লড়াইটা জমিয়েছেন কেজরিওয়াল by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
শুক্রবার সকাল থেকে বারানসির জগদ্বিখ্যাত
অলিগলি ও রাজপথে একটাই আলোচনা, আগের রাতে নরেন্দ্র মোদির চার কিলোমিটার
যাত্রাপথে কত মানুষের ঢল নেমেছিল? কারও মতে, এক লাখ। কারও ধারণা, কয়েক লাখ।
বেনারস (এই প্রাচীন নগরের আরেক নাম) হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দলীয়
কার্যালয়ের চার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে মোদির গাড়িবহরের সময় লাগে চার
ঘণ্টা। এ পুরো সময় মোদি সারা দেশের টেলিভিশনের প্রাইম টাইমে আর কাউকে এক
ইঞ্চি জায়গা ছাড়লেন না, আনুষ্ঠানিক ‘রোড শো’ না হলেও সেটা শেষ পর্যন্ত তা-ই
হয়ে গেল। দ্বিতীয়ত, জাতীয় নির্বাচন কমিশন ও বারানসির জেলা প্রশাসকের
বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ে জয় হলো বিজেপির।
এত কিছুর পরও বারানসির মোদি বাহিনী তক্কে তক্কে আছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের জন্য। আম আদমি পার্টির (এএপি) নেতা আর যাই হোক, এ তীর্থ নগরের মোদিবিরোধীদের সমীহ কিন্তু আদায় করে ছেড়েছেন। গোটা নগর এককথায় স্বীকার করছে, (এমনকি নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে যাঁদের পাগলামির শেষ নেই তাঁরাও) আর কিছু না হোক, লড়াইটাকে উপভোগ্য করে তুলেছেন এই অরবিন্দ কেজরিওয়াল।
সকাল থেকেই মাথায় সাদা টুপি, হাতে দুর্নীতি তাড়ানোর ঝাঁটা (নির্বাচনী প্রতীক) নিয়ে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আম আদমি পার্টির সদস্যরা শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। গ্রামে গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছেন। লোকজনকে তাঁরা ভোট দেওয়ার যন্ত্র ইভিএমের ছাপমারা কাগজ দিচ্ছেন, যাতে ভোটের বোতাম কোথায় টিপতে হবে বুঝতে অসুবিধা না হয়। এই যে কয়েক শ মানুষ কেজরিওয়ালের জন্য জীবনপণ করে বারানসির নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন, এঁদের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) নেতাদের অদ্ভুত মিল। সংঘের মানুষজনের মতোই আদর্শে ভর করে লক্ষ্যে অবিচল থেকে আম আদমি পার্টির লোকজন অনেক কষ্টে মোদির অর্থবল, লোকবল, বাহুবল ও কৌশলের মোকাবিলা করছেন। এঁদের অধিকাংশই বাইরের লোক। প্রচারণা শেষে এঁদের বারানসি ছেড়ে চলে যেতে হবে। প্রশাসনের হুকুম, প্রচারণা শেষ, এলাকার বাইরের লোকজনেরও বারানসিতে থাকার মেয়াদ শেষ।
কেজরিওয়ালের জন্য বিজেপির তক্কে তক্কে থাকার কারণ তাঁর রোড শো। দুই দফায় ‘ঝাড়ু পার্টি’ (এখানে এএপিকে এই নামেই ডাকা হচ্ছে) সেই শো গতকাল করল ঠিকই, কিন্তু মেজাজে বা জৌলুশে তা মোদির ধারেকাছেও আসতে পারল না। কী করেই বা আসবে? একদিকে দেশের করপোরেটকুলের দেদার দাক্ষিণ্য, অন্যদিকে দুয়োরানির দারিদ্র্যমাখা মালিন্য! মোদি-সমর্থকেরা আরও উৎফুল্ল যখন দেখলেন শেষবেলায় প্রচারে এসে মায়াবতীও তেমন একটা দাগ কাটতে পারলেন না। খুব শোনা যাচ্ছিল, মায়াবতীকে সামনে রেখে ‘হাতি পার্টি’ ধীর লয়ে শহরে দাপিয়ে বেড়াবে। কিন্তু ‘বহিনজি’ বাইরে বাইরে থেকে পাশ কাটিয়ে গেলেন ‘সাম্প্রদায়িক’ মোদিকে গালমন্দ করে। মোদি এলে দেশের মানুষের কী ধরনের বিপদের মোকাবিলা করতে হবে, সে বিষয়ে দেহাতের মানুষকে শিক্ষিত করে তিনি ভিভিআইপি আসন বারানসির আশা ত্যাগ করে পূর্বাঞ্চলের অন্যত্র মনোনিবেশ শ্রেয় মনে করছেন। মায়াবতীর কৌশলী রাজনীতিতে এটাই ঠিক। অর্থাৎ, বারানসি এসেও এলেন না। মুলায়ম নিজে আসবেন না ঠিক করেছেন। তবে তাঁর ছেলে অখিলেশ মনে করছেন, তিনিও না এলে বারানসির মুসলমানরা ‘ভুল বার্তা’ পেতে পারেন। সেটা বিধানসভার পরের ভোটে খারাপ প্রভাব ফেলবে। তাই আজ শনিবার সাইকেল পার্টির মনোবল বাড়াতে অখিলেশ রোড শো করবেন।
কিন্তু অখিলেশ নন, বিজেপির আগ্রহ যাঁকে ঘিরে তিনি রাহুল গান্ধী। তাঁকে বেইজ্জত করতে মোদি যদি আমেথি যেতে পারেন, রাহুল তবে কেন বারানসি আসবেন না? এই যে পাল্লা, সাদা বাংলায় যাকে ইটের বদলে পাটকেল বলা হয় আজ প্রচারের শেষ দিনে সেই পাটকেল ছুড়তেই রাহুলের বারানসি আসা। তবে একটু তফাত রয়েছে। মোদি আমেথিতে গিয়ে জনসভা করেছিলেন, রাহুল করবেন রোড শো। তার প্রভাব কতটা পড়বে বারানসির ভোটারদের মনে, আপাতত সেই জল্পনাতেই শহর মশগুল। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ এখানে এসেছেন। রাহুলের রোড শো নিয়ে ঠাট্টা করলেন, ‘কেজরিওয়াল বা রাহুলেরা রোড শো করুন বা এয়ার শো, বারানসিতে মোদির স্টাম্প লেগে গেছে।’
পাঁচ বছর আগে বিজেপির মুরলী মনোহর জোশি বারানসি থেকে কোনোরকমে ১৭ হাজার ভোটে জিতেছিলেন। মোদি এবার সেই আসনকে প্রায় হেলায় ঝোলায় পুরলে কে তার জন্য দায়ী হবেন? রাহুল গান্ধীর শুনতে খারাপ লাগতে পারে, তবে ঘটনা হলো এ আসনের সাড়ে তিন লাখের বেশি মুসলমান ভোটারের অধিকাংশ মনে করেন, কংগ্রেসই তার জন্য দায়ী। কেন? কারণ, কংগ্রেস গড়িমসি করতে করতে একেবারে শেষবেলায় অজয় রাইকে টিকিট দিল। অথচ অরবিন্দ কেজরিওয়াল তার এক মাস আগে থেকে এখানে ঘাঁটি গেড়ে বসে। নিট ফল? মুসলমানদের বেশির ভাগ ভোট এবার চিরায়ত হাতের পাঞ্জা ছেড়ে ঝাড়ুতেই আশ্রয় নিচ্ছে। ইটের বদলে পাটকেল মারতে রাহুল বারানসি না এলেই ভালো করতেন। তাতে আর যাই হোক, তিনি যে প্রতিহিংসাপরায়ণ নন, তা বোঝানো যেত।
No comments