বাজেট বাস্তবায়নের ৬ মাসের প্রতিবেদন সংসদে পেশ
বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার মধ্যেও চলতি
অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব আয়, রেমিন্ট্যাস প্রবাহ ও বৈদেশিক মুদ্রার
রিজার্ভ বেড়েছে। একই সময়ে সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেয়া ঋণ প্রবাহ
হ্রাস পেয়েছে।
তবে সামান্য হ্রস পায় রফতানি আয়। মঙ্গলবার
বিকেলে জাতীয় সংসদে ঘোষিত বাজেটের (২০০৯-১০) ষান্মাসিক আয়-ব্যয়ের গতিধারা ও
অর্থনৈতিক বিশেস্নষণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল
মাল আবদুল মুহিত। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোন সরকার প্রথম ছয়
মাসের বাজেট বাস্তবায়নের অগ্রগতির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জাতীয় সংসদে
উপস্থাপন করল।
বাজেট প্রতিবেদনে অর্থমন্ত্রী বর্তমান মহাজোট সরকারের আগামী চারটি চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেন। চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে- (১) অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা দূর করা, বিশেষ করে জ্বালানি ও যোগাযোগ খাতে দ্রুত উন্নয়ন, (২) রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করে সরকারী ব্যয়ের হিস্যা জিডিপির ২০ শতাংশে উন্নীতকরণ, (৩) বৈদেশিক বিনিয়োগ ও অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিমালাকানা খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং (৪) আহরিত বৈদেশিক সহায়তার আশু ব্যবহার এবং সরকারী উন্নয়ন কার্যক্রমের যথাযথ বাস্তবায়ন। তিনি প্রতিবেদনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকারের কথাও পুনরুল্লেখ করে বাজেটে বরাদ্দ ১০ কোটি টাকা ছাড়ের বিষয়টি তুলে ধরেন।
মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের স্পীকার এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। প্রশ্নোত্তর পর্ব ও জনগুরুত্বসম্পন্ন নোটিসের নিষ্পত্তি শেষে অর্থমন্ত্রী সংসদে এই বাজেট বাস্তবায়নের প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। প্রতিবেদন উপস্থাপনে বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করে অর্থমন্ত্রী জানান, প্রথমে আমরা বাজেটে নির্ধারিত লৰ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব সংগ্রহ ও ব্যয়ের গতিধারার ওপর আলোকপাত করেছি। একইসঙ্গে রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের পর্যালোচনা, ফলাফল ও ফলাফলের ভিত্তিতে করণীয় সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছি। এরপরে বিশ্বমন্দার প্রেৰাপটে বাজেটে ঘোষিত লৰ্য ও উদ্দেশ্যের বিপরীতে সরকারের অবস্থান এবং দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর দৃষ্টি দিয়েছি।
তিনি জানান, আমরা প্রথমে ত্রৈমাসিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যখন একটি প্রতিবেদন তৈরি, তখন কোন সংসদ অধিবেশন ছিল না। এজন্য তৎৰণাৎ সেই প্রতিবেদনটি সংসদে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। সংসদ যখন শুরম্ন হলো তখন আমরা ত্রৈমাসিক (অক্টোবর-ডিসেম্বর) তথ্যভিত্তিক আর একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন শুরম্ন করি। এই কারণে আমরা স্থির করি, দুটি ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনই একসঙ্গে উপস্থাপন করা হবে। অবশ্য দুটি প্রানত্মিকের আয়-ব্যয়ের গতিধারা ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ স্বতন্ত্রভাবে দেয়া হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী তাঁর প্রতিবেদনে উলেস্নখ করেন, চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৪ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৫ শতাংশ। ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সূত্র থেকে ১৩ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা (জিডিপির ২ শতাংশ) এবং অভ্যনত্মরীণ সূত্র থেকে ২০ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা (জিডিপির ৩ শতাংশ) সংস্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথম প্রানত্মিকে উদ্বৃত্ত হয়েছে ৩ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। দ্বিতীয় প্রানত্মিকে বাজেট ঘাটতি হয়েছে ২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে প্রথম দুই প্রানত্মিকে বাজেট উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৯৪৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি হয় ৬ হাজার ১২৯ কোটি টাকা।
ব্যয় পরিস্থিতি সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী জানান, চলতি অর্থবছরের বাজেটে মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা (জিডিপির ১৬.৬ শতাংশ), যার মধ্যে অনুন্নয়ন ব্যয় ৮৩ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা (জিডিপির ১২.১ শতাংশ) এবং এডিপির ব্যয় ৩০ হাজার ৫শ' কোটি টাকা (জিডিপির ৪.৫ শতাংশ)। প্রথম প্রানত্মিকে মোট ব্যয় হয় ১৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। যার মধ্যে অনুন্নয়ন ব্যয় ১৩ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা (বরাদ্দের ১৬ শতাংশ) এবং এডিপির ব্যয় ৩ হাজার ১২৫ কোটি টাকা (বরাদ্দের ১০.২ শতাংশ)। দ্বিতীয় প্রানত্মিকে মোট ব্যয় হয়েছে ১৮ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। যার মধ্যে অনুন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা এবং এডিপির ব্যয় ৫ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যনত্ম দুই প্রানত্মিকে মোট ব্যয় হয় ৩৪ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। যা বাজেটের ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী জানান, বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যনত্ম ছয় মাসে প্রায় ২ লাখ ২৪ হাজার শ্রমশক্তি বিদেশে রফতানি হয়েছে। এই সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ এসেছে ৫ হাজার ৫৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের রেমিট্যান্স প্রবাহের (৪ হাজার ৫০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) তুলনায় ২২ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি।
তিনি জানান, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর শেষে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি পায় ২০ দশমিক ৭ শতাংশ। পূর্ববর্তী অর্থবছর শেষে (২০০৯ সালের জুন) এ বৃদ্ধির হার ছিল ১৯ দশমিক ২ শতাংশ। এই সময়ে অভ্যন্তরীণ ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ, পূর্ববর্তী অর্থবছর শেষে এ বৃদ্ধির হার ছিল ১৬ শতাংশ। যার মধ্যে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ বেড়েছে ১৯ দশকিম ২ শতাংশ। মন্ত্রী জানান, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা কষিঋণ বিতরণ করা হয়েছে। চরতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মেয়াদী শিল্প ঋণ বিতরণের পরিমাণ পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে ৪১ দশমিক ১ শতাংশ।
প্রতিবেদনে অর্থমন্ত্রী জানান. চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রানত্মিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১৯ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা রাজস্ব আহরিত হয়েছে। যা মোট প্রাক্কলনের ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। দ্বিতীয় প্রান্তকে (জুলাই-ডিসেম্বর) রাজস্ব আহরণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তকে রাজস্ব আহরিত হয় ৩৫ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে আহরিত রাজস্ব অপো ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের ল্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৯ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। যা জিডিপির ১১ দশমিক ৬ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে ল্যমাত্রার ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ রাজস্ব আয় হয়েছে। এনবিআর কর রাজস্ব এবং এনবিআর বহির্ভূত কর রাজস্ব আদায় বাজেটে নির্ধারিত ল্যমাত্রার অনুপাতে কম হলেও অর্থবছর শেষে ল্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে। এনবিআর কর রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে অর্থমন্ত্রী জানান, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য মূল্য হ্রাসের কারণে আমদানি শুল্ক কাঙ্তি মাত্রায় অর্জিত হয়নি। তবে স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর, সম্পূরক শুল্ক এবং আয়কর আদায়ের প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক। তার দাবি, সবকিছুর পরও প্রত্য করের হার এখনও ২৫ শতাংশের মধ্যে রয়েছে যা বৃদ্ধি হওয়া দরকার।
মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে আবুল মাল আব্দুল মুহিত জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সজাগ। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য সামগ্রির মূল্য বৃদ্ধিও প্রবণতা, রেমিট্যান্স প্রবাহ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রভাব, ইত্যাদি কারণে মূল্যস্ফীতি কিছুটা উর্ধগতি। গত ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় গড়ে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। আর এই ডিসেম্বরে হয়েছে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন রাখাসহ কতিপয় ব্যবস্থা ইতোমধ্যে নেয়া হয়েছে।
তিনি জানান, চলতি অর্থবছরে বাজেটে পিপিপি (সরকারী বেসরকারী অংশীদারিত্ব) খাতে ২ হাজার ৫শ' কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। তবে এই খাতে এখন কাঙ্তি অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। সংশোধিত বাজেটেও সরকার এই খাতে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার চিনত্মা করছে। পূর্বঘোষিত ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনেও সরকার সম হবে।
অর্থমন্ত্রী জানান, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে রফতানি হয়েছে ৭ হাজার ২৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ২ শতাংশ কম হলেও তৈরি পোশাক খাতে নতুন রফতানি আদেশ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, অর্থবছর শেষে রফতানি পরিস্থিতির উন্নতি হবে। রফতানি আয় বৃদ্ধির জন্য রফতানি সহায়তা বাবদ নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি খাতে ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১ হাজার ৮শ' কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৩০০ কোটি টাকা বেশি। এরমধ্যে প্রথম কিসত্মিতে ৯শ' কোটি টাকা ইতোমধ্যে ছাড় করা হয়েছে।
তিনি জানান, আমদানি ক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) মোট ব্যয় হয় ১১ হাজার ১৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের আমদানি ব্যয়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৫ শতাংশ কম। আনত্মর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য পণ্যেও মূল্য পতনের ফলে আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি বিগত কয়েক বছরের তুলনায় কম হয়েছে। তবে আশার কথা_ এই সময়ে ঋণপত্র খোলার ভিত্তিতে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
অর্থমন্ত্রী জানান, তার সরকারের সামনে বড় অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাসত্মবায়ন। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে এডিপি খাতে মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। যা এডিপির বরাদ্দের ২৯ শতাংশ। পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ে এই ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। যা ওই অর্থবছরের বরাদ্দের ২৪ শতাংশ।
তিনি জানান, এডিপিরি সিংহভাগই ব্যয় হয় ১০টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। এই দশটি বৃহৎ মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে চলতি অর্থবছরে মোট ৭৬ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই মন্ত্রণালয়গুলো বরাদ্দের ৩১ দশমিক ১ শতাংশ ব্যয় করে। অবশিষ্ট ৯টি মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দকৃত ২৪ শতাংশ অর্থেও মধ্যে ব্যয় হয়েছে ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। এতে দেখা যায়, ১০টি বৃহৎ মন্ত্রণালয়ের তুলনায় বাকি ৩৯টি মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়নের হার শ্লথ। বৃহৎ ১০টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ তাদের অনুকূলে বরাদ্দের ৭৪ শতাংশ, শিা মন্ত্রণালয় ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ, স্থানীয় সরকার বিভাগ ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ এবং কৃষি মন্ত্রণালয় ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে।
আবুল মাল আব্দুল মুহিত আরও জানান, চলতি অর্থবছরে বাজেটে মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে ৩৮ টি মন্ত্রণালয়/বিভাগের বরাদ্দ ১১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেতে পারে। ১৮টি মন্ত্রণালয়/বিভাগের বরাদ্দ ১৪ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা হ্রাস পেতে পারে।
বাজেট প্রতিবেদনে অর্থমন্ত্রী বর্তমান মহাজোট সরকারের আগামী চারটি চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেন। চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে- (১) অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা দূর করা, বিশেষ করে জ্বালানি ও যোগাযোগ খাতে দ্রুত উন্নয়ন, (২) রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করে সরকারী ব্যয়ের হিস্যা জিডিপির ২০ শতাংশে উন্নীতকরণ, (৩) বৈদেশিক বিনিয়োগ ও অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিমালাকানা খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং (৪) আহরিত বৈদেশিক সহায়তার আশু ব্যবহার এবং সরকারী উন্নয়ন কার্যক্রমের যথাযথ বাস্তবায়ন। তিনি প্রতিবেদনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকারের কথাও পুনরুল্লেখ করে বাজেটে বরাদ্দ ১০ কোটি টাকা ছাড়ের বিষয়টি তুলে ধরেন।
মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের স্পীকার এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। প্রশ্নোত্তর পর্ব ও জনগুরুত্বসম্পন্ন নোটিসের নিষ্পত্তি শেষে অর্থমন্ত্রী সংসদে এই বাজেট বাস্তবায়নের প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। প্রতিবেদন উপস্থাপনে বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করে অর্থমন্ত্রী জানান, প্রথমে আমরা বাজেটে নির্ধারিত লৰ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব সংগ্রহ ও ব্যয়ের গতিধারার ওপর আলোকপাত করেছি। একইসঙ্গে রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের পর্যালোচনা, ফলাফল ও ফলাফলের ভিত্তিতে করণীয় সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছি। এরপরে বিশ্বমন্দার প্রেৰাপটে বাজেটে ঘোষিত লৰ্য ও উদ্দেশ্যের বিপরীতে সরকারের অবস্থান এবং দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর দৃষ্টি দিয়েছি।
তিনি জানান, আমরা প্রথমে ত্রৈমাসিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যখন একটি প্রতিবেদন তৈরি, তখন কোন সংসদ অধিবেশন ছিল না। এজন্য তৎৰণাৎ সেই প্রতিবেদনটি সংসদে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। সংসদ যখন শুরম্ন হলো তখন আমরা ত্রৈমাসিক (অক্টোবর-ডিসেম্বর) তথ্যভিত্তিক আর একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন শুরম্ন করি। এই কারণে আমরা স্থির করি, দুটি ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনই একসঙ্গে উপস্থাপন করা হবে। অবশ্য দুটি প্রানত্মিকের আয়-ব্যয়ের গতিধারা ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ স্বতন্ত্রভাবে দেয়া হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী তাঁর প্রতিবেদনে উলেস্নখ করেন, চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৪ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৫ শতাংশ। ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সূত্র থেকে ১৩ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা (জিডিপির ২ শতাংশ) এবং অভ্যনত্মরীণ সূত্র থেকে ২০ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা (জিডিপির ৩ শতাংশ) সংস্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথম প্রানত্মিকে উদ্বৃত্ত হয়েছে ৩ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। দ্বিতীয় প্রানত্মিকে বাজেট ঘাটতি হয়েছে ২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে প্রথম দুই প্রানত্মিকে বাজেট উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৯৪৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি হয় ৬ হাজার ১২৯ কোটি টাকা।
ব্যয় পরিস্থিতি সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী জানান, চলতি অর্থবছরের বাজেটে মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা (জিডিপির ১৬.৬ শতাংশ), যার মধ্যে অনুন্নয়ন ব্যয় ৮৩ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা (জিডিপির ১২.১ শতাংশ) এবং এডিপির ব্যয় ৩০ হাজার ৫শ' কোটি টাকা (জিডিপির ৪.৫ শতাংশ)। প্রথম প্রানত্মিকে মোট ব্যয় হয় ১৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। যার মধ্যে অনুন্নয়ন ব্যয় ১৩ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা (বরাদ্দের ১৬ শতাংশ) এবং এডিপির ব্যয় ৩ হাজার ১২৫ কোটি টাকা (বরাদ্দের ১০.২ শতাংশ)। দ্বিতীয় প্রানত্মিকে মোট ব্যয় হয়েছে ১৮ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। যার মধ্যে অনুন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা এবং এডিপির ব্যয় ৫ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যনত্ম দুই প্রানত্মিকে মোট ব্যয় হয় ৩৪ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। যা বাজেটের ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী জানান, বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যনত্ম ছয় মাসে প্রায় ২ লাখ ২৪ হাজার শ্রমশক্তি বিদেশে রফতানি হয়েছে। এই সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ এসেছে ৫ হাজার ৫৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের রেমিট্যান্স প্রবাহের (৪ হাজার ৫০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) তুলনায় ২২ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি।
তিনি জানান, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর শেষে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি পায় ২০ দশমিক ৭ শতাংশ। পূর্ববর্তী অর্থবছর শেষে (২০০৯ সালের জুন) এ বৃদ্ধির হার ছিল ১৯ দশমিক ২ শতাংশ। এই সময়ে অভ্যন্তরীণ ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ, পূর্ববর্তী অর্থবছর শেষে এ বৃদ্ধির হার ছিল ১৬ শতাংশ। যার মধ্যে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ বেড়েছে ১৯ দশকিম ২ শতাংশ। মন্ত্রী জানান, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা কষিঋণ বিতরণ করা হয়েছে। চরতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মেয়াদী শিল্প ঋণ বিতরণের পরিমাণ পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে ৪১ দশমিক ১ শতাংশ।
প্রতিবেদনে অর্থমন্ত্রী জানান. চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রানত্মিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১৯ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা রাজস্ব আহরিত হয়েছে। যা মোট প্রাক্কলনের ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। দ্বিতীয় প্রান্তকে (জুলাই-ডিসেম্বর) রাজস্ব আহরণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তকে রাজস্ব আহরিত হয় ৩৫ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে আহরিত রাজস্ব অপো ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের ল্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৯ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। যা জিডিপির ১১ দশমিক ৬ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে ল্যমাত্রার ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ রাজস্ব আয় হয়েছে। এনবিআর কর রাজস্ব এবং এনবিআর বহির্ভূত কর রাজস্ব আদায় বাজেটে নির্ধারিত ল্যমাত্রার অনুপাতে কম হলেও অর্থবছর শেষে ল্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে। এনবিআর কর রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে অর্থমন্ত্রী জানান, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য মূল্য হ্রাসের কারণে আমদানি শুল্ক কাঙ্তি মাত্রায় অর্জিত হয়নি। তবে স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর, সম্পূরক শুল্ক এবং আয়কর আদায়ের প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক। তার দাবি, সবকিছুর পরও প্রত্য করের হার এখনও ২৫ শতাংশের মধ্যে রয়েছে যা বৃদ্ধি হওয়া দরকার।
মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে আবুল মাল আব্দুল মুহিত জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সজাগ। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য সামগ্রির মূল্য বৃদ্ধিও প্রবণতা, রেমিট্যান্স প্রবাহ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রভাব, ইত্যাদি কারণে মূল্যস্ফীতি কিছুটা উর্ধগতি। গত ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় গড়ে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। আর এই ডিসেম্বরে হয়েছে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন রাখাসহ কতিপয় ব্যবস্থা ইতোমধ্যে নেয়া হয়েছে।
তিনি জানান, চলতি অর্থবছরে বাজেটে পিপিপি (সরকারী বেসরকারী অংশীদারিত্ব) খাতে ২ হাজার ৫শ' কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। তবে এই খাতে এখন কাঙ্তি অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। সংশোধিত বাজেটেও সরকার এই খাতে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার চিনত্মা করছে। পূর্বঘোষিত ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনেও সরকার সম হবে।
অর্থমন্ত্রী জানান, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে রফতানি হয়েছে ৭ হাজার ২৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ২ শতাংশ কম হলেও তৈরি পোশাক খাতে নতুন রফতানি আদেশ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, অর্থবছর শেষে রফতানি পরিস্থিতির উন্নতি হবে। রফতানি আয় বৃদ্ধির জন্য রফতানি সহায়তা বাবদ নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি খাতে ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১ হাজার ৮শ' কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৩০০ কোটি টাকা বেশি। এরমধ্যে প্রথম কিসত্মিতে ৯শ' কোটি টাকা ইতোমধ্যে ছাড় করা হয়েছে।
তিনি জানান, আমদানি ক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) মোট ব্যয় হয় ১১ হাজার ১৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের আমদানি ব্যয়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৫ শতাংশ কম। আনত্মর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য পণ্যেও মূল্য পতনের ফলে আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি বিগত কয়েক বছরের তুলনায় কম হয়েছে। তবে আশার কথা_ এই সময়ে ঋণপত্র খোলার ভিত্তিতে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
অর্থমন্ত্রী জানান, তার সরকারের সামনে বড় অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাসত্মবায়ন। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে এডিপি খাতে মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। যা এডিপির বরাদ্দের ২৯ শতাংশ। পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ে এই ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। যা ওই অর্থবছরের বরাদ্দের ২৪ শতাংশ।
তিনি জানান, এডিপিরি সিংহভাগই ব্যয় হয় ১০টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। এই দশটি বৃহৎ মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে চলতি অর্থবছরে মোট ৭৬ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই মন্ত্রণালয়গুলো বরাদ্দের ৩১ দশমিক ১ শতাংশ ব্যয় করে। অবশিষ্ট ৯টি মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দকৃত ২৪ শতাংশ অর্থেও মধ্যে ব্যয় হয়েছে ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। এতে দেখা যায়, ১০টি বৃহৎ মন্ত্রণালয়ের তুলনায় বাকি ৩৯টি মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়নের হার শ্লথ। বৃহৎ ১০টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ তাদের অনুকূলে বরাদ্দের ৭৪ শতাংশ, শিা মন্ত্রণালয় ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ, স্থানীয় সরকার বিভাগ ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ এবং কৃষি মন্ত্রণালয় ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে।
আবুল মাল আব্দুল মুহিত আরও জানান, চলতি অর্থবছরে বাজেটে মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে ৩৮ টি মন্ত্রণালয়/বিভাগের বরাদ্দ ১১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেতে পারে। ১৮টি মন্ত্রণালয়/বিভাগের বরাদ্দ ১৪ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা হ্রাস পেতে পারে।
No comments