পুরনো দিল্লীর অলি গলি… by ওয়াসীম সোবহান চৌধুরী

পুরনো দিল্লীর অলিগলিতে আমি হেঁটে বেড়াই, যেমন কয়েক শতাব্দী ধরে অনবরত হাঁটছে কবি গালিব, কবি ইব্রাহীম জৌক, কাওয়ালী গুরু আমীর খসরু ও সুফি নিজামুদ্দিন আউলিয়া। তাদের সাথে দেখা হয় না কিন্তু তাদের কণ্ঠ, তাদের শরীরের ঘ্রাণ আমাকে স্পর্শ করে।
পুরাতন দিল্লীওয়ালারা আর কজনবা আছে এখন! দেশ ভাগের সময় করাচি, ইসলামাবাদে তো চলে গেছে বেশীরভাগ। যারা ছিল, তারা মারা পড়েছে দাঙ্গায়।
পুরাতন দিল্লীওয়ালাদের পুরাতন ধাত, দেমাগি মেজাজ, চোস্ত ডায়লেক্ট, সুগন্ধি তামাকের টান কি আছে এখন? কিছু নিশ্চয়ই আছে। আমি সেই অল্প পরিমাণ ধাত, মেজাজ, ডায়লেক্ট আর তামাকের টানে দিল্লীকে অনুভব করি আর পুলকিত হই। অলিগলি থেকে খণ্ড-খণ্ড গজল আর উর্দু শায়েরী ভেসে আসছে কি? হবে হয়তো।
পুরনো দিল্লী নিয়ন আলোয় neonaloy
জামে মসজিদ
জামে মসজিদ। মুঘল সম্রাট শাহজাহান ১৬৪৪ থেকে ১৬৫৬ সালের মধ্যে মসজিদটি তৈরি করেন। খরচ হয় প্রায় ১০ লক্ষ রুপি। আদি নাম ছিল মসজিদ-ই জাহান-নুমা, যার অর্থ ‘জগতের প্রতিবিম্ব মসজিদ’। মসজিদ প্রাঙ্গণে ২৫,০০০ মানুষ এক সাথে নামাজ পড়তে পারেন।
পুরনো দিল্লী নিয়ন আলোয় neonaloy
করিম’স
পুরনো দিল্লীর জামে মসজিদের পাশের এক গলিতে করিম’স দাঁড়িয়ে আছে মুঘল সাম্রাজ্য পতনের চিহ্ন নিয়ে। বাহাদুর শাহ জাফরকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যরা যখন চূড়ান্ত নাজেহাল করল এবং রাজপ্রাসাদের বাইরে নিয়ে এসে সাধারণ মানুষের কাতারে এনে ফেলল তখন শুধু মোঘল সাম্রাজ্যের সূর্য নেভেনি, সাথে সাথে নিভেছে রাজপ্রাসাদের ভেতরে থাকা কর্মচারীদের। অন্য অনেকের মতো রাজদরবারের অন্যতম প্রধান পাচক মোহাম্মদ আজিজ হয়ে পড়লেন চাকরীচ্যুত যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লালকেল্লা দখল নিয়ে নিল। মোহাম্মদ আজিজ যা পারেন তাই নিয়ে সামনে এগুতে চাইলেন; লালকেল্লার একটু দূরে, জামা মসজিদের পাশ ঘিরে একটা জায়গায় তিনি খাবার তৈরি করে স্থানীয় মানুষদের কাছে বেচতে শুরু করলেন। পরবর্তীতে তার ছেলে করিম উদ্দিন বাবার সেই উদ্যোগকে বিজনেস কেইসে রূপান্তর করে সেই স্থানে একটি খাবারের দোকান খুলে ফেললেন।
পুরনো দিল্লী নিয়ন আলোয় neonaloy
লাল কেল্লা
লাল কেল্লা, ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাট শাহ জাহান যমুনা নদীর তীরে শুরু করেন লাল কেল্লার নির্মাণ। ওস্তাদ আহমেদ লহরী ছিলেন এর স্থপতি; এই ওস্তাদ আহমেদ লহরী তাজমহলেরও স্থপতি। ৫৫ একর জায়গা নিয়ে এই দুর্গ তৈরি করা হয়েছিল যার প্রথম নাম ছিল কেল্লা ই মোবারক। মোঘল সাম্রাজ্যের পতাকা ও ক্ষমতা তথা লাল কেল্লার জৌলুস কমতে থাকে শাহ জাহান পুত্র আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর। ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে পারস্য সম্রাট নাদির শাহ দখল করে নেন এ কেল্লা, লুট করেন এর ভেতরে থাকা সকল সম্পদ, ধ্বংস করেন যা নিতে পারেননি; বাকি যা কিছু ছিল, ব্রিটিশরা ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে কেল্লা দখল করে তা ধ্বংস করে, মুঘল সম্রাটের বাসভবনকে বানায় আস্তাবল; লাল কেল্লার চূড়ান্ত অবমাননা এবং ধ্বংসের সাথে সাথে অস্ত যায় মুঘল সাম্রাজ্যের পতাকা।
নেই আর সেই সুদিন। এখানকার মুসলমান ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় মনোযোগী নয়, তারা ফটকাবাজারি আর দালালীতে মন দিয়েছে। প্রবীণরা অতীত প্রজন্মের স্বর্ণযুগের স্মৃতি রোমন্থন করেন কবুতর বাজি করে করে।
পুরনো দিল্লী নিয়ন আলোয় neonaloy
আমার জানা আছে অসংখ্য সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন দেখেছে এই দিল্লী। বিগত শতাব্দীগুলোতে হিন্দু রাজপুত শাসক থেকে শুরু করে আফগান, মোঘল, তুর্কি, এবং ব্রিটিশরা দখল করেছে দিল্লী; যদিও শেষমেশ রাখতে পারেনি কেউ। তবে জ্ঞাতসারে অজ্ঞাতসারে রেখে গেছে সংস্কৃতি, কৃষ্টি, শিল্পকলা, রন্ধনচর্চা। তাই দিল্লীর অলি গলির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানান সাম্রাজ্যের উত্থান পতনের চিহ্ন।
আর আছে মোগল সম্রাট আকবরের রেখে যাওয়া শখ – ‘ইসকবাজি’, যেখানে একজনের কবুতরের ঝাঁক অন্য কবুতরের সঙ্গে খেলা দেখাতে দেখাতে নিজের ঝাঁকের সঙ্গে নিয়ে আসার কৌশল নিয়ে হার-জিত নির্ধারণ হয়।
পুরনো দিল্লী নিয়ন আলোয় neonaloy
মির্জা গালিবের সমাধি
আমি হাঁটি; হেঁটে পার হই জাম-এ মসজিদ, মতি মহল, ইউসুফ সরাই, খুনী দারোয়াজা, কাশ্মীরি বাজওয়ান রেস্টুরেন্ট আর পার হই শতাব্দীর পর শতাব্দী। আমার সাথে হাটে কবি গালিব, কবি ইব্রাহীম জৌক, কাওয়ালী গুরু আমীর খসরু ও সুফি নিজামউদ্দিন আউলিয়া।
যে যার মত করে হাঁটি, একে অন্যের ধ্যান নষ্ট করি না।

No comments

Powered by Blogger.