চলমান সংকট : বিদেশী হস্তক্ষেপ এবং সমঝোতার প্রত্যাশা by ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী

দু’সপ্তাহ আগে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ভারতের কাম্য।’ বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের উদ্বেগ অতি স্বাভাবিক। বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হলে তা গোটা অঞ্চলকেই অস্থিতিশীল করে তুলবে। তাতে ভারতেরও ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। এটা ভারতীয় কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করছে, তাতে আশার আলো দেখছি। তবে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ও দৃশ্যমান নৈরাজ্যের জন্য ভারত সরকারের বাংলাদেশ নীতিও কি কিছুটা হলেও দায়ী নয়? ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। বলা যায় একমাত্র প্রতিবেশী। দক্ষিণে এক চিলতে জায়গা ছাড়া আমাদের স্থলসীমান্ত সবটুকুই ভারতের সঙ্গে। ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও অমূল্য সহায়তা দিয়েছে। ভারতের সেই শুভেচ্ছা অব্যাহত থাকা আমাদের রাষ্ট্রীয় সুস্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। দুর্ভাগ্যবশত ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে আমাদের নানা টানাপোড়েন যেন লেগেই আছে। সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহ উন্নয়ন ও বণ্টনসহ বলতে গেলে কোনো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনোভাবে এ দেশের সাধারণ মানুষ খুশি হতে পারছে না।
ভারত বড় দেশ। ‘বড়র পিরিতি বালির বাঁধ’। ভারতের প্রতি তার সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রেরই অভিজ্ঞতা প্রায় অভিন্ন। ভারত তার আধিপত্য এবং নানাবিধ স্বার্থ বিবেচনায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে নিজস্ব প্রভাব বলয় নির্মাণে নানাবিধ উদ্যোগ নিয়ে থাকে। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়।
কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডে এটি নতুন কিছু নয়। আধিপত্য বিস্তারে আগ্রহী সব বড় দেশই এ কাজ করে থাকে। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত ঘটার সম্ভাবনাও থেকে যায়। কারণ, এর ফলে ক্ষুদ্রতর প্রতিবেশী দেশ তার বড় প্রতিবেশীকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। অনেক সময় যা অহেতুক সন্দেহ বাতিকের পর্যায়ে চলে যায়। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি লক্ষণীয়রূপে বিরাজমান।
ভারত সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়শ বলা হয়, তারা বাংলাদেশের কোনো বিশেষ দলের সঙ্গে নয়, জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতেই আগ্রহী। কিন্তু বাংলাদেশকে ঘিরে ভারতের এযাবৎকালের কূটনীতি ও নানা পদক্ষেপ তা প্রমাণ করে না। ভারত নিশ্চিতরূপেই এ দেশে বিশেষ বিশেষ দল বা গোষ্ঠীকে বরাবর পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এসেছে। এখনও যা অব্যাহত আছে। বিশেষ করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। ভারতীয় রাজনীতিকরা যেন অতীতের বৃত্ত থেকে কিছুতেই বের হয়ে আসতে পারেন না। এর কিছু ঐতিহাসিক কারণ থাকলেও সময়ের বিবর্তনে এবং বর্তমানের বাস্তবতায় এই বৃত্ত ভেঙে নতুনভাবে পথ চলার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যবশত ভারত এখন বিশ্ব পরাশক্তি হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এতদঞ্চলে সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ভারতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এতই আত্মনিমগ্ন যে, প্রতিবেশী দেশগুলোর কল্যাণ-অকল্যাণ কিংবা সেসব দেশের জনমতের দিকে দৃষ্টি দেয়ার সময়ও তাদের আছে বলে মনে হয় না।
২.
যাই হোক, আমাদের দুর্দিনে শ্রীমতী সুজাতা সিং ঢাকায় এসেছেন। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছিলেন কয়েকদিন আগে। জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত মি. তারানকো এসেছেন। বাংলাদেশ এখন বিদেশী হাইপ্রোফাইল মেহমানদের পদচারণায় মুখর। তারা সবাই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, সমঝোতার তাগিদ দিচ্ছেন। মি. তারানকো তো দিন-রাত ছুটে বেড়াচ্ছেন। সেজন্য তাদের ধন্যবাদ।
কিন্তু তাদের কিছু কিছু মন্তব্য ও কর্মকাণ্ড কি কূটনৈতিক শালীনতার সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে না? শ্রীমতী সিং জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে দেখা করে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য তাকে চাপ দিয়েছেন বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। জনাব এরশাদকে নির্বাচনে যোগ দেয়ার জন্য ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব চাপ প্রদান করার বিষয়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। একে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপের শামিল মনে করা কি অযৌক্তিক হবে?
একইভাবে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূতগণও প্রায়শ আমাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে প্রকাশ্যেই নানা শলাপরামর্শ দিয়ে চলেছেন। সম্প্রতি একজন রাষ্ট্রদূত আমাদের একজন মন্ত্রীর সঙ্গে পাশাপাশি বসে যৌথ সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। এ এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। তাদের নিজ নিজ দেশে অন্য কোনো দেশের একজন রাষ্ট্রদূত কি এ ধরনের সুযোগ পেতে পারেন?
নানা কারণে বাংলাদেশ এখন আঞ্চলিক ও বিশ্ব রাজনীতির দাবার ঘুঁটি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমাদের দুই বড় দলের রাজনৈতিক সংঘাতের সুযোগ নিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে আসছেন অনেকে। দেশের শীর্ষ রাজনীতিকরা দেশের মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে মর্যাদা দেয়ার বদলে বিদেশী শক্তির অনুকম্পা ও সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে দিন-রাত কূটনীতিকপাড়ায় ধরনা দিচ্ছেন। কেবল দেশের ভেতরেই নয়, বিদেশের মাটিতেও তারা পরস্পরের ‘বস্ত্রহরণে’ লিপ্ত হয়ে দেশের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করছেন। ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে তাদের অনেকে বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ বিশেষ বিশেষ বিদেশী শক্তির হাতে তুলে দিতেও কুণ্ঠিত নন বলে অনেকের আশংকা।
বাংলাদেশ ১৬ কোটি মানুষের দেশ। একটি সফল মুক্তি সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে লাখো প্রাণের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। এই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এ দেশের মানুষ কখনও আপস করতে পারে না। এই প্রশ্নে সামান্যতম আপসকামী রাজনৈতিক দলকেও জনগণ কিভাবে প্রত্যাখ্যান করে, তা স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী লীগের বিড়ম্বনা ও বিপর্যয়ের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। বঙ্গবন্ধুর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাও যা ঠেকাতে পারেনি।
এ বাস্তবতা আমাদের বিদেশী বন্ধুদেরও মনে রাখতে হবে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিবাদ-বিসংবাদ যত তীব্রই হোক না কেন, এই দেশকে কেউ যদি আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশের মতো বিবেচনা করেন এবং বেশি বেশি হস্তক্ষেপ করতে অভিলাষী হন, তাহলে তাদের হাত নিশ্চিতরূপেই পুড়বে।
আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে দিতে হবে। এ ধরনের রাজনৈতিক সংঘাত এ দেশে নতুন কিছু নয়। অতীতেও এ ধরনের সংঘাতে বিদেশী হস্তক্ষেপের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত নিজেরাই আমরা পথ খুঁজে পেয়েছি। স্যার নিনিয়ানের মধ্যস্থতায় যে সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি, তারও সমাধান হয়েছে। আপস-সমঝোতা না হলেও নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমরা নিজেরাই একটা সমাধানে পৌঁছতে পেরেছি।
আমাদের বিদেশী বন্ধুরা, যারা আমাদের এই সংকটের দ্রুত সমাধান কামনা করছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েই বলা যায়, এবারেও শেষ পর্যন্ত একটা সমাধান বের হয়ে আসবে। গ্রাম-বাংলায় প্রবাদ আছে- ‘বাছুর কুঁদে খুঁটির জোরে’। তাই বাইরের হস্তক্ষেপ না থাকলে বিবদমান পক্ষগুলো নিজ নিজ স্বার্থেই আলোচনার টেবিলে বসে দ্রুত মীমাংসায় পৌঁছতে বাধ্য হবে।
৩.
কিছু বিদেশী মিডিয়া বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর আশু হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার কথা বলছে। আমাদের সশস্ত্র বাহিনী দুনিয়ার দেশে দেশে শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত। ভয়ংকর গৃহযুদ্ধে নিমগ্ন দেশে নির্বাচন করে ক্ষমতা হস্তান্তরের দায়িত্ব সম্পন্ন করে তারা প্রশংসিত হয়েছে। নামিবিয়ার সাম্প্রতিক নির্বাচন জাতিসংঘ শান্তি মিশনের তত্ত্বাবধানে সুসম্পন্ন হয়েছে। আর সেই মিশনের নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশেরই একজন সাবেক আইজিপি।
২০০৭ সালে এমনই এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতার আওতায় ‘জরুরি আইন’ জারি হয় এবং সেনাবাহিনী দেশের আইন-শৃংখলা রক্ষায় প্রশাসনকে সহায়তা প্রদান করে। মনে রাখা দরকার, জরুরি আইন আর ‘সামরিক শাসন’ এক কথা নয়। অনেকে এই দুই ব্যবস্থাকে এক করে ফেলেন। জরুরি আইন একটি সাময়িক সাংবিধানিক পদক্ষেপ। রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনবোধে দেশের কোনো অংশে বা সারা দেশে তা জারি করতে পারেন। অন্যদিকে সামরিক শাসন একটি অসাংবিধানিক পদক্ষেপ, যা দেশের সংবিধান বিলুপ্ত বা স্থগিত না করে কার্যকর করার কোনো সুযোগ নেই।
দেশে এখন যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার প্রেক্ষিতে অনেকে ইতিমধ্যেই জরুরি আইন জারির সপক্ষে কথা বলছেন। আমাদের রাজনীতিকরা, বিশেষ করে দুই বড় দল, সজাগ ও তৎপর হয়ে পরিস্থিতির লাগাম টেনে ধরলে তেমন পরিস্থিতি এড়ানো এখনও সম্ভব।
৪.
নির্বাচন সামনে রেখে চলমান রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে ইতিপূর্বেকার জাতীয় নির্বাচন থেকে আমরা চারটি ‘মডেল’ বিবেচনায় নিতে পারি।
১৯৮৬ সালে গোপন সমঝোতার নির্বাচন
১৯৮৬’র নির্বাচনে তৎকালীন ‘স্বৈরাচার’-এর বিরুদ্ধে আন্দোলনরত দলগুলোর অন্যতম আওয়ামী লীগ রাতারাতি ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ নিয়ে নির্বাচনে যোগ দিলে বিএনপিসহ আন্দোলনকারী দলগুলো বেকায়দায় পড়ে যায়। আন্দোলন বিপর্যস্ত হয়ে নির্বিঘেœ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই সংসদ ২ বছরও টিকে থাকতে পারেনি।
১৯৮৮ সালে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ নিয়ে নির্বাচন দুই বছর পর ১৯৮৮ সালে ‘স্বৈরাচার’-এর অধীনে আরেকটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবারে আওয়ামী লীগ আর নির্বাচনে যোগ দেয়নি। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারি উদ্যোগে গঠিত হয় ৭২ দলের একটি জোট। যাকে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। বলা হয়, সেই নির্বাচনে প্রকৃত ভোটার উপস্থিতি ছিল ৩ শতাংশ মাত্র। তারপরও ৩০০ আসনে যথারীতি ফলাফল ঘোষিত হয়। ২ বছরের মধ্যে সেই সংসদও ভেঙে দিতে হয়।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারির ‘৩ মাস মেয়াদি’ নির্বাচন ১৯৯৬তে বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’-এর দাবি ক্ষমতাসীন বিএনপি নীতিগতভাবে মেনে নেয়। কিন্তু সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সন্নিবেশিত করার জন্য সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের দরকার। ১৪৪ জন সদস্য পদত্যাগ করার কারণে তখনকার সংসদে সেই সংখ্যক সদস্য ছিল না। অতএব শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করার জন্যই একটি স্বল্পমেয়াদি সংসদ নির্বাচন দিতে হয়। সেটাই ছিল ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্র“য়ারির নির্বাচন। আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো এ নির্বাচনে অংশ না নিলেও তা যথারীতি সম্পন্ন হতে দিয়েছে। বিএনপি নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হয়। তবে দলটি প্রতিশ্র“তি মোতাবেক ৩ মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন দেয়ার প্রশ্নে গড়িমসি করতে থাকলে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। চাপের মুখে সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়। ১২ জুন নতুন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় চলে আসে। বর্তমান অবস্থায় সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য অনুরূপ একটি ‘স্বল্পমেয়াদি’ পার্লামেন্ট গঠন করার সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখা যেতে পারে।
২০০৮ সালে ‘জরুরি আইনে’ নির্বাচন ২০০৭-এর ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ছিল। তখন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করে তা প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। স্পষ্টতই দেশ এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের দিকে এগিয়ে চলেছিল। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদ ‘জরুরি আইন’ জারি করেন। দেশের জনগণ সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠিত হয়। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৩ মাসের সাংবিধানিক মেয়াদ পার হয়ে যায়। তবে ‘জাতীয় প্রয়োজন’ (ফড়পঃৎরহব ড়ভ হবপবংংরঃু) বিবেচনায় তা সবাই মেনে নেয়। অতঃপর প্রায় ২ বছর পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এই ৪টি মডেলের নির্বাচন সামনে রেখে আমরা বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করতে পারি।
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ১৯৮৬ মডেলে বিএনপিকে বাদ দিয়ে একদিকে বিভিন্ন বামপন্থী দল এবং অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ছাড়া অন্যান্য ইসলামী দলকে নির্বাচনে আনার চেষ্টা হয়েছে। এমনকি ‘হেফাজতে ইসলাম’কে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। কিন্তু এই প্রয়াস ফলপ্রসূ হয়নি। অতঃপর ১৯৮৮ স্টাইলে একটি ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ দাঁড় করিয়ে ‘ভোটারবিহীন নির্বাচন’ করার চেষ্টা হয়েছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এবারে এরশাদ সাহেব স্বয়ং সেই ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ গড়ার দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। তার পরিণতি এখন আমরা চোখের সামনে দেখছি।
অবশিষ্ট আছে অপর দুই মডেল-১৯৯৬ (ফেব্র“য়ারি) ও ২০০৮।
বর্তমান সরকার যে কোনো প্রকারে নির্বাচন সম্পন্ন করতে আগ্রহী। বলা হচ্ছে, ঘোষিত তফসিল আর বদলানো যাবে না। নির্বাচন পেছাতে হলে বড়জোর ৮/১০ দিন পেছানো সম্ভব; তার বেশি নয়। এ অবস্থায় ১৯৯৬ সালের ফেব্র“য়ারির মতো নির্বাচন করতে হলে প্রথমত সরকারি দলকে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিতে হবে যে, এই নির্বাচন কেবল সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন এবং পূর্বাহ্নেই এর মেয়াদ সর্বাধিক তিন মাস নির্দিষ্ট করে ঘোষণা দিতে হবে। তাহলে সব পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে ‘দশম’ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ৩ মাসের মাথায় ‘একাদশ’ জাতীয় সংসদের জন্য আরেকটি নির্বাচন হতে হবে। ’৯৬-এর ১৫ ফেব্র“য়ারির নির্বাচনের পর যেভাবে ১২ জুনের নির্বাচন হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সেই নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের রূপরেখাসহ অন্য কিছু বিষয় সমঝোতার ভিত্তিতে পার্লামেন্টে প্রয়োজনীয় বিল পাস করিয়ে নিতে হবে। এই মডেল বাস্তবায়নের আরেকটি পথ হতে পারে নবগঠিত মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে বর্তমান সংসদের সদস্যদের মধ্যে যারা আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না তেমন ১০ জনকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করা। এতে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা অটুট থাকবে। অপরদিকে বিরুদ্ধ পক্ষের দাবিও বহুলাংশে মিটে যাবে।
সবশেষে ২০০৮ সালের নির্বাচনকে মডেল হিসেবে নিতে হলে অবধারিতরূপে ২০০৭ সালের ১/১১, অর্থাৎ ‘জরুরি আইন’ জারির পথে যেতে হয়। সেটা সর্বশেষ পন্থা। আমাদের সংবিধানে জরুরি আইন জারির বিধান রয়েছে। কিন্তু তার অবশ্যম্ভাবী নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অভিজ্ঞতাও আমাদের সামনে রয়েছে। যার সবকিছু সুখকর না হলেও এটাই সংকট নিরসনের সর্বশেষ পন্থা।
সমঝোতার এত পথ খোলা থাকলেও আমরা নিজেরা আলোচনায় বসে সংকট নিরসন করতে পারছি না, বিদেশী মধ্যস্থতাকারী ডেকে আনতে হচ্ছে, আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য তা সুখকর নয়।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক

No comments

Powered by Blogger.