পুষ্টিকে কেন্দ্রে রেখেই হোক উন্নয়ন আলোচনা by মিখাল রুেকাভস্কি
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতিবছর দুই কোটি শিশু অপুষ্টির শিকার হয়ে মারা যায়, যা বিশ্বজুড়ে শিশুমৃত্যুর একক বৃহত্তম কারণ। বর্তমানে বিশ্বে অপুষ্টিতে ভুগছে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটির কাছাকাছি। এ সমস্যা সবচেয়ে বেশি প্রকট হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। দক্ষিণ এশিয়ায় ৪৫ শতাংশ শিশুই পুষ্টিস্বল্পতায় ভুগছে। অপুষ্টি ও খর্বাকৃতি উভয়ের হার বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল এমনকি সাব-সাহারান আফ্রিকান দেশগুলোর চেয়েও অনেক বেশি।
প্রায় এক দশক ধরে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে মোটামুটি তেজিভাব বজায় থাকলেও এ অঞ্চলের শিশুদের পুষ্টিহীনতা দূরীকরণে তেমন অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ অঞ্চলের কোনো দেশই ২০১৫ সাল নাগাদ পুষ্টি-পরিস্থিতির ক্ষেত্রে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল) অর্জনে জন্য কম ওজনের শিশুদের সংখ্যা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনার সঠিক পথে নেই। বাংলাদেশ নব্বইয়ের দশকে শিশুদের অপুষ্টি দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও ২০০০ সালে এসে তা আর ধরে রাখতে পারেনি। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, ২০০০ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এ দেশে শিশুদের অপুষ্টি ও কম ওজন সমস্যার হার ৫০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।
উল্লিখিত পরিসংখ্যান বাংলাদেশের জন্য যে একটি বড় ধরনের অভিঘাত এবং কঠিন সমস্যা তা এখন পরিষ্কার। সে জন্য বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখার পাশাপাশি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম হাতে নেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের করণীয় সম্পর্কেও প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারকেও এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের বিষয়ে জোর দিতে হবে, যা বাংলাদেশে পুষ্টি-পরিস্থিতির উন্নয়নে নেওয়া সব কর্মসূচি ও নীতিমালা সফলভাবে বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এ লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক ও বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা—ইউনিসেফ, বিল অ্যান্ড মেলিন্দা গেটস ফাউন্ডেশন, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি), গ্লোবাল এলায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (জিএআইএন) এবং পেপসিকো, শিশুদের অপুষ্টি সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবনী ধারণাগুলোকে সহায়তা করার লক্ষ্যে ডেভেলপমেন্ট মার্কেট প্লেস শীর্ষক একটি প্রতিযোগিতা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে।
অপুষ্টির পরিণতি হবে অমোঘ ও ভয়াবহ। যেসব শিশু তার জীবনের প্রথম দুই বছরে পুষ্টিস্বল্পতায় ভোগে, তাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করতে পারার সম্ভাবনা অনেক কম। এমনকি অপুষ্টির শিকার শিশুরা জীবনের পরবর্তী সময়েও গড়ে ১০ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত কম পরিমাণে আয় করে। অর্থাৎ শিশুদের পুষ্টিহীনতাজনিত আর্থিক মূল্য খুব বেশি হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাংকের এক জরিপে দেখা গেছে যে দরিদ্র দেশগুলোর শিশুর অপুষ্টির আর্থিক মানদণ্ডে মূল্য তাদের মোট বার্ষিক দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি) তিন শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে।
তথ্য-উপাত্তগুলোকে বাদ দিয়েও বলা যায় যে দক্ষিণ এশিয়ার শিশুর অপুষ্টির হার সহজ কথায় অগ্রহণযোগ্য। আর এই অপুষ্টি শিশুদের জীবনে সফল হওয়া, সুস্থভাবে জীবনযাপন করা, সৃজনশীল হয়ে ওঠার সুযোগ ও সম্ভাবনাকে ছিনিয়ে নেয়। অথচ সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও অঙ্গীকার দ্বারা অপুষ্টি ঠেকানো সম্ভব।
শিশুদের প্রচুর খাবার দিলেই তাদের অপুষ্টি দূর হবে—প্রচলিত এই ধারণা কিন্তু সঠিক নয়। বাস্তবিক পক্ষে, পর্যাপ্ত খাবার পাওয়া সত্ত্বেও অনেকে শিশুরই সে তুলনায় ওজন যেমন কম এবং শারীরিক বৃদ্ধি অর্থাৎ উচ্চতাও কম। সঠিক খাবার না দেওয়া, পরিচর্যার অভাব, যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা না দেওয়া এবং স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণেই এমনটি হয়।
অধিকন্তু, শিশুদের অপুষ্টির সূচক ও মান পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে শহর ও গ্রামের এবং দরিদ্র ও ধনী পরিবারের শিশুদের মধ্যে যথেষ্ট বৈষম্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে গরিব পরিবারের ৫০ শতাংশেরও বেশি শিশু খর্বকায় বা বয়সের তুলনায় খাটো হয়। ধনী পরিবারগুলোতে এই হার ২৬ শতাংশ। গ্রামের শিশুদের ৪৫ শতাংশেরই বয়সের তুলনায় খাটো। শহুরে শিশুদের ক্ষেত্রে এই হার ৩৬ শতাংশ। বিশেষ করে অশিক্ষিত মায়েদের শিশুরাই বেশি খর্বকায় হয় বয়সের তুলনায়।
দক্ষিণ এশিয়ায় শিশুদের ব্যাপকহারে অপুষ্টি কী রোধ করা সম্ভব? প্রথমত, অপুষ্টির সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব শুরু হয় গর্ভবতী হওয়ার ঠিক আগে থেকে শুরু করে শিশুর বয়স দুই বছর হওয়া পর্যন্ত। এ সময়টি শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধির পাশাপাশি মস্তিষ্কের উন্নয়ন এবং মানবিক বিকাশের সম্ভাবনা যে রুদ্ধ হয়ে যায় তা নিয়ে দ্বিমত নেই। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গর্ভবতী নারীদের প্রতি অধিকতর মনোযোগ দেওয়া দরকার। এই অঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ শিশুরই জন্মের সময় ওজন কম হয়। সাব-সাহারান আফ্রিকান দেশগুলোতে এই হার হচ্ছে মাত্র ১৫ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় নবজাতকদের ওজন কম হওয়ার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, তারা মায়ের গর্ভে থাকাবস্থায়ই অপুষ্টির শিকার হয়, তাদের মায়েরাও নিজেদের শিশুবেলায় অথবা গর্ভধারণের সময়ে অপুষ্টিতে ভুগছিলেন। পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশিসংখ্যক প্রাপ্তবয়স্ক নারীর ওজন কম ও শরীরে আয়রনের ৫৫ থেকে ৮১ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে।
আগামী ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠেয় ‘ডেভেলপমেন্ট মার্কেট প্লেস’ শীর্ষক সম্মেলনে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সুশীল সমাজ ও তৃণমূল পর্যায়ের মোট ৬০টি সংগঠন যোগ দেবে। এতে উল্লিখিত দেশগুলোর সুশীল সমাজ ও তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠনগুলো গর্ভবতী নারী, নবজাতক ও দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের অপুষ্টি দূর করা তথা পুষ্টি বাড়ানোর ব্যাপারে ধারণাগুলো উপস্থাপন করবে।
‘ডেভেলপমেন্ট মার্কেট প্লেসের’ অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের পুষ্টিস্বল্পতা দূর করার ব্যাপারে সৃজনশীল ধারণাগুলো তুলে ধরা। যাতে দেশগুলো তাদের নিজ নিজ জাতীয় পুষ্টিবিষয়ক পরিকল্পনা ও কর্মসূচিগুলোর কৌশল নির্ধারণ করতে পারে। আমরা আশা করি, ডেভেলপমেন্ট মার্কেট প্লেস পুষ্টি বৃদ্ধির ব্যাপারে পরিবারে তথা গোষ্ঠীগত পর্যায়ে নারীদের ক্ষমতায়নের বিষয়ে জোর দেওয়া হবে। পাশাপাশি অপুষ্টি দূরীকরণে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও জনমত সৃষ্টির বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। এ ছাড়া শিশুদের পুষ্টিস্বল্পতা দূরীকরণে পারিবারিক পর্যায়ের আচরণ বা দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো এবং শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য পুষ্টিমানসমৃদ্ধ সম্পূরক খাদ্য নিশ্চিত করার বিষয়ে জোর দেওয়া হবে।
আমরা আশা করি যে ডেভেলপমেন্ট মার্কেট প্লেসের সুবাদে এই অঞ্চলের উন্নয়ন-আলোচনায় নারী ও শিশুদের পুষ্টি বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। এর ফলে আর্থসামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। যা-ই হোক, এ অঞ্চলের দেশগুলোতে জনগণের শক্ত-সামর্থ্য স্বাস্থ্য গঠনে মনোযোগ দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ কাজটি সূচারুভাবে সম্পন্ন করা গেলে একদিকে জাতিগুলো শিক্ষিত হয়ে উঠবে অন্যদিকে তারা বর্তমান সময়ের দ্রুত বিশ্বায়িত বিশ্বে কর্মসংস্থানের অবারিত সুযোগ লুফে নিতে পারবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আমরা দেখেছি, যেসব দেশ তাদের শিশুদের পুষ্টি বাড়ানোর বিষয়ে বেশি পরিমাণে অর্থ বিনিয়োগ করেছে, তারা তত সুফল পেয়েছে। পুষ্টিমান ভালো হলে তা কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহজ হয়। কারণ যেসব শিশু অধিকতর পুষ্টিমানসম্পন্ন খাবার পায়, তারা কম অসুস্থ হয়, বেশি করে স্কুলে যেতে পারে ও স্কুল থেকে ছিটকেও পড়ে কম এবং বেশি জ্ঞানার্জনের সুযোগ পায়। বদৌলতে নিজেদের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে তারা।
বর্তমান সংকটের সময়ে পুষ্ট শিশু মানেই হলো একটি দেশের দক্ষ মানবসম্পদের প্রতিচ্ছবি বা মানবপুঁজি। কোনো দেশকে ভবিষ্যৎ অভিঘাত থেকে রক্ষায় বা মোকাবিলায় উের যেতে হলে শিশুদের জন্য পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করা বাঞ্ছনীয়। কাজটি করার এখনই উপযুক্ত সময়। বিশ্বব্যাংকও এ ব্যাপারে দেশগুলোকে তাদের মানবসম্পদ বা মানবপুঁজি গঠনের ক্ষেত্রে সহায়তা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
মিখাল রুেকাভস্কি, বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ায় মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক পরিচালক।
প্রায় এক দশক ধরে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে মোটামুটি তেজিভাব বজায় থাকলেও এ অঞ্চলের শিশুদের পুষ্টিহীনতা দূরীকরণে তেমন অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ অঞ্চলের কোনো দেশই ২০১৫ সাল নাগাদ পুষ্টি-পরিস্থিতির ক্ষেত্রে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল) অর্জনে জন্য কম ওজনের শিশুদের সংখ্যা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনার সঠিক পথে নেই। বাংলাদেশ নব্বইয়ের দশকে শিশুদের অপুষ্টি দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও ২০০০ সালে এসে তা আর ধরে রাখতে পারেনি। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, ২০০০ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এ দেশে শিশুদের অপুষ্টি ও কম ওজন সমস্যার হার ৫০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।
উল্লিখিত পরিসংখ্যান বাংলাদেশের জন্য যে একটি বড় ধরনের অভিঘাত এবং কঠিন সমস্যা তা এখন পরিষ্কার। সে জন্য বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখার পাশাপাশি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম হাতে নেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের করণীয় সম্পর্কেও প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারকেও এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের বিষয়ে জোর দিতে হবে, যা বাংলাদেশে পুষ্টি-পরিস্থিতির উন্নয়নে নেওয়া সব কর্মসূচি ও নীতিমালা সফলভাবে বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এ লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক ও বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা—ইউনিসেফ, বিল অ্যান্ড মেলিন্দা গেটস ফাউন্ডেশন, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি), গ্লোবাল এলায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (জিএআইএন) এবং পেপসিকো, শিশুদের অপুষ্টি সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবনী ধারণাগুলোকে সহায়তা করার লক্ষ্যে ডেভেলপমেন্ট মার্কেট প্লেস শীর্ষক একটি প্রতিযোগিতা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে।
অপুষ্টির পরিণতি হবে অমোঘ ও ভয়াবহ। যেসব শিশু তার জীবনের প্রথম দুই বছরে পুষ্টিস্বল্পতায় ভোগে, তাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করতে পারার সম্ভাবনা অনেক কম। এমনকি অপুষ্টির শিকার শিশুরা জীবনের পরবর্তী সময়েও গড়ে ১০ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত কম পরিমাণে আয় করে। অর্থাৎ শিশুদের পুষ্টিহীনতাজনিত আর্থিক মূল্য খুব বেশি হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাংকের এক জরিপে দেখা গেছে যে দরিদ্র দেশগুলোর শিশুর অপুষ্টির আর্থিক মানদণ্ডে মূল্য তাদের মোট বার্ষিক দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি) তিন শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে।
তথ্য-উপাত্তগুলোকে বাদ দিয়েও বলা যায় যে দক্ষিণ এশিয়ার শিশুর অপুষ্টির হার সহজ কথায় অগ্রহণযোগ্য। আর এই অপুষ্টি শিশুদের জীবনে সফল হওয়া, সুস্থভাবে জীবনযাপন করা, সৃজনশীল হয়ে ওঠার সুযোগ ও সম্ভাবনাকে ছিনিয়ে নেয়। অথচ সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও অঙ্গীকার দ্বারা অপুষ্টি ঠেকানো সম্ভব।
শিশুদের প্রচুর খাবার দিলেই তাদের অপুষ্টি দূর হবে—প্রচলিত এই ধারণা কিন্তু সঠিক নয়। বাস্তবিক পক্ষে, পর্যাপ্ত খাবার পাওয়া সত্ত্বেও অনেকে শিশুরই সে তুলনায় ওজন যেমন কম এবং শারীরিক বৃদ্ধি অর্থাৎ উচ্চতাও কম। সঠিক খাবার না দেওয়া, পরিচর্যার অভাব, যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা না দেওয়া এবং স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণেই এমনটি হয়।
অধিকন্তু, শিশুদের অপুষ্টির সূচক ও মান পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে শহর ও গ্রামের এবং দরিদ্র ও ধনী পরিবারের শিশুদের মধ্যে যথেষ্ট বৈষম্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে গরিব পরিবারের ৫০ শতাংশেরও বেশি শিশু খর্বকায় বা বয়সের তুলনায় খাটো হয়। ধনী পরিবারগুলোতে এই হার ২৬ শতাংশ। গ্রামের শিশুদের ৪৫ শতাংশেরই বয়সের তুলনায় খাটো। শহুরে শিশুদের ক্ষেত্রে এই হার ৩৬ শতাংশ। বিশেষ করে অশিক্ষিত মায়েদের শিশুরাই বেশি খর্বকায় হয় বয়সের তুলনায়।
দক্ষিণ এশিয়ায় শিশুদের ব্যাপকহারে অপুষ্টি কী রোধ করা সম্ভব? প্রথমত, অপুষ্টির সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব শুরু হয় গর্ভবতী হওয়ার ঠিক আগে থেকে শুরু করে শিশুর বয়স দুই বছর হওয়া পর্যন্ত। এ সময়টি শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধির পাশাপাশি মস্তিষ্কের উন্নয়ন এবং মানবিক বিকাশের সম্ভাবনা যে রুদ্ধ হয়ে যায় তা নিয়ে দ্বিমত নেই। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গর্ভবতী নারীদের প্রতি অধিকতর মনোযোগ দেওয়া দরকার। এই অঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ শিশুরই জন্মের সময় ওজন কম হয়। সাব-সাহারান আফ্রিকান দেশগুলোতে এই হার হচ্ছে মাত্র ১৫ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় নবজাতকদের ওজন কম হওয়ার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, তারা মায়ের গর্ভে থাকাবস্থায়ই অপুষ্টির শিকার হয়, তাদের মায়েরাও নিজেদের শিশুবেলায় অথবা গর্ভধারণের সময়ে অপুষ্টিতে ভুগছিলেন। পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশিসংখ্যক প্রাপ্তবয়স্ক নারীর ওজন কম ও শরীরে আয়রনের ৫৫ থেকে ৮১ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে।
আগামী ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠেয় ‘ডেভেলপমেন্ট মার্কেট প্লেস’ শীর্ষক সম্মেলনে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সুশীল সমাজ ও তৃণমূল পর্যায়ের মোট ৬০টি সংগঠন যোগ দেবে। এতে উল্লিখিত দেশগুলোর সুশীল সমাজ ও তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠনগুলো গর্ভবতী নারী, নবজাতক ও দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের অপুষ্টি দূর করা তথা পুষ্টি বাড়ানোর ব্যাপারে ধারণাগুলো উপস্থাপন করবে।
‘ডেভেলপমেন্ট মার্কেট প্লেসের’ অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের পুষ্টিস্বল্পতা দূর করার ব্যাপারে সৃজনশীল ধারণাগুলো তুলে ধরা। যাতে দেশগুলো তাদের নিজ নিজ জাতীয় পুষ্টিবিষয়ক পরিকল্পনা ও কর্মসূচিগুলোর কৌশল নির্ধারণ করতে পারে। আমরা আশা করি, ডেভেলপমেন্ট মার্কেট প্লেস পুষ্টি বৃদ্ধির ব্যাপারে পরিবারে তথা গোষ্ঠীগত পর্যায়ে নারীদের ক্ষমতায়নের বিষয়ে জোর দেওয়া হবে। পাশাপাশি অপুষ্টি দূরীকরণে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও জনমত সৃষ্টির বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। এ ছাড়া শিশুদের পুষ্টিস্বল্পতা দূরীকরণে পারিবারিক পর্যায়ের আচরণ বা দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো এবং শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য পুষ্টিমানসমৃদ্ধ সম্পূরক খাদ্য নিশ্চিত করার বিষয়ে জোর দেওয়া হবে।
আমরা আশা করি যে ডেভেলপমেন্ট মার্কেট প্লেসের সুবাদে এই অঞ্চলের উন্নয়ন-আলোচনায় নারী ও শিশুদের পুষ্টি বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। এর ফলে আর্থসামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। যা-ই হোক, এ অঞ্চলের দেশগুলোতে জনগণের শক্ত-সামর্থ্য স্বাস্থ্য গঠনে মনোযোগ দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ কাজটি সূচারুভাবে সম্পন্ন করা গেলে একদিকে জাতিগুলো শিক্ষিত হয়ে উঠবে অন্যদিকে তারা বর্তমান সময়ের দ্রুত বিশ্বায়িত বিশ্বে কর্মসংস্থানের অবারিত সুযোগ লুফে নিতে পারবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আমরা দেখেছি, যেসব দেশ তাদের শিশুদের পুষ্টি বাড়ানোর বিষয়ে বেশি পরিমাণে অর্থ বিনিয়োগ করেছে, তারা তত সুফল পেয়েছে। পুষ্টিমান ভালো হলে তা কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহজ হয়। কারণ যেসব শিশু অধিকতর পুষ্টিমানসম্পন্ন খাবার পায়, তারা কম অসুস্থ হয়, বেশি করে স্কুলে যেতে পারে ও স্কুল থেকে ছিটকেও পড়ে কম এবং বেশি জ্ঞানার্জনের সুযোগ পায়। বদৌলতে নিজেদের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে তারা।
বর্তমান সংকটের সময়ে পুষ্ট শিশু মানেই হলো একটি দেশের দক্ষ মানবসম্পদের প্রতিচ্ছবি বা মানবপুঁজি। কোনো দেশকে ভবিষ্যৎ অভিঘাত থেকে রক্ষায় বা মোকাবিলায় উের যেতে হলে শিশুদের জন্য পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করা বাঞ্ছনীয়। কাজটি করার এখনই উপযুক্ত সময়। বিশ্বব্যাংকও এ ব্যাপারে দেশগুলোকে তাদের মানবসম্পদ বা মানবপুঁজি গঠনের ক্ষেত্রে সহায়তা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
মিখাল রুেকাভস্কি, বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ায় মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক পরিচালক।
No comments