৯ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১৬,৬৫৬ কোটি টাকা
দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অবস্থাপনা ও তদারকির অভাবে ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো মূলধন সংকটে পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সরকারি মালিকানাধীন ৮ ব্যাংকের মধ্যে ৭ ব্যাংকই মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। যেখানে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতে মাত্র ৯টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংকিং খাতের আর্থিক পরিস্থিতি নাজুক হয়ে যাবে। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি খুবই খারাপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সোমবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও তদারকির অভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আর খেলাপি ঋণ বাড়লে মূলধন ঘাটতি বাড়বেই। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের কারণে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে।
ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে মূলধন ঘাটতি কমানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের নানা উদ্যোগের পরও মূলধন ঘাটতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না সরকারি ব্যাংকগুলো। গত জুনে সরকারি খাতের ৭ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। গত মার্চে মূলধন ঘাটতি ছিল ৫ ব্যাংকে। এই ব্যাংকগুলোর ঘাটতি ছিল ১৩ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে ঘাটতিতে পড়া ব্যাংকের সংখ্যা ও পরিমাণ উভয় বেড়েছে। নিয়মানুযায়ী ব্যাংকগুলোকে ৪০০ কোটি টাকা অথবা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশের মধ্যে যা বেশি সেই পরিমাণ অর্থ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। জুন শেষে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৪২ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ১৪ হাজার ১৭০ কোটি মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা মূলধন সংরক্ষণ করতে সক্ষম হওয়ায় ৬ হাজার ৭১ কোটি টাকা ঘাটতি পড়েছে। সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ ও মূলধন ঘাটতি সবচেয়ে বেশি সোনালী ব্যাংকের। জুন শেষে ব্যাংকটির ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৩ হাজার ৭৫০ কোটি। ঝুঁকিভিত্তিক এই সম্পদের বিপরীতে ৪ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা মূলধন রাখার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এটি রাখতে সক্ষম হয়নি ব্যাংকটি। মাত্র ১ হজার ৭৬৯ কোটি টাকা রাখায় মূলধন ঘাটতি হয়েছে ২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মূলধন পর্যাপ্ততার হার মাত্র ৪ শতাংশ। যেখানে ন্যূনতম ১০ শতাংশ থাকতে হয়।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২ হাজার ২৮৬ কোটি ঘাটতি বেসিক ব্যাংকের। ব্যাংকটির মূলধন পর্যাপ্ততার হারও ঋণাত্মক প্রায় ১০ শতাংশ। ব্যাংকটির ঝুঁকিভিত্তিক ১১ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকার সম্পদের বিপরীতে ১ হাজার ১৫৩ কোটি রাখার প্রয়োজন ছিল। রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি ১ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। ঝুঁকিপূর্ণ ১৬ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা সম্পদের বিপরীতে মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে পেরেছে। মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ হারে ১ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা সংরক্ষণের বিপরীতে মাত্র ৫৭৫ কোটি টাকা রাখতে পেরেছে ব্যাংকটি। জনতা ব্যাংকের ঘাটতি ৬৬৪ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ৩ হাজার ৮৭০ কোটি টাকার বিপরীতে ৩ হাজার ২০৬ কোটি সংরক্ষণ করতে পেরেছে। অন্যদিকে অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২০০ কোটি টাকা। সরকারি মালিকানাধীন ৮ ব্যাংকের মধ্যে শুধু বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) মূলধন উদ্বৃত্ত রয়েছে ৭৩৭ কোটি টাকা। সরকারি মালিকানাধীন দুই বিশেষায়িত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৮ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ঘাটতি ৭ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা। মূলধনের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থায় ব্যাংকটি। জুন শেষে ১৩ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি ৬৯৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ৪ হাজার ২২২ কোটি টাকার বিপরীতে কোনো মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি।
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে মাত্র দুটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হয়েছে। আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতি হয়েছে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ২৯৮ কোটি টাকা। সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৪৩ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ৭৭ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো ৭৬ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতে ৬৪০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি হয়েছে। দেশের মোট ৫৬টি ব্যাংকের মধ্যে ৯টি বাদে ৪৭টি ব্যাংকের প্রয়োজনীয় পরিমাণে তুলনায় বেশি পরিমাণে মূলধন রাখতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে ওই ৯ ব্যাংকের ১৬ হাজার ৬৫৬ কোটি ঘাটতি হলেও অন্য ব্যাংকের অতিরিক্ত মূলধন সংরক্ষণ করায় সামগ্রিকভাবে ঘাটতি কমে এসেছে। এছাড়া জুন শেষে ব্যাংক খাতে মূলধন পর্যাপ্ততার হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আগের প্রান্তিক মার্চে এই পরিমাণ আরও বেশি ছিল ১০ দশমিক ৬৪ শতাংশ। তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতে মূলধন পর্যাপ্ততার হার কমেছে।
No comments