অটিস্টিক শিশুদের মেলায় একদিন by নুরুন্নবী হাছিব
অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনে ঢুকতেই চোখে পড়ল গেটের সাজসজ্জা। সুসজ্জিত গেট পেরিয়ে এগোতেই চোখে পড়ল অটিস্টিক শিশুদের তৈরি নানা পণ্যের সমাহার। প্রতিটি স্টলে সাজানো পণ্যগুলো আগত দর্শকদের দেখাচ্ছে পণ্য তৈরি করা শিক্ষার্থীরা। এ দৃশ্য চোখে পড়ে অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের আয়োজনে অটিস্টিক শিশুদের তৈরি বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী নিয়ে আয়োজিত মেলায়। এক স্টলের সামনে যেতেই নিজের তৈরি বিভিন্ন ডিজাইনের মোম দেখায় শিক্ষার্থী সাদ। কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করতেই হেসে নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল সে। তারা, ফুলসহ নানা আকারে তৈরি এসব মোম দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি আকৃষ্ট করছে দর্শকদের। আরেক শিক্ষার্থী তাসনিয়া মেলা সামনে রেখে সুন্দরভাবে সাজিয়েছে মেলা প্রাঙ্গণ। দেয়ালে বিভিন্ন রং ব্যবহার করে আঁকা ফুলগুলো দেখিয়ে সে বলে উঠল, ‘এ কাজ আমার। এখানে রং করেছি আর অনেকগুলো মালাও গেঁথেছি।’ শিক্ষার্থীদের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে রয়েছে জরি আর সুতোর সমন্বয়ে তৈরি ঈদ কার্ড, বিভিন্ন রঙের ফুল, প্রজাপতির ছবি দিয়ে তৈরি ঈদ কার্ড। পাশাপাশি কিছু ঈদ কার্ড ব্লক করা হয়েছে এবং তার ওপর পেস্টিংয়ের কাজটুকু করেছে শিক্ষার্থীরা। কিছু কার্ডে আঙুলের ছাপের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন দৃশ্য। পাশাপাশি নিজেদের তৈরি কানের দুল, বিভিন্ন ডিজাইনের মোম, মাটির জিনিস, কাপড় আর তুলোর মাধ্যমে তৈরি পুতুল, মোবাইল ব্যাগ, চাদর, রুমাল, টি-শার্ট, ট্রে, অফিসে ব্যবহূত ছোট-বড় খামসহ বিভিন্ন জিনিস প্রদর্শন করা হয় মেলায়। অটিজম শিশুদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের শিক্ষক আবুল মনসুর আজাদ বললেন, ‘অটিস্টিক শিশুরা পারে এবং তারা এ কাজগুলো করতে পারলে নিজেরাই স্বাবলম্বী হতে পারবে খুব সহজেই।’ শিক্ষার্থীদের কাজের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি যোগ করলেন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের নিজস্ব ক্যাফেটেরিয়াও পরিচালনা করছে ওরা নিজেরা। বিভিন্ন ধরনের জিনিস তৈরিতে সিদ্ধহস্ত লাবিব রান্না থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজ নিজেই করতে পারে। মেলায় সেও তৈরি করেছে নানা জিনিস। শিক্ষার্থী অনিক বলে উঠল, ‘মেলা চলছে আর এখানে হাতি, শোপিস করেছি আমরা।’ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা জানালেন, প্রতিটি পণ্য তৈরির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কিছুটা সহযোগিতা করা হয়, আর বাকি কাজটুকু তারা নিজেরাই সম্পন্ন করতে পারে। শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপারে শিক্ষকেরা জানালেন, শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন কাজগুলোকে বিভিন্ন ছবির মাধ্যমে শেখানো হয়। মেলার আরেকটি স্টলে যেতেই নিজের তৈরি বিভিন্ন রঙের ছোট-বড় পুঁতির মালা দেখায় আরেক শিক্ষার্থী প্রীতম। শিক্ষক আবুল মনসুর আজাদ জানালেন, এ মালাগুলো তৈরিতে শিক্ষার্থীদের শুধু বলে দেওয়া হয়েছে দুটি ছোট এক রঙের পুঁতির পর বড় একটি অন্য রঙের পুঁতি হবে। বাকি কাজটুকু নিজেরাই সেরেছে শিক্ষার্থীরা। মেলাঙ্গনের পাশেই একটি কক্ষে গিয়ে দেখা গেল কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে তৈরি করছে ব্লকের চাদর। সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক জানালেন, এবারের মেলায় শিক্ষার্থীদের তৈরি ব্লকের এ চাদরটি অনেকেই পছন্দ করেছেন। পাশাপাশি বেশ কিছু অগ্রিম অর্ডারও এসেছে। আর তাই মেলা চলাকালীন ব্লকের চাদর তৈরির কাজটুকু করে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। পুরো মেলা প্রাঙ্গণে দর্শক আর শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। এক পাশে সবাইকে গানের মাধ্যমে মেলায় স্বাগত জানাচ্ছে একজন শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের নিজেদের পণ্যগুলো তৈরির সময় তা ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে ধারণ করে এক পাশে প্রচারও করা হচ্ছে। আগত দর্শকেরা মেলা প্রাঙ্গণ ঘোরার পাশাপাশি কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকছেন টিভি পর্দার সামনে আর দেখে নিচ্ছিলেন শিক্ষার্থীদের পণ্য তৈরির ব্যাপারগুলো। এ মেলার আয়োজক অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ডা. রওনাক হাফিজ জানালেন, ‘এই নিয়ে চতুর্থবারের মতো অটিস্টিক শিশুদের তৈরি পণ্যমেলা হচ্ছে। অটিস্টিক শিশুরাও যে পারে, এ ব্যাপারটি তুলে ধরতে এ ধরনের আয়োজন করে যাচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এসব অটিজম শিক্ষার্থীকে স্বাবলম্বী করতেও সাহায্য করবে এ মেলা এবং ভবিষ্যতে তারা যাতে নিজেরাও কিছু করতে পারে, সে লক্ষ্য নিয়ে আমাদের এগিয়ে চলা।’ মেলার প্রতিটি স্টলে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ছিল সানিডেল স্কুলের একদল শিক্ষার্থী। তারা অটিস্টিক শিক্ষার্থীদের পণ্য প্রদর্শন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে। মেলা দেখতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী চৌধুরী ইশতিয়াক বলেন, অটিজম শিশুরা যে এ ধরনের সুন্দর কাজ করতে পারে, নিজে না দেখলে জানা হতো না। তিনি নিজে বেশ কিছু পণ্য কেনার পাশাপাশি এসব কাজে উত্সাহিত করেন শিক্ষার্থীদের। অটিস্টিক শিশুরাও নিজেদের স্বপ্নকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চায় এবং নিজেদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে নানা পণ্য তৈরি করে। দেয়ালে টাঙানো বিভিন্ন ওয়ালমেটও তৈরি করেছে কয়েকজন শিক্ষার্থী, যেখানে নানা দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণে। এ ধরনের কাজ দেখে সত্যিই অটিস্টিক শিক্ষার্থীদের শিল্পী মনের পরিচয়ও পাওয়া যায়। ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এ মেলা শেষ হলো গতকাল।
No comments