বব ডিলানের জায়গায় সভেতলানার স্বাক্ষর করা চেয়ার
গোল টেবিলে উপুড় করে রাখা চেয়ারগুলোতে রয়েছে নোবেল বিজয়ীদের স্বাক্ষর। ছবি: প্রথম আলো |
নোবেল মিউজিয়ামের দরজা খুলল স্থানীয় সময় ঠিক দুটোর সময়। সারিবদ্ধ মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো না। আমাদের জন্য রাস্তা করে দিলেন প্রহরীরা। নোবেল বিজয়ীদের ছবি পাশ কাটিয়ে পৌঁছে যাই গন্তব্যে। সেখানে একজন সাংবাদিক খুব নিবিষ্ট মনে চেয়ারগুলো দেখছেন। একটু পরেই সেখানে উপস্থিত হতে থাকেন আরও সাংবাদিক। আমরা এখানে, এই গ্যামলা স্তানের নোবেল মিউজিয়ামে কেন এসেছি, তা বুঝতে পারি এখন। একটি গোল টেবিলে উপুড় করে রাখা হয়েছে ছয়টি চেয়ার। সে চেয়ারগুলোয় নোবেল বিজয়ীদের স্বাক্ষর। আর তার পাশেই আছে নোবেল বিজয়ীদের স্মারক। মঙ্গলবারেই প্রথম নোবেল মিউজিয়ামে এসেছেন নোবেল বিজয়ীরা। এখানেই তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। খেয়েছেন দুপুরের খাবার। আর তারপর সবাই স্বাক্ষর দিয়েছেন চেয়ারগুলোয়। পদার্থবিজ্ঞানীরা দিয়েছেন একটি চেয়ারে, রসায়নবিদেরা আরেকটায়। এভাবে ছয়টি চেয়ারে রয়েছে স্বাক্ষর। আমরা সবাই একটি নির্দিষ্ট স্বাক্ষর দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু সে চেয়ারে ভদ্রলোকের নামটা আছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে যে অন্য কারও স্বাক্ষর! বব ডিলানের স্বাক্ষর নেই। বিষয়টা প্রথম চোখে পড়ে ভারতীয় সাংবাদিক দিব্যর। আমি একটু তাকিয়েই বুঝে গেলাম বিষয়টা। বললাম, ‘দেখুন, এই চেয়ারে ছবি আছে দুজনের। স্বাক্ষরটা ওই দ্বিতীয়জনের। দেখুন, এই চেয়ারে সাল লেখা আছে ২০১৫।’ আমরা বুঝে ফেলি, গত বছর সাহিত্যে নোবেল পাওয়া সাহিত্যিক সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচের স্বাক্ষর করা চেয়ারটা এখনে রাখা হয়েছে। সঙ্গে আছে বব ডিলানের ছবি। কী ব্যাপার—জানতে চাই মিউজিয়ামের প্রেস অ্যান্ড মার্কেটিং ম্যানেজার হেলেনা ওয়াল্লেমোর কাছে। হেলেনা বলেন, ‘আপনারা তো জানেনই, ডিলান আসেননি।
যখন আসবেন, তখন আমরা তাঁর স্বাক্ষরটি রেখে দেব এ রকম আরেকটি চেয়ারে।’ কালো চেয়ারগুলোয় নোবেল বিজয়ীদের হাতের লেখা স্পষ্ট হয়ে আছে। খুব কাছে থেকে তাঁদের স্পর্শ পাচ্ছি যেন। কোস্টারলিজের থিসিস, ফেরিঙ্গার জুতা মঙ্গলবার দুপুরটা ডিলান বাদে সব নোবেল বিজয়ীই কাটিয়েছেন মিউজিয়ামে। স্টকহোম শহরের পুরোনো অংশে এই মিউজিয়াম। চেয়ারে স্বাক্ষর করার পর নোবেল বিজয়ীদের কাছে কোনো স্মারক দেবেন কি না, জানতে চাওয়া হয়। তাঁরা সানন্দে নিজেদের ব্যবহার করা কিছু জিনিস দিয়েছেন। সেগুলো দেখানো হলো সাংবাদিকদের। পদার্থবিজ্ঞানী মাইকেল কোস্টারলিজের একটি থিসিস দেখা গেল। প্রদর্শক বললেন, ‘এটা খুবই দামি একটা জিনিস। এটার আর কোনো কপি নেই। কোথাও ছাপা হয়নি। সুতরাং একক স্মারক হিসেবেই এটা এখানে থাকবে।’ রসায়নে নোবেল পাওয়া বের্নার্ড ফেরিঙ্গা দিয়েছেন দুটো জুতা। ডান ও বাঁ পায়ে দুই ধরনের জুতো পরতে হয়, এ রকম সরল করে নাকি তিনি তাঁর তত্ত্ব সাজিয়েছেন। স্মারক দেখার সময়ও ঘুরেফিরে আসে ডিলান প্রসঙ্গ। হেলেনা বললেন, ‘ডিলানের পক্ষ থেকে ব্যাংকোয়েটে কিছু একটা হবে। হতে পারে তাঁর বক্তব্য তাঁর প্রিয় কোনো মানুষ পড়ে শোনাবেন।’ এ ব্যাপারে নাকি গত পরশু দিনই কথা হয়েছে। সবাই ডিলানের বক্তব্য পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী।
মনিটরে তিন বাঙালি
প্রতি ১০ বছরের নোবেল বিজয়ীদের নিয়ে একটি আয়োজন রয়েছে হলের সামনের দিকেই। মনিটরে বাটন চাপ দিলেই সেই ১০ বছরে কোন বিষয়ে কে পুরস্কার পেয়েছেন এবং কেন পেয়েছেন, তা উঠে আসে। আমি প্রথমে ১৯১১-১৯২০ সালে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে পেলাম। এরপর খুঁজলাম অমর্ত্য সেনকে। অমর্ত্য সেনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। তিনজনকে পেয়ে গেলাম। মন গর্বে ভরে উঠল। পাশের একটি ঘরে দু-তিন মিনিটের চলচ্চিত্র চলছে। আমি যখন ঢুঁ মারলাম, তখন চলছে বরিস পাস্তারনাকের ওপর তৈরি করা তথ্যচিত্র। রুশ ভাষায় কবিতা পড়ে চলেছেন বরিস। বব ডিলান যখন নিশ্চুপ ছিলেন, তখনো মনে হচ্ছিল তিনি নোবেল গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। বরিস পাস্তারনাকের ব্যাপারটা সে রকম নয়। স্বেচ্ছায় নোবেল পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর ঘটনা আছে দুটি। ১৯৬৪ সালে জাঁ পল সার্ত্র নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আড়ম্বরপূর্ণভাবে পুরস্কার দেওয়ারই বিপক্ষে ছিলেন। তাই তিনি তা গ্রহণ করেননি।
মনিটরে তিন বাঙালি
প্রতি ১০ বছরের নোবেল বিজয়ীদের নিয়ে একটি আয়োজন রয়েছে হলের সামনের দিকেই। মনিটরে বাটন চাপ দিলেই সেই ১০ বছরে কোন বিষয়ে কে পুরস্কার পেয়েছেন এবং কেন পেয়েছেন, তা উঠে আসে। আমি প্রথমে ১৯১১-১৯২০ সালে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে পেলাম। এরপর খুঁজলাম অমর্ত্য সেনকে। অমর্ত্য সেনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। তিনজনকে পেয়ে গেলাম। মন গর্বে ভরে উঠল। পাশের একটি ঘরে দু-তিন মিনিটের চলচ্চিত্র চলছে। আমি যখন ঢুঁ মারলাম, তখন চলছে বরিস পাস্তারনাকের ওপর তৈরি করা তথ্যচিত্র। রুশ ভাষায় কবিতা পড়ে চলেছেন বরিস। বব ডিলান যখন নিশ্চুপ ছিলেন, তখনো মনে হচ্ছিল তিনি নোবেল গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। বরিস পাস্তারনাকের ব্যাপারটা সে রকম নয়। স্বেচ্ছায় নোবেল পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর ঘটনা আছে দুটি। ১৯৬৪ সালে জাঁ পল সার্ত্র নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আড়ম্বরপূর্ণভাবে পুরস্কার দেওয়ারই বিপক্ষে ছিলেন। তাই তিনি তা গ্রহণ করেননি।
আরেকজন হলেন ভিয়েতনামের রাজনীতিবিদ লে ডিক তোহ। ১৯৭৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, কিন্তু দেশের তখনকার পরিস্থিতির কারণে তিনি এই পুরস্কার নিতে পারছেন না বলে জানিয়ে দেন। তবে স্বেচ্ছায় নয়, অন্যের ইচ্ছায় পুরস্কার নিতে না আসার ঘটনাও আছে। রসায়নে নোবেল পাওয়া তিন বিজ্ঞানী রিখার্ড কুন, অ্যাডলফ বুটেনান্ডট ও গেরহার্ড ডোমাগক নোবেল পুরস্কার নিতে আসতে পারেননি। অ্যাডলফ হিটলার তাঁদের আসতে দেননি। পরে তাঁরা মেডেল ও সনদ পেয়েছেন কিন্তু অর্থ পাননি। আর সোভিয়েত লেখক বরিস পাস্তারনাক নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করবেন বলে সম্মতি জানিয়েছিলেন, কিন্তু সরকারের চাপে পড়ে তিনি নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। ফিরে আসার আগে চেয়ারগুলোর দিকে তাকাই। এগুলো কিন্তু মিলনায়তনে রাখা হবে। এগুলোর ওপর বসবেন সাধারণ মানুষ। তবে এগুলো এই জাদুঘরেই থাকবে সব সময়।
No comments