রোহিঙ্গা সংকট আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি: -জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী
আঞ্চলিক
নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে ওঠা রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে জাতিসংঘের সাধারণ
পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে নতুন চার দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোহিঙ্গা সমস্যার অনিশ্চয়তার বিষয়টি অনুধাবন
করার জন্য তিনি বিশ্ব সমপ্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন,
বাংলাদেশের সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিষয়টি এখন আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয় হয়ে
দাঁড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান স্থান সংকট এবং পরিবেশগত অবক্ষয়ের কারণে ক্যাম্প
এলাকার পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। স্থানীয় সময়
শুক্রবার (বাংলাদেশ সময় শনিবার ভোরে) বিকালে জেনারেল অ্যাসেম্বলি হলে
অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যান্য বারের মত এবারও
বাংলায় ভাষণ দেন। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সরকার প্রধানের উত্থাপিত
প্রস্তাবের চার দফা হচ্ছে- প্রথমত: রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন এবং
আত্মীকরণে মিয়ানমারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক সদিচ্ছার
পূর্ণ প্রতিফলন দেখাতে হবে। দ্বিতীয়ত: বৈষম্যমূলক আইন ও রীতি বিলোপ করে
মিয়ানমারে ফেরার জন্য রোহিঙ্গাদের আস্থা তৈরি করতে হবে এবং রোহিঙ্গা
প্রতিনিধিদের উত্তর রাখাইন সফরের আয়োজন করতে হবে। তৃতীয়ত: আন্তর্জাতিক
সমপ্রদায় হতে বেসামরিক পর্যবেক্ষক মোতায়েনের মাধ্যমে মিয়ানমার কর্তৃক
রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। চতুর্থ এবং
সর্বশেষ প্রস্তাব হচ্ছে- আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের অবশ্যই রোহিঙ্গা সমস্যার
মূল কারণসমূহ বিবেচনায় আনতে হবে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অন্যান্য নৃশংসতার
দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। এর আগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশন
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কফি আনান কমিশনের সুপারিশসমূহের পূর্ণ বাস্তবায়ন
এবং রাখাইন প্রদেশে বেসামরিক তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় (সেফ জোন)
প্রতিষ্ঠাসহ পাঁচ-দফা প্রস্তাব পেশ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করে বলেন, এটি বাস্তবিকপক্ষেই দুঃখজনক যে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান না হওয়ায় আজ এই মহান সভায় এ বিষয়টি আমাকে পুনরায় উত্থাপন করতে হচ্ছে। ১১ লাখ রোহিঙ্গা আমাদের আশ্রয়ে রয়েছে। যারা হত্যা ও নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা প্রলম্বিত হয়ে তৃতীয় বছরে পদার্পণ করেছে, কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও চলাফেরার স্বাধীনতা এবং সামগ্রিকভাবে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফিরে যায়নি। এই সমস্যার অনিশ্চয়তার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে অনুধাবনের অনুরোধ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সমস্যা এখন আর বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। বাংলাদেশের সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিষয়টি এখন আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু, ক্রমবর্ধমান স্থান সঙ্কট এবং পরিবেশগত অবক্ষয়ের কারণে এই এলাকার পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যুকে মিয়ানমার এবং তাঁদের নিজস্ব জনগণের সমস্যা আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এমন একটি সমস্যার বোঝা বহন করে চলেছি যা মিয়ানমারের তৈরি। এটি সর্ম্পূর্ণ মিয়ানমার এবং তার নিজস্ব নাগরিক রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সমস্যা।
তাদের নিজেদেরই এর সমাধান করতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, সুরক্ষিত ও সম্মানের সঙ্গে স্বেচ্ছায় রাখাইনে নিজ গৃহে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের আলাপ-আলোচনা অব্যাহত থাকবে বলেও বিশ্বকে জানান। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে রোহিঙ্গা সংকট ছাড়াও বিভিন্ন বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবেলায় বিশেষ করে নিরাপদ অভিবাসন, উদ্বাস্তু সমস্যা, জলবায়ু পরিবর্তন, এসডিজি এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিষয়ে তার সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন। বাঙ্গালীদের মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের প্রসঙ্গ আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় দোসরদের পরিচালিত গণহত্যায় ৩০ লাখ নিরপরাধ মানুষ নিহত এবং ২ লাখ নারী নির্যাতনের শিকার হন। আমাদের এই নির্মম অভিজ্ঞতাই সব সময় আমাদের নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়াতে সাহস যুগিয়েছে। যতদিন পর্যন্ত আমাদের ফিলিস্তিনী ভাই-বোনদের ন্যায়সঙ্গত ও বৈধ সংগ্রাম সফল না হচ্ছে, ততদিন তাদের পক্ষে আমাদের দৃঢ় অবস্থান অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে শেখ হাসিনা তার ভাষণে বলেন, বাংলাদেশে আমরা মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে তা শুরু হতে যাচ্ছে। তার দর্শন ও চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটিয়ে আগামী বছর জাতিসংঘে আমরা এ উৎসব উদযাপন করতে চাই। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের গতিশীল নেতৃত্বের জন্য তার প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের ভূমিকা অপরিসীম। আমরা শান্তির সংস্কৃতি ধারণাকে নিয়মিতভাবে উত্থাপন করে আসছি। সময়ের পরিক্রমায় বর্তমানে এটি জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপাদ্যে পরিণত হয়েছে। এ মাসের শুরুতে এই সভাকক্ষেই কালচার অব পিস ঘোষণার ২০ বছর পূর্তি উদযাপনের কথা স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয়: এদিকে জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা উল্লেখ করে বলেন, এতে মানুষের মনে শান্তি ও স্বস্তি ফিরে এসেছে। ফলে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। একটি শক্তিশালী বহুপাক্ষিক ফোরাম হিসেবে জাতিসংঘের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন সর্বদা অব্যাহত থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আমরা এর সংগঠন এবং সনদে বর্ণিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সদা প্রস্তুত। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী মোতায়েনে জাতিসংঘের আহ্বানে নিয়মিতভাবে সাড়া প্রদান করে আসছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। বৈশ্বিক শান্তিরক্ষা কার্যক্রমকে ভবিষ্যতের উপযোগী করে তুলতে জাতিসংঘ মহাসচিব গৃহীত উদ্যোগের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার ‘অ্যাকশন ফর পিস কিপিং’ উদ্যোগ বাস্তবায়নের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা অন্যতম চ্যাম্পিয়ন দেশ হিসেবে ঐ উদ্যোগে সামিল হয়েছি। এছাড়া, ‘টেকসই শান্তি’-এর ধারণাগত কাঠামো প্রণয়নেও আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছি। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, বহুপাক্ষিকতাবাদ বৈশ্বিক সমস্যা সমাধান এবং সর্বজনীন মঙ্গলের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। বিশ্বে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধির জন্য জাতিসংঘই আমাদের সকল আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।
ঢাকায় জলবায়ু কেন্দ্র স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে: ওদিকে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সদ্য সমাপ্ত ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিট’র মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক যে কার্যক্রম গ্রহণের ঘোষণা এসেছে তা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের অংশ হিসেবে প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নকে আরও বেগবান করবে। ‘ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স এন্ড অ্যাডাপটেশন’ সংক্রান্ত জোটের অংশীদার হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানা বাধা-বিপত্তি ও দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ রূপান্তরযোগ্য এবং জলবায়ু-সহনশীল প্রযুক্তি ও শস্য উদ্ভাবন করেছে এবং এ নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, অভিযোজন ও সহনশীলতার জন্য আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ডেল্টাপ্ল্যান-২১০০ গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি অর্থ-প্রযুক্তিগত, সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এতে খাদ্য নিরাপত্তা, নিরাপদ পানি, জলবায়ু পরিবর্তন, টেকসই পরিবেশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং সমপ্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপটেশন’ সভার ঘোষণা অনুযায়ী আমরা ঢাকায় একটি গ্লোবাল সেন্টার ফর অ্যাডাপটেশন’ স্থাপনের জন্য কাজ করছি, বলেন প্রধানমন্ত্রী। অভিবাসন সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ নিরাপদ, সুষ্ঠু ও নিয়মিত অভিবাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘গ্লোবাল কমপ্যাক্ট অন মাইগ্রেশন’ সফলভাবে গৃহীত হওয়ার পর, বাংলাদেশ এটি বাস্তবায়নের কার্যবিধি প্রণয়ন করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ অভিবাসনের বিভিন্ন ইস্যুকে জাতীয় উন্নয়ন কৌশলের সঙ্গে অঙ্গীভূত করেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। অনিয়মিত অভিবাসন ও মানবপাচারকে বৈশ্বিক সমস্যা আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর মূলে রয়েছে জটিল ও সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্র। জাতীয় পর্যায়ে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন এবং মানবপাচার সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমপ্রতি মানবপাচার বিষয়ক ‘পালেরমো প্রোটোকল’-এ যোগদান করেছে।
প্রধানমন্ত্রী তার দীর্ঘ ভাষণে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ফিরিস্তি বিশ্ববাসীর বিবেচনায় উপস্থাপন করেন। বলেন, এ কারণেই বাংলাদেশের মানুষ টানা তৃতীয়বারের মত তাকে সরকার গঠনের ম্যান্ডেড দিয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের ২১ দফার রাজনৈতিক অঙ্গীকার মূলত জনগণের কল্যাণের নিমিত্তে গৃহীত অঙ্গীকার। প্রধানমন্ত্রী প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সমুদ্র সীমার শান্তিপূর্ণ সমাধানে বাংলাদেশের জন্য সুনীল অর্থনীতি তথা ব্লু-ইকোনমির সম্ভাবনার আরেকটি নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে বলেও উল্লেখ করেন। দেশের ৯৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মূলনীতিকে উপজীব্য করে আমরা রূপপুরে আমাদের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছি। তিনি বলেন, পারমাণবিক শক্তির শান্তি ব্যবহারের প্রতি অঙ্গীকার মূলত পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থানেরই বলিষ্ঠ প্রতিফলন। আমরা সমপ্রতি ২৬তম দেশ হিসেবে ‘ট্রিটি অন দ্যা প্রহিবিশিন অব নিউক্লিয়ার উইপন্স’ অনুস্বাক্ষর করেছি। শেখ হাসিনা তার ভাষণে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাতিসংঘের ৭৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে মানব সভ্যতার জন্য একটি শক্তিশালী জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠায় সকলকে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।
রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করে বলেন, এটি বাস্তবিকপক্ষেই দুঃখজনক যে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান না হওয়ায় আজ এই মহান সভায় এ বিষয়টি আমাকে পুনরায় উত্থাপন করতে হচ্ছে। ১১ লাখ রোহিঙ্গা আমাদের আশ্রয়ে রয়েছে। যারা হত্যা ও নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা প্রলম্বিত হয়ে তৃতীয় বছরে পদার্পণ করেছে, কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও চলাফেরার স্বাধীনতা এবং সামগ্রিকভাবে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফিরে যায়নি। এই সমস্যার অনিশ্চয়তার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে অনুধাবনের অনুরোধ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সমস্যা এখন আর বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। বাংলাদেশের সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিষয়টি এখন আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু, ক্রমবর্ধমান স্থান সঙ্কট এবং পরিবেশগত অবক্ষয়ের কারণে এই এলাকার পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যুকে মিয়ানমার এবং তাঁদের নিজস্ব জনগণের সমস্যা আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এমন একটি সমস্যার বোঝা বহন করে চলেছি যা মিয়ানমারের তৈরি। এটি সর্ম্পূর্ণ মিয়ানমার এবং তার নিজস্ব নাগরিক রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সমস্যা।
তাদের নিজেদেরই এর সমাধান করতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, সুরক্ষিত ও সম্মানের সঙ্গে স্বেচ্ছায় রাখাইনে নিজ গৃহে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের আলাপ-আলোচনা অব্যাহত থাকবে বলেও বিশ্বকে জানান। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে রোহিঙ্গা সংকট ছাড়াও বিভিন্ন বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবেলায় বিশেষ করে নিরাপদ অভিবাসন, উদ্বাস্তু সমস্যা, জলবায়ু পরিবর্তন, এসডিজি এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিষয়ে তার সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন। বাঙ্গালীদের মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের প্রসঙ্গ আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় দোসরদের পরিচালিত গণহত্যায় ৩০ লাখ নিরপরাধ মানুষ নিহত এবং ২ লাখ নারী নির্যাতনের শিকার হন। আমাদের এই নির্মম অভিজ্ঞতাই সব সময় আমাদের নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়াতে সাহস যুগিয়েছে। যতদিন পর্যন্ত আমাদের ফিলিস্তিনী ভাই-বোনদের ন্যায়সঙ্গত ও বৈধ সংগ্রাম সফল না হচ্ছে, ততদিন তাদের পক্ষে আমাদের দৃঢ় অবস্থান অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে শেখ হাসিনা তার ভাষণে বলেন, বাংলাদেশে আমরা মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে তা শুরু হতে যাচ্ছে। তার দর্শন ও চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটিয়ে আগামী বছর জাতিসংঘে আমরা এ উৎসব উদযাপন করতে চাই। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের গতিশীল নেতৃত্বের জন্য তার প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের ভূমিকা অপরিসীম। আমরা শান্তির সংস্কৃতি ধারণাকে নিয়মিতভাবে উত্থাপন করে আসছি। সময়ের পরিক্রমায় বর্তমানে এটি জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপাদ্যে পরিণত হয়েছে। এ মাসের শুরুতে এই সভাকক্ষেই কালচার অব পিস ঘোষণার ২০ বছর পূর্তি উদযাপনের কথা স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয়: এদিকে জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা উল্লেখ করে বলেন, এতে মানুষের মনে শান্তি ও স্বস্তি ফিরে এসেছে। ফলে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। একটি শক্তিশালী বহুপাক্ষিক ফোরাম হিসেবে জাতিসংঘের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন সর্বদা অব্যাহত থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আমরা এর সংগঠন এবং সনদে বর্ণিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সদা প্রস্তুত। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী মোতায়েনে জাতিসংঘের আহ্বানে নিয়মিতভাবে সাড়া প্রদান করে আসছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। বৈশ্বিক শান্তিরক্ষা কার্যক্রমকে ভবিষ্যতের উপযোগী করে তুলতে জাতিসংঘ মহাসচিব গৃহীত উদ্যোগের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার ‘অ্যাকশন ফর পিস কিপিং’ উদ্যোগ বাস্তবায়নের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা অন্যতম চ্যাম্পিয়ন দেশ হিসেবে ঐ উদ্যোগে সামিল হয়েছি। এছাড়া, ‘টেকসই শান্তি’-এর ধারণাগত কাঠামো প্রণয়নেও আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছি। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, বহুপাক্ষিকতাবাদ বৈশ্বিক সমস্যা সমাধান এবং সর্বজনীন মঙ্গলের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। বিশ্বে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধির জন্য জাতিসংঘই আমাদের সকল আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।
ঢাকায় জলবায়ু কেন্দ্র স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে: ওদিকে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সদ্য সমাপ্ত ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিট’র মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক যে কার্যক্রম গ্রহণের ঘোষণা এসেছে তা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের অংশ হিসেবে প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নকে আরও বেগবান করবে। ‘ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স এন্ড অ্যাডাপটেশন’ সংক্রান্ত জোটের অংশীদার হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানা বাধা-বিপত্তি ও দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ রূপান্তরযোগ্য এবং জলবায়ু-সহনশীল প্রযুক্তি ও শস্য উদ্ভাবন করেছে এবং এ নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, অভিযোজন ও সহনশীলতার জন্য আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ডেল্টাপ্ল্যান-২১০০ গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি অর্থ-প্রযুক্তিগত, সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এতে খাদ্য নিরাপত্তা, নিরাপদ পানি, জলবায়ু পরিবর্তন, টেকসই পরিবেশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং সমপ্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপটেশন’ সভার ঘোষণা অনুযায়ী আমরা ঢাকায় একটি গ্লোবাল সেন্টার ফর অ্যাডাপটেশন’ স্থাপনের জন্য কাজ করছি, বলেন প্রধানমন্ত্রী। অভিবাসন সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ নিরাপদ, সুষ্ঠু ও নিয়মিত অভিবাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘গ্লোবাল কমপ্যাক্ট অন মাইগ্রেশন’ সফলভাবে গৃহীত হওয়ার পর, বাংলাদেশ এটি বাস্তবায়নের কার্যবিধি প্রণয়ন করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ অভিবাসনের বিভিন্ন ইস্যুকে জাতীয় উন্নয়ন কৌশলের সঙ্গে অঙ্গীভূত করেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। অনিয়মিত অভিবাসন ও মানবপাচারকে বৈশ্বিক সমস্যা আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর মূলে রয়েছে জটিল ও সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্র। জাতীয় পর্যায়ে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন এবং মানবপাচার সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমপ্রতি মানবপাচার বিষয়ক ‘পালেরমো প্রোটোকল’-এ যোগদান করেছে।
প্রধানমন্ত্রী তার দীর্ঘ ভাষণে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ফিরিস্তি বিশ্ববাসীর বিবেচনায় উপস্থাপন করেন। বলেন, এ কারণেই বাংলাদেশের মানুষ টানা তৃতীয়বারের মত তাকে সরকার গঠনের ম্যান্ডেড দিয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের ২১ দফার রাজনৈতিক অঙ্গীকার মূলত জনগণের কল্যাণের নিমিত্তে গৃহীত অঙ্গীকার। প্রধানমন্ত্রী প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সমুদ্র সীমার শান্তিপূর্ণ সমাধানে বাংলাদেশের জন্য সুনীল অর্থনীতি তথা ব্লু-ইকোনমির সম্ভাবনার আরেকটি নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে বলেও উল্লেখ করেন। দেশের ৯৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মূলনীতিকে উপজীব্য করে আমরা রূপপুরে আমাদের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছি। তিনি বলেন, পারমাণবিক শক্তির শান্তি ব্যবহারের প্রতি অঙ্গীকার মূলত পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থানেরই বলিষ্ঠ প্রতিফলন। আমরা সমপ্রতি ২৬তম দেশ হিসেবে ‘ট্রিটি অন দ্যা প্রহিবিশিন অব নিউক্লিয়ার উইপন্স’ অনুস্বাক্ষর করেছি। শেখ হাসিনা তার ভাষণে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাতিসংঘের ৭৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে মানব সভ্যতার জন্য একটি শক্তিশালী জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠায় সকলকে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।
No comments