মোদির পথে আমাদের নেতারাও হাঁটতে পারেন
শিরোনামটি সেনাপতি ও সম্রাট নেপোলিয়নের একটি উক্তির অংশবিশেষ। ফরাসি বিপ্লবোত্তর যুগে সেনাপতি থেকে সম্রাট পদে আসীন নেপোলিয়ন খ্যাতির শীর্ষে উঠেছিলেন। তিনি সমানভাবে ছিলেন নন্দিত ও সমালোচিত। বহু যুদ্ধ করেছেন। বিজয়ী হয়েছেন। হয়েছেন পরাজিতও। এমনি একটি যুদ্ধে বিপর্যয়ের পর তাঁর অধীনস্থ সেনানায়কদের সঙ্গে এক বৈঠকে এর কারণ বিশ্লেষণ করা হয়। সেনানায়কেরা বলছিলেন, নিম্নমানের সৈনিকদের জন্যই তাঁরা নির্দেশিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হননি। নেপোলিয়ন সে আলোচনা বৈঠকটির সমাপ্তি টানতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘জেন্টলম্যান, দেয়ার আর নো ব্যাড সোলজার্স। অনলি ব্যাড অফিসার্স।’ এ উক্তিটির মধ্যে বার্তা ছিল, নেতৃত্বের ভূমিকাই লক্ষ্য অর্জনে প্রধান নিয়ামক। ব্যর্থতার জন্য নেতার অনুসারীরা দায়ী নন। নেপোলিয়নের এ উক্তিটি অতিসম্প্রতি উচ্চারিত হলো ভারতের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুখে। কলকাতার আনন্দবাজার সূত্রে জানা গেল, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কথাটি বলেছেন তাঁর সতীর্থ মন্ত্রী আর আমলাদের কাছে। নরেন্দ্র মোদির এ উক্তি উচ্চারণের পটভূমিকা আলোচনার দাবি রাখে। বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা গ্রহণের পর গুরুত্বপূর্ণ পদে সাবেক সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের বহাল রাখা হয়। এখানে তড়িঘড়ি পরিবর্তন চান না নরেন্দ্র মোদি। ভারতে সিভিল সার্ভিস মূলত অরাজনৈতিক। রাজনৈতিক পরিবর্তন এখানে তেমন ঢেউ তোলে না। তা সত্ত্বেও কিছু স্পর্শকাতর পদে পরিবর্তন আনা হয় দ্রুতই।
এমনকি ২০০৪ সালে ইউপিএ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই তখনকার মন্ত্রিপরিষদ সচিব কমল পান্ডের স্থলে নিয়োগ দেওয়া হয় বিকে চতুর্বেদীকে। মনে করা হয়েছিল, কমল পান্ডে বিদায়ী উপপ্রধানমন্ত্রী আদভানির কাছের লোক। মোদি কিন্তু ভিন্ন পথই ধরলেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব অজিত শেঠের চাকরির বর্ধিত মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল মধ্য জুনে। মোদি তা ছয় মাস বাড়িয়ে দিলেন। অবশ্য নিয়োগসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন নিয়েই। নিজেদের পদে বহাল রয়েছেন স্বরাষ্ট্রসচিব ও পররাষ্ট্রসচিব। যে সরকারের নীতিপঙ্গুত্ব এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে আক্রমণ করে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এলেন, সে সরকারের শীর্ষ আমলাদের তিনি সঙ্গে রাখতে চাইছেন কেন? এসব প্রশ্নের জবাবেই মোদি ওই উক্তি করেছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর মতে, সরকারের কাজকর্মের জন্য আমলাতন্ত্রকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সমস্যাটা নেতৃত্বের, আমলাদের নয়। এ প্রসঙ্গে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রবিশংকর প্রসাদ বলেছেন, মোদি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। বলির পাঁঠা খোঁজায় বিশ্বাস করেন না। এরই মধ্যে নরেন্দ্র মোদি সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি সভা করেছেন। রাজনীতি-নিরপেক্ষ একটি শক্ত প্রশাসনব্যবস্থা তিনি গড়ে তুলতে চান বলে সে বৈঠকে বলেছেন। সরকার বদলে তাঁদের ভীত হওয়ার কারণ নেই বলেও আশ্বস্ত করেছেন। এমনকি প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতেও তিনি তাঁদের নির্দেশ দিয়েছেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন, এর আগে দীর্ঘ ১০ বছর কেন্দ্রীয় সরকারে ছিল কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ জোট। সুতরাং পদস্থ কর্মকর্তারা সে সময়কার নেতাদের কিছু ঘনিষ্ঠ হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
সরকার পরিবর্তনে নিজেদের পদ-পদিব হারানোর শঙ্কায় থাকতে পারেন তাঁরা। তবে ভারতের শাসনব্যবস্থার সংস্কৃতিতে সীমিত ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে সরকারি কর্মকর্তাদের পদায়ন-পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় হয় না। নিয়োগ তো নয়ই। তার পরও নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর এ আশ্বাস ভারতের শীর্ষ কর্মকর্তাদের আরও প্রত্যয়ী করল। দূর করে দিল সব শঙ্কা আর ভয়। তাঁরা দ্রুত নিবেদিত হতে পারবেন নিজেদের দায়িত্ব পালনে। বিরোধী কংগ্রেস দল অবশ্য আমলাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের সম্পর্ক স্থাপনকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে। এর ফলে প্রশাসনে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হ্রাসের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন তাদের একজন মুখপাত্র। তাঁর মতে, এতে জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্ব কমে যাবে। এর জবাবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এমন ভাবনার কোনো কারণ নেই। প্রশাসনে স্বচ্ছন্দ গতি আনতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর এ কার্যকর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে বিস্মিত হচ্ছেন তাঁরা নিজেরাই। তাঁদের একজন তো এমনও বললেন, ‘অধস্তন কর্মীরা “বস”কে নিয়ে আগে হোমওয়ার্ক করে থাকেন। “বস” যে কর্মীদের ব্যাপারে হোমওয়ার্ক করেন, এই প্রথম দেখলাম।’ ভারতের প্রশাসনিক সংস্কৃতি সম্পর্কে ওপরে যে আলোচনা হয়েছে তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার পর্যায়ে চিড় ধরেছে। ব্যর্থতার দায়ভার চাপানো হয় শুধু আমলাদের ঘাড়ে। কথায় কথায় তাঁদের দোষ ধরা হয়। মুহূর্তেই করা হয় বদলি। এমন ব্যবস্থা উত্তর প্রদেশে অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। অতিসম্প্রতি দুটি গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় গোটা দেশে তোলপাড় হলো। বিস্ময়করভাবে এর ফলে অপসারিত হলেন রাজ্যের মুখ্য সচিব। ভারতীয় গণমাধ্যম এ সিদ্ধান্তটির বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে।
এ সংস্কৃতি অন্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। পশ্চিমবঙ্গ অনেকটা উত্তর প্রদেশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। প্রকৃতপক্ষে অকারণে এমনটা হলে শুধু বিশেষ দু-একজন কর্মকর্তা ক্ষতিগ্রস্ত হন না, আঘাত পড়ে গোটা প্রশাসনব্যবস্থায়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মনোবলে পড়ে ভাটা। এমনটা যাতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে না হয়, তার জন্য সূচনা থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন নরেন্দ্র মোদি। তাঁর প্রত্যাশা, একটি অরাজনৈতিক শক্তিশালী প্রশাসনব্যবস্থা। আর এটা গড়ে তোলার জন্য আগের সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের দ্রুততার সঙ্গে পাল্টানোর আবশ্যকতা নেই; এমনটাই তাঁর কার্যক্রমে সুস্পষ্ট। এ উপমহাদেশ একই প্রশাসনিক সংস্কৃতির অংশীদার। ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাটিকেই ভারত সফলভাবে জনমুখী ও জোরদার করেছে। দলীয়করণের অভিযোগ সেখানে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। আর আমরা? দলীয় বিবেচনার নামে গোটা শাসনব্যবস্থাটিকে আজ বিপন্ন করে ফেলা হয়েছে। কেন্দ্র থেকে উপজেলা সর্বত্রই এর কালো হাত। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি। এ ছাড়া, প্রভাবশালী মহলের বিরাগভাজন হলে দ্রুততার সঙ্গে সে কর্মকর্তাকে করা হয় বদলি কিংবা ওএসডি। চারদলীয় জোট সরকারের সময় বাধ্যতামূলক অবসরও দেওয়া হতো। ব্যর্থতার দায়ভার শুধু আমলার। এভাবে গোটা ব্যবস্থাটিকে আমরা বিপন্ন করছি। এ ব্যবস্থায় সে কর্মকর্তাদেরই কেউ বনে গেছেন দলের নেতা-কর্মী আর অনেকেই হতোদ্যম। শেষোক্তরা যতটুকু সম্ভব হাত গুটিয়ে রাখেন। অনেক রুটিন দায়িত্বকে তাঁরা ধরে নেন স্পর্শকাতর বলে। আর বাস্তবতাও তাই। বহুল আলোচিত চাঞ্চল্যকর মামলায়ও বিশেষ কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে কি না, এ সিদ্ধান্ত তদন্তকারী কর্মকর্তা দূরে থাকুক, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমনকি জেলার এসপিও নিতে পারেন না।
নির্দেশনা চাওয়া হয় ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের’। এভাবে একটি দেশের পরীক্ষিত ও কার্যকর শাসনব্যবস্থা আজ চ্যালেঞ্জের মুখে। আর দলীয়করণ? সরকার পরম্পরা ক্রমবর্ধমান হারে তা ঘটে চলছে। সব ক্ষেত্রেই ব্যবস্থাটির সদম্ভ অবস্থান। তা ছাড়া রয়েছে বিবেচনাহীন অনুপাতে কোটা ব্যবস্থায় নিয়োগ। ফলে মেধা কার্যত উপেক্ষিত। শুধু গত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন দায়ে ওএসডি ও পদোন্নতিবঞ্চিত আছেন ডজন ডজন কর্মকর্তা। তাঁদের কারও কারও ওএসডি থাকার মেয়াদ পাঁচ বছরের ঊর্ধ্বে। তবে তাঁরা ‘ভাগ্যবান’ এ অর্থে যে বর্তমান সরকার বাধ্যতামূলক অবসরের অস্ত্রটি প্রয়োগ করেননি, সীমিত ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে। এসব কর্মকর্তার মধ্যে আছেন প্রতিশ্রুতিশীল নিষ্ঠাবান অনেক কর্মকর্তা। উপকৃত হতো দেশ ও সরকার, তাঁদের সেবা নিতে পারলে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা সে সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারিনি। বরং সৃষ্টি করছি একটি কদর্য পরিস্থিতি। আমাদের এখানে ব্যর্থতার দায়ভার চাপানো হয় মূলত নিচের দিকেই। নেপোলিয়ন যুগের সে সৈনিকদের মতো আমাদের প্রশাসনের সৈনিকেরা সবাই দক্ষ ও উপযুক্ত, এমন দাবি এখন হয়তো করা যাবে না। আবার অনেকেই আছেন, যাঁদের সুনাম ও সততা বিতর্কিত। দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ। তেমনি বলা যায় না, সব নেতাই মন্দ। তবে এটুকু তো বলা যায় যে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব তাঁদেরই। অদক্ষ আর বিতর্কিত সৈনিকদের তাঁরা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ঝেড়ে ফেলতে পারেন। তা না করে তাঁরা ব্যর্থতার দায়ভার নেওয়ার জন্য বলির পাঁঠা খোঁজেন কেন অধীনস্থদের মধ্যে? নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য তো আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো দৃশ্যমানভাবে সক্রিয়। তারা প্রশাসন পরিচালনায় মোদির সূচনার নজিরটি তো অনুসরণ করতে পারে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments