রবীন্দ্রসান্নিধ্যে গগন হরকরা by মো. মুখলেছুর রহমান ভূঁঞা
আমার মনের মানুষ যে রে, আমি কোথায় পাব তারে।
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশবিদেশে বেড়াই ঘুরে।
কোথায় পাব তারে।
এই বিখ্যাত মরমি গানের রচয়িতা গগন। যার পূর্ণ নাম গগনচন্দ্র দাম। দাম পদবী বাঙ্গালী হিন্দুদের মধ্যে দেখা যায়। দাঁ এবং দাম পদবী একই উৎস থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। গগন ছিলেন সামান্য শিক্ষিত আর তা দিয়েই তিনি শিলাইদহ ডাকঘরে ডাক হরকরার চাকরি পেয়েছিলেন। এ জন্য তার নামের পাশে হরকরা শব্দটি যোগ করে গগন হরকরা নামে ডাকা হত এবং এ নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তার প্রকৃত নাম গগনচন্দ্র দাস।
নাম তার গগন কিন্তু পদবি ডাক হরকরা তাই পোস্ট অফিসের চিঠি বিলির কাজে ঝাঁ ঝাঁ রোদে মাঠে ময়দানে কিংবা গাঁয়ে গাঁয়ে এঁকে ঘুরতে হত। সে সময় মাঠের মধ্যে, নদীর তীরে গগন প্রাণের আনন্দে মরমি সঙ্গীত গেয়ে শান্ত প্রকৃতিকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে দিতেন। তার গানের সুরে পল্লীর কুঠিরে কুঠিরে রসতরঙ্গ জেগে উঠত।
জমিদার রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৯-১৯০১ সাল পর্যন্ত শিলাইদহ ও শাহজাদপুরের জমিদারি দেখার জন্য নিয়মিত আসতেন। এই সময় গগনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে বলে অনুমেয় হয়। আর চিঠি বিলি করার জন্য জমিদার রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রত্যহই গগনকে যেতে হত, সেই সুবাদে হয়ত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হত এবং কিছু খোসগল্প ও রসালাপও হত এটাই স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার পর নির্জনে বোটের ছাদে-কখনো তারা ভরা আকাশের নিচে কখনো নির্জন দুপুরে পদ্মা ঘাটে, কখনো কাচারি বাড়িতে গগন অপূর্ব সুষমা ও সুরব্যঞ্জনা দিয়ে আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে সঙ্গীত প্রিয় মানুষদের মাতিয়ে তুলতেন। সে সময় স্বয়ং জমিদার রবীন্দ্রনাথও তার গীতসুধা পান করতেন এবং মুগ্ধ হতেন। জমিদারি পরিচালনার কাজে শিলাইদহ এসে রবীন্দ্রনাথ যেমন ফকির লালন সাঁইয়ের গানে প্রভাবিত হয়েছিলেন, তেমনি লালনের পরে গগন হরকরার গানে যে কম প্রভাবিত হয়েছিলেন এমন নহে। আর তাই গগন হরকরার অনুকৃত সুরে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশীযুগের অনেক বাউল গান রচনা করেছেন, যা তার ‘বাউল’ গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন। বাউলতত্ত¡ ও দর্শন সম্পর্কে তার ধারণা গঠনে গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানটির ভ‚মিকা অত্যন্ত স্পষ্ট। কারণ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মহান সুরটি রবীনদ্রনাথ ঠাকুর গগন হরকরার গাওয়া ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানটির সুরের উপর নতুন কথা বসিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রচনা করেন।
গগন ছেঁউড়িয়ার বাউল লালন ফকিরের ভক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ জমিদারির দায়িত্ব নিয়ে শিলাইদহে এসে গগনের বাউল গানের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা লাভ করেন এবং রবীন্দ্রনাথ তার সান্নিধ্য থেকেই কাঙ্গাল হরিনাথ, গোসাই রামলালসহ বিভিন্ন সাধকের বাউল গান শোনার সুযোগ পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তার কোন কোন নাটকে বাউল চরিত্র সংযোজন গগনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
‘ডাকঘর’ নাটকেও আছে গগন চরিত্রের ছাপ। বহু ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহও লক্ষ্য করেছেন, রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’, ‘অচলায়তন’ ইত্যাদি নাটকে ঠাকুর্দা, দাদা ঠাকুর, অন্ধবাউল শ্রেণীর যে একটি চরিত্রের সংযোজন দেখা যায়- এই চরিত্র সৃষ্টিতে শিলাইদহের কোন এক বাউল ফকিরের ছায়া পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ যে বাউলের সাথে দেখা পেয়েছিলেন, কথাও বলেছিলেন সেই বাউল গগন হরকরা। গগনের গানের ভনিতায় গুরুর নাম উল্লেখ নেই তবে পন্ডিত ক্ষিতিমোহন শাস্ত্রী গগনকে ‘লালনের শিষ্য ধারার একজন’ বলে অনুমান করেছেন। ত
বে গগন লালনের গান গাইতেন, গগনের কাছ থেকে অনেকে লালনসহ আরো কয়েকজন সাধকের গান সংগ্রহ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ গগনকে পরিচিত ও বিখ্যাত করলেও তার অনেক আগেই শ্রীমতি সরলা দেবী (ভারতী-ভাদ্র-১৩০২) গগনের গান সংগ্রহ ও প্রকাশ করেন এবং ‘লালনফকির ও গগন’ নামীয় প্রবন্ধ লেখেন উপসংহারে গগনের ভক্ত জীবনের বিবরণী সংগ্রহ করে ‘ভারতী’তে প্রকাশার্থে পাঠানোর জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ তার বিভিন্ন প্রবন্ধ আলোচনায় ও বক্তৃতায় গগনের ওই একটি গানের কথাই বারবার উল্লেখ করেছেন আর ওই গানটিকে যেন বাউল দর্শনের ভিত্তি হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন। ‘গগনের গানই শুধু তাকে মুগ্ধ করেনি, তার সরলতা, স্বতঃস্ফ‚র্ততা, ভাবুকতা ও চাল চলনও ঠাকুর কবির মন জয় করেছিল।’ রবীন্দ্রনাথ তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন বাউলের মূল উদ্দেশ্য যে মনের মানুষকে খোঁজ করা সেই পরম সত্যটি গগনের গানে উপলদ্ধি করা যায়।
ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে খুব সম্ভবত ১৮৪০ সালের দিকে শিলাইদহ ইউনিয়নের গবরাখালি গ্রামে এক কৃষিজীবী কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই মহাপুরুষ গগন হরকরা। গগনের পিতা ও মাতা সম্পর্কে তেমন কোন খোঁজ জানা না গেলেও কিরণচন্দ্র নামে তার একপুত্র ছিল বলে জানা যায়। তবে জনশ্রুতি রয়েছে, গগন পুত্র কিরণ চন্দ্রের অল্প বয়সে মৃত্যু হয়েছিল। মংলাচন্দ্র, সুন্দরীদাসী, কানাইচন্দ্র তার পৌত্র পৌত্রী। গগনের মৃত্যুর পর তার ভবিষ্যত বংশধর কেউ শিলাইদহে ছিল না। অভাব অভিযোগই মূল কারণ।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পূর্বেই পাংশার সরিষা পেসটিয়াতে গিয়ে বসবাস করে বলে জানা যায়। কৃষক পরিবারে জš§ গগন হরকরা প্রথমে কৃষিকাজ করতেন এটাই স্বাভাবিক। তবে বিভিন্ন জনশ্রুতি রয়েছে, গগনের বাস্তভিটায় আসামদ্দি নামক একজন কৃষক বাড়ি করে থাকতেন এবং সে বাড়িটি আজও দাসের ভিটা নামে পরিচিত। গগন হরকরার বিশাল এক আমবাগান ছিল। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে এসব আমগাছ আমদানি করেছিলেন। দুই যুগ আগেও গগনের ভিটা ও ফলের বাগানের অস্তিত্ব ছিল কিন্তু আজ সেই বাগানে কিছু মেহগনী গাছ ছাড়া আর কিছু চোখে পরে না। গগন অনেকটাই অবহেলিত। কারণ পূর্বে শিলাইদহের কাছারি বাড়ির পূর্ব পাশে গগন হরকরা স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহ পোস্ট অফিস ছিল। পরবর্তীতে সরকার সেটি নিলাম করে দিয়েছিল।
বর্তমানে সেখানে পুকুর খনন করা হয়েছে। গগন হরকরার আর কোন স্মৃতি চিহ্ন নেই বললেই চলে। তাকে কেউ গুরুত্ব সহকারে স্বরণ করে না। তবে কুষ্টিয়া জেলা সদরের নিশান মোড়ে পৌরসভার উদ্যোগে গগনের একটি প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে যা গগন ভক্তদের মনে দোলা দেয় ও নতুন প্রজšে§র কাছে গগননামী বাউল সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করে। তিনি এক মহান সুরকার তাইত গগনের গান রবীন্দ্র মানসে অভ‚তপূর্ব দোলা লেগেছিল এবং তার গানে বাউলতত্ত সম্পর্কীয় আধ্যাত্মিক মনের ছবি সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। এই গানটির সুরে রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি রচনা করেছিলেন।
গগনের গানে মনের মানুষকে সন্ধান করার ব্যাকুলতা এবং মনের মানুষের জন্য ভালবাসা ফুটে উঠেছিল। আর রবীন্দ্রনাথ গানটির সুরে সোনার বাংলা তথা বাংলা ভাষা, বাংলার সঙ্গীত, বাংলার শিল্প, বাংলার যা কিছু আছে তাই-ই ভালবাসা দিয়ে অনুভব করেছিলেন। বিদেশী শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হবার পর বাউল সুরে রচিত গানটিই আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেয়েছে।
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশবিদেশে বেড়াই ঘুরে।
কোথায় পাব তারে।
এই বিখ্যাত মরমি গানের রচয়িতা গগন। যার পূর্ণ নাম গগনচন্দ্র দাম। দাম পদবী বাঙ্গালী হিন্দুদের মধ্যে দেখা যায়। দাঁ এবং দাম পদবী একই উৎস থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। গগন ছিলেন সামান্য শিক্ষিত আর তা দিয়েই তিনি শিলাইদহ ডাকঘরে ডাক হরকরার চাকরি পেয়েছিলেন। এ জন্য তার নামের পাশে হরকরা শব্দটি যোগ করে গগন হরকরা নামে ডাকা হত এবং এ নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তার প্রকৃত নাম গগনচন্দ্র দাস।
নাম তার গগন কিন্তু পদবি ডাক হরকরা তাই পোস্ট অফিসের চিঠি বিলির কাজে ঝাঁ ঝাঁ রোদে মাঠে ময়দানে কিংবা গাঁয়ে গাঁয়ে এঁকে ঘুরতে হত। সে সময় মাঠের মধ্যে, নদীর তীরে গগন প্রাণের আনন্দে মরমি সঙ্গীত গেয়ে শান্ত প্রকৃতিকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে দিতেন। তার গানের সুরে পল্লীর কুঠিরে কুঠিরে রসতরঙ্গ জেগে উঠত।
জমিদার রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৯-১৯০১ সাল পর্যন্ত শিলাইদহ ও শাহজাদপুরের জমিদারি দেখার জন্য নিয়মিত আসতেন। এই সময় গগনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে বলে অনুমেয় হয়। আর চিঠি বিলি করার জন্য জমিদার রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রত্যহই গগনকে যেতে হত, সেই সুবাদে হয়ত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হত এবং কিছু খোসগল্প ও রসালাপও হত এটাই স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার পর নির্জনে বোটের ছাদে-কখনো তারা ভরা আকাশের নিচে কখনো নির্জন দুপুরে পদ্মা ঘাটে, কখনো কাচারি বাড়িতে গগন অপূর্ব সুষমা ও সুরব্যঞ্জনা দিয়ে আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে সঙ্গীত প্রিয় মানুষদের মাতিয়ে তুলতেন। সে সময় স্বয়ং জমিদার রবীন্দ্রনাথও তার গীতসুধা পান করতেন এবং মুগ্ধ হতেন। জমিদারি পরিচালনার কাজে শিলাইদহ এসে রবীন্দ্রনাথ যেমন ফকির লালন সাঁইয়ের গানে প্রভাবিত হয়েছিলেন, তেমনি লালনের পরে গগন হরকরার গানে যে কম প্রভাবিত হয়েছিলেন এমন নহে। আর তাই গগন হরকরার অনুকৃত সুরে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশীযুগের অনেক বাউল গান রচনা করেছেন, যা তার ‘বাউল’ গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন। বাউলতত্ত¡ ও দর্শন সম্পর্কে তার ধারণা গঠনে গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানটির ভ‚মিকা অত্যন্ত স্পষ্ট। কারণ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মহান সুরটি রবীনদ্রনাথ ঠাকুর গগন হরকরার গাওয়া ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানটির সুরের উপর নতুন কথা বসিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রচনা করেন।
গগন ছেঁউড়িয়ার বাউল লালন ফকিরের ভক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ জমিদারির দায়িত্ব নিয়ে শিলাইদহে এসে গগনের বাউল গানের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা লাভ করেন এবং রবীন্দ্রনাথ তার সান্নিধ্য থেকেই কাঙ্গাল হরিনাথ, গোসাই রামলালসহ বিভিন্ন সাধকের বাউল গান শোনার সুযোগ পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তার কোন কোন নাটকে বাউল চরিত্র সংযোজন গগনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
‘ডাকঘর’ নাটকেও আছে গগন চরিত্রের ছাপ। বহু ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহও লক্ষ্য করেছেন, রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’, ‘অচলায়তন’ ইত্যাদি নাটকে ঠাকুর্দা, দাদা ঠাকুর, অন্ধবাউল শ্রেণীর যে একটি চরিত্রের সংযোজন দেখা যায়- এই চরিত্র সৃষ্টিতে শিলাইদহের কোন এক বাউল ফকিরের ছায়া পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ যে বাউলের সাথে দেখা পেয়েছিলেন, কথাও বলেছিলেন সেই বাউল গগন হরকরা। গগনের গানের ভনিতায় গুরুর নাম উল্লেখ নেই তবে পন্ডিত ক্ষিতিমোহন শাস্ত্রী গগনকে ‘লালনের শিষ্য ধারার একজন’ বলে অনুমান করেছেন। ত
বে গগন লালনের গান গাইতেন, গগনের কাছ থেকে অনেকে লালনসহ আরো কয়েকজন সাধকের গান সংগ্রহ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ গগনকে পরিচিত ও বিখ্যাত করলেও তার অনেক আগেই শ্রীমতি সরলা দেবী (ভারতী-ভাদ্র-১৩০২) গগনের গান সংগ্রহ ও প্রকাশ করেন এবং ‘লালনফকির ও গগন’ নামীয় প্রবন্ধ লেখেন উপসংহারে গগনের ভক্ত জীবনের বিবরণী সংগ্রহ করে ‘ভারতী’তে প্রকাশার্থে পাঠানোর জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ তার বিভিন্ন প্রবন্ধ আলোচনায় ও বক্তৃতায় গগনের ওই একটি গানের কথাই বারবার উল্লেখ করেছেন আর ওই গানটিকে যেন বাউল দর্শনের ভিত্তি হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন। ‘গগনের গানই শুধু তাকে মুগ্ধ করেনি, তার সরলতা, স্বতঃস্ফ‚র্ততা, ভাবুকতা ও চাল চলনও ঠাকুর কবির মন জয় করেছিল।’ রবীন্দ্রনাথ তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন বাউলের মূল উদ্দেশ্য যে মনের মানুষকে খোঁজ করা সেই পরম সত্যটি গগনের গানে উপলদ্ধি করা যায়।
ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে খুব সম্ভবত ১৮৪০ সালের দিকে শিলাইদহ ইউনিয়নের গবরাখালি গ্রামে এক কৃষিজীবী কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই মহাপুরুষ গগন হরকরা। গগনের পিতা ও মাতা সম্পর্কে তেমন কোন খোঁজ জানা না গেলেও কিরণচন্দ্র নামে তার একপুত্র ছিল বলে জানা যায়। তবে জনশ্রুতি রয়েছে, গগন পুত্র কিরণ চন্দ্রের অল্প বয়সে মৃত্যু হয়েছিল। মংলাচন্দ্র, সুন্দরীদাসী, কানাইচন্দ্র তার পৌত্র পৌত্রী। গগনের মৃত্যুর পর তার ভবিষ্যত বংশধর কেউ শিলাইদহে ছিল না। অভাব অভিযোগই মূল কারণ।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পূর্বেই পাংশার সরিষা পেসটিয়াতে গিয়ে বসবাস করে বলে জানা যায়। কৃষক পরিবারে জš§ গগন হরকরা প্রথমে কৃষিকাজ করতেন এটাই স্বাভাবিক। তবে বিভিন্ন জনশ্রুতি রয়েছে, গগনের বাস্তভিটায় আসামদ্দি নামক একজন কৃষক বাড়ি করে থাকতেন এবং সে বাড়িটি আজও দাসের ভিটা নামে পরিচিত। গগন হরকরার বিশাল এক আমবাগান ছিল। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে এসব আমগাছ আমদানি করেছিলেন। দুই যুগ আগেও গগনের ভিটা ও ফলের বাগানের অস্তিত্ব ছিল কিন্তু আজ সেই বাগানে কিছু মেহগনী গাছ ছাড়া আর কিছু চোখে পরে না। গগন অনেকটাই অবহেলিত। কারণ পূর্বে শিলাইদহের কাছারি বাড়ির পূর্ব পাশে গগন হরকরা স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহ পোস্ট অফিস ছিল। পরবর্তীতে সরকার সেটি নিলাম করে দিয়েছিল।
বর্তমানে সেখানে পুকুর খনন করা হয়েছে। গগন হরকরার আর কোন স্মৃতি চিহ্ন নেই বললেই চলে। তাকে কেউ গুরুত্ব সহকারে স্বরণ করে না। তবে কুষ্টিয়া জেলা সদরের নিশান মোড়ে পৌরসভার উদ্যোগে গগনের একটি প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে যা গগন ভক্তদের মনে দোলা দেয় ও নতুন প্রজšে§র কাছে গগননামী বাউল সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করে। তিনি এক মহান সুরকার তাইত গগনের গান রবীন্দ্র মানসে অভ‚তপূর্ব দোলা লেগেছিল এবং তার গানে বাউলতত্ত সম্পর্কীয় আধ্যাত্মিক মনের ছবি সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। এই গানটির সুরে রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি রচনা করেছিলেন।
গগনের গানে মনের মানুষকে সন্ধান করার ব্যাকুলতা এবং মনের মানুষের জন্য ভালবাসা ফুটে উঠেছিল। আর রবীন্দ্রনাথ গানটির সুরে সোনার বাংলা তথা বাংলা ভাষা, বাংলার সঙ্গীত, বাংলার শিল্প, বাংলার যা কিছু আছে তাই-ই ভালবাসা দিয়ে অনুভব করেছিলেন। বিদেশী শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হবার পর বাউল সুরে রচিত গানটিই আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেয়েছে।
No comments