কাঠমান্ডুর দরবারে by গাজী মুনছুর আজিজ
নেপালের
কাঠমান্ডুতে অবস্থিত হনুমান ধোকা দরবার ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য
হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এটি ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত নেপালের রাজপ্রাসাদ ছিল। ঘুরে
এসে লিখেছেন- গাজী মুনছুর আজিজ
দরবারে প্রবেশ পথের এক প্রান্তে বেশ বড় আকৃতির হনুমান মূর্তি। এ মূর্তির জন্যই দরবারটির পোশাকি নাম হনুমান ধোকা দরবার স্কয়ার। নেপালের কাঠমান্ডু শহরের এ দরবার কাঠমান্ডু দরবার স্কয়ার নামেও পরিচিত। ১৫০ রুপির টিকিট কেটে কাঠমান্ডুর প্রাচীন এ রাজপ্রাসাদে যখন প্রবেশ করি তখন সূর্য মাথা বরাবর। অবশ্য বরফের দেশ বলে সূর্যের তেজ খুব একটা গায়ে লাগছে না। তবে দরবারে প্রবেশ করে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। কারণ, দরবারের অনেক স্থাপনা ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে ভেঙে গেছে। এ ভূমিকম্পের প্রায় বছর দুই পর প্রথমবার এসেছিলাম এ দরবারে। এক বছরের মাথায় আবারও এলাম। এবারের ভ্রমণসঙ্গী সাইক্লিস্ট আবুল হোসেন আসাদ।
দরবারের অন্যতম আকর্ষণ বসন্তপুর টাওয়ার। ভূমিকম্পের আঘাতে এ টাওয়ারও ভেঙে গেছে। এ টাওয়ারসহ পুরোপুরি ভেঙেপড়া দরবারের স্থাপনাগুলো আবার নতুন করে আগের আদলে সংস্কার করা হচ্ছে। এছাড়া যেসব স্থাপনা বেশি বা অল্প ক্ষতি হয়েছে, সেগুলোরও সংস্কার চলছে আগের আদলে। কিছু কিছু স্থাপনার দেওয়াল কাঠ ও লোহার পাইপ দিয়ে ঠেক দেওয়া হয়েছে, যাতে ভেঙে না পড়ে।
দরবারের খোলা চত্বরে অস্থায়ী অনেক দোকানে নানা পণ্য সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। আমরা ঘুরে ঘুরে এসব দোকানের পণ্য দেখি। এসব পণ্যের মধ্যে আছে কাঁসা-পিতলের বৌদ্ধমূর্তিসহ বিভিন্ন দেব-দেবির মূর্তি, নেপালের ঐতিহ্যবাহী খুরকি বা নকশা করা খাপঅলা ছুরি, কাঁসা-পিতলের বিভিন্ন পাত্র, উজ্জ্বল রঙের পাথর, পুঁতি বা কাঠের মালা, চুড়ি, নানা গহনাসহ বিভিন্ন পর্যটন-স্মারক। কিছুক্ষণ এসব পণ্য দেখি।
দরবারের ইতিহাস ঘেঁটে জানি, ১৪৮২ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীন কাঠমান্ডুর প্রথম রাজা ছিলেন রতœ মল্লা। মূলত তার নির্দেশেই দরবারের নির্মাণ কাজ শুরু। ১৬ শতকেও কিছু নির্মাণ হয়েছে। ১৬৭২ সালে দরবারের প্রধান গেটের সামনে হনুমানের মূর্তি স্থাপন করা হয়। তবে ১৭ শতকে রাজা প্রতাপ মল্লার দ্বারা দরবারের অধিকাংশ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। মূলত ১৫ থেকে ২০ শতকের মধ্যে নির্মিত হয় রাজকীয় এ প্রাসাদ। রতœ মল্লা থেকে পৃথিবী বীরবিক্রম শাহ পর্যন্ত প্রত্যেক রাজাই প্রাসাদে কিছু না কিছু নির্মাণ বা সংস্কার করেন। এ দরবার ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত নেপালের রাজকীয় প্রাসাদ ছিল। ১৯৭৯ সালে এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়।
দরবারে একাধিক চৌক বা আঙিনা আছে। প্রতিটি চৌকের আলাদা আলাদা নাম। এসব চৌক বা আঙিনায় যেসব ভবন বা মন্দির আছে, তার নামও আলাদা আলাদা। একেকটি ভবন একেক রকমের। কোনোটি দোতলা, কোনোটি তিনতলা, আবার কোনোটি চারতলা বা তারও বেশি তলা বিশিষ্ট। তবে সব ভবনই নান্দনিক কারুকাজে নির্মিত এবং প্রায় একই ধাঁচের।
ঘুরে ঘুরে একে একে আসি দরবারের দখ চৌক, সুন্দরী চৌক, মহাখালী চৌক, মাসান চৌক, মহা বিষ্ণু মূর্তি, নরসিংহের মূর্তিসহ বিভিন্ন চৌক। সব চৌক বা আঙিনার সব ভবনই অনেকটা একই নকশায় নির্মিত। এছাড়া অধিকাংশ ভবনের ওপরের অংশ চৌচালা আকৃতির। কিছু আছে গোলাকার। তবে সব ওপরের অংশই পর্যায়ক্রমে নিচেরটার চেয়ে ওপরেরটা ছোট হয়ে উঠে গেছে। অনেকটা পিরামিডের মতো। অবশ্য প্রত্যেক ভবনেরই দরজা ও জানালা কাঠের। শুধু কাঠের নয়, এসব দরজা ও জানালায় নিখুঁতভাবে খোদাই করে নকশা করা ফুল, পাখিসহ বিভিন্ন দেব-দেবির মূর্তি। কাঠের এসব কারুকাজ সত্যিই বিস্ময়কর। শত শত বছর আগে যেসব কারিগর বা শিল্পী কাঠের এসব কারুকাজ করেছেন, তারা আসলেই অনেক মেধাবী ও সৃজনশীল জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। কাঠের কারুকাজ ছাড়াও দরবারের বিভিন্ন আঙ্গিনা বা ভবনের দরজার দুই পাশে আছে বড় আকৃতির সিংহসহ বিভিন্ন মূর্তি।
দরবারের একটি আঙিনায় দেখি অনেক কবুতর। দরবারে আসা দর্শনার্থীরা এসব কবুতরকে খাবার ছিটিয়ে খেতে দেন। ভ্রমণসঙ্গী আসাদও কিছু খাবার ছিটিয়েছেন। এছাড়া দরবারের খোলা চত্বরের অস্থায়ী দোকানের পাশাপাশি বিভিন্ন ভবনের নিচেও ছোট ছোট দোকান আছে। এসব দোকানে আছে বিভিন্ন গরম কাপড়, চিত্রকর্মসহ নানা ধরনের পণ্য ও পর্যটন স্মারক।
বিভিন্ন আঙিনা ঘুরে প্রবেশ করি দরবারের জাদুঘরে। মূলত এটিও একটি আঙিনা বা ভবন। এ আঙিনায় এক সময় নেপালের রাজ পরিবারের বসবাস ছিল। আঙিনার বারান্দার দেওয়ালজুড়ে সাজানো নেপালের রাজপরিবারের ছবি। এছাড়া এ জাদুঘরে আছে শাহ সিংহাসন। শাহ রাজারা এ সিংহাসন ব্যবহার করতেন। আরও আছে রাজকীয় পরিবারের সদস্যদের বহন করার পালকি। পিতলসহ নানা ধাতুর মাধ্যমে কারুকাজ করা এ পালকি রাজপরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠানেও ব্যবহার হতো।
পালকির পাশাপাশি রাজপরিবারের সদস্যদের লাশ বহন করার জন্য ব্যবহৃত স্ট্রেচারও আছে। এছাড়া জাদুঘরের আরেক আকর্ষণ মল্লা সিংহাসন। কাঠের নির্মিত এ সিংহাসন নান্দনিক কারুকাজে অলঙ্করিত।
বিকালের দিকে বের হই দরবার থেকে। আগের বছর যখন এসেছিলাম, তখন এ দরবার দেখে ললিতপুরের পাটান দরবারেও পা রাখি। কাঠমান্ডুর এ দরবারও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। সে গল্প আরেক দিন।
ছবি : লেখক
দরবারে প্রবেশ পথের এক প্রান্তে বেশ বড় আকৃতির হনুমান মূর্তি। এ মূর্তির জন্যই দরবারটির পোশাকি নাম হনুমান ধোকা দরবার স্কয়ার। নেপালের কাঠমান্ডু শহরের এ দরবার কাঠমান্ডু দরবার স্কয়ার নামেও পরিচিত। ১৫০ রুপির টিকিট কেটে কাঠমান্ডুর প্রাচীন এ রাজপ্রাসাদে যখন প্রবেশ করি তখন সূর্য মাথা বরাবর। অবশ্য বরফের দেশ বলে সূর্যের তেজ খুব একটা গায়ে লাগছে না। তবে দরবারে প্রবেশ করে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। কারণ, দরবারের অনেক স্থাপনা ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে ভেঙে গেছে। এ ভূমিকম্পের প্রায় বছর দুই পর প্রথমবার এসেছিলাম এ দরবারে। এক বছরের মাথায় আবারও এলাম। এবারের ভ্রমণসঙ্গী সাইক্লিস্ট আবুল হোসেন আসাদ।
দরবারের অন্যতম আকর্ষণ বসন্তপুর টাওয়ার। ভূমিকম্পের আঘাতে এ টাওয়ারও ভেঙে গেছে। এ টাওয়ারসহ পুরোপুরি ভেঙেপড়া দরবারের স্থাপনাগুলো আবার নতুন করে আগের আদলে সংস্কার করা হচ্ছে। এছাড়া যেসব স্থাপনা বেশি বা অল্প ক্ষতি হয়েছে, সেগুলোরও সংস্কার চলছে আগের আদলে। কিছু কিছু স্থাপনার দেওয়াল কাঠ ও লোহার পাইপ দিয়ে ঠেক দেওয়া হয়েছে, যাতে ভেঙে না পড়ে।
দরবারের খোলা চত্বরে অস্থায়ী অনেক দোকানে নানা পণ্য সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। আমরা ঘুরে ঘুরে এসব দোকানের পণ্য দেখি। এসব পণ্যের মধ্যে আছে কাঁসা-পিতলের বৌদ্ধমূর্তিসহ বিভিন্ন দেব-দেবির মূর্তি, নেপালের ঐতিহ্যবাহী খুরকি বা নকশা করা খাপঅলা ছুরি, কাঁসা-পিতলের বিভিন্ন পাত্র, উজ্জ্বল রঙের পাথর, পুঁতি বা কাঠের মালা, চুড়ি, নানা গহনাসহ বিভিন্ন পর্যটন-স্মারক। কিছুক্ষণ এসব পণ্য দেখি।
দরবারের ইতিহাস ঘেঁটে জানি, ১৪৮২ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীন কাঠমান্ডুর প্রথম রাজা ছিলেন রতœ মল্লা। মূলত তার নির্দেশেই দরবারের নির্মাণ কাজ শুরু। ১৬ শতকেও কিছু নির্মাণ হয়েছে। ১৬৭২ সালে দরবারের প্রধান গেটের সামনে হনুমানের মূর্তি স্থাপন করা হয়। তবে ১৭ শতকে রাজা প্রতাপ মল্লার দ্বারা দরবারের অধিকাংশ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। মূলত ১৫ থেকে ২০ শতকের মধ্যে নির্মিত হয় রাজকীয় এ প্রাসাদ। রতœ মল্লা থেকে পৃথিবী বীরবিক্রম শাহ পর্যন্ত প্রত্যেক রাজাই প্রাসাদে কিছু না কিছু নির্মাণ বা সংস্কার করেন। এ দরবার ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত নেপালের রাজকীয় প্রাসাদ ছিল। ১৯৭৯ সালে এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়।
দরবারে একাধিক চৌক বা আঙিনা আছে। প্রতিটি চৌকের আলাদা আলাদা নাম। এসব চৌক বা আঙিনায় যেসব ভবন বা মন্দির আছে, তার নামও আলাদা আলাদা। একেকটি ভবন একেক রকমের। কোনোটি দোতলা, কোনোটি তিনতলা, আবার কোনোটি চারতলা বা তারও বেশি তলা বিশিষ্ট। তবে সব ভবনই নান্দনিক কারুকাজে নির্মিত এবং প্রায় একই ধাঁচের।
ঘুরে ঘুরে একে একে আসি দরবারের দখ চৌক, সুন্দরী চৌক, মহাখালী চৌক, মাসান চৌক, মহা বিষ্ণু মূর্তি, নরসিংহের মূর্তিসহ বিভিন্ন চৌক। সব চৌক বা আঙিনার সব ভবনই অনেকটা একই নকশায় নির্মিত। এছাড়া অধিকাংশ ভবনের ওপরের অংশ চৌচালা আকৃতির। কিছু আছে গোলাকার। তবে সব ওপরের অংশই পর্যায়ক্রমে নিচেরটার চেয়ে ওপরেরটা ছোট হয়ে উঠে গেছে। অনেকটা পিরামিডের মতো। অবশ্য প্রত্যেক ভবনেরই দরজা ও জানালা কাঠের। শুধু কাঠের নয়, এসব দরজা ও জানালায় নিখুঁতভাবে খোদাই করে নকশা করা ফুল, পাখিসহ বিভিন্ন দেব-দেবির মূর্তি। কাঠের এসব কারুকাজ সত্যিই বিস্ময়কর। শত শত বছর আগে যেসব কারিগর বা শিল্পী কাঠের এসব কারুকাজ করেছেন, তারা আসলেই অনেক মেধাবী ও সৃজনশীল জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। কাঠের কারুকাজ ছাড়াও দরবারের বিভিন্ন আঙ্গিনা বা ভবনের দরজার দুই পাশে আছে বড় আকৃতির সিংহসহ বিভিন্ন মূর্তি।
দরবারের একটি আঙিনায় দেখি অনেক কবুতর। দরবারে আসা দর্শনার্থীরা এসব কবুতরকে খাবার ছিটিয়ে খেতে দেন। ভ্রমণসঙ্গী আসাদও কিছু খাবার ছিটিয়েছেন। এছাড়া দরবারের খোলা চত্বরের অস্থায়ী দোকানের পাশাপাশি বিভিন্ন ভবনের নিচেও ছোট ছোট দোকান আছে। এসব দোকানে আছে বিভিন্ন গরম কাপড়, চিত্রকর্মসহ নানা ধরনের পণ্য ও পর্যটন স্মারক।
বিভিন্ন আঙিনা ঘুরে প্রবেশ করি দরবারের জাদুঘরে। মূলত এটিও একটি আঙিনা বা ভবন। এ আঙিনায় এক সময় নেপালের রাজ পরিবারের বসবাস ছিল। আঙিনার বারান্দার দেওয়ালজুড়ে সাজানো নেপালের রাজপরিবারের ছবি। এছাড়া এ জাদুঘরে আছে শাহ সিংহাসন। শাহ রাজারা এ সিংহাসন ব্যবহার করতেন। আরও আছে রাজকীয় পরিবারের সদস্যদের বহন করার পালকি। পিতলসহ নানা ধাতুর মাধ্যমে কারুকাজ করা এ পালকি রাজপরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠানেও ব্যবহার হতো।
পালকির পাশাপাশি রাজপরিবারের সদস্যদের লাশ বহন করার জন্য ব্যবহৃত স্ট্রেচারও আছে। এছাড়া জাদুঘরের আরেক আকর্ষণ মল্লা সিংহাসন। কাঠের নির্মিত এ সিংহাসন নান্দনিক কারুকাজে অলঙ্করিত।
বিকালের দিকে বের হই দরবার থেকে। আগের বছর যখন এসেছিলাম, তখন এ দরবার দেখে ললিতপুরের পাটান দরবারেও পা রাখি। কাঠমান্ডুর এ দরবারও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। সে গল্প আরেক দিন।
ছবি : লেখক
No comments