সেই দিনগুলোর জন্য অপেক্ষা করে আছি by মুহম্মদ জাফর ইকবাল
গত
সপ্তাহটি আমার জন্যে খুব আনন্দের একটি সপ্তাহ ছিল। এক সপ্তাহে বাংলাদেশের
ল্যাবরেটরিতে করা তিনটি সফল গবেষণার খবর দেশের মানুষ জানতে পেরেছে। প্রথমটি
অবশ্যি আমি আগে থেকেই জানি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা পদার্থ
বিজ্ঞানের অত্যন্ত বিশেষ একটা প্রক্রিয়া ক্যান্সার রোগীদের রক্তে প্রয়োগ
করে সেখানে আলাদা এক ধরনের সংকেত পাওয়া।
অন্য দুটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা, দু’জায়গাতেই ইলিশ মাছের জিনোম বের করা হয়েছে। আমাদের ইলিশ মাছের জিনোম যদি আমরা বের না করি তাহলে কে বের করবে?
আমার মনে আছে ২০১০ সালে আমার প্রিয় একজন মানুষ মাকসুদুল আলম পাটের জিনোম বের করেছিলেন। আমরা আগেই খবর পেয়েছি, পরেরদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে এর ঘোষণা দিবেন। কিন্তু আমাদের দেশের খবরের কাগজগুলো কী খবরটা ঠিক করে ছাপাবে?
আমার মনে আছে এর আগের দিন আমরা দেশের সবগুলো খবরের কাগজের সম্পাদকদের সাথে দেখা করে তাদের বলেছি, “আগামী কাল সংসদে বিজ্ঞানের অনেক বড় একটা খবর ঘোষণা করা হবে। আপনারা প্লিজ খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় খবরটা বড় করে ছাপাবেন।”
খবরের কাগজগুলো আমাদের অনুরোধ রেখেছিল, সব খবরের কাগজ বড় বড় করে খবরটা ছাপিয়েছিল। দেশের বাইরে থেকে দেশে গবেষণার জন্যে মাকসুদুল আলম অনেক চেষ্টা করতেন, হঠাৎ করে সবাইকে ছেড়ে একদিন চলে গেলেন।
আমাদের দেশের অনেকের ধারণা এই দেশে বুঝি বিজ্ঞানের বড় গবেষণা হতে পারে না। সেজন্যে জুট জিনোমের খবরটা আমরা অনেক বড় করে সবাইকে জানাতে চেয়েছিলাম। গত সপ্তাহে একইভাবে তিনটি বড় গবেষণার খবর এসেছে, যারা নিজের দেশের বিজ্ঞানীদের উপর বিশ্বাস রাখে না, তারা নিশ্চয়ই এবারে নূতন করে ভাববে। আমি যতটুকু জানি, আরো কিছুদিনের ভেতর পেটেন্টের আরো কিছু খবর আসবে। পেটেন্টের জন্যে আবেদন করার আগে যেহেতু কোনো তথ্য জানাতে হয় না তাই আমরা এই মূহুর্তে সেই গবেষণাগুলোর খবর সম্পর্কে এখনো কিছু জানতে পারছি না।
পেটেন্টের বিষয়টা সবাই ঠিকভাবে জানে কীনা আমার জানা নেই। এটি হচ্ছে আবিষ্কারের স্বত্ত্ব রক্ষা করার পদ্ধতি। পৃথিবীর যে কোনো মানুষকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় রেডিও কে আবিষ্কার করেছে, সেই মানুষটি মার্কোনির নাম বলবে। আমিও ছোটবেলায় তার নাম মুখস্ত করে এসেছি। অথচ বিজ্ঞান জগতের ইতিহাস যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে আমাদের বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু রেডিও প্রযুক্তির খুঁটিনাটি মার্কোনির সমসাময়িককালে আবিষ্কার করেছিলেন। জগদীশ চন্দ্র বসু কিছুতেই তার আবিষ্কার পেটেন্ট করতে রাজী হননি, (এই ব্যাপারে তার একটা চমৎকার চিঠি আছে, তিনি কতোটা নির্লোভ মানুষ এবং জ্ঞানের ব্যাপারে কতোটা উদার সেই চিঠি পড়লে বোঝা যায়।) মার্কোনি তার উল্টো, প্রথম সুযোগে তিনি তার কাজ পেটেন্ট করে ফেলেছিলেন, সে জন্যে সারা পৃথিবী রেডিও এর আবিষ্কারক হিসেবে মার্কোনির নাম জানে, জগদীশ চন্দ্র বসুর কথা কেউ জানে না। (তবে অতি সাম্প্রতিককালে জগদীশ চন্দ্র বসুকে ইতিহাসে তার যোগ্য স্থান দেওয়ার জন্যে অনেক কাজ শুরু হয়েছে।)
পেটেন্ট করা হয় একটা আবিষ্কারের স্বত্ত্বকে রক্ষা করার জন্য। কাজেই পেটেন্টটি কোন দেশে করা হচ্ছে সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট সম্পর্কে আমার অল্প কিছু ধারণা আছে। আমি যখন বেল কমিউনিকেশন্স রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে যোগ দিই একেবারে প্রথম দিনেই সেই ল্যাবরেটরি আমার সমস্ত মেধাস্বত্ত্ব এক ডলার দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিনে নিয়েছিল! হ্যাঁ, লিখতে ভুল হয়নি, পরিমাণটা এক ডলার। আমাকে দেওয়ার জন্যে তারা নূতন ঝকঝকে একটি এক ডলারের নোট নিয়ে এসেছিল।
বেল কমিউনিকেশন্স ল্যাবরেটরিতে থাকার সময় আমরা যে বিষয় নিয়ে কাজ করেছি সেগুলো নিয়ে গোটা তিনেক পেটেন্ট হয়েছে- তবে তার কোনটারই মেধাস্বত্ত্ব আমার নিজের না, ল্যাবরেটরি প্রথমদিনই এক ডলার দিয়ে কিনে রেখেছে! মজার ব্যাপার হলো যুক্তরাষ্ট্রে পেটেন্ট করতে অনেক টাকা লাগে। পরিমানটা একশ হাজার ডলারও হতে পারে! যার আবিষ্কার পেটেন্ট হয়েছে সে চাইলে তাকে খুব সুন্দর করে ফ্রেম করে পেটেন্টের একটা কপি তৈরি করে দেয়- তার বেশী কিছু নয়!
তবে পেটেন্ট নিয়ে আমার একটা মজার স্মৃতি আছে। আমি যখন বেল কমিউনিকেশন্স ল্যাবরেটরিতে ফাইবার অপটিক সংক্রান্ত একটা বিষয় নিয়ে কাজ করছি তখন ইতালি থেকে একজন বিজ্ঞানী আমার সাথে কাজ করতে এসেছে। আমি একটি এক্সপেরিমেন্ট করছি, এক্সপেরিমেন্টটি ঠিক করে করার জন্য আমি সেখানে দুটি অপটিক্যাল আইসোলেটর নামে ডিভাইস লাগিয়েছি। ইতালির বিজ্ঞানী আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি ঐ দুটো কেন লাগিয়েছো? আমি তাকে কারণটা ব্যাখ্যা করে বললাম আমাদের এক্সপেরিমেন্টে এগুলো সব সময় ব্যবহার করতে হয়।”
ইতালির বিজ্ঞানীর চোখ চক চক করে উঠল! সে বলল, “এই বিষয়টা পেটেন্ট করে ফেলি!”
আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম সে নূতন এসেছে বলে জানে না, আমরা যারা এই ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করে আসছি তারা জানি বিষয়টা একটা কমন সেন্স ছাড়া কিছু না।
আমি বললাম, “তুমি এটা পেটেন্ট করতে চাও? এটা হচ্ছে- ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ এর মতো একটা কমন সেন্স। কেউ কখনো একশ হাজার ডলার খরচ করে ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ কে পেটেন্ট করে?”
ইতালীর বিজ্ঞানী ‘পিরেলি’ নামে অনেক বড় একটা কোম্পানি থেকে এসেছে তাদের টাকার অভাব নেই। সে আমার কথায় বিচলিত হলো না, আমাকে জানাল সে আসলেই এটা পেটেন্ট করে ফেলবে!
বলাই বাহুল্য আমি তার ছেলেমানুষী কাজকর্ম দেখে খুবই হতাশ! তাকে বললাম, “তোমার যা ইচ্ছে হয় কর! আমি এর মাঝে নেই।”
বিজ্ঞানী মানুষটি শেষ পর্যন্ত কী করেছে আমি সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না।
তারপর কয়েক বছর কেটে গেছে। আমি দেশে চলে এসে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রের জীবনের সাথে আর বিশেষ সম্পর্ক নেই।
তখন হঠাৎ একদিন আমি আমার প্রাক্তন বসের কাছে থেকে একটা টেলিফোন পেলাম। বেচারা প্রায় পাগলের মত আমাকে ফোন করেছে, চিৎকার করে বলল, “তুমি জান এখানে কী হয়েছে?” আমি বললাম, “কী হয়েছে?”
“মনে আছে তোমার সাথে ইতালীর একজন বিজ্ঞানী কাজ করছিল?”
আমি বললাম, “মনে আছে।”
“সে অপটিক্যাল আইসোলেটর ব্যবহার করার বিষয়টা পেটেন্ট করে ফেলেছে। এখন আমরা আর এক্সপেরিমেন্ট করতে পারি না- সেই কোম্পানি আমাদের কাছে লাইসেন্সিং ফি চায়!”
আমি শুনে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারি না। আমার কাছে ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ বিষয়টা কেউ পেটেন্ট করে ফেলেছে, এখন সত্যি কথা বললেই তাকে টাকা দিতে হচ্ছে!
যাই হোক, আমার বস আমাকে অনুরোধ করল আমার সব ল্যাবরেটরি নোট বুক যেন ফটোকপি করে তার কাছে পাঠাই। এগুলো দেখিয়ে তারা দাবি করবে যেহেতু গবেষণার কাজে আমারও অবদান আছে, অন্তত আমাদের কাছে যেন লাইসেন্সের ফি দাবি না করে।
আমি সব কাগজপত্র পাঠিয়েছিলাম, শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল আমার জানা নেই।
আমাদের দেশের জন্যে পেটেন্ট বিষয়টি নতুন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার যে বিষয়টির জন্যে পেটেন্টের আবেদন করা হয়েছে আমার জানা মতে এটি এই দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক পেটেন্ট। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের বড় কর্মকর্তার নিজের মুখে শুনেও আমি বিশ্বাস করতে পারি না যে এর আগে এই দেশ থেকে পেটেন্টের আবেদন করা হয়নি। পেটেন্ট আসলে এক ধরনের সম্পদ। সব পেটেন্টই যে বড় সম্পদ তার কোনো গ্যারান্টি নেই।
কিন্তু কোনো আবিষ্কার যদি হঠাৎ করে বড় কোনো কাজে লেগে যায় তখন সেটি অনেক বড় সম্পদ হতে পারে। নূতন পৃথিবীটিতে জ্ঞান হচ্ছে সম্পদ এবং সেই সম্পদের পরিমাপ করা হয় পেটেন্ট দিয়ে। আমাদের দেশে বিজ্ঞানীদের যেহেতু গবেষণা করার ক্ষমতা আছে, তারা তাদের আবিষ্কারগুলো পেটেন্ট করে দেশের জন্যে সম্পদ সৃষ্টি করবে সেটি তো আমরা আশা করতেই পারি। ঘটনাটি এই দেশে আগে ঘটেনি, এই প্রথমবার শুরু হলো।
বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে সেটি একেকজন একেকভাবে অনুভব করেন। আমি সেটা অনুভব করি এই দেশে বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয়টি দিয়ে। গবেষণা কিন্তু খরচ সাপেক্ষ, সব গবেষণা যে সফল হয়, তাও নয়। অনেক গবেষণারই ফলাফল হয় শূন্য। কিন্তু তারপরেও গবেষণায় লেগে থাকতে হয়।
গবেষণার পরিমাপের সবচেয়ে নিখুঁত সূচক হচ্ছে পিএইচডি শিক্ষার্থীর সংখ্যা। আমার মনে আছে বেশ কয়েক বছর আগে আমরা আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম, সেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়েই পিএইচডি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল বারোশত থেকে বেশি। অথচ আমাদের সারা দেশ মিলিয়েও সংখ্যাটি তার ধরে কাছে নয়। আমার মনে আছে ফিরে এসে আমি পত্রিকায় একটা লেখা লিখেছিলাম যে ‘এক হাজার পিএইইডি চাই’। আমার সেই লেখা পড়ে কেউ কেউ পিএইচডি নিয়ে অনেক নেতিবাচক কথা লিখেছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো কানাডা প্রবাসী একজন প্রাক্তন কূটনীতিক একজনের পিএইচডি গবেষণার জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থের একটা চেক আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এদিক দিয়ে আমি খুবই সৌভাগ্যবান সারাটি জীবনই আমি চমৎকার হৃদয়বান মানুষের দেখা পেয়েছি।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো মূলত আন্ডার গ্রাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়- অর্থাৎ আমরা ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে একটা ব্যাচেলর ডিগ্রি দিই। সোজা বাংলায় জ্ঞান বিতরণ করি। শুধু জ্ঞান বিতরণ করা হলে কিন্তু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে না। সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হতে হলে তাকে জ্ঞান সৃষ্টি করতে হয়। জ্ঞান সৃষ্টি করার জন্যে গবেষণা করতে হয় এবং গবেষণা করার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে পিএইচডি প্রোগ্রাম। কারণ পিএইচডি করার সময় শিক্ষার্থীরা টানা কয়েক বছর নিরবিচ্ছিন্নভাবে সময় দেয়।
একটা সময় ছিল যখন পিএইচডি শিক্ষার্থীদের কোনো স্কলারশিপ দেওয়ার উপায় ছিল না, যদি বা দেওয়া হতো তার পরিমান এত কম ছিল যে কোনো শিক্ষার্থীর যদি নিজের আলাদা উপার্জন না থাকতো তার পক্ষে পিএইচডি গবেষণা করার কোনো উপায় ছিল না।
গত কয়েক বছর থেকে আমি লক্ষ্য করছি যে পিএইচডি গবেষণার জন্যে স্কলারশিপ বাড়ছে এবং সেটি মোটামুটি একটা সম্মানজনক পরিমানে পৌঁছে গেছে। আমার কাছে মনে হয় দেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে এটি তার একটা বড় প্রমাণ। আমরা গবেষণার জন্য টাকা খরচ করতে প্রস্তুত হয়েছি।
তবে এখনো কিছু কিছু বিষয় নিষ্পত্তি হয়নি। আমাদের দেশের ছেলে মেয়েরা এখনো নিজ দেশে পিএইচডি করার বিষয়টি অন্তর থেকে গ্রহণ করেনি। এই দেশের বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীরা পিএইচডি করার জন্যে দেশের বাইরে যাচ্ছে। একবার দেশের বাইরে গেলে তাদের খুব ছোট একটা অংশ দেশে ফিরে আসছে। আমরা যদি আমাদের দেশের ল্যাবরেটরিতে সত্যিকারের গবেষণা করতে পারি, তাহলে হয়তো এই নতুন প্রজন্মকে বোঝানো সম্ভব হবে দেশেও সত্যিকারের গবেষণা করা সম্ভব। যারা দেশ ছেড়ে গিয়ে দেশের কথা স্মরণ করে লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে তাদের কাউকে কাউকে হয়তো তখন দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
যেদিন আমরা আবিষ্কার করব আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা বিদেশে গিয়ে তাদের লেখাপড়া গবেষণা শেষ করে আবার দেশে ফিরে আসতে শুরু করেছে সেদিন বুঝতে পারব যে আমাদের দেশটি এবারে সত্যি সত্যি নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতে শুরু করেছে।
অনেক আশা নিয়ে সেই দিনগুলোর জন্যে অপেক্ষা করে আছি।
(ফেসবুক থেকে)
অন্য দুটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা, দু’জায়গাতেই ইলিশ মাছের জিনোম বের করা হয়েছে। আমাদের ইলিশ মাছের জিনোম যদি আমরা বের না করি তাহলে কে বের করবে?
আমার মনে আছে ২০১০ সালে আমার প্রিয় একজন মানুষ মাকসুদুল আলম পাটের জিনোম বের করেছিলেন। আমরা আগেই খবর পেয়েছি, পরেরদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে এর ঘোষণা দিবেন। কিন্তু আমাদের দেশের খবরের কাগজগুলো কী খবরটা ঠিক করে ছাপাবে?
আমার মনে আছে এর আগের দিন আমরা দেশের সবগুলো খবরের কাগজের সম্পাদকদের সাথে দেখা করে তাদের বলেছি, “আগামী কাল সংসদে বিজ্ঞানের অনেক বড় একটা খবর ঘোষণা করা হবে। আপনারা প্লিজ খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় খবরটা বড় করে ছাপাবেন।”
খবরের কাগজগুলো আমাদের অনুরোধ রেখেছিল, সব খবরের কাগজ বড় বড় করে খবরটা ছাপিয়েছিল। দেশের বাইরে থেকে দেশে গবেষণার জন্যে মাকসুদুল আলম অনেক চেষ্টা করতেন, হঠাৎ করে সবাইকে ছেড়ে একদিন চলে গেলেন।
আমাদের দেশের অনেকের ধারণা এই দেশে বুঝি বিজ্ঞানের বড় গবেষণা হতে পারে না। সেজন্যে জুট জিনোমের খবরটা আমরা অনেক বড় করে সবাইকে জানাতে চেয়েছিলাম। গত সপ্তাহে একইভাবে তিনটি বড় গবেষণার খবর এসেছে, যারা নিজের দেশের বিজ্ঞানীদের উপর বিশ্বাস রাখে না, তারা নিশ্চয়ই এবারে নূতন করে ভাববে। আমি যতটুকু জানি, আরো কিছুদিনের ভেতর পেটেন্টের আরো কিছু খবর আসবে। পেটেন্টের জন্যে আবেদন করার আগে যেহেতু কোনো তথ্য জানাতে হয় না তাই আমরা এই মূহুর্তে সেই গবেষণাগুলোর খবর সম্পর্কে এখনো কিছু জানতে পারছি না।
পেটেন্টের বিষয়টা সবাই ঠিকভাবে জানে কীনা আমার জানা নেই। এটি হচ্ছে আবিষ্কারের স্বত্ত্ব রক্ষা করার পদ্ধতি। পৃথিবীর যে কোনো মানুষকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় রেডিও কে আবিষ্কার করেছে, সেই মানুষটি মার্কোনির নাম বলবে। আমিও ছোটবেলায় তার নাম মুখস্ত করে এসেছি। অথচ বিজ্ঞান জগতের ইতিহাস যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে আমাদের বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু রেডিও প্রযুক্তির খুঁটিনাটি মার্কোনির সমসাময়িককালে আবিষ্কার করেছিলেন। জগদীশ চন্দ্র বসু কিছুতেই তার আবিষ্কার পেটেন্ট করতে রাজী হননি, (এই ব্যাপারে তার একটা চমৎকার চিঠি আছে, তিনি কতোটা নির্লোভ মানুষ এবং জ্ঞানের ব্যাপারে কতোটা উদার সেই চিঠি পড়লে বোঝা যায়।) মার্কোনি তার উল্টো, প্রথম সুযোগে তিনি তার কাজ পেটেন্ট করে ফেলেছিলেন, সে জন্যে সারা পৃথিবী রেডিও এর আবিষ্কারক হিসেবে মার্কোনির নাম জানে, জগদীশ চন্দ্র বসুর কথা কেউ জানে না। (তবে অতি সাম্প্রতিককালে জগদীশ চন্দ্র বসুকে ইতিহাসে তার যোগ্য স্থান দেওয়ার জন্যে অনেক কাজ শুরু হয়েছে।)
পেটেন্ট করা হয় একটা আবিষ্কারের স্বত্ত্বকে রক্ষা করার জন্য। কাজেই পেটেন্টটি কোন দেশে করা হচ্ছে সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট সম্পর্কে আমার অল্প কিছু ধারণা আছে। আমি যখন বেল কমিউনিকেশন্স রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে যোগ দিই একেবারে প্রথম দিনেই সেই ল্যাবরেটরি আমার সমস্ত মেধাস্বত্ত্ব এক ডলার দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিনে নিয়েছিল! হ্যাঁ, লিখতে ভুল হয়নি, পরিমাণটা এক ডলার। আমাকে দেওয়ার জন্যে তারা নূতন ঝকঝকে একটি এক ডলারের নোট নিয়ে এসেছিল।
বেল কমিউনিকেশন্স ল্যাবরেটরিতে থাকার সময় আমরা যে বিষয় নিয়ে কাজ করেছি সেগুলো নিয়ে গোটা তিনেক পেটেন্ট হয়েছে- তবে তার কোনটারই মেধাস্বত্ত্ব আমার নিজের না, ল্যাবরেটরি প্রথমদিনই এক ডলার দিয়ে কিনে রেখেছে! মজার ব্যাপার হলো যুক্তরাষ্ট্রে পেটেন্ট করতে অনেক টাকা লাগে। পরিমানটা একশ হাজার ডলারও হতে পারে! যার আবিষ্কার পেটেন্ট হয়েছে সে চাইলে তাকে খুব সুন্দর করে ফ্রেম করে পেটেন্টের একটা কপি তৈরি করে দেয়- তার বেশী কিছু নয়!
তবে পেটেন্ট নিয়ে আমার একটা মজার স্মৃতি আছে। আমি যখন বেল কমিউনিকেশন্স ল্যাবরেটরিতে ফাইবার অপটিক সংক্রান্ত একটা বিষয় নিয়ে কাজ করছি তখন ইতালি থেকে একজন বিজ্ঞানী আমার সাথে কাজ করতে এসেছে। আমি একটি এক্সপেরিমেন্ট করছি, এক্সপেরিমেন্টটি ঠিক করে করার জন্য আমি সেখানে দুটি অপটিক্যাল আইসোলেটর নামে ডিভাইস লাগিয়েছি। ইতালির বিজ্ঞানী আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি ঐ দুটো কেন লাগিয়েছো? আমি তাকে কারণটা ব্যাখ্যা করে বললাম আমাদের এক্সপেরিমেন্টে এগুলো সব সময় ব্যবহার করতে হয়।”
ইতালির বিজ্ঞানীর চোখ চক চক করে উঠল! সে বলল, “এই বিষয়টা পেটেন্ট করে ফেলি!”
আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম সে নূতন এসেছে বলে জানে না, আমরা যারা এই ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করে আসছি তারা জানি বিষয়টা একটা কমন সেন্স ছাড়া কিছু না।
আমি বললাম, “তুমি এটা পেটেন্ট করতে চাও? এটা হচ্ছে- ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ এর মতো একটা কমন সেন্স। কেউ কখনো একশ হাজার ডলার খরচ করে ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ কে পেটেন্ট করে?”
ইতালীর বিজ্ঞানী ‘পিরেলি’ নামে অনেক বড় একটা কোম্পানি থেকে এসেছে তাদের টাকার অভাব নেই। সে আমার কথায় বিচলিত হলো না, আমাকে জানাল সে আসলেই এটা পেটেন্ট করে ফেলবে!
বলাই বাহুল্য আমি তার ছেলেমানুষী কাজকর্ম দেখে খুবই হতাশ! তাকে বললাম, “তোমার যা ইচ্ছে হয় কর! আমি এর মাঝে নেই।”
বিজ্ঞানী মানুষটি শেষ পর্যন্ত কী করেছে আমি সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না।
তারপর কয়েক বছর কেটে গেছে। আমি দেশে চলে এসে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রের জীবনের সাথে আর বিশেষ সম্পর্ক নেই।
তখন হঠাৎ একদিন আমি আমার প্রাক্তন বসের কাছে থেকে একটা টেলিফোন পেলাম। বেচারা প্রায় পাগলের মত আমাকে ফোন করেছে, চিৎকার করে বলল, “তুমি জান এখানে কী হয়েছে?” আমি বললাম, “কী হয়েছে?”
“মনে আছে তোমার সাথে ইতালীর একজন বিজ্ঞানী কাজ করছিল?”
আমি বললাম, “মনে আছে।”
“সে অপটিক্যাল আইসোলেটর ব্যবহার করার বিষয়টা পেটেন্ট করে ফেলেছে। এখন আমরা আর এক্সপেরিমেন্ট করতে পারি না- সেই কোম্পানি আমাদের কাছে লাইসেন্সিং ফি চায়!”
আমি শুনে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারি না। আমার কাছে ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ বিষয়টা কেউ পেটেন্ট করে ফেলেছে, এখন সত্যি কথা বললেই তাকে টাকা দিতে হচ্ছে!
যাই হোক, আমার বস আমাকে অনুরোধ করল আমার সব ল্যাবরেটরি নোট বুক যেন ফটোকপি করে তার কাছে পাঠাই। এগুলো দেখিয়ে তারা দাবি করবে যেহেতু গবেষণার কাজে আমারও অবদান আছে, অন্তত আমাদের কাছে যেন লাইসেন্সের ফি দাবি না করে।
আমি সব কাগজপত্র পাঠিয়েছিলাম, শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল আমার জানা নেই।
আমাদের দেশের জন্যে পেটেন্ট বিষয়টি নতুন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার যে বিষয়টির জন্যে পেটেন্টের আবেদন করা হয়েছে আমার জানা মতে এটি এই দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক পেটেন্ট। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের বড় কর্মকর্তার নিজের মুখে শুনেও আমি বিশ্বাস করতে পারি না যে এর আগে এই দেশ থেকে পেটেন্টের আবেদন করা হয়নি। পেটেন্ট আসলে এক ধরনের সম্পদ। সব পেটেন্টই যে বড় সম্পদ তার কোনো গ্যারান্টি নেই।
কিন্তু কোনো আবিষ্কার যদি হঠাৎ করে বড় কোনো কাজে লেগে যায় তখন সেটি অনেক বড় সম্পদ হতে পারে। নূতন পৃথিবীটিতে জ্ঞান হচ্ছে সম্পদ এবং সেই সম্পদের পরিমাপ করা হয় পেটেন্ট দিয়ে। আমাদের দেশে বিজ্ঞানীদের যেহেতু গবেষণা করার ক্ষমতা আছে, তারা তাদের আবিষ্কারগুলো পেটেন্ট করে দেশের জন্যে সম্পদ সৃষ্টি করবে সেটি তো আমরা আশা করতেই পারি। ঘটনাটি এই দেশে আগে ঘটেনি, এই প্রথমবার শুরু হলো।
বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে সেটি একেকজন একেকভাবে অনুভব করেন। আমি সেটা অনুভব করি এই দেশে বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয়টি দিয়ে। গবেষণা কিন্তু খরচ সাপেক্ষ, সব গবেষণা যে সফল হয়, তাও নয়। অনেক গবেষণারই ফলাফল হয় শূন্য। কিন্তু তারপরেও গবেষণায় লেগে থাকতে হয়।
গবেষণার পরিমাপের সবচেয়ে নিখুঁত সূচক হচ্ছে পিএইচডি শিক্ষার্থীর সংখ্যা। আমার মনে আছে বেশ কয়েক বছর আগে আমরা আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম, সেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়েই পিএইচডি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল বারোশত থেকে বেশি। অথচ আমাদের সারা দেশ মিলিয়েও সংখ্যাটি তার ধরে কাছে নয়। আমার মনে আছে ফিরে এসে আমি পত্রিকায় একটা লেখা লিখেছিলাম যে ‘এক হাজার পিএইইডি চাই’। আমার সেই লেখা পড়ে কেউ কেউ পিএইচডি নিয়ে অনেক নেতিবাচক কথা লিখেছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো কানাডা প্রবাসী একজন প্রাক্তন কূটনীতিক একজনের পিএইচডি গবেষণার জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থের একটা চেক আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এদিক দিয়ে আমি খুবই সৌভাগ্যবান সারাটি জীবনই আমি চমৎকার হৃদয়বান মানুষের দেখা পেয়েছি।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো মূলত আন্ডার গ্রাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়- অর্থাৎ আমরা ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে একটা ব্যাচেলর ডিগ্রি দিই। সোজা বাংলায় জ্ঞান বিতরণ করি। শুধু জ্ঞান বিতরণ করা হলে কিন্তু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে না। সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হতে হলে তাকে জ্ঞান সৃষ্টি করতে হয়। জ্ঞান সৃষ্টি করার জন্যে গবেষণা করতে হয় এবং গবেষণা করার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে পিএইচডি প্রোগ্রাম। কারণ পিএইচডি করার সময় শিক্ষার্থীরা টানা কয়েক বছর নিরবিচ্ছিন্নভাবে সময় দেয়।
একটা সময় ছিল যখন পিএইচডি শিক্ষার্থীদের কোনো স্কলারশিপ দেওয়ার উপায় ছিল না, যদি বা দেওয়া হতো তার পরিমান এত কম ছিল যে কোনো শিক্ষার্থীর যদি নিজের আলাদা উপার্জন না থাকতো তার পক্ষে পিএইচডি গবেষণা করার কোনো উপায় ছিল না।
গত কয়েক বছর থেকে আমি লক্ষ্য করছি যে পিএইচডি গবেষণার জন্যে স্কলারশিপ বাড়ছে এবং সেটি মোটামুটি একটা সম্মানজনক পরিমানে পৌঁছে গেছে। আমার কাছে মনে হয় দেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে এটি তার একটা বড় প্রমাণ। আমরা গবেষণার জন্য টাকা খরচ করতে প্রস্তুত হয়েছি।
তবে এখনো কিছু কিছু বিষয় নিষ্পত্তি হয়নি। আমাদের দেশের ছেলে মেয়েরা এখনো নিজ দেশে পিএইচডি করার বিষয়টি অন্তর থেকে গ্রহণ করেনি। এই দেশের বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীরা পিএইচডি করার জন্যে দেশের বাইরে যাচ্ছে। একবার দেশের বাইরে গেলে তাদের খুব ছোট একটা অংশ দেশে ফিরে আসছে। আমরা যদি আমাদের দেশের ল্যাবরেটরিতে সত্যিকারের গবেষণা করতে পারি, তাহলে হয়তো এই নতুন প্রজন্মকে বোঝানো সম্ভব হবে দেশেও সত্যিকারের গবেষণা করা সম্ভব। যারা দেশ ছেড়ে গিয়ে দেশের কথা স্মরণ করে লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে তাদের কাউকে কাউকে হয়তো তখন দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
যেদিন আমরা আবিষ্কার করব আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা বিদেশে গিয়ে তাদের লেখাপড়া গবেষণা শেষ করে আবার দেশে ফিরে আসতে শুরু করেছে সেদিন বুঝতে পারব যে আমাদের দেশটি এবারে সত্যি সত্যি নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতে শুরু করেছে।
অনেক আশা নিয়ে সেই দিনগুলোর জন্যে অপেক্ষা করে আছি।
(ফেসবুক থেকে)
No comments