উল্লসিত ইসরাইল, কী পরিবর্তন আসছে মধ্যপ্রাচ্যে: আসাদের পতনের নেপথ্যে কে এই জোলানি? by আব্দুল কাইয়ুম
রোববার বিনা বাধায় রাজধানী দামেস্ক দখলের পর আসাদ সরকারের পতনের ঘোষণা দিয়ে বিবৃতি দেয় এইচটিএস নামের গোষ্ঠীটি। এতে বলা হয়, দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন জালিম শাসক বাশার আল-আসাদ। সিরিয়া এখন মুক্ত। এর মধ্যদিয়ে একটি অন্ধকার যুগের সমাপ্তি হলো। আর সূচনা হলো একটি নতুন যুগের। দুই যুগের বেশি সময় ধরে সিরিয়াকে লৌহমুষ্টিতে শাসন করা আসাদের এমন করুণ পতনে গোটা বিশ্বই হতবাক। কেননা, কোনো ধরনের পূর্বাভাস ছাড়াই দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে একটি দেশের শক্তিশালী প্রেসিডেন্টের পতন নিশ্চিত করা নজিরবিহীন ঘটনাই বটে। তবে টানা ২৪ বছর পর আসাদের এমন পতনের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন এইচটিএসের নেতৃত্বে থাকা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি। সকলেই জানতে চাইছে আসাদের পতনের নেতৃত্ব দেয়া নেপথ্যের নায়ক কে এই জোলানি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে জোলানির অতীত-বর্তমান। কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে ওই নেতার নানা দিক। তাতে বলা হয়, আবু মোহাম্মদ আল-জোলানির আসল নাম আহমেদ হুসাইন আল-শারা। ১৯৮২ সালে তিনি সৌদি আরবের রিয়াদে জন্মগ্রহণ করেন। তখন তার পিতা সেখানে পেট্রোলিয়াম প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৮৯ সালে তার পরিবার সিরিয়ায় ফিরে আসে। দামেস্কের অদূরে বসতি স্থাপন করে। দামেস্কে থাকাকালে জোলানি কী করতেন, তা জানা যায় নি। ২০০৩ সালে সিরিয়া থেকে ইরাকে এসে তিনি আল-কায়েদায় যোগ দেন। এই বছরই ইরাকে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। তিনি সেখানে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দেন। তখন থেকে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে।
২০০৬ সালে জোলানি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হন। পাঁচ বছর আটক থাকেন। গণতন্ত্রের দাবিতে ২০১১ সালে সিরিয়ায় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ দমনে বাশার আল-আসাদ সহিংসতার পথ বেছে নেন। এর জেরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় জোলানি ছাড়া পান। এরপর তার নেতৃত্বে সিরিয়ায় আল-কায়েদার শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা আল-নুসরা ফ্রন্ট নামে পরিচিত। সশস্ত্র গোষ্ঠীটি সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে, বিশেষত ইদলিবে শক্তিশালী হতে থাকে। প্রথম দিকের কয়েক বছর আবু বকর আল-বাগদাদির সঙ্গে কাজ করেন জোলানি। বাগদাদি ছিলেন ইরাকের ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রধান। এই সশস্ত্র গোষ্ঠী পরে আইএসআইএল (আইএসআইএস) নাম ধারণ করে। ২০১৩ সালের এপ্রিলে বাগদাদি আকস্মিকভাবে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেন। সিরিয়ায় নিজেদের তৎপরতা বৃদ্ধিতে কাজ শুরু করেন। একটা পর্যায়ে আইএসআইএল আল-নুসরা ফ্রন্টকে বেশ ভালোভাবে নিজেদের সঙ্গে একীভূত করে ফেলে। তখনই আইএসআইএলের জন্ম হয়।
জোলানি এ পরিবর্তন প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন। এ অবস্থায় ২০১৪ সালে আল-জাজিরাকে প্রথমবারের মতো টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দেন জোলানি। এতে তিনি বলেছিলেন, তার গোষ্ঠী ‘ইসলামিক আইনের’ যে ব্যাখ্যা দেবে, সিরিয়া সেই অনুযায়ী শাসিত হবে। তবে কয়েক বছর পর জোলানির মধ্যে পরিবর্তন আসে। তিনি আল কায়েদার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোয় ‘বিশ্বব্যাপী খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার প্রকল্প থেকে সরে আসেন। এমন কিছুর পরিবর্তে সিরিয়া সীমান্তের ভেতরে নিজের গোষ্ঠীর তৎপরতা সীমাবদ্ধ করেন জোলানি। তার এ পরিবর্তনকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তারা মনে করেন, এর মধ্যদিয়ে জোলানির গোষ্ঠীটি বহুজাতিক বা আন্তঃদেশীয় গোষ্ঠীর বদলে একটি জাতীয় গোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয়।
২০১৬ সালের জুলাইয়ে বাশার সরকার আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো ইদলিবের দিকে চলে যায়। সিরিয়ার এ অঞ্চল তখনো বিদ্রোহীদের দখলে। ২০১৬ সালে জোলানি প্রকাশ্যে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার ঘোষণা দেন। পাশাপাশি আল-নুসরা বিলুপ্ত করেন। গঠন করেন নতুন সংগঠন জাভাত ফাতেহ আল-শাম। ২০১৭ সালের শুরুর দিকে আলেপ্পো থেকে হাজার হাজার যোদ্ধা ইদলিবে পালিয়ে আসেন। এ সময়ে বিদ্রোহীদের ছোট ছোট অনেক গোষ্ঠী ও নিজের জাভাত ফাতেহ আল-শাম নিয়ে এইচটিএস গঠন করেন জোলানি। এইচটিএসের ঘোষিত লক্ষ্যই ছিল বাশার আল-আসাদের স্বৈরাচারী শাসন থেকে সিরিয়াকে মুক্ত করা। এইচটিএস আজ এই লক্ষ্য অর্জনের ঘোষণা দিলো।
এইচটিএসের অন্য লক্ষ্যের মধ্যে আছে সিরিয়া থেকে ‘ইরানের সব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে বিতাড়িত করা’। নিজেদের দেয়া ‘ইসলামী আইনের’ ব্যাখ্যা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা। পর্যবেক্ষকদের মতে, বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ‘সবচেয়ে কার্যকর’ ভূমিকা পালন করেছে এইচটিএস ও এর প্রধান জোলানি।
আসাদকে কী হত্যা করা হয়েছে?
ক্ষমতা ছেড়ে কোনোমতে জীবন নিয়ে পালান সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। যে বিমান তাকে নিয়ে আকাশে উড়েছে তাতে তার স্ত্রী আসমা এবং দুই সন্তান ছিলেন কিনা তাও কেউ বলতে পারছেন না। কেউই বলতে পারছেন না বাশার আল আসাদের শেষ গন্তব্য আসলে কোথায়? তাকে বহনকারী বিমানকেও আর শনাক্ত করতে পারেনি ফ্লাইটরাডার। এর আগে শোনা যায়, বিমানটি কিছুদূর যাওয়ার পর গতিপথ পরিবর্তন করে ইউটার্ন নেয়। এমন অবস্থায় সিরিয়ার দু’টি সূত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, যদি ওই বিমানে আসাদ থেকে থাকেন, তাহলে তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। কারণ, তাকে বহনকারী বিমানটি ফ্লাইটরাডার ওয়েবসাইট থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিন্তু শতভাগ সত্য কোনো তথ্য মিলছে না। ইথারে অনেক খবর। গত এক সপ্তাহ ধরে রাজনৈতিক উত্তাল অবস্থা মোকাবিলা করছিলেন বাশার আল আসাদ। জল্পনা আছে তিনি মস্কো বা তার প্রধান মিত্র ইরানের কাছে আশ্রয় চেয়ে থাকতে পারেন। সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় মিডিয়া থেকেও নিশ্চিত করা হয়নি তিনি কোথায় আছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প জানিয়ে দিয়েছেন, তাকে আশ্রয় দেননি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাহলে কোথায় যেতে পারেন বাশার? তাকে বহনকারী বিমান যখন ইউটার্ন নিয়েছে এবং তা অদৃশ্য হয়েছে, এরপরই জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। দু’জন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা বলেছেন, বিদ্রোহীরা রাজধানী দামেস্ক দখলে নিয়েছে। এর মধ্যদিয়ে ২৪ বছর পর ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাশার। এমন অবস্থায় তিনি রোববার দিনের একেবারে শুরুর দিকে একটি বিমানে করে অজ্ঞাত স্থানের উদ্দেশ্যে আকাশে পাখা মেলেন। এক সপ্তাহ আগে আকস্মিকভাবে বিদ্রোহীরা আক্রমণ তীব্র করে তোলে। তারা উত্তরাঞ্চলীয় আলেপ্পো শহর দখল করে নেয়ার পর অগ্রসর হতে থাকে রাজধানীমুখে। এরপর থেকে প্রকাশ্যে আর কোনো বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি আসাদকে। পালিয়ে গেলেও তিনি, তার স্ত্রী এবং দু’সন্তান কোথায়, তাদের পরিণতি কি- এসব প্রশ্নের নিশ্চিত কোনোই উত্তর মিলছে না। রয়টার্স লিখেছে, বিদ্রোহীরা রাজধানী শহর দখলে নেয়ার পরই দামেস্ক বিমানবন্দর থেকে সিরিয়ার একটি বিমানে করে দেশ ছাড়েন আসাদ। ফ্লাইটরাডার এই তথ্য দিচ্ছে। এতে বলা হয়, প্রথমে সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল আসাদের শক্তিশালী ঘাঁটি আলাউয়িটের দিকে উড়ে যায় বিমানটি। তার পরপরই তা ইউটার্ন নেয় আকস্মিকভাবে এবং কয়েক মিনিট বিপরীত দিকে উড়তে থাকে। এরপরই তা মানচিত্র থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। বিমানে আসাদ ছিলেন বলে বলা হলেও তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। তবে সিনিয়র কর্মকর্তারা বলছেন- তিনি ওই বিমানে থাকলে তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত হয়ে থাকতে পারেন। বিস্তারিত না জানিয়ে সিরিয়ার একটি সূত্র বলেছেন- বিমানটি রাডার থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সম্ভবত এর ট্রান্সপন্ডার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি বিমানটি গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে।
সারা দেশে ফ্রন্টলাইনে সরকারি বাহিনীর বড় পতন হয়। ফলে শনিবার রাজধানী দামেস্কের দিকে অগ্রসর হতে থাকে বিদ্রোহীরা। এর ফলে বাশার আল আসাদের জন্য টিকে থাকাই বড় রকম হুমকি সৃষ্টি হয়। রয়টার্স বলছে, রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহর হোমস বিদ্রোহীরা দখল করে নেয়ার পরপরই দামেস্ক ছাড়ে ওই বিমানটি। আসাদের রাশিয়ান মিত্রদের বিমান ও নৌঘাঁটি আছে- এমন স্থানের সঙ্গে তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
বদলে যাবে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি
ঠিক এক সপ্তাহ আগে বিদ্রোহীরা তাদের ইদলিব প্রদেশের ঘাঁটি থেকে সিরিয়ার শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিস্ময়কর আক্রমণ শুরু করে। তখনো প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পতন হবে এ বিষয়টি ছিল অচিন্তনীয়। কিন্তু সিরিয়ায় সে ঘটনাই একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের শুধু পতন হয়েছে এমনই নয়। তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তার আগে ২৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তার পিতা হাফিজ আল আসাদ। গত এক সপ্তাহে বিদ্রোহীরা হাফিজ আল আসাদের মূর্তি ভেঙে, তার ওপর প্রহার করেছে, যে যেভাবে পারে- অবমাননা করেছে। হাফিজ আল আসাদের মৃত্যুর পর ২০০০ সালে ক্ষমতায় আসেন তার ছেলে আসাদ। কিন্তু তিনিও পিতার মতো কঠোর হয়ে ওঠেন। সবকিছু লৌহমানবের মতো চালাতে থাকেন। তার পিতার প্রশাসন ও দেশের ওপর ছিল কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং তার ছিল নিষ্পেষণমূলক রাজনৈতিক কাঠামো। তার শাসনামলে বিরোধীদের মোটেও সহ্য করা হতো না। সেই ধারা উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছেন বাশার আল আসাদ। প্রথমে সবাই ধারণা করেছিলেন বাশার তার পিতার মতো হবেন না। তিনি উদার হবেন। মুক্ত হবেন। কম নিষ্ঠুর হবেন। কিন্তু সেই আশার মেয়াদ হয়েছে খুব কম। ২০১১ সালে তার শাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়। কিন্তু তার ওপর তিনি সহিংসতা শুরু করেন। সেই সহিংসতার ফলে দেশটি গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়। এই যুদ্ধে কমপক্ষে ৫ লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন। শরণার্থী হয়েছেন ৬০ লাখ মানুষ। রাশিয়া ও ইরানের সহযোগিতায় বিদ্রোহীদের দমন করতে থাকেন বাশার এবং তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকেন। রাশিয়া তাকে আকাশপথের শক্তি এবং ইরান তার সামরিক সহযোগিতা পাঠিয়ে বাশার আল আসাদকে সহযোগিতা করে। কিন্তু সব শুরুর একটা শেষ আছে। শেষ পর্যন্ত ইরান ও রাশিয়ার তরফ থেকে সেই সহযোগিতা তিনি পাননি। তার মিত্ররা এবার তাকে পরিত্যাগ করে। তাদের সহায়তা ছাড়া আসাদের সেনারা বিদ্রোহীদের থামাতে পারেনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা সেটা করেননি। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ইচ্ছা করেই ইসলামিস্ট মিলিট্যান্ট গ্রুপ হায়াত তাহরির আল শামস (এইচটিএস) বিদ্রোহীদের বাধা দেননি। প্রথমেই গত সপ্তাহে তারা দখল করে নেয় দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো। এক্ষেত্রে তাদেরকে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়নি। এর কয়েকদিন পরে দখল করে হামা এবং গুরুত্বপূর্ণ হোমস। বিদ্রোহীরা পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকেন। তাদের আক্রমণের মুখে রাজধানী কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা রাজধানীতে প্রবেশ করেন এবং আসাদের মসনদ উল্টে ফেলেন। এর মধ্যদিয়ে পিতা হাফিজ আল বাশার ও ছেলে বাশার আল আসাদের মোট ৫৩ বছরের ক্ষমতার অবসান হয়। আসাদ পরিবারের কব্জা থেকে মুক্তি পায় সিরিয়াবাসী। এরপর এখন আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে দেশটি ভারসাম্য রক্ষায় চেষ্টা করবে। এর মধ্যদিয়ে কিন্তু ইরান আবারো একটি বড় রকমের আঘাত খেলো। আসাদের ক্ষমতার মেয়াদে ইরান ও লেবাননের যোদ্ধাগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ’র মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করেছে সিরিয়া। এই সম্পর্ককে ব্যবহার করে হিজবুল্লাহ’র কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ দেয়া হতো। তবে ইসরাইলের সঙ্গে এক বছরের বেশি সময় যুদ্ধ করে করে হিজবুল্লাহও দুর্বল হয়ে গেছে। তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। অন্যদিকে ইরানের সমর্থনপুষ্ট ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুতি বার বার বিমান হামলা চালাচ্ছে। এসব অংশ, সঙ্গে ইরাকের মিলিশিয়া, গাজার যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাসকে মিলে বলা হয় অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স।এই প্রতিরোধের অক্ষ সম্প্রতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন অবস্থায় বাশার আল আসাদের পলায়ন এবং হিজবুল্লাহ, হামাস দুর্বল হয়ে যাওয়া ইসরাইলের জন্য খুশির খবর। তবে তারা এখনো ইরানকে বড় রকমের হুমকি হিসেবে দেখে। অনেকে মনে করেন সিরিয়ায় সর্বশেষ ঘটনা বা প্রেসিডেন্ট বাশারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত সম্ভব হতো না যদি তুরস্ক এইচটিএস’কে সমর্থন না দিতো। তবে এমন অভিযোগ তুরস্ক প্রত্যাখ্যান করেছে। কিছু সময় ধরে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান কূটনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান করার জন্য বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতা আলোচনার জন্য আসাদকে চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাতে রাজি হননি আসাদ। ফলে আসাদের বিদায়ে বেশ খুশি তার দেশবাসী। এটা কি খুব খুশির খবর? এরপরে কী ঘটতে যাচ্ছে সিরিয়ায়? বলা হচ্ছে এইচটিএসের শিকড় রয়েছে আল কায়েদায়। তাদের আছে সহিংস অতীতও। এখন শাসকগোষ্ঠী পরিবর্তনের পর তাদের ভূমিকা কী হবে তা সময়ই বলে দেবে। একই সঙ্গে আসাদ পালিয়ে যাওয়ায় সিরিয়ার ক্ষমতায় এক বিপজ্জনক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। তা দূর করতে প্রধানমন্ত্রী দ্রুত নির্বাচন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
দামেস্ক এখন নিরাপদ
সিরিয়ার রাজধানী এখন নিরাপদ বলে জানিয়েছেন বিরোধী দলের নেতা হাদি আল-বাহরা। স্থানীয় গণমাধ্যম আল-আরাবিয়্যাকে এ কথা জানিয়েছেন তিনি। হাদি বলেছেন, আসাদ শাসনামলের অবসান হয়েছে এবং এর মধ্যদিয়ে সিরিয়া তার অন্ধকার যুগ শেষ করেছে। দ্য ন্যাশনাল কোয়ালিশন অব সিরিয়া রেভ্যুলুশন অ্যান্ড অপজিশন ফোর্সেস জোটের নেতৃত্ব রয়েছেন বাহরা। তিনি জনগণকে উদ্দেশ্য করে জোর দিয়ে বলেছেন দামেস্কের পরিস্থিতি এখন নিরাপদ। এক্সে দেয়া এক বার্তায় বাহরা বলেছেন, সকল সমপ্রদায়ের এবং ধর্মের মানুষকে লক্ষ্য করে এক্সের এক বার্তায় বাহরা বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি অন্য কারও উপর অস্ত্র তুলে ধরছেন বা ঘরে অবস্থান করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি নিরাপদ। এখন থেকে কোনোরকম প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে না এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হবে না। এ ছাড়া সিরিয়ার সকল জনগণের মানবিক মর্যাদা রক্ষা করার ঘোষণাও দিয়েছেন বিরোধী দলের ওই নেতা।
গোলান মালভূমিতে প্রতিরক্ষা লাইন শক্তিশালী করার আহ্বান ইসরাইলি মন্ত্রীর
অধিকৃত গোলান মালভূমিতে নতুন করে প্রতিরক্ষা লাইন শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছেন ইসরাইলের প্রবাসী বিষয়ক মন্ত্রী অ্যামিচাই চিকলি। তিনি বলেছেন, সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অগ্রগতি দেশটির জন্য ‘উদ্যাপনের কোনো বিষয়’ নয়। এ খবর দিয়েছে অনলাইন আল জাজিরা। এতে বলা হয়, সিরিয়ার বেশির ভাগ অংশ এখন ‘আল কায়েদা ও আইএসআইএল’-এর সহযোগী তাহরির আল-শামসহ অন্যান্য সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রণে। সশস্ত্র এসব গোষ্ঠীর নেতৃত্বে যোদ্ধারা দামেস্কে প্রবেশ করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। তবে সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের (এসডিএফ) শক্তিশালী উত্থানকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন অ্যামিচাই চিকলি। এক্ষেত্রে তিনি মনে করেন, ইসরাইলকে অবশ্যই অধিকৃত গোলান মালভূমির মাউন্ট হারমন অঞ্চলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ পুনর্নবীকরণ করতে হবে। ১৯৭৪ সাল থেকে চলা গোলান মালভূমিতে যুদ্ধবিরতির ভিত্তিতে জোরালোভাবে নতুন প্রতিরক্ষা লাইন স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন ইসরাইলের ওই মন্ত্রী। উল্লেখ্য, এসডিএফের ঘনিষ্ঠ মিত্র হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা। সিরিয়ার গোলান মালভূমির বেশির ভাগ অংশই ১৯৬৭ সালে দখলে নিয়েছিল ইসরাইল।
No comments