এসব ছিটমহলবাসীর কী হবে? by তুহিন ওয়াদুদ
ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার কারণে ছিটমহলবাসীর অনেক বড় একটি অংশ এখন হতাশায় নিমজ্জিত |
ছিটমহল
বিনিময়-প্রক্রিয়া সামান্য ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার কারণে ছিটমহলবাসীর অনেক বড়
একটি অংশ এখন হতাশায় নিমজ্জিত। ৩১ জুলাই ছিটমহল বিনিময় হলে বাংলাদেশের
অভ্যন্তরে থাকা ১১১টি ভারতীয় ছিটমহলের যারা ভারতের মূল ভূখণ্ডে যেতে চাইবে,
আগামী ১ আগস্ট থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত তারা যেতে পারবে। যারা যাবে না,
তারা বাংলাদেশের নাগরিক হবে। এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালের
সেপ্টেম্বরে দুই দেশের মধ্যে একটি যৌথ জরিপ হয়। সেই জরিপে যাদের নাম
অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তারাই কেবল কোন দেশে থাকবে, সেই মতামত নেওয়া হয়েছে ৬
থেকে ১৬ জুলাইয়ের পরিসংখ্যানে। যারা তখন অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি, তাদের
কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। তাহলে জরিপে যারা বাদ পড়েছে, তারা ছিটের মানুষ বলে
আপাতত স্বীকৃতি পাচ্ছে না। ২০১১ সালের জরিপে বাদ পড়া ব্যক্তির সংখ্যা কত
হবে, তা কেউই নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন না। অনেকের অনুমান, এই সংখ্যা পাঁচ
থেকে সাত হাজারও হতে পারে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরের বৃহৎ ছিটমহল দাশিয়ার ছড়া। ২০১১ সালের জরিপে বাদ পড়া ব্যক্তিদের বাস্তবতা বোঝার জন্য ঈদের আগের দিন গেলাম সেখানে। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার খড়িবাড়ী বাজার থেকে দাশিয়ার ছড়া ছিটমহলে ঢুকেই ছোট কামাত এলাকায় এক বৃদ্ধকে দেখতে পেলাম। নাম মনমোহন রায়। জিজ্ঞাসা করলাম, ভারতে যাবেন, নাকি বাংলাদেশে থাকবেন? তিনি খুব হতাশ চিত্তে নাগরিকত্ব হারানোর কথা শোনালেন। তিনি জোর করে তাঁর বাড়ির ভেতরে আমাকে ডেকে নিলেন। অনেক পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে তাঁর জমির দলিল বের করে এনে বললেন, ‘আমার বাবা ও তাঁর বাবা এখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ২০১১ সালের জরিপে আমাদের নাম নেই। আমরা এখন কোন দেশের তাহলে?’ মনমোহন রায়ের সঙ্গে কথা বলতেই তাঁর উঠানে আরও কয়েকজন উপস্থিত হলেন, যাঁদের নাম নেই ২০১১ সালের জরিপে। তাঁদের একজন সুদীপ রায় বলছিলেন, ‘আমরা এখন না ভারতের নাগরিক, না বাংলাদেশের নাগরিক।’ মনমোহন রায় ভারতে যেতে চেয়েছিলেন। পাশেই দাঁড়ানো কমলিনী রায়, শ্বশুরবাড়ি ভারতে। তাঁরও ইচ্ছা ভারতে যাওয়ার। ২০১১ সালের জরিপে তাঁর নাম না থাকার কারণে মনঃকষ্ট নিয়ে আছেন। তিনি এর সমাধান চান।
যাদের দেশ থেকেও নেই, তাদের দেশ দেওয়ার চেষ্টাতেই ছিটমহল বিনিময় হচ্ছে, কাউকে দেশহীন করার জন্য নয়। তাই যারা দেশহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কার মধ্যে আছে, তারা কেউই যেন দেশহীন হয়ে না পড়ে।
কয়েক বাড়ি এগিয়ে গেলে বৃদ্ধা জাহানারার সঙ্গে কথা হলো। তিনিও জানালেন, অনেকেই বাদ পড়েছেন জনগণনা থেকে। তিনি বলছিলেন, ‘জরিপে বাদ পড়া লোকজন তো ইতিম হইল। তাদের এখন কোনো দেশ নাই। তবে একটু চেষ্টা করলেই এই ইতিমের মা-বাবা পাওয়া যাইবে। দুই দেশের সরকার যেন এদের মা-বাবাক আনি দেয়।’ আরও একটু এগিয়ে গেলে মোটরবাইক আর চালানো যায় না, এতটাই বেহাল দশা সড়কের। বাড়ির ভেতরের নারীর কাছে কণ্ঠ উঁচু করে জানতে চাইলাম, জরিপে এ বাড়ির কেউ বাদ পড়েছে নাকি? শরিফা নামের একজন এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমারই তো নাম নাই।’ মেয়েকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এরও নাম নাই।’ জানতে চাইলাম আশপাশে আর কারও নাম বাদ পড়েছে নাকি। তিনি জানান, পাশের বাড়ি রফিকুলের নাম বাদ পড়েছে। রফিকুলের বাড়ি গেলাম। সেখানে গিয়ে শুনলাম তাঁর পরিবার, তাঁর ভাইয়ের পরিবারসহ অনেকেরই নাম নেই ২০১১ সালের জরিপে।
মুঠোফোনে কথা হচ্ছিল ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফার সঙ্গে। তিনিও জানান, অনেকেই বাদ পড়েছেন জরিপ থেকে। তিনি আমাকে একটু পাশেই মহির নামের একজনের নাম বাদ পড়ার কথা জানালেন। মহিরের বাড়ির উঠানে গিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন বসে আছেন। তাঁদের অনেকেই বাদ পড়েছেন। মহিরের পরিবারের ১১ জনের কারও নাম নেই। জহুরুল, খালেকসহ অনেকেই বলছিলেন তাঁদের নাম না থাকার কথা। সেখানে সাইকেল চালিয়ে এসে দাঁড়ালেন আফসার আলী। কণ্ঠ থেকে গড় গড় করে ক্ষোভ ঝরে পড়ছে। তিনি দিল্লিতে চাকরি করেন। দিল্লি থেকে এসে দেখেন নাম নেই।
বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের সরকারের প্রচেষ্টাই হচ্ছে ছিটমহলবাসীর সুবিধা নিশ্চিত করা। সেখানে কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে সেটা যথাসময়ে দূর করাও ভীষণ প্রয়োজন। ২০১১ সালে যে জরিপ হয়েছে, তখন ভারতে যেতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ৭৪৩ জন। এখন সেই সংখ্যা ৯৭৯ জন। ২০১১ সালের জরিপ যে সম্পূর্ণরূপে অনুসরণ করা হচ্ছে, তা-ও নয়। আবার সেই জরিপের পর নতুন করে জন্ম নেওয়া এবং বৈবাহিক সূত্রে অধিকারপ্রাপ্তদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাহলে যারা ২০১১ সালে বাদ পড়েছে, তারা কেন নতুন করে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না। বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ অংশের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘ছিটমহল বিনিময়ে যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদেরও অনেকেই বাদ পড়েছেন। ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি এবং স্থানীয়দের সহযোগিতা নিয়ে বাদ পড়া প্রকৃত ছিটমহলবাসীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।’ দািশয়ার ছড়ার স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত ২০০২-২০০৭ মেয়াদের পঞ্চায়েতপ্রধান নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বাড়ি বাড়ি গিয়ে জরিপের কাজ করে বাদ পড়া বৈধ ছিটমহলবাসীকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।’
কয়েক হাজার ছিটমহলবাসীর নাম বাদ পড়েছে ২০১১ সালের জরিপ থেকে। ৩১ জুলাইয়ের পর জরিপে বাদ পড়া ছিটমহলবাসীর অবৈধ অভিবাসীতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা কম নয়। অবৈধ অভিবাসীদেরও নিজস্ব একটা দেশ থাকে। কিন্তু এরা হয়ে উঠবে দেশহীন। যাদের দেশ থেকেও নেই, তাদের দেশ দেওয়ার চেষ্টাতেই ছিটমহল বিনিময় হচ্ছে, কাউকে দেশহীন করার জন্য নয়। তাই যারা দেশহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কার মধ্যে আছে, তারা কেউই যেন দেশহীন হয়ে না পড়ে; সেটাই আমরা বাংলাদেশ-ভারত উভয় রাষ্ট্রের কাছে আশা করি।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail. com
বাংলাদেশের অভ্যন্তরের বৃহৎ ছিটমহল দাশিয়ার ছড়া। ২০১১ সালের জরিপে বাদ পড়া ব্যক্তিদের বাস্তবতা বোঝার জন্য ঈদের আগের দিন গেলাম সেখানে। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার খড়িবাড়ী বাজার থেকে দাশিয়ার ছড়া ছিটমহলে ঢুকেই ছোট কামাত এলাকায় এক বৃদ্ধকে দেখতে পেলাম। নাম মনমোহন রায়। জিজ্ঞাসা করলাম, ভারতে যাবেন, নাকি বাংলাদেশে থাকবেন? তিনি খুব হতাশ চিত্তে নাগরিকত্ব হারানোর কথা শোনালেন। তিনি জোর করে তাঁর বাড়ির ভেতরে আমাকে ডেকে নিলেন। অনেক পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে তাঁর জমির দলিল বের করে এনে বললেন, ‘আমার বাবা ও তাঁর বাবা এখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ২০১১ সালের জরিপে আমাদের নাম নেই। আমরা এখন কোন দেশের তাহলে?’ মনমোহন রায়ের সঙ্গে কথা বলতেই তাঁর উঠানে আরও কয়েকজন উপস্থিত হলেন, যাঁদের নাম নেই ২০১১ সালের জরিপে। তাঁদের একজন সুদীপ রায় বলছিলেন, ‘আমরা এখন না ভারতের নাগরিক, না বাংলাদেশের নাগরিক।’ মনমোহন রায় ভারতে যেতে চেয়েছিলেন। পাশেই দাঁড়ানো কমলিনী রায়, শ্বশুরবাড়ি ভারতে। তাঁরও ইচ্ছা ভারতে যাওয়ার। ২০১১ সালের জরিপে তাঁর নাম না থাকার কারণে মনঃকষ্ট নিয়ে আছেন। তিনি এর সমাধান চান।
যাদের দেশ থেকেও নেই, তাদের দেশ দেওয়ার চেষ্টাতেই ছিটমহল বিনিময় হচ্ছে, কাউকে দেশহীন করার জন্য নয়। তাই যারা দেশহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কার মধ্যে আছে, তারা কেউই যেন দেশহীন হয়ে না পড়ে।
কয়েক বাড়ি এগিয়ে গেলে বৃদ্ধা জাহানারার সঙ্গে কথা হলো। তিনিও জানালেন, অনেকেই বাদ পড়েছেন জনগণনা থেকে। তিনি বলছিলেন, ‘জরিপে বাদ পড়া লোকজন তো ইতিম হইল। তাদের এখন কোনো দেশ নাই। তবে একটু চেষ্টা করলেই এই ইতিমের মা-বাবা পাওয়া যাইবে। দুই দেশের সরকার যেন এদের মা-বাবাক আনি দেয়।’ আরও একটু এগিয়ে গেলে মোটরবাইক আর চালানো যায় না, এতটাই বেহাল দশা সড়কের। বাড়ির ভেতরের নারীর কাছে কণ্ঠ উঁচু করে জানতে চাইলাম, জরিপে এ বাড়ির কেউ বাদ পড়েছে নাকি? শরিফা নামের একজন এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমারই তো নাম নাই।’ মেয়েকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এরও নাম নাই।’ জানতে চাইলাম আশপাশে আর কারও নাম বাদ পড়েছে নাকি। তিনি জানান, পাশের বাড়ি রফিকুলের নাম বাদ পড়েছে। রফিকুলের বাড়ি গেলাম। সেখানে গিয়ে শুনলাম তাঁর পরিবার, তাঁর ভাইয়ের পরিবারসহ অনেকেরই নাম নেই ২০১১ সালের জরিপে।
মুঠোফোনে কথা হচ্ছিল ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফার সঙ্গে। তিনিও জানান, অনেকেই বাদ পড়েছেন জরিপ থেকে। তিনি আমাকে একটু পাশেই মহির নামের একজনের নাম বাদ পড়ার কথা জানালেন। মহিরের বাড়ির উঠানে গিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন বসে আছেন। তাঁদের অনেকেই বাদ পড়েছেন। মহিরের পরিবারের ১১ জনের কারও নাম নেই। জহুরুল, খালেকসহ অনেকেই বলছিলেন তাঁদের নাম না থাকার কথা। সেখানে সাইকেল চালিয়ে এসে দাঁড়ালেন আফসার আলী। কণ্ঠ থেকে গড় গড় করে ক্ষোভ ঝরে পড়ছে। তিনি দিল্লিতে চাকরি করেন। দিল্লি থেকে এসে দেখেন নাম নেই।
বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের সরকারের প্রচেষ্টাই হচ্ছে ছিটমহলবাসীর সুবিধা নিশ্চিত করা। সেখানে কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে সেটা যথাসময়ে দূর করাও ভীষণ প্রয়োজন। ২০১১ সালে যে জরিপ হয়েছে, তখন ভারতে যেতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ৭৪৩ জন। এখন সেই সংখ্যা ৯৭৯ জন। ২০১১ সালের জরিপ যে সম্পূর্ণরূপে অনুসরণ করা হচ্ছে, তা-ও নয়। আবার সেই জরিপের পর নতুন করে জন্ম নেওয়া এবং বৈবাহিক সূত্রে অধিকারপ্রাপ্তদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাহলে যারা ২০১১ সালে বাদ পড়েছে, তারা কেন নতুন করে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না। বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ অংশের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘ছিটমহল বিনিময়ে যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদেরও অনেকেই বাদ পড়েছেন। ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি এবং স্থানীয়দের সহযোগিতা নিয়ে বাদ পড়া প্রকৃত ছিটমহলবাসীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।’ দািশয়ার ছড়ার স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত ২০০২-২০০৭ মেয়াদের পঞ্চায়েতপ্রধান নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বাড়ি বাড়ি গিয়ে জরিপের কাজ করে বাদ পড়া বৈধ ছিটমহলবাসীকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।’
কয়েক হাজার ছিটমহলবাসীর নাম বাদ পড়েছে ২০১১ সালের জরিপ থেকে। ৩১ জুলাইয়ের পর জরিপে বাদ পড়া ছিটমহলবাসীর অবৈধ অভিবাসীতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা কম নয়। অবৈধ অভিবাসীদেরও নিজস্ব একটা দেশ থাকে। কিন্তু এরা হয়ে উঠবে দেশহীন। যাদের দেশ থেকেও নেই, তাদের দেশ দেওয়ার চেষ্টাতেই ছিটমহল বিনিময় হচ্ছে, কাউকে দেশহীন করার জন্য নয়। তাই যারা দেশহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কার মধ্যে আছে, তারা কেউই যেন দেশহীন হয়ে না পড়ে; সেটাই আমরা বাংলাদেশ-ভারত উভয় রাষ্ট্রের কাছে আশা করি।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail. com
No comments