জাতীয় ঐক্যের কাউন্সিল গঠনের পরামর্শ: প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের বৈঠক

দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পতিত আওয়ামী লীগ ও তার দোসর রাজনৈতিক দল ছাড়া এ বৈঠকে অংশ নিয়েছে সব রাজনৈতিক দল। বৈঠক থেকে দলগুলোর নেতারা বার্তা দিয়েছেন, দলীয় আদর্শ ভিন্ন হলেও দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সবাই ঐক্যবদ্ধ। দল-মতের ওপরে উঠে বাংলাদেশ প্রশ্নে কোনো আপস হবে না। বৈঠক থেকে নিন্দা জানানো হয়, শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ, আগরতলায় সহকারী হাইকমিশনে হামলার। সবাই মিলে একটি পলিটিক্যাল ও নিরাপত্তা কাউন্সিল করা যায় কি না, জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে কোনো কাউন্সিল করার সুযোগ আছে কিনা তা ভেবে দেখতে সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়। সভার মূল সুর ছিল, মত-পথ-আদর্শের ভিন্নতা থাকবে, রাজনৈতিক ভিন্নতা থাকবে, অবস্থার ভিন্নতা থাকবে, কিন্তু দেশ ও সার্বভৌমত্ব এবং অস্তিত্বের প্রশ্নে সবাই এক। এছাড়াও ভারতের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সব দল ও পক্ষকে নিয়ে কোনো সমাবেশ করা যায় কি না সে বিষয়েও প্রস্তাব রাখা হয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দাবি করেছেন বিগত শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে হওয়া ভারতের সঙ্গে সব চুক্তি প্রকাশ্যে আনার। এছাড়াও রামপালসহ ক্ষতিকর সব চুক্তি বাতিলের। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি  রক্ষা করে সবাই এক থাকার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছেন। দেশের বিরুদ্ধে চলমান অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পিআর সেল করার প্রস্তাব করা হয়। বিএনপি’র পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে নির্বাচনী রোডম্যাপের। একই সঙ্গে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা উপদেষ্টা পরিষদ, বিদেশি মিশন ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা স্বৈরাচারের দোসরদের বাদ দেয়ার দাবি তোলেন। বলেন, এদের কারণে শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। সরকারপ্রধান দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। দীর্ঘ বৈঠক শেষে সবার ফটোসেশনে জানান দেয়া হয়- একতা ও ঐক্যের। বিকাল ৩টা থেকে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আসতে শুরু করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। ৪টা ১০ মিনিটে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রবেশ করেন প্রধান উপদেষ্টা। এরপর শুরু হয় বৈঠক। বৈঠকে সরকারের তিন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, আদিলুর রহমান খান, মাহফুজ আলম উপস্থিত ছিলেন। আর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ডক্টর আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, প্রফেসর ডা. এ জেডএম জাহিদ হোসেন, জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান, নায়েবে আমীর প্রফেসর মুজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল হালিম, ন্যাশনাল পিপল্‌স পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী ও সদস্যসচিব আখতার হোসেন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মো. শাহ আলম ও সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনুস আহমাদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, এবি পার্টির মজিবুর রহমান মঞ্জু, জাতীয় পার্টির (জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু ও যুগ্ম আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির শহীদউদ্দিন মাহমুদ, বাংলাদেশ জাসদের শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধান, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের ফয়জুল হক লালা, জাতীয় জোটের এহসানুল হুদা, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের (একাংশ) নুরুল আমিন ব্যাপারী, ভাসানী অনুসারী পরিষদের রফিকুল ইসলাম বাবলু, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মামুনুল হক, খেলাফত মজলিসের আবদুল বাসিত আজাদ ও জাহাঙ্গীর হোসেন, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের আবদুর রব ইউসুফী ও মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, এনপিপি’র ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, বাংলাদেশ এলডিপি’র মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মুফতি ফখরুল ইসলাম, গণঅধিকার পরিষদের (ফারুক) সদস্যসচিব ফারুক হাসান, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম’র ববি হাজ্জাজ, এনডিপি’র আবু তাহের প্রমুখ।

দীর্ঘ বৈঠকের শুরুতে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, সবাই মিলে আমরা একজোট হয়ে যেন কাজটা করতে পারি। সবাই একত্র হয়ে বললে একটা সমবেত শক্তি তৈরি হয়, এই সমবেত শক্তির জন্যই আপনাদের সঙ্গে বসা। ড. ইউনূস বলেন, আমরা কেন জানি মানুষের ক্রোধ থেকে মুক্ত হতে পারছি না। বিজয়ের মাসে আরও বেশি করে আনন্দ করার কথা আমাদের। কিন্তু আমাদের এই স্বাধীনতা অনেকের কাছে পছন্দ হচ্ছে না। ৫ই আগস্টের পর থেকে কী হয়েছে, বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতে আপনারা তা দেখেছেন। আমরা এই পরিস্থিতিতে মনে করেছিলাম দুর্গাপূজা নিয়ে একটা হাঙ্গামা শুরু হবে। সেখানে আপনারা সবাই ঐক্যের মধ্যে শরিক হয়েছিলেন। সারা দেশ জুড়ে শান্তিপূর্ণভাবে পূজা পালিত হয়েছে। কোথাও কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা হয়নি। সেটাও অনেকের পছন্দ হয়নি। দেশকে নতুন করে অস্থির করার চেষ্টা চলছে। এখন যে চেষ্টা চলছে সেখানে বিশেষভাবে আমরা আপনাদের চাচ্ছি।
তিনি বলেন, যে বাংলাদেশ আমরা গড়ে তোলার চেষ্টা করছি, সেটাকে ধামাচাপা দিয়ে তারা আগের বাংলাদেশের কাহিনী রচনা করে যাচ্ছে।  সারাক্ষণ নানা রূপে তারা এটা করে যাচ্ছে। এটা যে শুধু এক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে তাও নয়, বড় দেশের মধ্যেও এটি ছড়িয়ে গেছে। আমাদের এই অভ্যুত্থানটা তাদের পছন্দ হয়নি। তারা এটাকে নতুন ভঙ্গিতে দুনিয়ার সামনে পেশ করতে চায়। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে আমাদের দেশকে রক্ষা করতে হবে। এখন সেগুলোকে মিথ্যা প্রমাণ করা বা বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদের সবাইকে একজোট হতে হবে। এটা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের বিষয় না। জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের বিষয়।

বাংলাদেশ নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি করলাম, তারা এটাকে মুছে দিয়ে আগেরটায় ফিরে যেতে চায়। মুখে বলছে না যে আগেরটা, কিন্তু ভঙ্গি হলো আগেরটা ভালো ছিল। তাদের শক্তি এত বেশি যে, তারা মানুষকে এর ভেতরে ভেড়াতে পারছে। তাদের কল্পকাহিনীর কারণে মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করছে যে, এটা কী ধরনের সরকার হলো।

বহির্বিশ্বের মিডিয়া নিয়ে ড. ইউনূস বলেন, আমরা বারবার তাদের বলছি যে, আপনারা আসেন এখানে, দেখেন, এখানে কোনো বাধা নেই। কিন্তু না, তারা ওখান থেকেই কল্পকাহিনী বানিয়ে যাচ্ছে। এখন আমাদের সারা দুনিয়াকে বলতে হবে যে, আমরা এক, আমরা যেটা পেয়েছি সেটা একজোট হয়ে পেয়েছি, কোনো মতবাদের কারণে পাইনি, ধাক্কাধাক্কি করে পাইনি, যারা আমাদের ওপর চেপে ছিল, তাদের উপড়ে ফেলেছি। এটাই সবার সামনে তুলে ধরতে হবে, সবাই মিলে যেন এটা করতে পারি। আমাদের নতুন বাংলাদেশের যাত্রাপথে এটা মস্ত বড় একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, অস্তিত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শেষে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা আজকে সকলকে এজন্য আহ্বান জানিয়েছি যে, আগস্টের ৫ তারিখে যে উত্তেজনা এবং শক্তি নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা শত্রুর মোকাবিলা করেছি, আমাদের ছাত্র-জনতা বুক পেতে দিয়েছিল, জীবন দিয়েছিল সে ঐক্যের কোথাও কোনো চির কিংবা ফাটল ধরেনি। আমরা সেই জাতি, যারা স্বৈরাচারী সরকারকে বিদায় দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেই জাতি এখনো সজাগ আছে, মজবুত আছে। সেই মজবুত জিনিসটা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরতে আমরা সববেত হয়েছি।

তিনি আরও বলেন, তারা মনে করছে আমরা ঠাণ্ডা হয়ে গেছি, আমরা ঠাণ্ডা হই নাই। আমরা যখন দেখি যে, পুলিশ বলে- স্যার একটা মারি চারটা দাঁড়ায়া যায়, চারটা না চল্লিশটা দাঁড়াবে এবার। এই জাতি মরে নাই, দুর্বল হয় নাই, সবল আছে। আপনাদের আজকে উপস্থিতিটা শুধু সেটা জানানোর জন্য। আমাদের সবার মনে যেন সেটা জাগিয়ে দেয় যে, এটা আমাদের থেকে ছিনিয়ে নেয়ার কোনো অবকাশ নাই।

কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রের প্রচেষ্টা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, যে যত ষড়যন্ত্র করুক, যত অপ-প্রচার করুক, তারা এটা আমাদের থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। কারণ আমাদের রক্ত এখনো শুকায় নাই। দেয়ালের লেখা এখনো মুছে যায় নাই, দগদগ করছে এখনো। আমাদের হৃদয়ের ক্ষতও দগদগ করছে। আমরা সেই শক্তিমান জাতি, আমরা লড়াই করবো। যে হাস্যকর প্রচেষ্টাগুলো হচ্ছে, সেটা তুলে ধরার জন্য আপনাদের আহ্বান জানিয়েছি। আপনারা সুন্দরভাবে সেগুলো তুলে ধরেছেন। আমাদের নানা মত থাকবেই, কিন্তু এই বিষয়ে কোনো মতভেদ আমাদের নাই।

রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, যেভাবে আপনারা ৫ই আগস্টের পর থেকে একত্র হয়ে চলেছেন, সেই একতা-মজবুত ঐক্য রয়ে গেছে এবং থাকবে। সেটা জনগণকে আজকে জানিয়ে দিলাম। সবার মনে সন্দেহ আসছে যে কী হচ্ছে জানি না। এই ছবিটা দেখলে আবার মানুষের মনে ভরসা জাগবে। আমরা তো সরে যাইনি, মজবুত অবস্থাতে আমরা এখনো আছি, এভাবেই থাকবো। কেউ আমাদের ঐক্য ছিনিয়ে নিতে পারবে না। আমাদের স্বাধীনতা থেকে কেউ আমাদের বঞ্চিত করতে পারবে না।

বৈঠক শেষে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন সরকারের আইন উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা ছাড়া বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল ওই বৈঠকে অংশ নিয়েছে। নানা মত-পথ ও আদর্শের ভিন্নতা ছিল কিন্তু বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব, স্বাধীনতা ও মর্যাদার রক্ষার ক্ষেত্রে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণা দিয়েছে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ হয়েছে সেগুলো হলো- ভারতে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা, সহকারী হাইকমিশনে হামলা, বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা, অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সরকারের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে ভারতের এ ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের আত্মমর্যাদাশীল ও সাহসী ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। একইসঙ্গে ভারতের এ ধরনের প্রচারণার সরকারকে আরও শক্তিশালীভাবে মোকাবিলা করার কথা বলা হয়েছে। এজন্য প্রবাসী, বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাকে ডেকে নিয়ে আসার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের যোগাযোগ ও আইনি দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

আসিফ নজরুল বলেন, বৈঠকে গত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে ভারতের সঙ্গে হওয়া সব চুক্তি প্রকাশের দাবি করা হয়েছে। একইসঙ্গে রামপালসহ ক্ষতিকর সব চুক্তি বাতিলের দাবি করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের যে অর্থনৈতিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা ও অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নাক গলানোর নিন্দা জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে ভারতকে বাংলাদেশের প্রতি মর্যাদাশীল এবং সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশবিরোধী যে অপপ্রচার চালাচ্ছে, এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব সমপ্রদায়ের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে। একইসঙ্গে যেকোনো উস্কানির মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। আসিফ নজরুল আরও বলেন, সবাই একটা কথা বলেছেন, আমাদের আর শক্তিহীন, দুর্বল, নতজানু ভাবার কোনোরকম অবকাশ নেই। যেকোনো ধরনের অপপ্রচার এবং উস্কানির বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকবো এবং আমাদের ঐক্য অটুট রাখবো। আমরা সাহসী থাকবো। ভবিষ্যতে যেকোনো প্রচারণা এলে, উস্কানি এলে আমরা আমাদের ঐক্যকে আরও বেগবান রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবো। তিনি বলেন, প্রস্তাব আকার এসেছে, গোটা জাতি ভারতের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে যে ঐক্যবদ্ধ আছে- সবাই মিলে একটা সমাবেশ করতে পারে কিনা, সবাই মিলে পলিটিক্যাল একটা কাউন্সিল করতে পারে কিনা, নিরাপত্তা কাউন্সিল করতে পারে কিনা, এজন্য প্রস্তাবনা হয়েছে। আর সভার মূল সুর ছিল, আমাদের মধ্যে মত-পথ-আদর্শের ভিন্নতা থাকবে, আমাদের রাজনৈতিক ভিন্নতা থাকবে, অবস্থার ভিন্নতা থাকবে, কিন্তু দেশ ও সার্বভৌমত্ব এবং অস্তিত্বের প্রশ্নে আমরা সবাই এক। সব রাজনৈতিক সমাবেশে এ বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে।

বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, রাজনৈতিক নেতারা বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যে বাংলাদেশ ডিসেম্বরে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে বিজয় লাভ করেছি। সেটি আমরা করেছি গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক মুক্তি ও শান্তিশৃঙ্খলার জন্য। আমরা মনে করি, এখন যে সরকার আছে এটি বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই সরকারের দায়িত্ব এ দেশে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা।

তিনি বলেন, পতিত সরকার বিদেশে বসে ষড়যন্ত্র করছে। আর এতে বিদেশি কোনো দেশ সহায়তা করছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকা। ড. মোশাররফ বলেন, যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে সেটি বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য হচ্ছে। আমরা সরকারের সঙ্গে একমত পোষণ করেছি। সবাই মিলে যেমনি জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করা হয়েছে, তেমনি তাদের এবং তাদের সহযোগীদের ষড়যন্ত্রকে এদেশের ছাত্র-জনতা সবাই মিলে মোকাবিলা করবো। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির জন্য তিনি যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। আমরা সবাই জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে একমত হয়েছি। বিএনপি নির্বাচনের দাবি করেছে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা নির্বাচন সম্পর্কে বলেছি। অতিদ্রুত একটা নির্বাচনী রোডম্যাপ দেয়ার কথা বলেছি আমরা। এখন যেসব ষড়যন্ত্র এখন আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, জনগণ রোডম্যাপ পেয়ে নির্বাচনমুখী হয়ে গেলে সেসব আর কেউ করার সাহস পাবে না।

বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, দল, মত, আদর্শ ভিন্ন হলেও আমাদের পথ এক। এ পথ হচ্ছে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হবে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে দেশমাতা সবার। এটা শুধু রাজনৈতিক দল নয়, জনগণের একটা বিশাল অংশ সাংবাদিকরাও। গত আন্দোলনে আপনাদের ভূমিকা অনেক সহায়ক ছিল। তিনি বলেন, আগামীর বাংলাদেশ গঠনে আমরা পথে পথে নানা অন্তরায় দেখতে পাচ্ছি। বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী। তাদের সঙ্গে আমরা সৎ প্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক চাই। কিন্তু সামপ্রতিক সময়ে তাদের ভূমিকা উসকানিমূলক, অসহিষ্ণু, অগ্রহণযোগ্য। তারা মিথ্যা তথ্যের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশকে কলুষিত করার জন্য, এ দেশের জনগণ ও সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য অপপ্রয়াস ও অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে এর নিন্দা জানিয়েছি। আমরা সবাই এক জায়গায় ঐকমত্য হয়েছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে কোনো ছাড় নয়, এ ক্ষেত্রে আমরা সিমেন্টের মতো। যেমন অতীতে ছিলাম, ৫ই আগস্ট এ ছিলাম, ভবিষ্যতে আমাদের এটি অব্যাহত থাকবে।

ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ছাত্রদের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে হয়েছে, ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে হবে। সাংবাদিকদের সঙ্গেও পরামর্শ করার আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। সবার সঙ্গে মতবিনিময়ের শেষে একটা জাতীয় ঘোষণা আসবে। সরকারের পক্ষ থেকে আমরা সে ঘোষণার অপেক্ষায় থাকবো। আমরা সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করবো। তিনি বলেন, আরেকটি বিষয় আমরা পরিষ্কারভাবে বলেছি যে চরমপন্থা যেদিক থেকে আসবে, আমরা সব রূপের চরমপন্থাকে ঘৃণা করি। আমরা তাদের প্রশ্রয় দেবো না, মেনেও নেবো না। এ ব্যাপারে সবাই আমরা একমত হয়েছি। আমরা আশা করছি, জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে আগামীর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে, আমরা চূড়ান্ত সফলতার দিকে এগিয়ে যাব। চূড়ান্ত সফলতা না আসা পর্যন্ত আমাদের ঐক্য অটুট থাকবে। চূড়ান্ত সফলতা আসার পরও দেশের জন্য আমাদের অটুট ঐক্য অব্যাহত থাকবে।

অতিথি তালিকায় নাম না থাকায় ফিরে যান অলি আহমদ:
প্রধান উপদেষ্টার ডাকা বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এলডিপি প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদকে। বৈঠকে অংশ নিতে তিনি এবং তার দলের মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভেন্যুতে প্রবেশের সময় অতিথি তালিকায় নাম না দেখে তারা সেখানে প্রবেশ না করে ফিরে যান। পরে উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান তাদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলেও তারা আর বৈঠকে আসেননি। বুধবার সন্ধ্যায় এলডিপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দীন রাজ্জাক স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বিষয়টি জানানো হয়।

mzamin


No comments

Powered by Blogger.