ফ্রান্সে ধর্মযুদ্ধের শংকা
ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে গির্জায় হামলার পর এলিসি প্রাসাদে বুধবার বৈঠকে বসেন বিভিন্ন ধর্মের নেতারা -ইপিএ |
ক্যাথলিক ধর্মযাজক হত্যাকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সে ধর্মযুদ্ধ শুরু হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছে দেশটির রাজনীতিকরা। ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভালস বলেছেন, ‘ক্যাথলিক গির্জায় ধর্মযাজকদের ওপর আক্রমণের মাধ্যমে ফরাসি নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। একটি ধর্মকে আঘাত করে সরাসরি ধর্মযুদ্ধকে উস্কে দেয়া হচ্ছে।’ বুধবার সকালে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলান্দ দেশটির ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে উত্তেজনা হ্রাস করার আহ্বান জানান। ভবিষ্যতে যে কোনো হামলা প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয় তাদের। নরম্যান্ডির ফাদার জ্যাকস হামেলকে মঙ্গলবার গির্জার মধ্যে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। আইএস এই হত্যার দায় স্বীকার করার পর ফুঁসে উঠেছে দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসীরা। এদিকে গত দেড় বছরে বিভিন্ন জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রান্সে বসবাসকারী মুসলিম নাগরিকদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ ব্যাপারে টলায়মান ও অস্থির সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে ধর্মযাজক হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে।
নরম্যান্ডির রুয়েন অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে যুদ্ধ এবং হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ১৪৩১ সালে ফরাসি অগ্নিকন্যা জোয়ান অব আর্ককে হত্যা করা হয় এখানে। সে স্থানের খুব কাছেই হত্যা করা হয়েছে ৮৫ বছর বয়সী ক্যাথলিক ধর্মযাজককে। ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভালস এ হত্যাকাণ্ডকে ধর্মযুদ্ধের প্রতীকী আহ্বান হিসেবে গণ্য করে বলেন, ‘ফ্রান্সে দুই ধর্মের মানুষকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ধর্মযুদ্ধের জন্য মদদ দেয়া হচ্ছে।’ আরও এক ধাপ এগিয়ে আছেন দেশটির ডানপন্থী একটি দলের প্রধান ম্যারিয়েন লি পেন। ইসলামবিরোধী অবস্থান নেয়ার জন্য জনগণকে উস্কে দিচ্ছেন তিনি। নিজের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে টুইট করে পেন বলেন, ‘পশ্চিম অথবা পূর্বাঞ্চল, যেখানেই হোক না কেন, ইসলামকে প্রতিহত করার জন্য খ্রিস্টানদের গর্জে উঠতে হবে।’ এছাড়া নিজে সেনাবাহিনীর রিজার্ভ ফোর্সে যোগদানের ঘোষণা দিয়ে তরুণ ফরাসিদেরও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন ম্যারিয়েন লি পেন। তবে সহিংস আচরণ থেকে বিরত থাকার কথাও বলছেন অনেকে। রোয়েনের আর্চবিশপ ডোমিনিক লেবরান বলেন, ‘মানুষের মধ্যে হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠার জন্য প্রার্থনা ছাড়া আর কোনো অস্ত্রে বিশ্বাস করে না ক্যাথলিকরা।’ অন্যদিকে নরম্যান্ড অঞ্চলের মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি মোহাম্মদ কারাবিলা যাজক হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘দেড় বছর ধরে ফ্রান্সের নাগরিকরা হামলার শিকার হচ্ছে। আমাদের ইসলাম ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। এভাবে আর চলতে পারে না।’ শুরুতে ফ্রান্সের ইহুদিদের টার্গেট করে হামলা করা হতো। এখন হামলার লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছে খ্রিস্টানরা। সিরিয়া ও ইরাকের আইএস জঙ্গিরা সেখানে কোণঠাসা হয়ে পড়ায় তারা এখন বিশ্বজুড়ে নাশকতা ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
বাভারিয়া ও নিসে হামলার ঘটনার দ্বারা ঘৃণার সংস্কৃতি ছড়ানোর চেষ্টা করছে তারা। ফ্রান্সের জাতীয় মানবাধিকার সংস্থার তথ্যানুসারে, গত বছর ৪২৯টি হুমকি ও আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে দেশটিতে- যার সবগুলোতেই অমুসলিমদের টার্গেট করা হয়েছে। ২০১৪ সালের তুলনায় গত বছরের হামলার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ২২৩ শতাংশ। যাজক হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রান্সের মসজিদগুলো বন্ধ করে দেয়ার দাবিও উঠেছে দেশটির ন্যাশনাল ফ্রন্টের পক্ষ থেকে। অন্যদিকে শুধু নাইজেরিয়াতেই গত বছর ৪ হাজার খ্রিস্টানকে হত্যা এবং ২০০ গির্জা ধ্বংস করেছে বোকো হারাম। মিসরে গির্জার যাজককে হত্যা করেছে আইএস। ইরাকের মসুল এবং সিরিয়ার রাঙ্কা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বিপুলসংখ্যক খ্রিস্টান নাগরিককে। সবগুলো ঘটনাকে একত্র করে ফ্রান্সের যাজক হত্যার ঘটনাকে সরাসরি খ্রিস্টান ধর্মের বিরুদ্ধে মুসলিমদের আক্রমণ বলে চিহ্নিত করে ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের আক্রমণে উস্কানি দিচ্ছে ফরাসিদের একাংশ। গির্জায় হামলাকারী সন্ত্রাসের অভিযোগে বন্দি ছিলেন : সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে গৃহবন্দি ছিল ফ্রান্সের গির্জায় হামলাকারী ও ধর্মযাজক হত্যাকারী ব্যক্তিটি। মঙ্গলবার গৃহবন্দিত্ব চলাকালীন সময়েই সে এই হামলা চালায় বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা ব্যবস্থার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে দেশজুড়ে। আদেল কারমিচি আক্রমণকারী নামের যুবক দুই ঘাতকের অন্যতম। সে বৃদ্ধ ধর্মযাজককে গলা কেটে হত্যা করে। ১৯ বছর বয়সী এই ঘাতকের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে।
No comments