধে রেখেছে। এর পেছনে প্রচ্ছন্ন রয়েছে বিজ্ঞাপন-মানসিকতা। যেন তারা বলতে চাচ্ছে- হে লোকজন, দেখ- আমার কোরবানির ষাঁড় কত বড়। তার ঠ্যাং কত মোটা। তার কুঁজ কত উঁচু। অথচ আল্লাহপাক কোরবানির পশুর আকার-আয়তন ও ওজন দেখেন না, দেখেন শুধু কোরবানিদাতার ঈমান ও নিয়ত। তার দরবারে কোরবানির পশুর হাড়-গোশত-রক্ত-চামড়া কিছুই পৌঁছে না, পৌঁছে শুধু ত্বাকওয়া। আফসোস! যে জিনিস ত্যাগের, যে বস্তু দানের- তা নিয়ে মানুষ তোকাব্বরি করে, অহংকার করে। অহংকারীকে আল্লাহপাক পছন্দ করেন না। তারপরও মানুষ তার রূপ-যৌবন, ধনদৌলত, ক্ষমতা এবং জ্ঞান-গুণ নিয়ে অহংকার করে। জ্ঞান নিয়ে গরিমা করতে গিয়ে আমি একবার ভয়ানক রকম অহংকারী হয়ে উঠেছিলাম। ঘটনাটা ঘটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরপরই। মহসিন হলের একটা গণরুমে দশ-বারোজন মিলে থাকি। একদিন আড্ডায় সিনেমার প্রসঙ্গ উঠল। সেই সূত্র ধরে সত্যজিৎ রায়ের নাম উচ্চারিত হতেই সাতক্ষীরার খোকন বলল-
: সত্যজিৎ রায় কে?
খোকনের প্রশ্ন শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গেল। সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে গড়গড় করে লম্বা একটা লেকচার দেয়ার পর ভর্ৎসনার সুরে খোকনকে বললাম-
: ব্যাটা বলদ! এই জ্ঞান-বুদ্ধি লইয়া ভার্সিটিতে পড়তে আসছস? যা, হল থেইক্যা বাইর হইয়া যা।
এ ঘটনার পর রাতে ঘুমোতে গিয়ে দেখি ঘুম আসছে না। অনুশোচনার আগুনে অহংকারের শেষ কণাটি পুড়ে ছাই না হওয়া পর্যন্ত ছটফট করে কাটালাম। এর পর মাঝরাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে খোকনকে বললাম-
: তোমার সঙ্গে আজ আমি যে আচরণ করেছি, তা ঠিক হয়নি। আমি দুঃখিত। খুবই দুঃখিত ও লজ্জিত। এ জন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী...
খোকনের ঘটনা আমাকে সাধু-সন্তে পরিণত করেনি সত্য, তবে আমার ভেতরের অহমিকাবোধের বৃক্ষটিকে সমূলে উপড়ে ফেলতে সাহায্য করেছে। আমি যখন অফিস-আদালতে পদ-পদবিওয়ালা লোকজনকে অহংকারে ফেটে পড়তে দেখি, বিত্তশালীর ধন-গরিমা প্রত্যক্ষ করি, জ্ঞানীর জ্ঞান-গরিমা অবলোকন করি- নীরবে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে শুধু এ মিনতি জানাই- রাব্বুল আলামিন, তুমি মানুষের বিবেক জাগ্রত কর। তাদের উপলব্ধিবোধের প্রসার ঘটাও। আমার এ অবস্থা দেখে আব্বা ঠাট্টা করে মাঝেমধ্যে বলেন-
: যুগ পাল্টাইয়া গেছে। এখন কারও ঘাড়ে ধইরা এইটা আন, ওইটা কর- না বললে কোনো কাজ হয় না। যে যুগের যে বাও- সেই বাওমতন না চইল্যা তুমি ভদ্রলোক সাজতে গেলে পদে পদে ঠকবা!
ঠকলে ক্ষতি নেই, কিন্তু আমি অহংকার করব কিসের ভিত্তিতে? দম্ভ করব কোন ভরসায়? আমার এ জিন্দেগানি হচ্ছে মেঘের পানির মতোই ক্ষণস্থায়ী। দরিয়ার পানি বাষ্প হয়ে মেঘ হয়। সেই মেঘ তিন দিনের বাহাদুরিকে সম্বল করে আকাশে ভেসে বেড়ায়। পরে বাতাসের ধাক্কায় পুনরায় দরিয়ার বুকেই ফিরে আসে। কত দিল্লিশ্বর-বঙ্গেশ্বর, কত রাজা-মহারাজা, কত বাদশাহ-সম্রাট-সুলতান পৃথিবীর বুকে দম্ভভরে পদচারণা করেছে, কিন্তু কালসে াতে ভেসে যাওয়ার নিয়তি থেকে কেউ রেহাই পায়নি। আমিও পাব না।
ঈদের একদিন পরেই ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিতে হল। মোগলরা বাংলা মুল্লুককে ‘দোজখ’ বলে অভিহিত করত। তাদের কথিত সেই দোজখ ছিল খাদ্যে পরিপূর্ণ। তাই দোজখ হলেও এর মায়া তারা ত্যাগ করতে পারত না। বর্তমানে ঢাকা শহরও আমার কাছে নরকতুল্য। নরকতুল্য হলেও এ শহর আমার রুটি-রুজির সংস্থান করছে। কাজেই না ফিরে উপায় নেই। ফিরছি রেলগাড়িতে চড়ে। রেল নিয়ে ইতিমধ্যে বিস্তর বলা হয়েছে। আর কিছু বলার প্রয়োজন মনে করি না। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, আমি ছাড়তে চাইলেও রেল তো আমাকে ছাড়ে না! এর প্রমাণ পেলাম টয়লেটে ঢুকতে গিয়ে। টয়লেটের দরজা একটু ফাঁক করেই সাপ দেখে ভয় পাওয়া মানুষের মতো পিছিয়ে এলাম। পিছিয়ে এলেও নিস্তার নেই। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যাওয়াটা খুবই জরুরি। পকেট থেকে রুমাল বের করলাম। রুমাল দিয়ে আমাকে দু’চোখ বাঁধতে দেখে পাশ থেকে একজন বলে উঠল-
: ঘটনা কী ভাই! আপনে চোখে রুমাল বান্ধতেছেন কেন?
- রেলের সঙ্গে কানামাছি খেলব।
কথা শুনে আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন হেসে উঠল। এবার অন্য একজন বলে উঠল-
: আপনে চোখ বাইন্ধা ট্রেন থেইক্যা লাফ দিবেন না তো?
আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম-
: না রে ভাই! রেলের অবস্থা এখনও এতটা খারাপ হয় নাই যে, তা দেইখ্যা মনে লাফ দেওয়ার বাসনা জাগবে। আমি যাব টয়লেটে।
- তাইলে চোখে রুমাল বান্ধার প্রয়োজন কী!
: প্রয়োজন আছে। বোবার যেমন কোনো শত্র“ নাই, তেমনি যে চোখে দেখে না, তার কোনো শরম নাই। টয়লেটের ভেতরে শরম পাওয়ার মতো কিছু পদার্থ আছে। সেইটা যাতে দেখতে না হয় সেজন্য চোখ বাইন্ধ্যা অন্ধ সাজছি।
টয়লেট থেকে বের হয়ে সিটে বসতে যাব- এমন সময় আমার সামনের আসনে বসা যাত্রীর মাথার উপর ঘুরতে থাকা ফ্যান নাট-বল্টুসহ ভেঙে তার কাঁধে পড়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি উঠে তাকে জিজ্ঞেস করলাম-
: ভাই, ব্যথা পাইছেন?
আতংকে ভদ্রলোকের চেহারা কালো হয়ে গেছে। তিনি কোনোমতে বললেন-
: না, না। তেমন কিছু হয়নি।
ভাওয়াল গাজীপুর রেলস্টেশনে পৌঁছার পর বিপরীত দিকে থেকে আসা একটি ট্রেনের সঙ্গে ক্রসিং হওয়ায় আমাদের ট্রেন অনির্ধারিত যাত্রাবিরতি করল। ট্রেন থেকে নামলাম। ভাওয়াল গাজীপুর নামের সঙ্গে ভাওয়াল রাজার ইতিহাস জড়িয়ে আছে। ভাওয়াল রাজার ইতিহাস যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনি বেদনাবিধুর। রানী ও তার ভাই সম্পত্তির লোভে রাজাকে বিষ খাওয়ানোর পর থেকেই মূলত এ উপাখ্যানের শুরু।
ভাওয়াল রাজার উপাখ্যান নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমার শ্বশুরবাড়ির দরজার উপরে টাঙিয়ে রাখা একটা কাচের ফ্রেম চোখের সামনে ভেসে উঠল। সাদা কাপড়ের ওপর রঙিন সুতা দিয়ে কাজ করে আমার শাশুড়ি তাতে লিখেছেন-
এ সংসার মরুময়
কেহ কারও নয়
জ্ঞাতি বন্ধু ভ্রাতা যত
পথের পরিচয়।
জীবন মানেই পথচলা। জন্মের মধ্য দিয়ে জীবনপথের পথিক মানুষ তার পথচলা শুরু করে। আর তার পরিসমাপ্তি ঘটে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। চলার পথে অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়। সখ্য হয়। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে মানুষ আসলে একা। সে একা পৃথিবীতে আসে। আবার একাই তাকে চলে যেতে হয়।
বাঁশি শুনে ট্রেনে উঠে বসলাম। বাঁশির এ সুর কখন কার কানে জীবনের শেষ বাঁশির সুর হিসেবে ধ্বনিত হবে- আমরা কেউ কি তা জানি?
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
আবদুর রশিদের জানাজা শেষ করে বাড়িতে এসেছি, লবণ বেগম বলল-
: তাসিনের আব্বা, একটা জিনিস ভুল হইয়া গেছে!
লবণ বেগমের মুখে ভুল শব্দটি উচ্চারিত হতে শুনে ছন্দ মেলানোর লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। সুর করে বললাম-
ভুলে ভুলে জীবন গেল-
কন্যা, প্রথম যেদিন তোমার সঙ্গে দেখা হল
সেটাও একটা ভুল ছিল।
ভুলে ভুলে জীবন গেল-
ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে
আবার তোমার ভুল হল।
ভুলে ভুলে জীবন গেল-
জীবনখাতার প্রতি পাতায়
ভুলের কাব্যই লেখা হল।
ভেবেছিলাম, ছন্দ শুনে লবণ বেগমের ঠোঁটের কোনায় হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠবে। তার বদলে সে নির্বাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। লবণ বেগমের দু’হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম-
: আরে পাগলি, ভুল মানুষেরই হয়। শয়তান কোনো ভুল করে না। এইবার বল- নতুন কইরা আবার কী ভুল করলা!
স্বাভাবিক হতে লবণ বেগমের আরও কিছুটা সময় লাগল। এক পর্যায়ে সে বলল-
: তোমারে মোরব্বা আনার কথা বলতে ভুইল্যা গেছিলাম।
- মোরব্বা দিয়া কী হবে?
: জর্দা রান্না করব।
- জর্দার প্রয়োজন কী? মিষ্টির আইটেম হিসেবে সেমাই আর পায়েস তো আছে!
: সেমাই-পায়েস আর কয়জনরে দেওয়া যাবে! মানুষ তো শুধু আমরা একলা না। পাড়া-প্রতিবেশী আছে, গরিব-মিসকিনরা আছে। ঈদের দিন তাদের সামনে একটা কিছু না দিলে কেমন দেখায়!
ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে আনন্দ। সবার সঙ্গে খুশি ও আনন্দ ভাগাভাগি করে নিলে তবেই ঈদ সার্থক হয়। কাজেই লবণ বেগমের কথা অগ্রাহ্য করি কী করে!
বাড়ি থেকে বের হচ্ছি- হঠাৎ আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির তেজ কিছুটা কমলে হেঁটে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে জয়বাংলা বাজারে পৌঁছার পর মুক্তাগাছার বাসে উঠে বসেছি, লবণ বেগম ফোন করে জিজ্ঞেস করল-
: তুমি কই?
- বাসে।
: বাসে কেন!
- মুক্তাগাছা যাইতেছি।
: এই কাদা-বৃষ্টির মধ্যে মুক্তাগাছা যাইতেছ কীজন্য!
- মোরব্বা আনতে।
: আরে পাগল! মোরব্বা আনতে তোমারে মুক্তাগাছা যাইতে বলছে কে! আমি আরও ভাইব্যা বইসা রইছি- অষ্টধার বাজারে গেছ তুমি!
- মোরব্বা হইল বেকারির আইটেম। অষ্টধার বাজারে তো কোনো বেকারি নাই। সেই জন্য মুক্তাগাছা যাইতেছি...
মুক্তাগাছা ঢোকার পথে হাতের ডানপাশে প্রাচীন জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মাত্র কয়েকঘণ্টা আগে মারা যাওয়া আবদুর রশিদের কথা মনে পড়ল। মৃত্যু এমনই এক ফয়সালা যে, বিশাল জমিদারিত্বও এর থাবা থেকে জমিদারকে রক্ষা করতে পারেনি। কপর্দকহীন আবদুর রশিদ যে পথের পথিক হয়েছে, প্রতাপশালী জমিদারকেও সেই একই পথের পথিক হতে হয়েছে।
ঈদের দিন আগেভাগে ঈদগাহ মাঠে পৌঁছে প্রথম কাতারে জায়নামাজ পেতে বসা আব্বার অনেক দিনের অভ্যাস। এ ঈদেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আব্বার সঙ্গে চাঁনপুর শের মাহমুদ সরকার ঈদগাহ মাঠে ঈদের নামাজ পড়তে গেছি। সবাই উঠে দাঁড়ানোর পর ইমাম সাহেব মাইকে ঈদের নামাজের নিয়ম বলে দিচ্ছেন। একটু পরেই নামাজ শুরু হবে। এমন সময় মহিষমারির ফরাজি বাড়ির একজন এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল-
: হুজুর! আমার আব্বা নামাজের জন্য উঠে দাঁড়ানোর পরপরই স্ট্রোক করেছেন। তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। আমি আমার আব্বার জন্য সবার কাছে দোয়া চাই...
পিতার বেঁচে থাকা নিয়ে সন্তানের এই যে আকুলতা- তা সর্বজনীন। কিন্তু মৃত্যু এমনই এক বিধান যে, সে ছেলেমেয়ের কাছ থেকে মা ও বাবাকে কিংবা মা-বাবার কাছ থেকে ছেলেমেয়েকে, স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে অথবা স্ত্রীর কাছ থেকে স্বামীকে, ভাইয়ের কাছ থেকে বোনকে বা বোনের কাছ থেকে ভাইকে কেড়ে নেয়। মায়ার বাঁধনে, স্নেহের সিন্দুকে, শ্রদ্ধার আসনে ও ভালোবাসার পিঞ্জরে বন্দি করেও মানুষ কোনোভাবেই আরেকজন মানুষকে ধরে রাখতে পারে না।
নামাজের পর বাড়িতে এসে চুপচাপ কোরবানির আয়োজন শুরু করলাম। কোরবানি নিয়ে আজকাল এ দেশে নানারকম মাতামাতি চলে। অনেকের কাছেই কোরবানি মানে ত্যাগ নয়, বরং তুমুল প্রতিযোগিতা। নামাজ শেষে ফেরার পথে দেখলাম, অনেকেই রাস্তার পাশে কোরবানির পশু বেঁধে রেখেছে। এর পেছনে প্রচ্ছন্ন রয়েছে বিজ্ঞাপন-মানসিকতা। যেন তারা বলতে চাচ্ছে- হে লোকজন, দেখ- আমার কোরবানির ষাঁড় কত বড়। তার ঠ্যাং কত মোটা। তার কুঁজ কত উঁচু। অথচ আল্লাহপাক কোরবানির পশুর আকার-আয়তন ও ওজন দেখেন না, দেখেন শুধু কোরবানিদাতার ঈমান ও নিয়ত। তার দরবারে কোরবানির পশুর হাড়-গোশত-রক্ত-চামড়া কিছুই পৌঁছে না, পৌঁছে শুধু ত্বাকওয়া। আফসোস! যে জিনিস ত্যাগের, যে বস্তু দানের- তা নিয়ে মানুষ তোকাব্বরি করে, অহংকার করে। অহংকারীকে আল্লাহপাক পছন্দ করেন না। তারপরও মানুষ তার রূপ-যৌবন, ধনদৌলত, ক্ষমতা এবং জ্ঞান-গুণ নিয়ে অহংকার করে। জ্ঞান নিয়ে গরিমা করতে গিয়ে আমি একবার ভয়ানক রকম অহংকারী হয়ে উঠেছিলাম। ঘটনাটা ঘটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরপরই। মহসিন হলের একটা গণরুমে দশ-বারোজন মিলে থাকি। একদিন আড্ডায় সিনেমার প্রসঙ্গ উঠল। সেই সূত্র ধরে সত্যজিৎ রায়ের নাম উচ্চারিত হতেই সাতক্ষীরার খোকন বলল-
: সত্যজিৎ রায় কে?
খোকনের প্রশ্ন শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গেল। সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে গড়গড় করে লম্বা একটা লেকচার দেয়ার পর ভর্ৎসনার সুরে খোকনকে বললাম-
: ব্যাটা বলদ! এই জ্ঞান-বুদ্ধি লইয়া ভার্সিটিতে পড়তে আসছস? যা, হল থেইক্যা বাইর হইয়া যা।
এ ঘটনার পর রাতে ঘুমোতে গিয়ে দেখি ঘুম আসছে না। অনুশোচনার আগুনে অহংকারের শেষ কণাটি পুড়ে ছাই না হওয়া পর্যন্ত ছটফট করে কাটালাম। এর পর মাঝরাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে খোকনকে বললাম-
: তোমার সঙ্গে আজ আমি যে আচরণ করেছি, তা ঠিক হয়নি। আমি দুঃখিত। খুবই দুঃখিত ও লজ্জিত। এ জন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী...
খোকনের ঘটনা আমাকে সাধু-সন্তে পরিণত করেনি সত্য, তবে আমার ভেতরের অহমিকাবোধের বৃক্ষটিকে সমূলে উপড়ে ফেলতে সাহায্য করেছে। আমি যখন অফিস-আদালতে পদ-পদবিওয়ালা লোকজনকে অহংকারে ফেটে পড়তে দেখি, বিত্তশালীর ধন-গরিমা প্রত্যক্ষ করি, জ্ঞানীর জ্ঞান-গরিমা অবলোকন করি- নীরবে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে শুধু এ মিনতি জানাই- রাব্বুল আলামিন, তুমি মানুষের বিবেক জাগ্রত কর। তাদের উপলব্ধিবোধের প্রসার ঘটাও। আমার এ অবস্থা দেখে আব্বা ঠাট্টা করে মাঝেমধ্যে বলেন-
: যুগ পাল্টাইয়া গেছে। এখন কারও ঘাড়ে ধইরা এইটা আন, ওইটা কর- না বললে কোনো কাজ হয় না। যে যুগের যে বাও- সেই বাওমতন না চইল্যা তুমি ভদ্রলোক সাজতে গেলে পদে পদে ঠকবা!
ঠকলে ক্ষতি নেই, কিন্তু আমি অহংকার করব কিসের ভিত্তিতে? দম্ভ করব কোন ভরসায়? আমার এ জিন্দেগানি হচ্ছে মেঘের পানির মতোই ক্ষণস্থায়ী। দরিয়ার পানি বাষ্প হয়ে মেঘ হয়। সেই মেঘ তিন দিনের বাহাদুরিকে সম্বল করে আকাশে ভেসে বেড়ায়। পরে বাতাসের ধাক্কায় পুনরায় দরিয়ার বুকেই ফিরে আসে। কত দিল্লিশ্বর-বঙ্গেশ্বর, কত রাজা-মহারাজা, কত বাদশাহ-সম্রাট-সুলতান পৃথিবীর বুকে দম্ভভরে পদচারণা করেছে, কিন্তু কালসে াতে ভেসে যাওয়ার নিয়তি থেকে কেউ রেহাই পায়নি। আমিও পাব না।
ঈদের একদিন পরেই ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিতে হল। মোগলরা বাংলা মুল্লুককে ‘দোজখ’ বলে অভিহিত করত। তাদের কথিত সেই দোজখ ছিল খাদ্যে পরিপূর্ণ। তাই দোজখ হলেও এর মায়া তারা ত্যাগ করতে পারত না। বর্তমানে ঢাকা শহরও আমার কাছে নরকতুল্য। নরকতুল্য হলেও এ শহর আমার রুটি-রুজির সংস্থান করছে। কাজেই না ফিরে উপায় নেই। ফিরছি রেলগাড়িতে চড়ে। রেল নিয়ে ইতিমধ্যে বিস্তর বলা হয়েছে। আর কিছু বলার প্রয়োজন মনে করি না। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, আমি ছাড়তে চাইলেও রেল তো আমাকে ছাড়ে না! এর প্রমাণ পেলাম টয়লেটে ঢুকতে গিয়ে। টয়লেটের দরজা একটু ফাঁক করেই সাপ দেখে ভয় পাওয়া মানুষের মতো পিছিয়ে এলাম। পিছিয়ে এলেও নিস্তার নেই। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যাওয়াটা খুবই জরুরি। পকেট থেকে রুমাল বের করলাম। রুমাল দিয়ে আমাকে দু’চোখ বাঁধতে দেখে পাশ থেকে একজন বলে উঠল-
: ঘটনা কী ভাই! আপনে চোখে রুমাল বান্ধতেছেন কেন?
- রেলের সঙ্গে কানামাছি খেলব।
কথা শুনে আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন হেসে উঠল। এবার অন্য একজন বলে উঠল-
: আপনে চোখ বাইন্ধা ট্রেন থেইক্যা লাফ দিবেন না তো?
আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম-
: না রে ভাই! রেলের অবস্থা এখনও এতটা খারাপ হয় নাই যে, তা দেইখ্যা মনে লাফ দেওয়ার বাসনা জাগবে। আমি যাব টয়লেটে।
- তাইলে চোখে রুমাল বান্ধার প্রয়োজন কী!
: প্রয়োজন আছে। বোবার যেমন কোনো শত্র“ নাই, তেমনি যে চোখে দেখে না, তার কোনো শরম নাই। টয়লেটের ভেতরে শরম পাওয়ার মতো কিছু পদার্থ আছে। সেইটা যাতে দেখতে না হয় সেজন্য চোখ বাইন্ধ্যা অন্ধ সাজছি।
টয়লেট থেকে বের হয়ে সিটে বসতে যাব- এমন সময় আমার সামনের আসনে বসা যাত্রীর মাথার উপর ঘুরতে থাকা ফ্যান নাট-বল্টুসহ ভেঙে তার কাঁধে পড়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি উঠে তাকে জিজ্ঞেস করলাম-
: ভাই, ব্যথা পাইছেন?
আতংকে ভদ্রলোকের চেহারা কালো হয়ে গেছে। তিনি কোনোমতে বললেন-
: না, না। তেমন কিছু হয়নি।
ভাওয়াল গাজীপুর রেলস্টেশনে পৌঁছার পর বিপরীত দিকে থেকে আসা একটি ট্রেনের সঙ্গে ক্রসিং হওয়ায় আমাদের ট্রেন অনির্ধারিত যাত্রাবিরতি করল। ট্রেন থেকে নামলাম। ভাওয়াল গাজীপুর নামের সঙ্গে ভাওয়াল রাজার ইতিহাস জড়িয়ে আছে। ভাওয়াল রাজার ইতিহাস যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনি বেদনাবিধুর। রানী ও তার ভাই সম্পত্তির লোভে রাজাকে বিষ খাওয়ানোর পর থেকেই মূলত এ উপাখ্যানের শুরু।
ভাওয়াল রাজার উপাখ্যান নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমার শ্বশুরবাড়ির দরজার উপরে টাঙিয়ে রাখা একটা কাচের ফ্রেম চোখের সামনে ভেসে উঠল। সাদা কাপড়ের ওপর রঙিন সুতা দিয়ে কাজ করে আমার শাশুড়ি তাতে লিখেছেন-
এ সংসার মরুময়
কেহ কারও নয়
জ্ঞাতি বন্ধু ভ্রাতা যত
পথের পরিচয়।
জীবন মানেই পথচলা। জন্মের মধ্য দিয়ে জীবনপথের পথিক মানুষ তার পথচলা শুরু করে। আর তার পরিসমাপ্তি ঘটে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। চলার পথে অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়। সখ্য হয়। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে মানুষ আসলে একা। সে একা পৃথিবীতে আসে। আবার একাই তাকে চলে যেতে হয়।
বাঁশি শুনে ট্রেনে উঠে বসলাম। বাঁশির এ সুর কখন কার কানে জীবনের শেষ বাঁশির সুর হিসেবে ধ্বনিত হবে- আমরা কেউ কি তা জানি?
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
No comments