ইংরেজি ভাষার ক্রিকেট উপন্যাস by শারমিন সুলতানা
প্রথম আলো, ১৪ জুন ২০১৯:
ইংরেজদের মাধ্যমে কমনওয়েলথ দেশগুলোতে জনপ্রিয় হওয়া ক্রিকেটকে উপজীব্য করে
ওই সব দেশে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে বেশ কিছু উপাখ্যান। উইকিপিডিয়া এবং বিভিন্ন
সূত্র ঘেঁটে তৈরি করা হয়েছে ইংরেজি ভাষার কয়েকটি ক্রিকেট উপন্যাস নিয়ে এই
লেখা।
ইংরেজি ভাষা ও ক্রিকেট—ভারতবর্ষ থেকে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, আফ্রিকা থেকে অস্ট্রেলিয়ান ভূখণ্ড—সবখানে ব্রিটিশ ঔপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যের পরবর্তীকালে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জাতীয়তার পরিচায়ক হয়ে বিকশিত হয়েছে। খোদ ব্রিটিশ ইংরেজি সাহিত্যে ক্রিকেটের সংক্রমণ ভীষণ রকম। চার্লস ডিকেন্সের পিক উইক পেপার (১৮৩৬)-এ কাল্পনিক ক্রিকেট দল সর্ব-মাগলটনের বিপক্ষে ডিংলি ডেল দলের ক্রিকেট ম্যাচের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা সম্ভবত উপন্যাসে সবচেয়ে প্রাচীন ক্রিকেটীয় উপাদান। তারপর টমাস হিউজের টম ব্রাউন’স স্কুল ডেইজ–এ (১৮৫৭) ক্রিকেট উল্লেখযোগ্যভাবে স্থান পেয়েছে। টমাস হিউজের এই উপন্যাসের একটি বখাটে চরিত্র হ্যারি ফ্লাশম্যান শতবর্ষ পরে জর্জ ম্যাকডোনাল্ড ফ্লেজারের ‘ফ্ল্যাশম্যান’ সিরিজে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমর্স ও ড. ওয়াটসন ‘দ্য ফিল্ড বাজার’ গল্পে ক্রিকেটবাজ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সিগফ্রিড সাসুনের মেমোয়ারস অব ফক্স হান্টিং ম্যান (১৯২৮); ডরোথি সেয়ার্স, এজি ম্যাকডোনাল্ড প্রমুখের লেখায় ক্রিকেট নানা পরিসরে, বর্ণনাশৈলীতে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু এঁদের কোনো উপন্যাসই পুরোপুরি ক্রিকেট উপন্যাস নয়, এখানে ক্রিকেট এসেছে কেবল অনুষঙ্গ হয়ে। কিন্তু ক্রিকেট উপন্যাসে মূলত ক্রিকেট গল্পের মূল চরিত্রের মতো গুরুত্ব ও ব্যাপ্তি লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের সময়ে ডরোথি সেয়ার্সের ‘লর্ড পিটার উইমসি’ সিরিজেও ক্রিকেটের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
ইংরেজি সাহিত্যের প্রাথমিক ক্রিকেট উপন্যাস হিসেবে বলা যায় দুটি বইকে—পি জি উডহাইসের মাইক (১৯০৯) ও স্মিথ ইন দ্য সিটি (১৯১০)। মাইক উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মাইক জ্যাকসন, এক ক্রিকেটপাগল পরিবারের ছোট ছেলে। মাইকের ক্রিকেটের প্রতি আসক্তি এবং ক্রিকেটার হয়ে ওঠাই এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। এই উপন্যাসের ধারাবাহিকতায় স্মিথ ইন দ্য সিটিতে মাইক জ্যাকসন এবং তার ফ্যাশনসচেতন বন্ধু স্মিথের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম এবং ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা—এই দুইয়ের সংকটকে চিত্রায়িত হতে দেখা যায়।
হিউ দে সেলিনকোর্ট গ্রামীণ ক্রিকেট নিয়ে লিখেছেন দুটি উপন্যাস—দ্য ক্রিকেট ম্যাচ (১৯২৪) ও দ্য গেম অব দ্য সিজন (১৯৩৫)। ব্রুস হ্যামিলটনের প্রো: অ্যান ইংলিশ ট্র্যাজেডি (১৯৪৬), হ্যারল্ড হবসনের দ্য ডেভিল ইন দ্য উডফোর্ড ওয়েলস–এ–ও মিশে আছে ক্রিকেট। উইলিয়াম গডফ্রে, জে এল কর ও ডগলাস অ্যাডামসও ক্রিকেট নিয়ে লিখেছেন উপন্যাস। অ্যডামসের ‘হিচ হাইকার’ সিরিজের উপন্যাস লাইফ, দ্য ইউনিভার্স অ্যান্ড এভরিথিং–এ (১৯৮২) কল্পবিজ্ঞানের সম্মিলন ঘটেছে, ‘অ্যাশেজ’ নিয়ে বিকল্প বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে। আবার আইরিশ লেখক জোসেফ ও’ নিলের নেদারল্যান্ডস ও পল হুইলারের বডি লাইন—এই দুই উপন্যাসের গল্পও আবর্তিত হয়েছে ক্রিকেট নিয়ে। এ তো গেল ইংরেজ রচিত ইংরেজি ক্রিকেট-সাহিত্য। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশবাদের সাম্রাজ্য যত দূর ছিল, সবখানে নিজের অস্তিত্ব ভালোভাবেই পোক্ত করেছে ক্রিকেট, সাবেক শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া ইংরেজি ভাষা ও ক্রিকেট—এই দুটো ব্যাপার আত্তীকৃত করে উপনেবিশিত দেশগুলোয় লেখা হয়েছে এন্তার সাহিত্য।
ভারতবর্ষে ক্রিকেট-উন্মাদনা তো অবিশ্বাস্য রকমের। জনপ্রিয় সাহিত্যে, বিশেষত ইংরেজি ভাষায় রচিত উপন্যাসে ক্রিকেট উপস্থাপিত হয়েছে নিবিড়ভাবে, রচিত হয়েছে বেশ কিছু ক্রিকেট উপন্যাস। এ ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হলেন মালগুড়ি ডেজখ্যাত লেখক আর কে নারায়ণ। তাঁর স্বামী অ্যান্ড ফ্রেন্ডস সচেতনভাবে ক্রিকেট উপন্যাস না হলেও ঘটনাপ্রবাহ এবং চরিত্রগুলোও ক্রিকেটের ঘেরাটোপ থেকে বের হতে পারে না। দক্ষিণ ভারতে কল্পিত ছোট শহর মালগুড়িতে বালক স্বামীনাথ ও তার বন্ধুরা ব্রিটিশ শাসনামলে গড়ে তোলে একটি ক্রিকেট ক্লাব। স্বামীনাথ তার বোলিং কৌশলে দক্ষতার জন্য উপন্যাসে পরিচিতি পায় বিখ্যাত ইংরেজ ক্রিকেটার মরিস টেটের নামে। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসে চরিত্রগুলো ক্রিকেট নিয়ে সব সময় নিয়োজিত থাকলেও এবং এখানে অনেক খ্যাতিমান ক্রিকেটারের নাম নেওয়া হলেও এ উপন্যাসে কোনো ক্রিকেট ম্যাচের বিবরণ পাওয়া যায় না।
বর্তমানকালে ভারতের জনপ্রিয় ধারার ইংরেজি ভাষার লেখক চেতন ভগতের থ্রি মিসটেকস অব মাই লাইফ একটি ক্রিকেট উপন্যাস। এ উপন্যাস থেকে ক্রিকেটপ্রধান চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে বলিউডে—কাই পো চে নামে। এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ঈশান ক্রিকেটপাগল তরুণ। তার বন্ধু গোবিন্দ, ক্রিকেট সরঞ্জামের দোকান চালায়। ঈশান আবিষ্কার করে আলী নামের মুসলিম বালককে, যে একজন অসাধারণ ব্যাটসম্যান। বন্ধুত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রেম ও সংস্কারের পরতে পরতে থ্রি মিসটেকস অব মাই লাইফ-এ মিশে আছে ক্রিকেট।
দ্য হোয়াইট টাইগারখ্যাত বুকারজয়ী লেখক অরবিন্দ আদিগার সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত ক্রিকেট উপন্যাস সিলেকশন ডে (২০১৬)। ২০১৮ সালে এই উপন্যাস থেকে নির্মিত একই নামের একটি সিরিজ প্রকাশিত হয় নেটফ্লিক্সে। উপন্যাসে দুই ভাই মোহন, কুমার ও তার বাবার ক্রিকেট-জ্বরের গল্প উঠে এসেছে। স্থানীয় আচারবিক্রেতা বাবার ইচ্ছা, তার ছেলেরা শচীন টেন্ডুলকারের মতো ক্রিকেটার হোক, আর এ জন্য সে সবকিছু করতে প্রস্তুত। ক্রিকেটে পুঁজিবাদের আগ্রাসন, ভারতে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের বিপুল তারকাখ্যাতি এবং এই পপ কালচারে বিভ্রান্ত নিম্নবিত্ত বাবার স্বপ্ন ও তার ছেলেদের স্বতন্ত্রতা—এসব সংঘাতে এগিয়ে চলে গল্প। পুরো উপন্যাসে রয়েছে উত্তেজনাময় ক্রিকেট ম্যাচের স্নায়ু অবশ করা নিখাদ বর্ণনা।
অরবিন্দ আদিগার ক্রিকেট উপন্যাস নিয়ে লিখতেই মনে এল অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট সাহিত্যের কথা। কারণ, অরবিন্দ আদিগা একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলীয় লেখক, তাঁর সিলেকশন ডে উপন্যাসের পটভূমি ভারত হলেও তিনি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট কথাসাহিত্যের নাম খুঁজলে চলে আসবে ‘টবি জোনস’ সিরিজের নাম। মিশেল প্যানক্রিজ ও অস্ট্রেলিয়ার খ্যাতিমান পেসার ব্রেট লির লেখা মোট পাঁচটি ক্রিকেট উপন্যাস নিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে এই সিরিজ। এখানে দেখা যায়, টবি জোনস নামের এক তরুণ ক্রিকেটারকে, সাফল্য ও ব্যর্থতার একপর্যায়ে যে আবিষ্কার করে সময় পরিভ্রমণ করতে পারে সে। উইজডেন ক্রিকেট আলম্যানাকের যেকোনো স্কোরকার্ডের দিকে তাকিয়েই অতীতের সেই ম্যাচে চলে যেতে পারে সে।
এ ছাড়া অস্ট্রেলীয় লেখক ম্যালকম নক্স লিখেছেন অভিনব ক্রিকেট–রহস্য উপন্যাস আ প্রাইভেট ম্যান (২০০৪)। সিডনিতে অনুষ্ঠিত পাঁচ দিনব্যাপী টেস্ট ম্যাচের অন্তরালে দুর্ধর্ষ খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করেন লেখক, পাশাপাশি গল্পের অনেকখানি ব্যাপ্তিজুড়ে থাকে ক্রিসের ক্রিকেট ক্যারিয়ার বাঁচানোর লড়াই।
অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবেশী নিউজিল্যান্ডের নিজস্ব কিছু ক্রিকেট উপন্যাস আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো মিশেল ও’ লরির আউট অব ইট (১৯৮৭)। এখানে মধ্য আশির দশকের একটি এক দিনের ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনাপূর্ণ কাহিনি উপস্থাপন করেছেন তিনি, যেখানে নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট দলের বিপক্ষে তৎকালীন বিখ্যাত গায়ক ও তারকাদের একাদশকে খেলতে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে জিমি হেনডিক্স ও জ্যানিস জ্যাপলিনও আছেন। নিউজিল্যান্ডের মতো আরেক দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কারও রয়েছে গর্ব করার মতো কিছু ক্রিকেট সাহিত্য। লঙ্কান ঔপন্যাসিক শিহান করুনাতিলাকা তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস চায়নাম্যান: দ্য লিজেন্ড অব প্রদীপ ম্যাথিউ-এ ক্রিকেটকে আশ্রয় করে শ্রীলঙ্কার সমাজবাস্তবতার গল্পই বলেছেন।
ক্রিকেট ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের জল-হাওয়ার সঙ্গে মিশে গেলেও এখানে তেমন কোনো ক্রিকেট উপন্যাস মেলে না। তবে ভি এস নাইপলের গল্পসমগ্র মিগুয়েল স্ট্রিট (১৯৫৯)-এ পোর্ট অব স্পেনের শহরতলিতে নিম্নবিত্ত জীবনে ক্রিকেটকে মিশে থাকতে দেখা যায়। আর আর্ল লাভলেসের ইজ জাস্ট আ মুভি উপন্যাসের (২০১২) ‘ফ্র্যাঙ্কলিন ব্যাটিং’ নামের অধ্যায়টি ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটকেই চিত্রায়িত করে।
আর শেষে লিখতে হবে এ কথা যে ক্রিকেটটা ভালো খেললেও ইংরেজি ভাষায় লেখা উপন্যাসে ক্রিকেট এখনো অনুপস্থিতই থেকে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকা ও বাংলাদেশ।
ইংরেজি ভাষা ও ক্রিকেট—ভারতবর্ষ থেকে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, আফ্রিকা থেকে অস্ট্রেলিয়ান ভূখণ্ড—সবখানে ব্রিটিশ ঔপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যের পরবর্তীকালে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জাতীয়তার পরিচায়ক হয়ে বিকশিত হয়েছে। খোদ ব্রিটিশ ইংরেজি সাহিত্যে ক্রিকেটের সংক্রমণ ভীষণ রকম। চার্লস ডিকেন্সের পিক উইক পেপার (১৮৩৬)-এ কাল্পনিক ক্রিকেট দল সর্ব-মাগলটনের বিপক্ষে ডিংলি ডেল দলের ক্রিকেট ম্যাচের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা সম্ভবত উপন্যাসে সবচেয়ে প্রাচীন ক্রিকেটীয় উপাদান। তারপর টমাস হিউজের টম ব্রাউন’স স্কুল ডেইজ–এ (১৮৫৭) ক্রিকেট উল্লেখযোগ্যভাবে স্থান পেয়েছে। টমাস হিউজের এই উপন্যাসের একটি বখাটে চরিত্র হ্যারি ফ্লাশম্যান শতবর্ষ পরে জর্জ ম্যাকডোনাল্ড ফ্লেজারের ‘ফ্ল্যাশম্যান’ সিরিজে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমর্স ও ড. ওয়াটসন ‘দ্য ফিল্ড বাজার’ গল্পে ক্রিকেটবাজ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সিগফ্রিড সাসুনের মেমোয়ারস অব ফক্স হান্টিং ম্যান (১৯২৮); ডরোথি সেয়ার্স, এজি ম্যাকডোনাল্ড প্রমুখের লেখায় ক্রিকেট নানা পরিসরে, বর্ণনাশৈলীতে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু এঁদের কোনো উপন্যাসই পুরোপুরি ক্রিকেট উপন্যাস নয়, এখানে ক্রিকেট এসেছে কেবল অনুষঙ্গ হয়ে। কিন্তু ক্রিকেট উপন্যাসে মূলত ক্রিকেট গল্পের মূল চরিত্রের মতো গুরুত্ব ও ব্যাপ্তি লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের সময়ে ডরোথি সেয়ার্সের ‘লর্ড পিটার উইমসি’ সিরিজেও ক্রিকেটের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
ইংরেজি সাহিত্যের প্রাথমিক ক্রিকেট উপন্যাস হিসেবে বলা যায় দুটি বইকে—পি জি উডহাইসের মাইক (১৯০৯) ও স্মিথ ইন দ্য সিটি (১৯১০)। মাইক উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মাইক জ্যাকসন, এক ক্রিকেটপাগল পরিবারের ছোট ছেলে। মাইকের ক্রিকেটের প্রতি আসক্তি এবং ক্রিকেটার হয়ে ওঠাই এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। এই উপন্যাসের ধারাবাহিকতায় স্মিথ ইন দ্য সিটিতে মাইক জ্যাকসন এবং তার ফ্যাশনসচেতন বন্ধু স্মিথের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম এবং ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা—এই দুইয়ের সংকটকে চিত্রায়িত হতে দেখা যায়।
হিউ দে সেলিনকোর্ট গ্রামীণ ক্রিকেট নিয়ে লিখেছেন দুটি উপন্যাস—দ্য ক্রিকেট ম্যাচ (১৯২৪) ও দ্য গেম অব দ্য সিজন (১৯৩৫)। ব্রুস হ্যামিলটনের প্রো: অ্যান ইংলিশ ট্র্যাজেডি (১৯৪৬), হ্যারল্ড হবসনের দ্য ডেভিল ইন দ্য উডফোর্ড ওয়েলস–এ–ও মিশে আছে ক্রিকেট। উইলিয়াম গডফ্রে, জে এল কর ও ডগলাস অ্যাডামসও ক্রিকেট নিয়ে লিখেছেন উপন্যাস। অ্যডামসের ‘হিচ হাইকার’ সিরিজের উপন্যাস লাইফ, দ্য ইউনিভার্স অ্যান্ড এভরিথিং–এ (১৯৮২) কল্পবিজ্ঞানের সম্মিলন ঘটেছে, ‘অ্যাশেজ’ নিয়ে বিকল্প বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে। আবার আইরিশ লেখক জোসেফ ও’ নিলের নেদারল্যান্ডস ও পল হুইলারের বডি লাইন—এই দুই উপন্যাসের গল্পও আবর্তিত হয়েছে ক্রিকেট নিয়ে। এ তো গেল ইংরেজ রচিত ইংরেজি ক্রিকেট-সাহিত্য। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশবাদের সাম্রাজ্য যত দূর ছিল, সবখানে নিজের অস্তিত্ব ভালোভাবেই পোক্ত করেছে ক্রিকেট, সাবেক শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া ইংরেজি ভাষা ও ক্রিকেট—এই দুটো ব্যাপার আত্তীকৃত করে উপনেবিশিত দেশগুলোয় লেখা হয়েছে এন্তার সাহিত্য।
ভারতবর্ষে ক্রিকেট-উন্মাদনা তো অবিশ্বাস্য রকমের। জনপ্রিয় সাহিত্যে, বিশেষত ইংরেজি ভাষায় রচিত উপন্যাসে ক্রিকেট উপস্থাপিত হয়েছে নিবিড়ভাবে, রচিত হয়েছে বেশ কিছু ক্রিকেট উপন্যাস। এ ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হলেন মালগুড়ি ডেজখ্যাত লেখক আর কে নারায়ণ। তাঁর স্বামী অ্যান্ড ফ্রেন্ডস সচেতনভাবে ক্রিকেট উপন্যাস না হলেও ঘটনাপ্রবাহ এবং চরিত্রগুলোও ক্রিকেটের ঘেরাটোপ থেকে বের হতে পারে না। দক্ষিণ ভারতে কল্পিত ছোট শহর মালগুড়িতে বালক স্বামীনাথ ও তার বন্ধুরা ব্রিটিশ শাসনামলে গড়ে তোলে একটি ক্রিকেট ক্লাব। স্বামীনাথ তার বোলিং কৌশলে দক্ষতার জন্য উপন্যাসে পরিচিতি পায় বিখ্যাত ইংরেজ ক্রিকেটার মরিস টেটের নামে। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসে চরিত্রগুলো ক্রিকেট নিয়ে সব সময় নিয়োজিত থাকলেও এবং এখানে অনেক খ্যাতিমান ক্রিকেটারের নাম নেওয়া হলেও এ উপন্যাসে কোনো ক্রিকেট ম্যাচের বিবরণ পাওয়া যায় না।
বর্তমানকালে ভারতের জনপ্রিয় ধারার ইংরেজি ভাষার লেখক চেতন ভগতের থ্রি মিসটেকস অব মাই লাইফ একটি ক্রিকেট উপন্যাস। এ উপন্যাস থেকে ক্রিকেটপ্রধান চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে বলিউডে—কাই পো চে নামে। এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ঈশান ক্রিকেটপাগল তরুণ। তার বন্ধু গোবিন্দ, ক্রিকেট সরঞ্জামের দোকান চালায়। ঈশান আবিষ্কার করে আলী নামের মুসলিম বালককে, যে একজন অসাধারণ ব্যাটসম্যান। বন্ধুত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রেম ও সংস্কারের পরতে পরতে থ্রি মিসটেকস অব মাই লাইফ-এ মিশে আছে ক্রিকেট।
দ্য হোয়াইট টাইগারখ্যাত বুকারজয়ী লেখক অরবিন্দ আদিগার সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত ক্রিকেট উপন্যাস সিলেকশন ডে (২০১৬)। ২০১৮ সালে এই উপন্যাস থেকে নির্মিত একই নামের একটি সিরিজ প্রকাশিত হয় নেটফ্লিক্সে। উপন্যাসে দুই ভাই মোহন, কুমার ও তার বাবার ক্রিকেট-জ্বরের গল্প উঠে এসেছে। স্থানীয় আচারবিক্রেতা বাবার ইচ্ছা, তার ছেলেরা শচীন টেন্ডুলকারের মতো ক্রিকেটার হোক, আর এ জন্য সে সবকিছু করতে প্রস্তুত। ক্রিকেটে পুঁজিবাদের আগ্রাসন, ভারতে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের বিপুল তারকাখ্যাতি এবং এই পপ কালচারে বিভ্রান্ত নিম্নবিত্ত বাবার স্বপ্ন ও তার ছেলেদের স্বতন্ত্রতা—এসব সংঘাতে এগিয়ে চলে গল্প। পুরো উপন্যাসে রয়েছে উত্তেজনাময় ক্রিকেট ম্যাচের স্নায়ু অবশ করা নিখাদ বর্ণনা।
অরবিন্দ আদিগার ক্রিকেট উপন্যাস নিয়ে লিখতেই মনে এল অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট সাহিত্যের কথা। কারণ, অরবিন্দ আদিগা একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলীয় লেখক, তাঁর সিলেকশন ডে উপন্যাসের পটভূমি ভারত হলেও তিনি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট কথাসাহিত্যের নাম খুঁজলে চলে আসবে ‘টবি জোনস’ সিরিজের নাম। মিশেল প্যানক্রিজ ও অস্ট্রেলিয়ার খ্যাতিমান পেসার ব্রেট লির লেখা মোট পাঁচটি ক্রিকেট উপন্যাস নিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে এই সিরিজ। এখানে দেখা যায়, টবি জোনস নামের এক তরুণ ক্রিকেটারকে, সাফল্য ও ব্যর্থতার একপর্যায়ে যে আবিষ্কার করে সময় পরিভ্রমণ করতে পারে সে। উইজডেন ক্রিকেট আলম্যানাকের যেকোনো স্কোরকার্ডের দিকে তাকিয়েই অতীতের সেই ম্যাচে চলে যেতে পারে সে।
এ ছাড়া অস্ট্রেলীয় লেখক ম্যালকম নক্স লিখেছেন অভিনব ক্রিকেট–রহস্য উপন্যাস আ প্রাইভেট ম্যান (২০০৪)। সিডনিতে অনুষ্ঠিত পাঁচ দিনব্যাপী টেস্ট ম্যাচের অন্তরালে দুর্ধর্ষ খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করেন লেখক, পাশাপাশি গল্পের অনেকখানি ব্যাপ্তিজুড়ে থাকে ক্রিসের ক্রিকেট ক্যারিয়ার বাঁচানোর লড়াই।
অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবেশী নিউজিল্যান্ডের নিজস্ব কিছু ক্রিকেট উপন্যাস আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো মিশেল ও’ লরির আউট অব ইট (১৯৮৭)। এখানে মধ্য আশির দশকের একটি এক দিনের ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনাপূর্ণ কাহিনি উপস্থাপন করেছেন তিনি, যেখানে নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট দলের বিপক্ষে তৎকালীন বিখ্যাত গায়ক ও তারকাদের একাদশকে খেলতে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে জিমি হেনডিক্স ও জ্যানিস জ্যাপলিনও আছেন। নিউজিল্যান্ডের মতো আরেক দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কারও রয়েছে গর্ব করার মতো কিছু ক্রিকেট সাহিত্য। লঙ্কান ঔপন্যাসিক শিহান করুনাতিলাকা তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস চায়নাম্যান: দ্য লিজেন্ড অব প্রদীপ ম্যাথিউ-এ ক্রিকেটকে আশ্রয় করে শ্রীলঙ্কার সমাজবাস্তবতার গল্পই বলেছেন।
ক্রিকেট ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের জল-হাওয়ার সঙ্গে মিশে গেলেও এখানে তেমন কোনো ক্রিকেট উপন্যাস মেলে না। তবে ভি এস নাইপলের গল্পসমগ্র মিগুয়েল স্ট্রিট (১৯৫৯)-এ পোর্ট অব স্পেনের শহরতলিতে নিম্নবিত্ত জীবনে ক্রিকেটকে মিশে থাকতে দেখা যায়। আর আর্ল লাভলেসের ইজ জাস্ট আ মুভি উপন্যাসের (২০১২) ‘ফ্র্যাঙ্কলিন ব্যাটিং’ নামের অধ্যায়টি ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটকেই চিত্রায়িত করে।
আর শেষে লিখতে হবে এ কথা যে ক্রিকেটটা ভালো খেললেও ইংরেজি ভাষায় লেখা উপন্যাসে ক্রিকেট এখনো অনুপস্থিতই থেকে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকা ও বাংলাদেশ।
No comments