‘ক্রসফায়ারে’ আম ও আমজনতা by শুভ কিবরিয়া

‘ক্রসফায়ার’ নতুন ঘটনা নয়। দেশে দেশে এই ওষুধের পরীক্ষা-নীরিক্ষা বহুকাল আগেই হয়ে গেছে। মেক্সিকো কিংবা কলম্বিয়ায় ক্রসফায়ারের গল্প দিয়ে শত্রুদমন খুব কাজে লাগেনি। ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোয় এই ওষুধ অনেক বদ হজমের জন্মও দিয়েছে। হালে ফিলিপাইনে এই পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য দেশটিকে বদনাম কুড়াতে হচ্ছে খুব। সে দেশের শাসক এই ‘ক্রসফায়ার’ চালু করে কুখ্যাত তো হয়েছেন, আবার দেশের ভেতর খোদ বড় আদালতের বড় বিচারকদেরও অপ্রিয়ভাজন হয়েছেন। কিন্তু ফিলিপাইনের যে মূল সংকট, সেই দারিদ্র্য, আয় বৈষম্য, বেকারত্ব, ধর্মীয় জঙ্গিবাদ—এসব সমস্যার সমাধান মেলেনি এই ক্রসফায়ার ওষুধে।
আইন, সভ্যতা, গণতন্ত্র বলে ‘ক্রসফায়ার’ দুই রকমের বিপদ ডাকে। প্রথমত, এটা বেআইনি। এটা বিচারের স্বাভাবিক নীতির পরিপন্থী। এখানে অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, এটা সুশাসনের পরিপন্থী। এটা প্রতিপক্ষকে দুনিয়াছাড়া করার কাজে ব্যবহারের সম্ভাবনা বেশি। আর ক্রসফায়ার শেষাবধি প্রতিপক্ষের মনে যে প্রতিশোধ স্পৃহা জাগায়, সেটা যেকোনও ধরনের চরমপন্থাকেই উৎসাহিত করে। কাজেই ক্রসফায়ার, না দেয় শান্তি না আনে স্বস্তি।
...২...
মানুষের ক্রসফায়ার নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ আছে। স্পষ্টত পক্ষ-বিপক্ষ আছে। যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন দুনিয়াজোড়াই তারা এর বিপক্ষে। তারা মনে করেন কথিত অপরাধীরও বলার কিছু আছে। আছে সংশোধনের সুযোগ। কাজেই হত্যা শেষ বিচারে কোনও সমাধান নয়। শুধু তাই নয়, যে প্রতিষ্ঠান অভিযুক্তকে দোষী বলছে, সেই তাকে হত্যা করতে পারে না। প্রকৃতই অভিযুক্ত অপরাধী কিনা, তা বিচার করবে তৃতীয়পক্ষ। পুলিশ আসামি ধরে তাকে হত্যা করার বিচার সভ্য আইনে চলে না। আদালতে কথিত অভিযুক্তকে অপরাধী প্রমাণ করতে হয়। আদালত তার শাস্তির বিধান করে। সেই শাস্তির বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ দিতে হয়। আপিলে তা খারিজ হলে কিংবা চূড়ান্ত বিচারে যে সাজা বহাল থাকে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় তা বাস্তবায়ন করতে হয়। এটা ক্রসফায়ারের বিপক্ষ দলের মত। যারা ক্রসফায়ারের পক্ষে আছেন, তারা ভাবেন এত বাছ-বিচার করতে গেলে সমাজে আর অপরাধ দমন করা যাবে না। চিহ্নিত অপরাধীকে দুনিয়া থেকে না সরালে অপরাধ কমবে না। যারা এই মতের পক্ষের মানুষ, মূলত তারা আইনানুগ অস্ত্রধারী। তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন মানুষ। তাদের দায়িত্ব সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। তারা সমাজ রক্ষার দায়িত্ব পান সমাজের বিধিবিধান মেনেই। হয় জনতার ভোটে নয় গায়ের জোরে কোনও না কোনোভাবে ক্ষমতায় বসেই তারা সমাজ উদ্ধারের এই শর্ট-কার্ট পথকে মোক্ষম উপায় বলেই ভাবেন।
...৩...
আমাদের আজকের প্রতিপাদ্য বিষয় মানুষের ‘ক্রসফায়ার’ নয়। যে উপায়ে ডজন ডজন মানুষ মধ্যরাতে বন্দুকযুদ্ধে হাপিত্যেশ হয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রের বুলেটে তা নিয়ে আমরা আপাতত মাথা ঘামাতে চাচ্ছি না। ওটা রাষ্ট্রের বড় বড় মহাজনদের কারবার। আমরা আদার ব্যাপারি আমাদের জাহাজের খবর নিয়ে দরকার নেই। আমরা বরং আদা বা তার কাছাকাছি কিছু নিয়ে মাথা ঘামাই।
এখন রমজান মাস। এই মাসে বাজারে সব ধরনের খাদ্যপণ্যের চাহিদা থাকে ব্যাপক। মানুষ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী প্রচুর পরিমাণেই কেনা-বেচা করে এই মাসে। যদিও বলা হয় রমজান সংযমের মাস। কিন্তু বাংলাদেশে দিন শেষের সংযম আসলে প্রচুর ইনটেকের মাধ্যমেই শেষ হয়। এ মাসে আমরা সবকিছুই বেশি বেশি করি। এই মাসে আমরা যেমন ইবাদতের আচার অনুষ্ঠান অনেক বেশি বেশিই করি,তেমনি আমরা খাইও বেশি। হরেক পদের খাদ্য দিয়ে ইফতারি করি। সেহরি করি বহুপদের উপাদেয় খাদ্য দিয়ে। এ মাসে আমরা কামাই বেশি, খরচও করি বেশি। আমরা খাই বেশি, নষ্টও করি বেশি।
বাজার অর্থনীতিতে এ মাসে সব পণ্যের বেচাকেনা চলে রমরমা। তাই, যারা এসব পণ্য বিক্রি করেন, তাদের অনেকেই মুনাফা বেশি করতে চান অসাধু উপায়ে। যে যেরকমভাবে পারেন খাদ্যে-ফলে-পণ্যে এই সময়ে ভেজাল মিশিয়ে, ওজনে কম দিয়ে, ফরমালিন, কার্বাইড মিশিয়ে মানুষকে ঠকিয়ে বেশি বেশি মুনাফার চেষ্টা করেন। রাষ্ট্রের যারা অবিভাবক, তারাও তাই সোচ্চার হয়ে ওঠেন এই মাসেই বেশি করে। তারাও এইমাসে দ্রুত বিচারের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত ভ্রাম্যমাণ আদালতের চাকাঘোরান জোরে । বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারকেরা বাজার ঘুরে ঘুরে সাজা বাড়ান। তাদের ভাষায় নষ্ট-পচা-বাসি-খারাপ খাবার, খারাপ পণ্য , তারা নষ্ট  করেন। কখনও কখনও বুলডোজারের চাকায় চলে এই ক্রসফায়ারও। গত ক’বছর ধরে মৌসুমি ফল আম পড়েছে এই ক্রসফায়ার চক্রে। কেমনতর সে চক্র সেই গল্পটাই শুনি।
...৪...
আম উঠেছে বাজারে। অভিযোগ, অপিরপক্ব এই আম কার্বাইড ও ইথোফেন দিয়ে আগাম পাকিয়ে আনা হয়েছে বাজারে। এটা স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয় বলছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন(র‌্যাব) ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। ইতোমধ্যে ঢাকার কাওরান বাজারের আড়তে থাকা প্রায় ৩ হাজার মণ আম ধ্বংস করেছে বুলডোজার দিয়ে র‌্যাব ও ডিএমপি। তাদের অভিযোগ—আমগুলো অপরিপক্ব। এগুলো কার্বাইড ও ইথোফেন দিয়ে পাকানো।
কিন্তু বাজারে অভিযান চালিয়ে কয়েক হাজার মণ আম ধ্বংস করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এ বিষয়ক সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)। একটি জাতীয় দৈনিকে ২৩ মে ২০১৮ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, জানা-বোঝার ঘাটতির কারণেই র‌্যাব ও ডিএমপি এভাবে আম নষ্ট করেছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, অপরিপক্ব আমে স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টির পরিমাণ স্বাভাবিক পাকা আমের চেয়ে কম থাকে। কিন্তু এটা ক্ষতিকর নয়। তাই এসব আম ধ্বংস করার কোনও মানে হয় না। আর কার্বাইড দিয়ে পাকালে ফলে এর অবশিষ্টাংশ থাকে না। তাই তা ক্ষতিকর নয়। আবার নির্দিষ্ট মাত্রায় ইথোফেন ব্যবহার করে ফল পাকানো দেশের আইনে বৈধ। সারা বিশ্বেও তাই।
উল্লেখ্য অপরিপক্ব আম বাজারে আনা নিয়ন্ত্রণ করতে গত কয়েক বছর আমের উৎপাদক বড় দুই অঞ্চল রাজশাহী ও সাতক্ষীরায় আম পাড়ার সময় বেঁধে দিয়েছে প্রশাসন। এবারও তা করা হয়। এবার সাতক্ষীরার আম ১৫ মে ও রাজশাহীর আম ২০ মে পাড়ার তারিখ দেওয়া হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। বলা হচ্ছে, যে হাজার হাজার মণ আম ধ্বংস করা হলো, তা সাতক্ষীরার আম। ১৫ মে তারিখেই র‌্যাব ও পুলিশ ঢাকার বাজারে রক্ষিত এই আম ধ্বংস করে।
আমের জীবনে ক্রসফায়ার কিংবা বুলডোজার আঘাত নতুন নয়। ২০১৪ সালের আগে ফরমালিন মেশানোর অভিযোগে প্রচুর আম ও অন্যান্য ফল ধ্বংস করা হয়েছিল। পরে দেখা যায়, যে যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন পরীক্ষা করা হচ্ছে, তা বাতাসে ফরমালডিহাইড মাপার যন্ত্র। তিনটি সংস্থার পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে হাইকোর্ট সেই যন্ত্রটি ফল ও মাছে ফরমালিন পরীক্ষায় অকার্যকর ঘোষণা করে।
...৫...
তাই বোঝা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের হাত থেকে আমের জীবন বাঁচাতে আরও জানা-বোঝা দরকার। দেশের মানুষের উপকারের নামে আমরা দেশের সম্পদের, অর্থনীতির আরও কোনও বড় ক্ষতি করছি কিনা, সেটা খুব ভেবে দেখা দরকার। বাংলাদেশের কৃষক তার নিজের শক্তিতে যে আমের উৎপাদন বাড়িয়েছে আমাদের অজ্ঞতা, অক্ষমতা, কুশাসন, ক্ষমতার দাম্ভিকতা কী, তা ধ্বংস করে দিচ্ছে কিনা? যখন এত বিপুল পরিমাণে দেশের আম ছিল না, তখন বিদেশের আমে সয়লাব হতো বাংলাদেশের বাজার। আমরা কৌশলে আবার সেই বিদেশি আমের বাজারকেই উৎসাহিত করছি কিনা, সেটাও দেখা ও ভাবা দরকার।
...৬...
আম থেকে এবার আমজনতায় ফিরি। মিডিয়াজুড়েই এখন বন্দুকযুদ্ধের খবর। ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ যে নামেই ডাকি না কেন, বিনা বিচারে মানুষের জীবনহানি চলছে। তার পরিসংখ্যানও বাড়ছে। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান আমের ক্রসফায়ার বা বুলডোজার দিয়ে হত্যা নিয়ে চিন্তিত কিন্তু মানুষের জীবনহানি নিয়ে ততটা ভাবিত নয়। বরং তাকে উৎসাহিত করতেই উৎসাহী।
দুঃখের বিষয় সেটাই!
শুভ কিবরিয়া
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

No comments

Powered by Blogger.