সদরে অন্দরে-আঁচলে মুখ ঢাকা নয়, গর্জে ওঠো নারী by মোস্তফা হোসেইন

রুখে দাঁড়াও অন্যায়ের বিরুদ্ধে, প্রয়োজন হলে শক্তি দিয়ে। যদি না পারো, তাহলে প্রতিবাদ করো মুখের ভাষায়। তাও যদি সম্ভব না হয়, তাহলে মনে মনে ঘৃণা করো_এটি পবিত্র হাদিসের কথা। কিন্তু হাদিসের এ বাণীটি আমাদের কয়জনের অন্তরে আছে? মেয়েটিরও নেই অথবা সে হারিয়ে ফেলেছে।


অপরাধের কদর্যতা, বীভৎসতা তাকে হতবাক করে দিয়েছে। সামান্য ঘৃণা তো সেখানে তুচ্ছ ব্যাপার। অপরাধী ও তার সহযোগীদের কেবল ঘৃণা করে মেয়েটির মানসিক প্রশান্তি আসছে না। এ কারণে সমাজ ও মানুষকেই সে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। এ মুহূর্তে গোটা মানবসমাজের বিপরীতে সে যেন একক কোনো সত্তা। এ কারণেই মানুষ দেখলে মায়ের আঁচল খোঁজে, আর মুখ লুকিয়ে নেয় অতি দ্রুত। ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার শরীরের কোষে কোষে। খিঁচুনি আর কাঁপুনি জাগে। মায়ের শরীরও সেটা অনুভব করে। চেপে ধরেন মা। মেয়েটি মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে বলে, 'মা, আমি বাঁচতে চাই না। আমি আর এই মুখ দেখাতে পারব না মা!' বরগুনার এসএসসি পরীক্ষার্থী মেয়েটির আজ এমনই অবস্থা। আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটায়নি এখনো, যা তার মতো অনেক মেয়েই ঘটিয়েছে। কিন্তু মানুষের যদি বিবেক থাকে, সমাজ যদি সচেতন হয়, তাহলে খুন চড়ে যাওয়ার কথা সবার মাথায়। অথচ সমাজ যেন নির্বিকার! কিন্তু কেন?
হেনার কী হলো? শরীয়তপুরের হেনার কথা বলছি। কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি মেয়েটি। কারণ প্রতিবাদ করতে হলে সমাজের বিরুদ্ধেই করতে হতো। এতটা শক্তি কোথায় পাবে নড়িয়া উপজেলার চামটা গ্রামের দরবেশ খাঁর মেয়ে কিশোরী হেনা? কথিত সমাজপতি ও প্রভাবশালীদের রায় মানতেই হবে তাকে। তা না হলে ওরা তাকে ধর্মদ্রোহী ঘোষণা করবে। দেশে ব্লাসফেমি আইন না থাকলেও সামাজিক বিধান মতে তাকে ও তার পরিবারকে একঘরে করা হবে। অথবা দোররার মাত্রাটা আরেক ধাপ বেড়ে যেত। কিন্তু যা করা হলো তাতে ধর্মের সায় আছে কি আদৌ? অসম্ভব। কোনো ধর্মই এহেন অন্যায়কে সমর্থন করে না। ধর্ষক পার পেয়ে যাবে আর ধর্ষিতা পাবে শাস্তি_এ কোন বিধান? এ বিধান ইসলামের নয়, রাষ্ট্রেরও নয়। অন্যদিকে সর্বোচ্চ আদালতও এ ধরনের ফতোয়াভিত্তিক বিচারকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ২০০১ সালে ফতোয়ার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। কিন্তু এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে দুই ব্যক্তি। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, দীর্ঘ এক দশক প্রায় গত হয়ে যাওয়ার পরও আপিলের কোনো শুনানি হয়নি। কিন্তু গত বছর ৮ জুলাই উচ্চতর আদালত ফতোয়ার বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেন। রায়ে এ ধরনের বিচার সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। আদালত এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার চালানোরও নির্দেশনা দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, প্রচারের কাজটি যথাযথ হচ্ছে না। যদি ফতোয়ার বিরুদ্ধে এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রচার কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে হতো, তাহলে অন্তত ২০১০ সালে এসেও পাঁচ হাজার ৭৪০ জন নারী নির্যাতনের শিকার হতো না। আরো দুর্ভাগ্যজনক হলো, নির্যাতিতদের মধ্যে প্রায় ছয় শ জনই হয়েছে ধর্ষণের শিকার। ১৯৯৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ৫০৩টি ফতোয়ার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়, যা প্রকৃত ঘটনার চেয়ে অনেক কম। কারণ সব ঘটনা খবর হয় না। ফতোয়া, ধর্ষণ কিংবা অন্য উপায়ে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটার পেছনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার হয়েছে।
ফতোয়ার কারণে আত্মহত্যা কিংবা ফতোয়া কার্যকর করাকালেই আঘাতের কারণে মৃত্যুর ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এরও শিকার হচ্ছে সমাজের দুর্বল শ্রেণী। আর দুর্বলতম শ্রেণী হিসেবে নারীর ওপরই ফতোয়ার আঘাত আসে। যারা এসব কাজ করে তারা সামাজিক অনুশাসন কিংবা রাষ্ট্রীয় বিধানকে তোয়াক্কা করে না। বিবেককে তো নয়ই। এ বিবেকহীনরাই বলার চেষ্টা করে, সামাজিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ফতোয়ার মাধ্যমে দোররা মারার বিধান আছে এবং তা কার্যকর করা কোনো বেআইনি কাজ নয়। আমাদের দেশে ব্লাসফেমি আইন না থাকলেও পত্রিকান্তরে কিংবা সামনাসামনিও মুরতাদ ঘোষণার মতো দুঃসাহস তারা দেখিয়ে থাকে। ফতোয়াবিরোধী সচেতন মানুষকে অপবাদ দেওয়ার সময়ও সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী চিন্তা করে না ইসলামী বিধান কি শুধু হেনাদের জন্যই প্রযোজ্য? হেনার ওপর যে ব্যভিচার করেছে সেই অপরাধীকে কি শাস্তি দিয়েছে তারা? কতটা দোররা খেয়েছে ধর্ষণকারী পুরুষরা? আমরা তো দেখি ধর্ষিতার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করা হলেও ধর্ষকের শাস্তি মওকুফ হয়ে যায়। যা হেনার ধর্ষকের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। মনে আছে ২০০৯ সালে দাউদকান্দি উপজেলার বিটেশ্বরে এক কিশোরীকে দোররা মারার পর মরণাপন্ন অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, সেই ফতোয়াবাজ মামলার অভিযুক্তরা জামিন পেয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। মামলার বিচারকাজও থেমে গেছে। শুধু তাই নয়, এক অভিযুক্ত শহীদ ড্রাইভার বিদেশে চলে গেছে বলেও পত্রিকায় সংবাদ হয়েছে। অথচ আমাদের রাষ্ট্রীয় বিধান তথা সংবিধান ফতোয়ার মাধ্যমে নারী-পুরুষে বিভাজন কিংবা ধর্মের নামে নারী নির্যাতনকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমাদের সংবিধানের ২৭, ২৮, ৩১ ও ৩৫ ধারার সম্পূর্ণ পরিপন্থী হচ্ছে এমন ফতোয়া কিংবা নারী নির্যাতনের কাজ।
আমাদের সংবিধানের আলোকেই নারী নির্যাতনবিরোধী আইন চালু হয়েছে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এ আইন সংশোধন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ তহবিলের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিদিন অন্তত ৪৭ জন নারী পুরুষের হাতে নির্যাতিত হচ্ছে। অথচ এ দেশের জাতীয় সংসদের নেতা, উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা নারী, নির্বাচিত ও মনোনীত মিলে ৬৪ জন সদস্যও নারী। ক্ষমতার শীর্ষে এত নারীর অবস্থান অতীতে ছিল না। তার পরও আমাদের দেশে নারী যখন পুরুষের হাতে কখনো ধর্মের নামে কখনো বা শক্তির দাপটে নির্যাতিত হয় তখন আমাদের অবাক হয়ে কেবল তাকিয়ে দেখতে হয়। আমাদের ভাবতে হয়, আজও কি আমরা এক অসভ্য সমাজে বসবাস করি? আমরা ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করতে পারব কবে? তাই ফতোয়ার নামে নির্যাতন প্রতিরোধ করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন হবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। অন্যদিকে গুটিকয় ফতোয়াবাজের কারণে দেশের সাধারণ আলেম-ওলামাদের যাতে কেউ নির্যাতনকারীদের দলের না ভাবে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে একটি উদাহরণ দিয়েই লেখা শেষ করার ইচ্ছা আছে। সবারই দৃষ্টিগোচর হওয়ার কথা, কয়েক বছর ধরে টাউন সার্ভিস বাসগুলোতে পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি করে চড়তে বাধ্য হয়। হালে প্রতিটি বড় বাসে ৯টি আসন মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সেসব আসনে কখনো কখনো পুরুষ যাত্রীও বসে। এমনই একটি বাসে দেখা গেল হঠাৎ করে চেঁচামেচি শুরু হয়েছে। কারণ মধ্যবয়সী সহযাত্রীর কনুই লেগেছে মহিলার গায়ে।
এক কথা, দুই কথা হওয়ার পর ভদ্রলোক আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান। বিষয়টি থেমে যায়। অথচ কয়েক মিনিট পর ৩-৪ সারি পেছন থেকে আরেক ভদ্রলোক মহিলাকে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ শুরু করেন। মনে হচ্ছিল ভদ্রলোক গায়ে পড়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হতে চান। তাঁর গায়ে পড়া অবস্থা দেখে আরেক যাত্রী মন্তব্য ছুড়ে দিলেন, মনে হয় ফতোয়াবাজ, মহিলাদের আলাদা আসন দেখে গায়ে আগুন লেগেছে। যাত্রীদের কথাবার্তা আবারও শুরু হয় মহিলা ও পুরুষ দুই যাত্রীকে নিয়ে। কিন্তু সর্বোপরি যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেল তা হচ্ছে, ভেতরে ভেতরে অনেক মানুষই এখন ফতোয়াবাজিকে ঘৃণা করে।
ফতোয়ার মাধ্যমে সমাজে ক্ষত তৈরি করার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে। তা না হলে নির্যাতিত মেয়েরা মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়েও শান্তি পাবে না। তাই তাদেরও প্রতিবাদী হতে হবে। সমাজের সুস্থ ও বিবেকবান মানুষকে সেই প্রতিবাদে শরিক হতে হবে। তাহলেই দেশ থেকে বিদায় নেবে একটি অশুভ তৎপরতা।

mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.