দুর্নীতিবান্ধব সমাজে দুর্নীতি দমন by মনজুর রশীদ খান
দুর্নীতি ও মৌলিক অসাধুতা আমাদের সমাজে, বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিব্যাপ্ত হয়ে এক ধরনের সংস্কৃতির রূপ নিয়ে বসছে। ফলে সর্বত্র যেন দুর্নীতিবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। অনিয়ম, অসাধুতা ও অপকর্ম সাধনের সহায়ক অবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই বিরাজমান। রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক রীতিনীতি এমন হয়ে উঠছে, যেখানে নৈতিক ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার তাগিদ ও শাসন কমে গেছে। দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডকে অনৈতিক ও অপরাধ বলে মনে না করার লোকের সংখ্যা বাড়ছে। অপরাধের শাস্তি বা মন্দ পরিণাম এখন অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত। কেউ যদি অর্থ-বিত্ত-সম্পদের অধিকারী এবং সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হন, তাহলে তো কথাই নেই। পার পেয়ে যাওয়া সহজ। আইন প্রয়োগের শিথিল অবস্থা দুর্নীতিসহ সব অপরাধ বাড়াচ্ছে। যেমন চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কমিশনবাজি, ছিনতাই, দখলবাজি, জিম্মি করে অর্থ আদায় ইত্যাদি। আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বস্বীকৃত অন্যতম সমস্যা হলো দুর্নীতি, যা দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির প্রধান অন্তরায়। এর বিরুদ্ধে অনেক কথা বলা হলেও অবস্থার পরিবর্তন নেই। কি সামরিক শাসন, কি অসামরিক শাসন বা নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার কর্তৃক শাসন, প্রভৃতি যে ব্যবস্থাই আসুক, দুর্নীতির প্রকোপ কমেনি। বরং ব্যাপকতা ও পরিধি আরও বেড়েছে। কারণ অর্থলিপ্সা বা অর্থগৃধ্নুতা বৃদ্ধি ও শাস্তির ভয় তিরোহিত হওয়া। বিগত কয়েকটি বছরে, বিশেষ করে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে যে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিল, এর অনেক কিছু ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পট-পরিবর্তনের আগে সংবাদমাধ্যমে ও লোকমুখে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু সরকারের উচ্চমহল নিষ্ক্রিয় থেকেছে ও প্রশ্রয় দিয়েছে। পরে দুর্নীতি ও অসাধুতার অবিশ্বাস্য সব কাহিনী আরও বিস্তৃত আকারে প্রকাশ পেয়েছে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে প্রবল ঝাঁকুনি দেওয়া পট-পরিবর্তনের পর দেশবাসী আশাবাদী হয়েছিল, দুর্নীতি নির্মূল না হলেও অনেকটাই কমবে। লাগামহীন অবস্থা থাকবে না।
যে আশার আলো দেখা যাচ্ছিল, তা দপ করেই যেন নিভে গেল। দুই বছর পর এখন ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। একসময় যাঁরা বড় দুর্নীতিবাজ বলে পরিচিত হলেন এবং কেউ কেউ অভিযুক্ত হয়ে দণ্ডিতও হলেন, তাঁদের অনেকে বেকসুর খালাস পেয়ে বা জামিন নিয়ে বা উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে বীর বেশে সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে সচেষ্ট। দুর্নীতির কুশীলবদের ভয়ঙ্কর দুঃসময় গেছে; তাঁরা এখন বিক্ষুব্ধ ও প্রতিশোধ নিতে এককাট্টা। খুঁজে বেড়াচ্ছেন, যাঁরা অমন অবস্থায় ফেলেছিলেন তাঁদের। দুই বছর যেমন এক পক্ষের কথা শুনেছি, এখন অপর পক্ষের কথা শুনছি। পত্রপত্রিকা আর টক শোতে চলছে দেদার সব কাহিনী। সবাই নির্দোষ, তাঁদের রাজনৈতিক কারণে হয়রানি ও নির্যাতন করে মিথ্যা দুর্নীতির মামলা করা হয়েছে। এখন মামলা তুলে নেওয়ার দাবি উঠছে। দেশে সরকার পরিবর্তনের পর এমন দাবি নতুন নয়। কেউ হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি অসংগত নয়। তবে প্রশ্ন, সরকার বদলালেও মামলার অভিযোগ, তদন্ত প্রক্রিয়া, এমনকি বিচারিক কাজ বদলে যাবে কেন? অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ আমীরুল ইসলাম সম্প্রতি এক সাক্ষাত্কারে যথার্থই বলেছেন, ‘সরকারের পরিবর্তন এলে বিচারের মানদণ্ড বদলে যায়, যা বড়ই দুর্ভাগ্যজনক’; (প্রথম আলো, ২৬.০৭.০৯)। এমন অবস্থায় একজন সাধারণ নাগরিকের মনেও বিচারকাজ নিয়ে নানা প্রশ্ন জাগতে বাধ্য। একটি সভ্য জনগোষ্ঠীর বিচারালয়ই হচ্ছে শেষ ভরসার স্থল। সেখানে ন্যায়বিচার পাওয়ার মৌলিক অধিকার সবারই। কে, কারা, কীভাবে ও কখন তা নিশ্চিত করবেন, আমরা সে ভরসা পাচ্ছি কই।
আইন সবার জন্য সমান ও আইন নিজস্ব গতিতে চলবে, এমন সব কথা আমরা ক্ষমতাসীনদের মুখ থেকেই প্রচুর শুনেছি। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্নতর। আইনের গতি থামিয়ে ভিন্ন ধারায় চালানোর অনেক উদাহরণ রয়েছে। বিদেশে থাকা পলাতক ফাঁসির আসামি দেশে ফিরে কত দ্রুত রাষ্ট্রপতির মার্জনা আদায় করেছিলেন, সে খবর জাতীয় দৈনিকে এসেছে। অঢেল সম্পদশালী ও প্রভাব-প্রতিপত্তিধারীদের আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে অসুবিধা হয় না। তাঁরা আইনের মানদণ্ডকেও সহজেই বাঁকিয়ে নিতে পারেন।
ইংরেজি প্রবাদে আছে: A thief passes for a gentleman when stealing has made him rich. অর্থ দাঁড়ায়, ‘চোর ভদ্রলোক হয়ে যান, যখন চৌর্যবৃত্তি তাঁকে বিত্তশালী করে তোলে।’ কথাটি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কতটা সত্য, তা জ্ঞানী-গুণী-সজ্জন পাঠকদের বিবেচনায় থাকল। দুর্নীতিবাজদের প্রতি ঘৃণার বদলে প্রীতি বেড়ে গেছে। নমনীয়তা, সহমর্মিতা সৃষ্টির প্রয়াশ হরহামেশা চলছে। এখন যেন দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক নামের সংস্থাটিতে নিষ্ক্রিয়তা এসে গেছে। বোঝা যাচ্ছে, তারা উত্সাহ বা সাহস পাচ্ছে না। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বলে মামলা তুলে নেওয়ার যে প্রক্রিয়া চলছে এবং বড় মাপের মামলাগুলোর পরিণতি দেখে এমন আশঙ্কাই বাড়ছে। এ কথা সত্য যে রাজনৈতিক নেতৃত্বে সদিচ্ছা ও দৃঢ় অঙ্গীকার না থাকলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এবং শক্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়। দুর্নীতির ব্যাধিও দূর হবে না। কিন্তু সে অবস্থান, সদিচ্ছা ও অঙ্গীকার বাস্তবে কথা ও কাজে কবে দেখা যাবে সেটাই জিজ্ঞাস্য। দুদক কি আসলেই একটি স্বাধীন শক্তিশালী ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে পারবে, নাকি শুধু নামকাওয়াস্তেই এর অস্তিত্ব ধরে রাখা হবে, সে প্রশ্ন এখন সামনে চলে আসছে। সম্প্রতি দুর্নীতির বড় বড় মামলার বেশির ভাগেরই যে পরিণতি হয়েছে, এর জন্য দুদকের প্রতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দায়ী, নাকি পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি দায়ী, তা দেখার বিষয়। তবে শেষ পর্যন্ত জনগণের কাছে সরকারকেই জবাবদিহি করতে হবে বেশি। কারণ দুদকের শক্তি, সামর্থ্য ও তৎপরতা অনেকটাই নির্ভর করে সরকারের ওপর। সন্দেহ নেই, এর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা অনেক। অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের অভাব, তাঁদের অনেকের অদক্ষতা, অসততা, পক্ষপাতিত্ব এবং মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীদের দুর্বলতা বা নিষ্ক্রিয়তা ইত্যাদি। এর বিপরীতে দেশের বাঘা বাঘা ঝানু আইনজীবীর আইনের ফাঁকফোকর আবিষ্কার ও সুচতুর উপস্থাপনায় চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের কেউ কেউ উচ্চ আদালতের আদেশে বেরিয়ে আসছেন। অর্থাৎ পার পেয়ে যাচ্ছেন। এতে যে বার্তা বহন করছে, তা দুর্নীতিবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতেই সহায়ক হবে, দুর্নীতি দমনে নয়। সম্ভবত মহলবিশেষ এমনটিই চায়।
আমরা দেখে আসছি, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনের অনেক কিছু পাল্টে যায়। আদালত অঙ্গনেও তা-ই ঘটে। বিচার প্রশাসন ব্যবস্থাপনার গুণগত পরিবর্তন অতি জরুরি। অনুসন্ধান তদন্ত ও বিচারকাজকে প্রভাবমুক্ত রাখা এবং নিম্ন ও উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিচারক, আইনজীবী সম্প্রদায়সহ সরকার ও বিচার প্রশাসনসংশ্লিষ্ট সবার। তবে সরকারের দায়িত্বই সর্বাধিক। সম্প্রতি উচ্চ আদালতে দুর্নীতির কিছু মামলা নিষ্পত্তি নিয়ে আমার মতো আইন বিষয়ে অজ্ঞদের মনেও কিছু বিভ্রান্তির উদ্রেক হয়েছে। বিচারপতি সৈয়দ আমীরুল ইসলামের মতে, ‘দুদকের অধিকাংশ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে টেকনিক্যাল পয়েন্টে, মেরিট বা মামলার গুণগত বিচারে নয়...।’ নোটিশ ঠিকমতো দেওয়া হয়নি, সে কারণে দণ্ডপ্রাপ্তরাও খালাস পেয়ে গেলেন। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে প্রশ্ন, এদিকটি কি মহামান্য আদালত বিবেচনায় নেননি। বাদীপক্ষের কৌঁসুলি কি তুলে ধরেননি? আইন বিষয়ে আমার জ্ঞান যত্সামান্য। তাই বিষয়টি বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। বিচারপতির আমীরুল ইসলামের মতে, ‘বিচারক নিয়োগে বড় বেশি মাত্রায় রাজনৈতিকীকরণ ঘটেছে এবং বিচারকক্ষে এখন কখনো দলীয় পরিচয়ের নিরিখে আইনের পরিবর্তিত ব্যাখ্যা লক্ষ করা যাচ্ছে।’ এ তো খুবই ভয়ঙ্কর কথা। এ বক্তব্যে বিচারব্যবস্থার নৈরাজ্যকর চিত্রটি আরও সমর্থন পেল বৈকি। এমন অবস্থায় বিচারব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাহলে সমাজে দুর্নীতিবান্ধব পরিবেশটাই আরও জোরদার হয়ে একদিন ঘুষ-উপরি বাণিজ্য প্রকাশ্যে চললে কেউ ঠেকাতে পারবে না।
এ প্রসঙ্গে যোগ করতে চাই, দেশে বিচারব্যবস্থা মনে হয় যেন একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাপ্রবাহে তা আরও পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো। প্রতিদিন হাজার হাজার লোককে দেশের বিভিন্ন আদালতে ধরনা দিতে হয়। এদের গাঁটের লাখ লাখ টাকা আদালত চত্বরে পকেট বদল হয় (এর কতটা হালাল উপার্জন আর কতটা অবৈধ, এর সমীক্ষা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কাছে নিশ্চয়ই রয়েছে)। আদালতগুলোকে ঘিরে নানা স্বার্থবাদী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব যুক্ত হয়ে আরও সম্পদশালী ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি কিছু আইনজীবী ও তাঁদের প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের পক্ষে মামলা পরিচালনায় পারদর্শিতা দেখিয়ে প্রিয়পাত্র হয়েছেন। তাঁরা যে লাখ লাখ টাকার আইন-ব্যবসার সুবিধা করে নিয়েছেন, তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। সম্ভবত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের ফসল তাঁদের ঘরেই বেশি উঠেছে। আইন-ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত যে বিরাট সুবিধাভোগী শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে, তাতে কিছু বিচারক অন্তর্ভুক্ত থাকার কথাও শোনা যায়। এখানে আইনজীবী ছাড়া আরও আছে আদালতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি ও পুলিশ বিভাগের লোকজন।
আদালতে মামলা-মোকদ্দমার জট এবং হাজার হাজার লোকের দুর্ভোগ ও ভোগান্তির কথা সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই আসে (সম্প্রতি এই লেখকের জানার কিছু সুযোগ হয়েছিল)। সরকারি সূত্রমতে, বিভিন্ন আদালতে ২০ লক্ষাধিক মামলা বিচারাধীন। এ ছাড়া বিভিন্ন অভিযোগে পুলিশ, দুদক ও অন্যান্য সংস্থায় প্রাথমিক অনুসন্ধান, তদন্ত ইত্যাদি পর্যায়ের সঙ্গে যুক্ত আছে আরও বহু ব্যক্তি ও তাদের পরিবার। সব মেলালে ভুক্তভোগীর সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে যাওয়া কাল্পনিক হবে না। এরা প্রতি পদে দীর্ঘসূত্রতাসহ নানা ধরনের হয়রানির শিকার। কেউ পুলিশের হাতে, কেউ আদালতের লোক ও দালালদের হাতে, কেউ বা আইনজীবীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। আরও আছে পুলিশ বা দুদকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা কর্তৃক মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে বা পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া মামলা দায়ের করা, তদন্ত না করে ঝুলিয়ে রাখা বা মামলা ফাইলবন্দী ফেলে রেখে সুবিধা আদায়কারীদের দল। এমন অবস্থা থেকে জনসাধারণের একটি বিরাট অংশকে মুক্তি দিতে দিন বদলের সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। আদালত প্রাঙ্গণ তথা বিচার বিভাগ ও বিচার প্রশাসনসংশ্লিষ্ট বিষয়ের আমূল সংস্কার দাবি আইনজীবী মহলসহ সব মহলের। সঠিক প্রক্রিয়ায় যথাসম্ভব দ্রুততর বিচারকাজ পরিচালিত হলে জনগণের একটি বিরাট অংশকে হয়রানি ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যাবে এবং প্রশাসনকে গতিশীল ও দুর্নীতিমুক্ত করে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সমাজে দুর্নীতিবান্ধব পরিবেশও দূর হবে। আশা করি, এবারের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে মহাজোট সরকার দুর্নীতি নির্মূলের যে অঙ্গীকার করেছে, তা বাস্তবায়নে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পিছ পা হবে না।
মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মনজুর রশীদ খান: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা।
mnzr23@gmail.com
যে আশার আলো দেখা যাচ্ছিল, তা দপ করেই যেন নিভে গেল। দুই বছর পর এখন ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। একসময় যাঁরা বড় দুর্নীতিবাজ বলে পরিচিত হলেন এবং কেউ কেউ অভিযুক্ত হয়ে দণ্ডিতও হলেন, তাঁদের অনেকে বেকসুর খালাস পেয়ে বা জামিন নিয়ে বা উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে বীর বেশে সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে সচেষ্ট। দুর্নীতির কুশীলবদের ভয়ঙ্কর দুঃসময় গেছে; তাঁরা এখন বিক্ষুব্ধ ও প্রতিশোধ নিতে এককাট্টা। খুঁজে বেড়াচ্ছেন, যাঁরা অমন অবস্থায় ফেলেছিলেন তাঁদের। দুই বছর যেমন এক পক্ষের কথা শুনেছি, এখন অপর পক্ষের কথা শুনছি। পত্রপত্রিকা আর টক শোতে চলছে দেদার সব কাহিনী। সবাই নির্দোষ, তাঁদের রাজনৈতিক কারণে হয়রানি ও নির্যাতন করে মিথ্যা দুর্নীতির মামলা করা হয়েছে। এখন মামলা তুলে নেওয়ার দাবি উঠছে। দেশে সরকার পরিবর্তনের পর এমন দাবি নতুন নয়। কেউ হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি অসংগত নয়। তবে প্রশ্ন, সরকার বদলালেও মামলার অভিযোগ, তদন্ত প্রক্রিয়া, এমনকি বিচারিক কাজ বদলে যাবে কেন? অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ আমীরুল ইসলাম সম্প্রতি এক সাক্ষাত্কারে যথার্থই বলেছেন, ‘সরকারের পরিবর্তন এলে বিচারের মানদণ্ড বদলে যায়, যা বড়ই দুর্ভাগ্যজনক’; (প্রথম আলো, ২৬.০৭.০৯)। এমন অবস্থায় একজন সাধারণ নাগরিকের মনেও বিচারকাজ নিয়ে নানা প্রশ্ন জাগতে বাধ্য। একটি সভ্য জনগোষ্ঠীর বিচারালয়ই হচ্ছে শেষ ভরসার স্থল। সেখানে ন্যায়বিচার পাওয়ার মৌলিক অধিকার সবারই। কে, কারা, কীভাবে ও কখন তা নিশ্চিত করবেন, আমরা সে ভরসা পাচ্ছি কই।
আইন সবার জন্য সমান ও আইন নিজস্ব গতিতে চলবে, এমন সব কথা আমরা ক্ষমতাসীনদের মুখ থেকেই প্রচুর শুনেছি। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্নতর। আইনের গতি থামিয়ে ভিন্ন ধারায় চালানোর অনেক উদাহরণ রয়েছে। বিদেশে থাকা পলাতক ফাঁসির আসামি দেশে ফিরে কত দ্রুত রাষ্ট্রপতির মার্জনা আদায় করেছিলেন, সে খবর জাতীয় দৈনিকে এসেছে। অঢেল সম্পদশালী ও প্রভাব-প্রতিপত্তিধারীদের আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে অসুবিধা হয় না। তাঁরা আইনের মানদণ্ডকেও সহজেই বাঁকিয়ে নিতে পারেন।
ইংরেজি প্রবাদে আছে: A thief passes for a gentleman when stealing has made him rich. অর্থ দাঁড়ায়, ‘চোর ভদ্রলোক হয়ে যান, যখন চৌর্যবৃত্তি তাঁকে বিত্তশালী করে তোলে।’ কথাটি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কতটা সত্য, তা জ্ঞানী-গুণী-সজ্জন পাঠকদের বিবেচনায় থাকল। দুর্নীতিবাজদের প্রতি ঘৃণার বদলে প্রীতি বেড়ে গেছে। নমনীয়তা, সহমর্মিতা সৃষ্টির প্রয়াশ হরহামেশা চলছে। এখন যেন দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক নামের সংস্থাটিতে নিষ্ক্রিয়তা এসে গেছে। বোঝা যাচ্ছে, তারা উত্সাহ বা সাহস পাচ্ছে না। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বলে মামলা তুলে নেওয়ার যে প্রক্রিয়া চলছে এবং বড় মাপের মামলাগুলোর পরিণতি দেখে এমন আশঙ্কাই বাড়ছে। এ কথা সত্য যে রাজনৈতিক নেতৃত্বে সদিচ্ছা ও দৃঢ় অঙ্গীকার না থাকলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এবং শক্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়। দুর্নীতির ব্যাধিও দূর হবে না। কিন্তু সে অবস্থান, সদিচ্ছা ও অঙ্গীকার বাস্তবে কথা ও কাজে কবে দেখা যাবে সেটাই জিজ্ঞাস্য। দুদক কি আসলেই একটি স্বাধীন শক্তিশালী ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে পারবে, নাকি শুধু নামকাওয়াস্তেই এর অস্তিত্ব ধরে রাখা হবে, সে প্রশ্ন এখন সামনে চলে আসছে। সম্প্রতি দুর্নীতির বড় বড় মামলার বেশির ভাগেরই যে পরিণতি হয়েছে, এর জন্য দুদকের প্রতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দায়ী, নাকি পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি দায়ী, তা দেখার বিষয়। তবে শেষ পর্যন্ত জনগণের কাছে সরকারকেই জবাবদিহি করতে হবে বেশি। কারণ দুদকের শক্তি, সামর্থ্য ও তৎপরতা অনেকটাই নির্ভর করে সরকারের ওপর। সন্দেহ নেই, এর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা অনেক। অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের অভাব, তাঁদের অনেকের অদক্ষতা, অসততা, পক্ষপাতিত্ব এবং মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীদের দুর্বলতা বা নিষ্ক্রিয়তা ইত্যাদি। এর বিপরীতে দেশের বাঘা বাঘা ঝানু আইনজীবীর আইনের ফাঁকফোকর আবিষ্কার ও সুচতুর উপস্থাপনায় চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের কেউ কেউ উচ্চ আদালতের আদেশে বেরিয়ে আসছেন। অর্থাৎ পার পেয়ে যাচ্ছেন। এতে যে বার্তা বহন করছে, তা দুর্নীতিবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতেই সহায়ক হবে, দুর্নীতি দমনে নয়। সম্ভবত মহলবিশেষ এমনটিই চায়।
আমরা দেখে আসছি, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনের অনেক কিছু পাল্টে যায়। আদালত অঙ্গনেও তা-ই ঘটে। বিচার প্রশাসন ব্যবস্থাপনার গুণগত পরিবর্তন অতি জরুরি। অনুসন্ধান তদন্ত ও বিচারকাজকে প্রভাবমুক্ত রাখা এবং নিম্ন ও উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিচারক, আইনজীবী সম্প্রদায়সহ সরকার ও বিচার প্রশাসনসংশ্লিষ্ট সবার। তবে সরকারের দায়িত্বই সর্বাধিক। সম্প্রতি উচ্চ আদালতে দুর্নীতির কিছু মামলা নিষ্পত্তি নিয়ে আমার মতো আইন বিষয়ে অজ্ঞদের মনেও কিছু বিভ্রান্তির উদ্রেক হয়েছে। বিচারপতি সৈয়দ আমীরুল ইসলামের মতে, ‘দুদকের অধিকাংশ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে টেকনিক্যাল পয়েন্টে, মেরিট বা মামলার গুণগত বিচারে নয়...।’ নোটিশ ঠিকমতো দেওয়া হয়নি, সে কারণে দণ্ডপ্রাপ্তরাও খালাস পেয়ে গেলেন। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে প্রশ্ন, এদিকটি কি মহামান্য আদালত বিবেচনায় নেননি। বাদীপক্ষের কৌঁসুলি কি তুলে ধরেননি? আইন বিষয়ে আমার জ্ঞান যত্সামান্য। তাই বিষয়টি বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। বিচারপতির আমীরুল ইসলামের মতে, ‘বিচারক নিয়োগে বড় বেশি মাত্রায় রাজনৈতিকীকরণ ঘটেছে এবং বিচারকক্ষে এখন কখনো দলীয় পরিচয়ের নিরিখে আইনের পরিবর্তিত ব্যাখ্যা লক্ষ করা যাচ্ছে।’ এ তো খুবই ভয়ঙ্কর কথা। এ বক্তব্যে বিচারব্যবস্থার নৈরাজ্যকর চিত্রটি আরও সমর্থন পেল বৈকি। এমন অবস্থায় বিচারব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাহলে সমাজে দুর্নীতিবান্ধব পরিবেশটাই আরও জোরদার হয়ে একদিন ঘুষ-উপরি বাণিজ্য প্রকাশ্যে চললে কেউ ঠেকাতে পারবে না।
এ প্রসঙ্গে যোগ করতে চাই, দেশে বিচারব্যবস্থা মনে হয় যেন একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাপ্রবাহে তা আরও পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো। প্রতিদিন হাজার হাজার লোককে দেশের বিভিন্ন আদালতে ধরনা দিতে হয়। এদের গাঁটের লাখ লাখ টাকা আদালত চত্বরে পকেট বদল হয় (এর কতটা হালাল উপার্জন আর কতটা অবৈধ, এর সমীক্ষা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কাছে নিশ্চয়ই রয়েছে)। আদালতগুলোকে ঘিরে নানা স্বার্থবাদী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব যুক্ত হয়ে আরও সম্পদশালী ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি কিছু আইনজীবী ও তাঁদের প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের পক্ষে মামলা পরিচালনায় পারদর্শিতা দেখিয়ে প্রিয়পাত্র হয়েছেন। তাঁরা যে লাখ লাখ টাকার আইন-ব্যবসার সুবিধা করে নিয়েছেন, তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। সম্ভবত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের ফসল তাঁদের ঘরেই বেশি উঠেছে। আইন-ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত যে বিরাট সুবিধাভোগী শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে, তাতে কিছু বিচারক অন্তর্ভুক্ত থাকার কথাও শোনা যায়। এখানে আইনজীবী ছাড়া আরও আছে আদালতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি ও পুলিশ বিভাগের লোকজন।
আদালতে মামলা-মোকদ্দমার জট এবং হাজার হাজার লোকের দুর্ভোগ ও ভোগান্তির কথা সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই আসে (সম্প্রতি এই লেখকের জানার কিছু সুযোগ হয়েছিল)। সরকারি সূত্রমতে, বিভিন্ন আদালতে ২০ লক্ষাধিক মামলা বিচারাধীন। এ ছাড়া বিভিন্ন অভিযোগে পুলিশ, দুদক ও অন্যান্য সংস্থায় প্রাথমিক অনুসন্ধান, তদন্ত ইত্যাদি পর্যায়ের সঙ্গে যুক্ত আছে আরও বহু ব্যক্তি ও তাদের পরিবার। সব মেলালে ভুক্তভোগীর সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে যাওয়া কাল্পনিক হবে না। এরা প্রতি পদে দীর্ঘসূত্রতাসহ নানা ধরনের হয়রানির শিকার। কেউ পুলিশের হাতে, কেউ আদালতের লোক ও দালালদের হাতে, কেউ বা আইনজীবীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। আরও আছে পুলিশ বা দুদকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা কর্তৃক মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে বা পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া মামলা দায়ের করা, তদন্ত না করে ঝুলিয়ে রাখা বা মামলা ফাইলবন্দী ফেলে রেখে সুবিধা আদায়কারীদের দল। এমন অবস্থা থেকে জনসাধারণের একটি বিরাট অংশকে মুক্তি দিতে দিন বদলের সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। আদালত প্রাঙ্গণ তথা বিচার বিভাগ ও বিচার প্রশাসনসংশ্লিষ্ট বিষয়ের আমূল সংস্কার দাবি আইনজীবী মহলসহ সব মহলের। সঠিক প্রক্রিয়ায় যথাসম্ভব দ্রুততর বিচারকাজ পরিচালিত হলে জনগণের একটি বিরাট অংশকে হয়রানি ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যাবে এবং প্রশাসনকে গতিশীল ও দুর্নীতিমুক্ত করে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সমাজে দুর্নীতিবান্ধব পরিবেশও দূর হবে। আশা করি, এবারের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে মহাজোট সরকার দুর্নীতি নির্মূলের যে অঙ্গীকার করেছে, তা বাস্তবায়নে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পিছ পা হবে না।
মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মনজুর রশীদ খান: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা।
mnzr23@gmail.com
No comments