সাংসদের দপ্তরে ‘আদালত’ by কামরুল হাসান
সালিসের নামে প্রচলিত আইনের বাইরে বিশেষ
একধরনের বিচারব্যবস্থা চালু করেছেন ঢাকা-১৫ আসনের সাংসদ কামাল আহমেদ
মজুমদার। বিচার করার জন্য তিনি গঠন করেছেন পাঁচ সদস্যের কমিটি। প্রতি
শনিবার এই কমিটি বৈঠকে বসে শুনানি করে। কথিত আদালতের নাম ‘সামাজিক বিচার
কমিটি’। এলাকার মানুষের লিখিত অভিযোগ নিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নোটিশ
পাঠিয়ে ভয় দেখিয়ে হাজির হতে বলা হয়। হাজির না হলে একতরফা রায় দেওয়ার হুমকি
দেওয়া হয়। রায় মানতেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিষয়টিকে কেন্দ্র করে পুলিশ অস্বস্তিতে রয়েছে। পুলিশ এই সালিসি আদালতের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়েছে। সাংসদ কামাল মজুমদার অবশ্য পুলিশের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করে বলেছেন যে তাদের ঘুষ-দুর্নীতির সুযোগ কমে যাওয়ায় তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
রাজধানীর পল্লবীতে সাংসদের ব্যক্তিগত কার্যালয় মোহনায় বিচার কমিটির দপ্তর। স্থানীয় মানুষ এটাকে ‘আদালত’ বলেন। কমিটির সদস্যরা দাবি করেছেন, ২০০৯ সাল থেকে তাঁরা প্রায় ২৫০টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করে রায় দিয়েছেন।
এভাবে ‘আদালত’ বসিয়ে বিচার করা সাংসদের কাজ কি না, জানতে চাইলে আইনজ্ঞ শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে সাংসদদের কোনো বিচারিক ও নির্বাহী ক্ষমতা নেই। দুই পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে তাঁরা পারিবারিক বা সামাজিক কোনো বিরোধ মীমাংসা করতে পারেন কিন্তু এর বাইরে গিয়ে কাউকে হাজির করার নোটিশ দেওয়া, ভয় দেখানো বা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারেন না।
এ বিষয়ে কথা হয় সাংসদ কামাল মজুমদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকার দুই পক্ষ মারামারি করবে, আর আমি এমপি হয়ে বসে বসে তামাশা দেখব! আমার এলাকার লোকদের বিচার-সালিস করার ক্ষমতা আমার আছে, আমি সেটাই করি।’
সামাজিক বিচার কমিটির কার্যক্রম দেখতে ১৯ জুলাই আমি হাজির হই কামাল মজুমদারের কার্যালয় মোহনাতে। মোহনার নিচের তলায় ‘সাংসদের রাজনৈতিক কার্যালয়’ লেখা কক্ষে চলছিল বিচার কমিটির কাজ। প্রবেশ করতেই দেখা গেল জনা বিশেক লোক বসে আছেন। প্রায় সবার হাতেই দলিল-দস্তাবেজ। কমিটির নোটিশে তাঁরা হাজির হয়েছেন।
পাঁচ সদস্যের কমিটির দুজন তখনো আসেননি, তিনজন বসে আছেন। একজন এগিয়ে এসে জানতে চান, কী ধরনের অভিযোগ। আবেদনপত্রে সাংসদের সুপারিশ আছে কি না। পরে সাংবাদিক পরিচয় দিলে কামাল মজুমদারের একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এগিয়ে আসেন। তাঁর মাধ্যমে কমিটির দুই সদস্য প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা জানান, সামাজিক বিচার কমিটির কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে। তখন কমিটি ছিল সাত সদস্যের। ২০১৩ সালে সেই কমিটি বিলুপ্ত হয়। ২০১৪ সালে নতুন পাঁচ সদস্যের কমিটি হয়। এর আহ্বায়ক হলেন সাংসদের ঘনিষ্ঠ আবদুল ওহাব। অন্য চারজন হলেন: মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সহসভাপতি ও সাবেক সরকারি চাকুরে আবুল খায়ের ভুইয়া, কাফরুল থানা আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল আলী চৌধুরী, আওয়ামী লীগের নেতা সিরাজউদ্দিন আহমেদ ও কাফরুল থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল গফুর।
প্রথম আলো প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁদের সামনে মধ্যবয়স্ক এক নারী বসে ছিলেন। কমিটির এক সদস্য তাঁর হাতে ৫০০ টাকার একটি স্ট্যাম্প ধরিয়ে তাতে সই দিতে বলেন। এ সময় কমিটির সদস্য আবুল খায়ের ভুইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বর্ণালী হাউজিংয়ের সঙ্গে ওনার একটু ঝামেলা হয়েছিল। এখন দুই পক্ষ সমঝোতায় এসেছে।’ পাশে একটি লোককে দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘উনি কোম্পানির এমডি।’ এরপর লোকটির দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনি সই দেন।’ এমডি পরিচয় দেওয়া লোকটি মুখ কালো করে স্ট্যাম্পে সই করলেন।
কী হয়েছিল আবাসন কোম্পানির সঙ্গে? জানতে চাইলে আবুল খায়ের ভুইয়া বলেন, ‘সে এক লম্বা কথা ভাই। ম্যালা ঝামেলা। এত শুনে কী করবেন। অনেক দিন আলোচনা হলো। এই দ্যাখেন কত মোটা ফাইল। একেবারে আদালতের মতো, প্রতিদিনের প্রসিডিং লেখা আছে।’ অবশ্য এমডি পরিচয় দেওয়া লোকটি এ নিয়ে আর কোনো কথা বলতে চাইলেন না।
এ আদালতে কী ধরনের বিচার হয়? প্রশ্ন করতেই মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কমিটির আহ্বায়ক আবদুল ওহাব বলেন, ‘এটাকে আদালত বলছেন কেন, এটা তো সালিস কমিটি। এমপি সাহেব চিঠি দিয়ে কমিটি করেছেন। কোনো ফৌজদারি বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করি না। শুধু জমি বা অ্যাপার্টমেন্ট-সংক্রান্ত ঝামেলা হলে আমরা শুনানি করি। বলতে পারেন, দেওয়ানি বিষয় নিয়ে বিরোধ হলে আমরা তা নিষ্পত্তি করি। রায় ঘোষণা করি। তবে কাউকে জোর করি না।’
আবার মুখ খোলেন আবুল খায়ের ভুইয়া—‘আপনি নিয়মটা ভালো করে শোনেন আগে। লোকজন এমপি সাহেবের কাছে আবেদন করেন। তিনি সেই আবেদন কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেন। এরপর আমরা বিবাদীকে নোটিশ করি। দুই পক্ষ রাজি হলে তবেই সমঝোতা। ৫০০ টাকার স্ট্যাম্পে সই নিয়ে তা থানা ও অন্যান্য স্থানে পাঠানো হয়। আপসের ব্যাপারে কাউকে জোর করা হয় না।’
আবুল খায়ের এ দাবি করলেও কমিটির পাঠানো নোটিশ দেখে তার সত্যতা মেলেনি। এমন কয়েকটি নোটিশের অনুলিপি প্রথম আলো প্রতিনিধির হাতে রয়েছে। এতে দেখা গেছে, মিরপুরের মুক্তি হাউজিংয়ে এক ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি মুক্তি হাউজিংয়ের বাসিন্দা লুৎফর নেছা নাহারকে নোটিশ দিয়ে হাজির হতে বলেন। কিন্তু ওই নারী হাজির না হয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর কমিটির সদস্যরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে পরপর তিনটি চিঠি দেন। এর একটি চিঠিতে বলেন, ‘আপনি অত্র কার্যালয়ে হাজির না হয়ে থানায় জিডি করেছেন। এবং বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলে অজুহাত সৃষ্টি করেছেন, সালিস কমিটিতে হাজির না হয়ে উদ্দেশ্যমূলক আচরণ করেছেন। সংসদ সদস্য কর্তৃক গঠিত কমিটিকে আমলে না নিয়ে অপমানিত করেছেন।’
এভাবে হুমকি দিয়ে চিঠি দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে কমিটির আহ্বায়ক বলেন, ‘আমরা হুমকি দেব কেন? তাঁকে আসতে বলা হয়েছে। তিনি আমাদের কথা না শুনে আদালতে যাবেন, সেটা তাঁর ইচ্ছে।’ ওই দিন সামাজিক বিচার কমিটির সামনে এ অভিযোগের আবেদনকারীও বসেছিলেন। শফিউদ্দিন আহমেদ নামে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই আওয়ামী লীগের নেতা বলেন, প্রতিবেশী দেয়াল তুলে দেওয়ায় তিনি বাড়ির ভেতরে গাড়ি ঢোকাতে পারেন না। এর প্রতিকার চাইতে কমিটির কাছে এসেছেন।
জানতে চাইলে মিরপুর পুলিশের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এই কমিটির আইনগত কোনো বৈধতা নেই। তারা আদালতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কথায় কথায় লোকজনকে হাজির হতে নোটিশ দিচ্ছে। আবার নিজের খেয়ালখুশিমতো রায় দিচ্ছে।
মিরপুর থানা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের সাবেক পরিচালক এ বি এম বারেকের মুক্তি হাউজিংয়ের বাসার সীমানাপ্রাচীর ভেঙে দেওয়ার জন্য কমিটি তাঁকে চাপ দেয়। এরপর তিনি বিষয়টি পুলিশকে জানান। পুলিশ এতে হস্তক্ষেপ করার কারণে তিনি রক্ষা পান। কমিটির নির্দেশে মিরপুরে একটি তৈরি পোশাক কারখানার সীমানাপ্রাচীরও ভেঙে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ আছে।
এ ব্যাপরে জানতে চাইলে কামাল মজুমদার বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে পুলিশ এসব কথা রটাচ্ছে। আসলে সামাজিক বিচার কমিটির কারণে পুলিশের মামলা কমে গেছে। তারা টাকাপয়সা কামাতে পারছে না। এ কারণে এসব কথা বলছে।’ সামাজিক বিচার কমিটির বিচার নিয়ে ৯০ শতাংশ মানুষই খুশি বলে জানান সাংসদ।
স্থানীয় লোকজন জানান, মিরপুরে জমিজমা নিয়ে ঝামেলা অনেক বেশি। এ কারণে বিচার কমিটি শুধু জমিজমা-সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে বিচার করে। তারা রায় দেয় খেয়ালখুশিমতো । কিন্তু কামাল মজুমদার ও তাঁর লোকদের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করে না।
তার পরও কয়েকজন সামাজিক বিচার কমিটির কার্যক্রম নিয়ে থানা-পুলিশের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন ও পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ জিয়াউজ্জামান এ ধরনের অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করেন।
No comments