সিলিকন ভ্যালীর “মিসফিট” এর দল, কিংবা পেপ্যাল মাফিয়া! by ঊর্মি তনচংগ্যা
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির কোন এক শান্ত সকাল, ম্যাক্স লেভচিন
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির কোন এক হলঘরে এক অতিথি বক্তার বক্তব্য
শুনছিলেন। পিটার থিয়েল নামক বক্তার কথা শুনে ম্যাক্স লেভচিনের মনে হল যে এই
লোকটির সাথে একবার কথা বলা দরকার। দুজনে মিলে বক্তব্যের পরে একসাথে
কথাবার্তা শুরু করলেন এবং এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলেন “ডিজিটাল ওয়ালেট”
বিষয়টি নিয়ে তারা একত্রে কাজ শুরু করবেন। ১৯৯৮ প্রথমদিকে কোম্পানীর নাম
ফিল্ডলিংক ইনকরপোরেশন থাকলেও পরে তা কনফিনিটি নামে পরিচিতি পায় এবং সেখানে
যুক্ত হন লুক নসেক। কনফিনিটি প্রথমদিকে মোবাইল পেমেন্টের উপর নির্ভরশীল
থাকলেও পরবর্তীতে তাদের এক এমপ্লয়ী মেইল এর মাধ্যমে টাকা লেনদেনের পদ্ধতি
ডেভেলপ করায় মানি ট্রান্সফার সার্ভিসে পরিবর্তন আসে অনেকটুকু।
পরে ২০০০ সালে এক্সডটকম নামের অনলাইন ব্যাংকিং কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা
ইলোন মাস্ক সিদ্ধান্ত নেন পেপ্যালের সাথে একত্রিত হয়ে যাওয়ার এবং এভাবে
২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পেপ্যাল নামের বিশ্বের বৃহৎ স্টার্টআপগুলোর মধ্যে
একটি।
উদ্ভট কাজের পরিবেশ
প্রযুক্তি এবং স্টার্টআপের তীর্থভূমি সিলিকন ভ্যালীতে সবকিছুকে ধরা হয়
অনেকটা টিপটপ হিসেবেই। ফর্মালিটি, কর্পোরেট মনোভাব এবং একটা কাজ শুরুর আগে
হাজার-হাজার ফর্মাল মিটিং ছাড়া সিলিকন ভ্যালীর বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে
কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু এতসব ফর্মালদের ভীড়ে এসে হাজির হয়েছিল
পেপ্যালের ছোঁকড়ারা। তারা একসাথে পার্টি করে করে মিটিং করত, পোকার খেলত রাত
জেগে আর ফর্মালিটির কোনো বালাই ছিলনা।
এক সাক্ষাতকারে পেপ্যালের প্রাক্তন সিইও পিটার থিয়েল বলেছিলেন যে,
- “যখন আমরা পেপ্যাল শুরু করি তখনই আমি ম্যাক্স লেভিচিনের সাথে কথা বলেছিলাম একটা বন্ধুত্বপূর্ণ কোম্পানি তৈরি করব আমরা যেখানে বন্ধুত্বই হবে সবকিছু। কোম্পানির উত্থান কিংবা পতন যাই হোকনা কেন বন্ধুত্ব যেন অটুট রয়ে যায়।”
এক অন্যরকম পরিবেশ ছিল পেপ্যালে; যেখানে সবাই ছিল একে অপরের বন্ধু,
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী কিংবা সিনিয়র-জুনিয়র। মাসে ১০ মিলিয়ন ডলারের মত আয়
করা পেপ্যালের সবকিছুই ছিল অন্য স্টার্টআপ কোম্পানিগুলার চেয়ে আলাদা।
পেপ্যাল মাফিয়ার জন্ম
২০০২ সালে প্রতিটি শেয়ার ১৩ ডলার করে পাবলিক করে দেওয়ার পরে ই-বে
কোম্পানী পেপ্যালকে কিনে নিতে আগ্রহী হয় এবং পেপ্যালের প্রধানদের সাথে
আলোচনায় বসে।
কিথ র্যাবইস নামে পেপ্যালের প্রধানদের একজন পেপ্যালের সাথে ই-বে’র অদ্ভুত আলোচনা পর্বের কথায় বলেন,
- “আমার এখনো সেই দিনটির কথা মনে পড়ে যেদিন আমরা ই-বের সাথে আলোচনায় বসেছিলাম।আমরা সেখানে গিয়েছিলাম একদম ইনফরমালভাবে যেখানে ই-বে’র কর্তারা এসে হাজির হয়েছিল ১৩৭ পৃষ্ঠার একটা পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন নিয়ে এবং তারা চাচ্ছিল আমরা যেন সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়ি।আধাঘণ্টা পরে দেখা গেলো যে পেপ্যালের কেউই ২০ থেকে ৩০ স্লাইডের বেশি পড়তেই পারেনি এবং আমাদের মাঝে এত বড় প্রেজেন্টেশন পড়ার কোন ইচ্ছাই ছিলনা।”
এই স্মৃতিচারণ থেকেই বোঝা যায় যে ই-বে’র কর্মকর্তারা যদি উত্তর মেরু হয় তবে পেপ্যালের লোকেরা ছিল দক্ষিণ মেরুরও দক্ষিণ।
ই-বে’র আসলে দরকার ছিল পেপ্যাল নামক জিনিসটা, কিন্তু পেপ্যালের “মিসফিট”
প্রতিষ্ঠাতাদের ততটা নয়; এবং সেটা পেপ্যালের কর্মকর্তারা প্রথম থেকেই
অনুভব করতে পারছিলেন। তাই কিছুসময় পরেই ই-বে’র সাথে আলোচনা থেকে পেপ্যালের
প্রতিষ্ঠাতারা সরে দাঁড়ান এবং নিজেদের ব্যক্তিগত স্টার্টআপ শুরু করে দেন।
কিন্তু প্রত্যেকেই একে অন্যের সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং ভালোবেসে নিজেদের
নাম দেন “পেপ্যাল মাফিয়া”।
ছবিতে দেখানো নাম্বার অনুযায়ীঃ ১। জাওয়াদ করিম, ২। জেরেমি স্টপলম্যান,
৩। অ্যান্ড্রু ম্যাককরম্যাক, ৪। প্রেমাল শাহ, ৫। লুক নসেক, ৬। কেন হাওরি,
৭। ডেভিড স্যাকস, ৮। পিটার থিয়েল, ৯। কিথ রাবইস, ১০। রীড হফম্যান, ১১।
ম্যাক্স লেভচিন, ১২। রোলফ বোথা।
তবে পেপ্যালের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের একজন ডেভিড স্যাকসের মতে ই-বে
থেকে তাদেরকে আলাদা করে দেওয়াটাই পেপ্যাল এর প্রতিষ্ঠাতাদের উদ্যোক্তা
হিসেবে সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে এবং নতুন নতুন স্টার্টআপ বানাতে
প্রেরণা যুগিয়েছে।
আর এভাবেই জন্ম হয় পেপ্যাল মাফিয়ার।
সিলিকন ভ্যালীর “মিসফিট” বা মাফিয়াদের স্টার্টআপগুলো
সিলিকন ভ্যালীর মিসফিটরা পেপ্যাল থেকে বের হয়ে এসে শুরু করেন নতুন নতুন
স্টার্টআপ এবং তাদের অধিকাংশই এখন প্রতিষ্ঠিত এবং বিখ্যাত স্টার্টআপ।
পেপ্যালের সাবেক প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে যারা সফল হয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন-
পেপ্যালের সাবেক প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে যারা সফল হয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন-
জাওয়াদ করিম
বর্তমানে ১৪০ মিলিয়ন ডলারের মালিক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত জাওয়াদ করিম
প্রথমে ছিলেন পেপ্যালের রিয়েলটাইম এন্টিফ্রড সিস্টেমের ডিজাইনার এবং
ইমপ্লিমেন্টার, এরপরে তিনি চ্যাড হারলে এবং স্টিভ চ্যানের (পেপ্যাল মাফিয়া)
সাথে একত্রিত হয়ে একটা ভিডিও শেয়ারিং সাইট তৈরি করেন যেটা আজকের ইউটিউব।
পরে গুগলের কাছে বিশাল অংকের বিনিময়ে ইউটিউব বিক্রি করে দেওয়ার পরে জাওয়াদ
করিম নিজের আরেকটি স্টার্টআপ তৈরী করেছেন ইউ-নিভার্সিটি নামে, যেটার কাজ
হচ্ছে সদ্য স্নাতকদের এবং শিক্ষার্থীদের ব্যবসায়িক আইডিয়াগুলোকে বাস্তবায়নে
সাহায্য করা।
জেরেমি স্টপলম্যান
পেপ্যাল থেকে বের হয়ে জেরেমি স্টপলম্যান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে
যান একবছরের জন্য। একবার তার ফ্লু হওয়ার ফলে যখন ভালো ডাক্তারের
রিকমেন্ডেশন পাচ্ছিলেন না তখন তার মাথায় এটা নিয়ে স্টার্টআপ খোলার চিন্তা
আসে। পরে পেপ্যালের প্রাক্তন সহকর্মী রাসেল সিমনসের সাথে মিলে ম্যাক্স
লেভচিনের এক মিলিয়ন ডলার অর্থায়নে “ইয়েল্প” নামে স্টার্টআপ তৈরি করেন
জেরেমি স্টপলম্যান,যা তাকে কয়েকশত মিলিয়নের মালিক করে দেয়।
পিটার থিয়েল
পেপ্যালের কো-ফাউন্ডার এবং সিইও, যিনি ই-বে ডিলে প্রাপ্ত ৫৫ মিলিয়ন ডলার
থেকে পাঁচ লাখ ডলার সাথে সাথে ইনভেস্ট করে দেন তখনকার নতুন স্টার্টআপ
ফেসবুকে এবং সেই শেয়ারের দামের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে এক
বিলিয়ন প্রায়।
পিটার থিয়েলকে মানা হয় ভবিষ্যতের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে
একজন হিসেবে যিনি টেকনোলজি এবং বায়োটেকনোলজিসহ নানা বিষয়ে অভাবনীয় এবং
অদ্ভুত সব উদ্যোগ নিয়েছেন। “ফ্লোটিং কমিউনিটি” থেকে শুরু করে
“ক্রায়োপ্রিজারভেশন” এবং “অমরত্ব” এর মত অসংখ্য প্রজেক্টে পিটার থিয়েলের
বিনিয়োগ রয়েছে। লুক নসেক এবং কেন হাউরির মত পেপ্যালের প্রাক্তন মিলিওনিয়ার
প্রতিষ্ঠাতাদের সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার আছে থিয়েলের।
ম্যাক্স লেভচিন
পেপ্যালের আরেক প্রধান প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ম্যাক্স লেভচিন পেপ্যাল ত্যাগ
করার পরপরই স্লাইড নামের একটা স্টার্টআপ তৈরী করেন যা ১৮২ মিলিয়ন ডলারে
২০১০ সালে গুগল কিনে নেয় এবং সাথে লেভচিনকেও গুগলের ইঞ্জিনিয়ারীং সেকশনের
ভাইস প্রেসিডেন্ট বানানো হয়। তবে এক বছর পরেই ক্রমাগত লোকসান হওয়ার কারণে
গুগল স্লাইড প্রজেক্ট বন্ধ করে দেয় এবং লেভচিন ইস্তফা দেন। পরে ম্যাক্স
লেভচিন ইয়েল্প এর শেয়ারহোল্ডার হন এবং এফারম এবং এইচভিএফ নামে প্রজেক্ট
শুরু করেন আর ইয়াহুর বোর্ড অফ ডিরেক্টরসের সদস্য হিসেবে যোগ দেন।
কেইথ রাবইস
বলা হয়ে থাকে যে নতুন কোন প্রজেক্ট শুরু করতে হলে পার্টনার হিসেবে কেইথ
রাবইস এর জুড়ি নেই। তাই স্লাইড থেকে শুরু করে ইয়েল্প, জুমসহ নানা বিখ্যাত
স্টার্টআপ এর সাথে বিভিন্নভাবে যুক্ত রয়েছেন কেইথ রাবইস। এছাড়া জনপ্রিয়
ক্যারিয়ারভিত্তিক সোশ্যাল নেটওয়ার্ক “লিংকডিন” এর সিনিয়র পজিশনেও তিনি
আছেন।
রীড হফম্যান
বিশ্বের প্রথম সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সোশ্যালনেটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রীড
হফম্যান এবং সেটি ব্যর্থ হওয়ার পরে হফম্যান যোগ দেন পেপ্যালে।
“দি মোস্ট কানেক্টেড ম্যান ইন সিলিকন ভ্যালী” হিসাবে খ্যাত রীড হফম্যান তার বুদ্ধিমান বিনিয়োগের জন্য বিখ্যাত এবং এখন তিনি গেমিং প্রজেক্ট থেকে শুরু করে সিড ডিগিং কোম্পানীর মত প্রায় ৮০টি কোম্পানীতে বিনিয়োগ করেছেন।
“দি মোস্ট কানেক্টেড ম্যান ইন সিলিকন ভ্যালী” হিসাবে খ্যাত রীড হফম্যান তার বুদ্ধিমান বিনিয়োগের জন্য বিখ্যাত এবং এখন তিনি গেমিং প্রজেক্ট থেকে শুরু করে সিড ডিগিং কোম্পানীর মত প্রায় ৮০টি কোম্পানীতে বিনিয়োগ করেছেন।
ইলোন মাস্ক
অনলাইন ব্যাংকিং-এর বিশাল ভবিষ্যত উপলব্ধি করতে পারার মত হাতেগোনা
কয়েকজনদের মধ্যে একজন হলেন ইলোন মাস্ক। ১৯৯৯ সালে নিজের এক্স ডটকম ব্যাংকিং
স্টার্টআপকে পেপ্যালের সাথে যুক্ত করে তিনি যে দূরদর্শিতার পরিচয় দেন তা
প্রশংসাযোগ্য।
পেপ্যালের পরে ইলোন মাস্ক নানারকম স্টার্টআপে হাত দেন যার মধ্যে
উল্ল্যেখযোগ্য হল স্পেস-এক্স আর টেসলার মত ভিন্ন, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতেই
অপরিহার্য হতে চলা সব স্টার্টআপ।
সৌরবিদ্যুতে চালিত গাড়ি কিংবা মহাকাশযান স্টেশনে প্রথম প্রাইভেট মহাকাশযান পাঠানো ইলোন মাস্কের স্টার্টআপগুলোর যোগ্যতাই প্রমাণ করে।
এই প্রজেক্টগুলো ছাড়াও আরো বিভিন্ন স্টার্টআপ যেমন উবার, পিন্টারেস্ট,
রেডিট, টাম্বলার, ইয়েম্মার, এভান্ট, জিংগা গেমিং এবং কোরা’র মত অসংখ্য
প্রজেক্টে উদ্ভাবক, ডিরেক্টরিয়াল সদস্য কিংবা বিনিয়োগকারী হিসেবে যুক্ত
আছেন পেপ্যাল মাফিয়াদের সদস্যরা।
ইউনিকর্নের মত একত্রিত হয়ে একটা পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক করতে
চেয়েছিলেন পেপ্যালের প্রাক্তন সহকর্মীরা এবং সেই সম্পর্কের মাধ্যমে যেন
নতুন নতুন বিনিয়োগ গড়ে উঠে সেটাও ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।
ব্যবসায়িক জগতে একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও যেকোন ব্যবসায়িক
সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একে অন্যের সাথে আলোচনা করে নেন। আর তাতেও না হলে
প্রধান বিনিয়োগকারী হিসেবে তো পিটার থিয়েল আছেই।
সেদিনের সেই ছেলে-ছোঁকরার দলের একেকজন আজকে সিলিকন ভ্যালীর সবচেয়ে বড়
বিনিয়োগকারী। এবং তাদের অনেককেই ধরা হয় ভবিষ্যতের প্রভাবশালী হিসেবে। আর
কাজের মাধ্যমের তারা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে “মিসফিট” বাউন্ডুলেরা হচ্ছে
সিলিকন ভ্যালীর “ফিটেস্ট পারসন”।
তথ্যসূত্রঃ
১। উইকিপিডিয়া ১, ২
২। কোরা
৩। টেকরিপাবলিক
৪। টেলিগ্রাফ
৫। নিউ ইয়র্ক পোস্ট
৬। ফ্লেক্সিমাইজ
৭। ফরচুন
১। উইকিপিডিয়া ১, ২
২। কোরা
৩। টেকরিপাবলিক
৪। টেলিগ্রাফ
৫। নিউ ইয়র্ক পোস্ট
৬। ফ্লেক্সিমাইজ
৭। ফরচুন
No comments