মিডিয়ার চালচিত্র: সংবাদের সত্যতা এবং ‘স্যার’দের চোখ রাঙানো by সিরাজুল ইসলাম কাদির
দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় কর্মরত অবস্থায় এক অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে। তখনও প্রধান প্রতিবেদকের দায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত হয়নি। আমি জ্যেষ্ঠ অর্থনৈতিক প্রতিবেদক। আমাদের তৎকালীন বার্তা সম্পাদক আহমেদ ফারুক হাসানের সুবাদে একজন সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তার ধানমণ্ডির বাসভবনে গেলাম। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। ওই কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান, কয়েকজন পরিচালক এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী কীভাবে ওই ব্যাংক থেকে ক্ষমতার দাপট খাটিয়ে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন তার চিত্র তুলে ধরলেন। সঙ্গে তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করার জন্য কিছু সমর্থনপুষ্ট প্রমাণাদি দিলেন। আমি তার ওপর প্রতিবেদন করলাম। পরের দিন ওই সংবাদ বাংলাবাজার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শীর্ষ সংবাদ (Lead News) হিসেবে প্রশস্ত শিরোনামে (Banner Heading) ছাপা হলো। দুপুর না গড়াতেই সংবাদের তীব্র প্রতিক্রিয়া এলো সংবাদে যেসব ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশিত হয়েছে তাদের কাছ থেকে। এরমধ্যে একজন ছিলেন চট্টগ্রামের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। তার স্বাক্ষরে বিকালে একটি প্রতিবাদপত্র এলো। পত্রিকার প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সেটি গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হলো, সঙ্গে প্রতিবেদক হিসেবে আমার ব্যাখ্যা সংবলিত বক্তব্য। প্রতিবাদপত্রে তিনি লিখলেন: ‘আমি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমার এলাকা থেকে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করতে চাই। কিন্তু যাতে আমি এই নির্বাচনের জন্য দলের মনোনয়ন না পাই এবং পেলেও নির্বাচনে যাতে সফল হতে না পারি সেজন্যে দলের অভ্যন্তরে এবং দলের বাইরে একটি স্বার্থান্বেষী মহল বাংলাবাজার পত্রিকাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আমার বিরুদ্ধে এ ধরনের মিথ্যা অপবাদ প্রচার করছে। এই সংবাদ সর্বৈব অসত্য এবং হীন স্বার্থপ্রণোদিত...।’ মোটামুটি এটাই ছিল প্রতিবাদপত্রের ভাষা। রিপোর্টের বিষয়বস্তু হিসেবে অন্য যাদের নাম ছিল তারা ছিলেন নেপথ্যে। প্রতিবাদপত্র প্রকাশিত হলেও তিনি এতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। সম্পাদক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হলো। নিয়মমাফিক সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের বিরুদ্ধেও মামলা হওয়ার কথা। কিন্তু ওই প্রতিবেদনটি স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও ওটি ছিল একটি বিশেষ (Exclusive) রিপোর্ট। তবে পরে বুঝতে পেরেছি সম্পাদক সাহেব কেন রিপোর্টটি স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে ছাপানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ক্ষমতাসীন বিএনপি’র প্রথমসারির নেতার মামলা। পুলিশ খুব দ্রুত সক্রিয় হলো। আমি যথারীতি সন্ধ্যায় অফিসে গেলাম। বার্তা সম্পাদকের কাছ থেকে সবকিছু শুনে কিছুটা ভড়কে গেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে থানার অফিসার ইনচার্জ এলেন। সরাসরি সম্পাদকের কক্ষে চলে গেলেন। বার্তা সম্পাদক ফোন করে সম্পাদককে সবকিছু অবহিত করলেন। তিনি দ্রুত অফিসে চলে এলেন। দীর্ঘসময় পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে সম্পাদকের বৈঠক চললো। পুলিশ কর্মকর্তা বারবার সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের নাম জানতে চাইলেন। উত্তরে তিনি একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘এ রিপোর্ট আমি নিজে করেছি।’ কিন্তু পুলিশ অফিসার তাতে সন্তুষ্ট হননি। সম্পাদক সাহেব এক ফাঁকে তাঁর কক্ষ থেকে বেরিয়ে আমাকে নিভৃতে ডেকে নিয়ে ঐদিনের মতো বাসায় যেতে বললেন এবং তিনি না বলা পর্যন্ত অফিসে আসতে বারণ করলেন। পুলিশ কর্মকর্তা সম্পাদক সাহেবকে নিয়ে থানায় চলে গেলেন। সারারাত তার থানায় থাকতে হলো। পরের দিন ছিল শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তবে বিশেষ ব্যবস্থায় একজন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বসান এবং সেখানে তাকে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য জামিন মঞ্জুর করা হয় এই শর্তে যে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু হলে নিয়মিত আদালতে নিয়মমাফিক জামিনের জন্য আবেদন করতে হবে। সেই নিয়মে তিনি জামিন নিয়ে মামলা চালিয়ে যান। পরবর্তীকালে নির্বাচনে সরকারের পটপরিবর্তনের ফলে এই মামলার ধার হ্রাস পায়। বাংলাবাজার পত্রিকায় কাজটি ছিল আমার জন্য খণ্ডকালীন।
একটি জনপ্রিয় দৈনিকের সম্পাদককে গ্রেপ্তার এবং সারারাত থানায় বসিয়ে রাখা কোনো সভ্য দেশের, সভ্য সমাজের এবং গণতন্ত্রপিপাসু দেশের জন্য প্রত্যাশিত হতে পারে না। সাংবাদিকদের এই নিগৃহ শুধু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শাসকগোষ্ঠীর মোক্ষম হাতিয়ার নয়, অনুন্নত এবং উন্নত দেশেও এই অনুশীলন অতীততেও দৃশ্যমান ছিল এখনো একই ধারা বিরাজ করছে।
আমি নিজেও অতীতে এ ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতির শিকার হয়েছি। আমি তখন পিরোজপুরে। দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করছি। কলেজে পড়ার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছিলাম। ওই সময়ে পিরোজপুর মহকুমার বিভিন্ন থানার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বেশ অবনতি ঘটে। প্রায় প্রতিদিন খুন, হত্যা, ডাকাতি সংঘটিত হতো। বিভিন্ন থানায় এসব হত্যা-ডাকাতির মামলা নথিভুক্ত হতো না। গ্রাম বাংলার সাধারণ সরল মানুষ থানামুখী হতে অপছন্দ করতেন। এলাকার বেশির ভাগ মানুষ অতিদরিদ্র বলে মামলা চালিয়ে যাওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি তাদের ছিল না। যা হোক, বিভিন্ন থানা থেকে সংগৃহীত তথ্য- উপাত্তের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে ডাকযোগে দৈনিক সংবাদে পাঠিয়ে দেই। সংবাদের ভেতরের পৃষ্ঠায় বেশ গুরুত্ব সহকারে এই খবর পরিবেশিত হয়। সংবাদ প্রকাশের পর ঢাকায় পুলিশের সদর দপ্তর থেকে খবরের কাটিংসহ মন্তব্য জানতে চেয়ে মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়। সদর দপ্তরের এই নির্দেশ পাওয়ার পর মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে তার কার্যালয়ে চায়ের নিমন্ত্রণ পাঠান। তবে আমার অনুধাবন করতে কষ্ট হয় না যে, এটি নিছক চায়ের নিমন্ত্রণ নয়। তিনি তার কক্ষে আমাকে ডেকে নিয়ে সংবাদের কাটিং দেখিয়ে বলেন, ‘এটা আপনি কি লিখেছেন? কোথায় পেলেন এসব তথ্য? সবই তো মনগড়া। আমার বক্তব্য, মন্তব্য নেয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না?’ আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, ‘আমি বিভিন্ন থানায় ফোন করে এই তথ্য সংগ্রহ করেছি। তাই আপনার মতামত নেয়ার প্রয়োজন মনে করিনি।’ আমার এ ধরনের উত্তর শুনে তিনি সরাসরি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বয়স কম। বাস্তবতার সঙ্গে এখনো পরিচয় হয়নি। বাস্তবতা কিন্তু নির্দয়।’ এরপর কথা না বাড়িয়ে তিনি আমাকে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত করলেন। আমি তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলাম। তার এ ধরনের আচরণে বিষণ্ন বোধ করছিলাম। ঐদিন বিকালে আমার এক বন্ধু বাসায় এলো। কলেজে এক সঙ্গে পড়ি। তবে সে কলা বিভাগ আর আমি বাণিজ্য বিভাগে। বিকালে হাঁটতে হাঁটতে আমরা বালেশ্বর নদীর তীরে গিয়ে একটা সবুজ চত্বর দেখে বসে পড়লাম। বন্ধুটি প্রথম মুখ খুললো। ‘সিরাজ, মামা তোকে নিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় যেতে বলেছেন। রাতে আমরা একসঙ্গে খাবো।’ ওর মামা তখন পিরোজপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। আমার কেন যেন মনে হলো হঠাৎ এই নিমন্ত্রণের সঙ্গে দিনের প্রথমভাগে মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তার সাক্ষাতের যোগসূত্র রয়েছে। রাতে খাবার টেবিলে ওসি সাহেব খেতে খেতে বললেন, ‘তুমি আমার ভাগ্নের বন্ধু। তাই তুমি করেই বলছি।’ আমি সংক্ষেপে বললাম, ‘নিশ্চয়ই।’ ‘তাহলে শোনো তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। সংবাদে যে খবর তুমি ছাপিয়েছো আমরা তার একটা প্রতিবাদ পাঠাবো। কিন্তু তুমি এর কোনো জবাব বা ব্যাখ্যা দিতে পারবে না।’ আমি বললাম, ‘তা কি করে হয়?’ তিনি আর কোনো কথা বাড়ালেন না।…
রাতে ঘুমোতে পারলাম না। পরের দিন একইভাবে ওই বন্ধুটি এসে আমাকে নিয়ে সেই নদীর তীরে গিয়ে বসলো। ‘সিরাজ, তুই আমার বন্ধু বলে মামা তোর প্রতি কোমল আচরণ করছেন। তবে আমি একটা কথা বলছি। এই প্রতিবাদপত্র ছাপা না হলে পুলিশ যা করবে তা হচ্ছে, তোর ঘরের মধ্যে অস্ত্র ঢুকিয়ে দিয়ে বলবে এই অস্ত্র তোর কাছে পাওয়া গেছে। এরপর থানায় নিয়ে তোকে বেদম প্রহার করবে। সারাজীবন এর প্রভাব তোর শরীরে বয়ে বেড়াতে হবে। তদুপরি বেআইনিভাবে অস্ত্র রাখার অভিযোগে তোর বিরুদ্ধে মামলা হবে। এমনকি মামলায় এই অভিযোগ করা হতে পারে যে তুই একটি আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির হয়ে কাজ করছিস। আশাকরি পরিণতিটা বুঝতে পারছিস।’
আমি রাতে ট্রাংক কল করে ঢাকায় দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক সন্তোষ গুপ্তকে পুরো ঘটনা বর্ণনা করলাম। তিনি তার স্বভাবসুলভ গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘করিজেন্ডাম পাঠিয়ে দিন।’ এই বলে তিনি ফোনের লাইন কেটে দিলেন। টেলিফোন করে ঘরে ফেরার পথে নির্জন রাস্তায় রাতের অন্ধকারে হঠাৎ করে কারা যেন আমাকে পেছন থেকে আঘাত করলো। শক্ত লাঠি দিয়ে মাথার উপর সজোরে এই অপ্রত্যাশিত আঘাতে আমি রাস্তায় লুটিয়ে পড়ি। আমার চশমা অদূরে ছিটকে পড়ে। হামলাকারী ৬ যুবক আমার চশমা, ওয়ালেট এবং হাতের ঘড়ি নিয়ে হৈ হৈ শব্দ তুলে দৌড়ে পালিয়ে যায়। আমার কপালের ডানদিক থেকে তখন রক্ত ঝরছে। আমি দ্রুত মহকুমা সদর হাসপাতালে ছুটে গেলাম। মহকুমা সিভিল সার্জনের বাসায়। তিনি আমার এই রক্তাক্ত চেহারা দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং দ্রুত আমাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গেলেন। একপর্যায়ে বললেন, ‘চাইলে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’ আমি অসম্মতি জানালাম। আমার ঘরে ছোট ছোট ভাই-বোন। মাতৃহারা। পিতা থাকেন শহর থেকে দূরে।
কয়েকদিন পরে পুলিশের দেয়া প্রতিবাদলিপি সংবাদে ছাপা হলো আমার বক্তব্য ছাড়া। তবে সংবাদ অফিস থেকে আমাকে ঢাকায় ডেকে পাঠানো হলো। সংবাদ অফিসে প্রথম সাক্ষাতেই আমি অনুযোগের সুরে সন্তোষ গুপ্তকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘আমার ব্যাখ্যা তো ছাপা হলো না।’ তিনি মুঠিবদ্ধ ডান হাতে সিগারেটে সজোরে টান দিয়ে বললেন, ‘আপনার সুস্বাস্থ্যের জন্য ওটা ছাপা হয়নি। তাছাড়া আপনি ওখানে পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে আড়াআড়ি করে টিকতে পারবেন না। তারা আপনাকে নিয়ে নির্যাতন করলে আমরা এত দূর থেকে আপনাকে সুরক্ষা করতে পারবো না।’
সাংবাদিকতা পেশায় এটা ছিল আমার প্রথম আত্মসমর্পণ। পরবর্তীকালে এভাবে অনেকবার আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে।
[স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি ইউপিএল থেকে প্রকাশিতব্য ‘রয়টার্সের দিনগুলো’ গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে]
লেখক: রয়টার্সের সাবেক ব্যুরো প্রধান এবং বর্তমানে অ্যামচ্যাম জার্নালের সম্পাদক।
No comments