সম্প্রচার নীতিমালা হস্তক্ষেপমূলক by মাহ্ফুজ আনাম
বিশেষ সাক্ষাৎকার: সরকার প্রণীত জাতীয়
সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা লক্ষ করা গেছে। এই
পরিপ্রেক্ষিতে ডেইলি স্টার–এর সম্পাদক ও প্রকাশক মাহ্ফুজ আনামের সাক্ষাৎকার
প্রকাশ করা হলো
>>>সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম
প্রথম আলোঃ সম্প্রতি মন্ত্রিসভা একটি সম্প্রচার নীতিমালা অনুমোদন করেছে। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই নীতিমালা সম্প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করবে। সরকার বলছে, তা করবে না। আপনি কী বলেন?
মাহ্ফুজ আনামঃ এই নীতিমালা সম্পূর্ণভাবে হস্তক্ষেপমূলক। এটা বিভিন্নভাবে সম্প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করবে। এতে যেসব ধারা আছে, সেগুলোর অধিকাংশই সম্প্রচারের বিষয় বা আধেয় (কনটেন্ট) সম্পর্কে। কী প্রচার করা যাবে আর কী প্রচার করা যাবে না, তা এমনভাবে নির্দেশ করা হয়েছে যে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ধারাগুলো নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করে যেকোনো কিছুকেই নীতিমালার পরিপন্থী বলে অভিযোগ করতে পারবে।
প্রথম আলোঃ যেমন?
মাহ্ফুজ আনামঃ যেমন একটি ধারা আছে এ রকম: রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে—এমন ধরনের সামরিক, বেসামরিক বা সরকারি তথ্য প্রচার করা যাবে না। এখন এটার সংজ্ঞা কে দেবে? কী ধরনের তথ্য প্রচার করলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, এটা নির্ধারণ করবে কে? এটা তো যেমন ইচ্ছা তেমন করে ব্যাখ্যা করা যায়। ধরুন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ভীষণভাবে নেমে যাচ্ছে, এর ফলে ভীষণ খরা হতে পারে, কৃষিতে সেচসংকট হতে পারে, ফসল উৎপাদন ভীষণভাবে কমে গিয়ে দুর্ভিক্ষ লেগে যেতে পারে। আপনি তো বলতে পারেন, এই তথ্যে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে; কারণ, খাদ্যসংকট আর দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রচার করা হচ্ছে। এ রকম নানা ধরনের ব্যাখ্যা দিয়ে সম্প্রচারমাধ্যমের যেকোনো আচরণকেই নীতিমালা পরিপন্থী বলার হাতিয়ার তৈরি করা হয়েছে।
প্রথম আলোঃ অর্থাৎ নীতিমালার ধারাগুলো অস্পষ্ট বা এমন যে সেগুলো দেখিয়ে সরকার যেকোনো সম্প্রচারিত বিষয়কেই নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা করতে পারবে? এবং সেই সুবাদে সম্প্রচারমাধ্যমের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারবে?
মাহ্ফুজ আনামঃ হ্যাঁ। এ রকম আরও কিছু বিষয় দেখুন, একটি ধারায় লেখা আছে, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও অপরাধীদের দণ্ডবিধানে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে—এমন কোনো দৃশ্য বা বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। এ রকম নীতিমালা থাকলে ১০ ট্রাক অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা সম্পর্কে কিছুই প্রচার করা যেত না, কারণ ওই ঘটনায় এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ছিল। এটা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকেই জানা গেছে। এ রকম নীতিমালা থাকলে সেটা মানতে হলে ২০০৫ সালে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে সম্প্রচারমাধ্যমে কিছুই প্রচার করা যেত না। কারণ, তাতে এ ঘটনায় পুলিশের তিন সাবেক মহাপরিদর্শক, এনএসআইয়ের দুজন সাবেক প্রধান ও সিআইডির তিন সাবেক কর্মকর্তাসহ সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টতা ছিল এবং এ-সংক্রান্ত মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে। ডিজিএফআই, এনএসআই ইত্যাদি সরকারি সংস্থা ও সরকারের অনেক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ভাবমূর্তি বিনষ্ট হতো। একইভাবে নারায়ণগঞ্জে সাত ব্যক্তির অপহরণ ও খুনের ঘটনায় জড়িত র্যাবের সদস্যদের বিষয়ে সম্প্রচারমাধ্যমে কিছুই প্রচার করা যেত না, কারণ তাতে র্যাবের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতো। এই নীতিমালা মানতে হলে পুলিশ বা র্যাবের হেফাজতে নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ক্ষমতার অপব্যহার ইত্যাদি সম্পর্কেও কিছু সম্প্রচার করা যাবে না, কারণ তাতে ওই সংস্থাগুলোর ‘ভাবমূর্তি বিনষ্ট’ হবে। এই নীতিমালা থাকলে র্যাবের সদস্যদের গুলিতে পা হারানো কিশোর লিমন সম্পর্কে, কিংবা মিরপুর থানার পুলিশের এক সাব-ইন্সপেক্টরের নির্যাতনে এক ঝুট ব্যবসায়ীর মৃত্যুসহ অজস্র ক্ষমতা অপব্যবহারের ঘটনা সম্পর্কে সম্প্রচারমাধ্যমে কিছুই প্রচার করা যেত না।
প্রথম আলোঃ একটি ধারায় বলা হয়েছে, সম্প্রচারের ক্ষেত্রে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা, রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও নীতিমালা সমুন্নত রাখতে হবে। এটা সম্পর্কে আপনার কী বক্তব্য?
মাহ্ফুজ আনামঃ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা তো সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, যেখানে অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, সরকারি দমনপীড়ন ইত্যাদি থাকবে না। যেখানে আইন সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য হবে, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারবে না। কিন্তু সম্প্রচার নীতিমালা তো এগুলোর ক্ষেত্রে সম্প্রচারমাধ্যমের যথাযথ দায়িত্ব পালনেই প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে।
প্রথম আলোঃ নীতিমালা ছাড়াই তো সম্প্রচারমাধ্যম দিব্যি চলছে। সরকার কেন এটা করতে গেল?
মাহ্ফুজ আনামঃ দেশে অনেকগুলো ক্ষেত্রে গুরুতর জাতীয় সমস্যা আছে। যেমন, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ, প্রতিবছর বর্ষাকালে লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে, খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের ফলে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে, ভেজাল ওষুধে বাজার সয়লাব, নকল প্যারাসিটামল খেয়ে অনেক শিশু মারা গেছে। এগুলোই হওয়া উচিত সরকারের অগ্রাধিকার। কিন্তু এসব দিকে নজর না দিয়ে কেন সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে তারা এত উৎসাহিত হয়ে উঠল, এটাই প্রশ্ন। এমনিতেই কিন্তু গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য মানহানি-সম্পর্কিত আইনসহ বিভিন্ন রকমের আইন ও বিধিবিধান আছে। সেগুলোই কিন্তু যথেষ্ট। সম্প্রচারমাধ্যমের জন্য নতুন করে এই নীতিমালার প্রয়োজন ছিল না।
প্রথম আলোঃ এই নীতিমালার ভিত্তিতে একটা সম্প্রচার আইন প্রণয়ন ও গ্রহণ করা হবে বলে জানা গেছে...।
মাহ্ফুজ আনামঃ এ রকম একটা নীতিমালাকে যদি সম্প্রচার আইন প্রণয়নের ভিত্তি ধরি, তাহলে সেই আইন হবে স্বাধীন সাংবাদিকতার সম্পূর্ণ বিরোধী; সম্প্রচারমাধ্যমের ওপর একটা কালাকানুন চাপিয়ে দেওয়া হবে। তাই আমি সম্পূর্ণভাবে এর বিরোধী। আসলে কোনো শিল্প সম্পর্কে নীতিমালা বা আইনে এমন কিছু প্রতিশ্রুতি থাকতে হয়, যা ওই শিল্পের জন্য বিধিনিষেধের পাশাপাশি ওই শিল্পকে কিছু সুরক্ষাও দেবে। এই সম্প্রচার নীতিমালায় সম্প্রচারমাধ্যমের সুরক্ষা সম্পর্কে একটি প্রতিশ্রুতিও নেই। যাঁরা এই শিল্পে বিনিয়োগ করবেন, তাঁদের বিনিয়োগকে সুরক্ষা দেওয়া বা উৎসাহিত করার কোনো প্রসঙ্গই এতে নেই। এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে এ দেশের সম্প্রচারমাধ্যমের বিকাশ থেমে যাবে; বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোও বিটিভির মতো হবে। ফলে দর্শক দেশি টিভি চ্যানেলগুলোর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে বিদেশি চ্যানেলগুলোর প্রতি আরও বেশি মাত্রায় ঝুঁকে পড়বে। তাতে সম্প্রচারমাধ্যমের ভীষণ ক্ষতি হবে।
প্রথম আলোঃ তাহলে কী করা উচিত?
মাহ্ফুজ আনামঃ এই নীতিমালা প্রণয়ন ও গ্রহণের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে, তাও ঠিক নয়। প্রথমে একটি আইনের মাধ্যমে একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন করা উচিত, সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়নের দায়িত্ব হবে সেই কমিশনের। কমিশন সম্প্রচারমাধ্যমের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা-পরামর্শ করে এমন একটি সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করবে, যেটি হবে সম্প্রচারমাধ্যম বিকাশের সহায়ক, উল্টোটা নয়, নিয়ন্ত্রণমূলক নয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে, সেই নীতিমালার আলোকে একটি সম্প্রচার আইন প্রণীত হবে, যার লক্ষ্য হবে সম্প্রচারমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাকে সুরক্ষা দেওয়া। সম্প্রচার আইনটিকে হতে হবে এমন, যা সম্প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে, তা কোনোভাবে খর্ব করবে না বা সম্প্রচারমাধ্যমের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করবে না। বরং সরকার বা যেকোনো পক্ষ সম্প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা করলে সম্প্রচার আইন তার স্বাধীনতা রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।
প্রথম আলোঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মাহ্ফুজ আনামঃ আপনাকেও ধন্যবাদ।
>>>সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম
প্রথম আলোঃ সম্প্রতি মন্ত্রিসভা একটি সম্প্রচার নীতিমালা অনুমোদন করেছে। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই নীতিমালা সম্প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করবে। সরকার বলছে, তা করবে না। আপনি কী বলেন?
মাহ্ফুজ আনামঃ এই নীতিমালা সম্পূর্ণভাবে হস্তক্ষেপমূলক। এটা বিভিন্নভাবে সম্প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করবে। এতে যেসব ধারা আছে, সেগুলোর অধিকাংশই সম্প্রচারের বিষয় বা আধেয় (কনটেন্ট) সম্পর্কে। কী প্রচার করা যাবে আর কী প্রচার করা যাবে না, তা এমনভাবে নির্দেশ করা হয়েছে যে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ধারাগুলো নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করে যেকোনো কিছুকেই নীতিমালার পরিপন্থী বলে অভিযোগ করতে পারবে।
প্রথম আলোঃ যেমন?
মাহ্ফুজ আনামঃ যেমন একটি ধারা আছে এ রকম: রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে—এমন ধরনের সামরিক, বেসামরিক বা সরকারি তথ্য প্রচার করা যাবে না। এখন এটার সংজ্ঞা কে দেবে? কী ধরনের তথ্য প্রচার করলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, এটা নির্ধারণ করবে কে? এটা তো যেমন ইচ্ছা তেমন করে ব্যাখ্যা করা যায়। ধরুন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ভীষণভাবে নেমে যাচ্ছে, এর ফলে ভীষণ খরা হতে পারে, কৃষিতে সেচসংকট হতে পারে, ফসল উৎপাদন ভীষণভাবে কমে গিয়ে দুর্ভিক্ষ লেগে যেতে পারে। আপনি তো বলতে পারেন, এই তথ্যে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে; কারণ, খাদ্যসংকট আর দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রচার করা হচ্ছে। এ রকম নানা ধরনের ব্যাখ্যা দিয়ে সম্প্রচারমাধ্যমের যেকোনো আচরণকেই নীতিমালা পরিপন্থী বলার হাতিয়ার তৈরি করা হয়েছে।
প্রথম আলোঃ অর্থাৎ নীতিমালার ধারাগুলো অস্পষ্ট বা এমন যে সেগুলো দেখিয়ে সরকার যেকোনো সম্প্রচারিত বিষয়কেই নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা করতে পারবে? এবং সেই সুবাদে সম্প্রচারমাধ্যমের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারবে?
মাহ্ফুজ আনামঃ হ্যাঁ। এ রকম আরও কিছু বিষয় দেখুন, একটি ধারায় লেখা আছে, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও অপরাধীদের দণ্ডবিধানে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে—এমন কোনো দৃশ্য বা বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। এ রকম নীতিমালা থাকলে ১০ ট্রাক অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা সম্পর্কে কিছুই প্রচার করা যেত না, কারণ ওই ঘটনায় এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ছিল। এটা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকেই জানা গেছে। এ রকম নীতিমালা থাকলে সেটা মানতে হলে ২০০৫ সালে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে সম্প্রচারমাধ্যমে কিছুই প্রচার করা যেত না। কারণ, তাতে এ ঘটনায় পুলিশের তিন সাবেক মহাপরিদর্শক, এনএসআইয়ের দুজন সাবেক প্রধান ও সিআইডির তিন সাবেক কর্মকর্তাসহ সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টতা ছিল এবং এ-সংক্রান্ত মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে। ডিজিএফআই, এনএসআই ইত্যাদি সরকারি সংস্থা ও সরকারের অনেক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ভাবমূর্তি বিনষ্ট হতো। একইভাবে নারায়ণগঞ্জে সাত ব্যক্তির অপহরণ ও খুনের ঘটনায় জড়িত র্যাবের সদস্যদের বিষয়ে সম্প্রচারমাধ্যমে কিছুই প্রচার করা যেত না, কারণ তাতে র্যাবের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতো। এই নীতিমালা মানতে হলে পুলিশ বা র্যাবের হেফাজতে নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ক্ষমতার অপব্যহার ইত্যাদি সম্পর্কেও কিছু সম্প্রচার করা যাবে না, কারণ তাতে ওই সংস্থাগুলোর ‘ভাবমূর্তি বিনষ্ট’ হবে। এই নীতিমালা থাকলে র্যাবের সদস্যদের গুলিতে পা হারানো কিশোর লিমন সম্পর্কে, কিংবা মিরপুর থানার পুলিশের এক সাব-ইন্সপেক্টরের নির্যাতনে এক ঝুট ব্যবসায়ীর মৃত্যুসহ অজস্র ক্ষমতা অপব্যবহারের ঘটনা সম্পর্কে সম্প্রচারমাধ্যমে কিছুই প্রচার করা যেত না।
প্রথম আলোঃ একটি ধারায় বলা হয়েছে, সম্প্রচারের ক্ষেত্রে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা, রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও নীতিমালা সমুন্নত রাখতে হবে। এটা সম্পর্কে আপনার কী বক্তব্য?
মাহ্ফুজ আনামঃ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা তো সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, যেখানে অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, সরকারি দমনপীড়ন ইত্যাদি থাকবে না। যেখানে আইন সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য হবে, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারবে না। কিন্তু সম্প্রচার নীতিমালা তো এগুলোর ক্ষেত্রে সম্প্রচারমাধ্যমের যথাযথ দায়িত্ব পালনেই প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে।
প্রথম আলোঃ নীতিমালা ছাড়াই তো সম্প্রচারমাধ্যম দিব্যি চলছে। সরকার কেন এটা করতে গেল?
মাহ্ফুজ আনামঃ দেশে অনেকগুলো ক্ষেত্রে গুরুতর জাতীয় সমস্যা আছে। যেমন, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ, প্রতিবছর বর্ষাকালে লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে, খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের ফলে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে, ভেজাল ওষুধে বাজার সয়লাব, নকল প্যারাসিটামল খেয়ে অনেক শিশু মারা গেছে। এগুলোই হওয়া উচিত সরকারের অগ্রাধিকার। কিন্তু এসব দিকে নজর না দিয়ে কেন সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে তারা এত উৎসাহিত হয়ে উঠল, এটাই প্রশ্ন। এমনিতেই কিন্তু গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য মানহানি-সম্পর্কিত আইনসহ বিভিন্ন রকমের আইন ও বিধিবিধান আছে। সেগুলোই কিন্তু যথেষ্ট। সম্প্রচারমাধ্যমের জন্য নতুন করে এই নীতিমালার প্রয়োজন ছিল না।
প্রথম আলোঃ এই নীতিমালার ভিত্তিতে একটা সম্প্রচার আইন প্রণয়ন ও গ্রহণ করা হবে বলে জানা গেছে...।
মাহ্ফুজ আনামঃ এ রকম একটা নীতিমালাকে যদি সম্প্রচার আইন প্রণয়নের ভিত্তি ধরি, তাহলে সেই আইন হবে স্বাধীন সাংবাদিকতার সম্পূর্ণ বিরোধী; সম্প্রচারমাধ্যমের ওপর একটা কালাকানুন চাপিয়ে দেওয়া হবে। তাই আমি সম্পূর্ণভাবে এর বিরোধী। আসলে কোনো শিল্প সম্পর্কে নীতিমালা বা আইনে এমন কিছু প্রতিশ্রুতি থাকতে হয়, যা ওই শিল্পের জন্য বিধিনিষেধের পাশাপাশি ওই শিল্পকে কিছু সুরক্ষাও দেবে। এই সম্প্রচার নীতিমালায় সম্প্রচারমাধ্যমের সুরক্ষা সম্পর্কে একটি প্রতিশ্রুতিও নেই। যাঁরা এই শিল্পে বিনিয়োগ করবেন, তাঁদের বিনিয়োগকে সুরক্ষা দেওয়া বা উৎসাহিত করার কোনো প্রসঙ্গই এতে নেই। এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে এ দেশের সম্প্রচারমাধ্যমের বিকাশ থেমে যাবে; বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোও বিটিভির মতো হবে। ফলে দর্শক দেশি টিভি চ্যানেলগুলোর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে বিদেশি চ্যানেলগুলোর প্রতি আরও বেশি মাত্রায় ঝুঁকে পড়বে। তাতে সম্প্রচারমাধ্যমের ভীষণ ক্ষতি হবে।
প্রথম আলোঃ তাহলে কী করা উচিত?
মাহ্ফুজ আনামঃ এই নীতিমালা প্রণয়ন ও গ্রহণের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে, তাও ঠিক নয়। প্রথমে একটি আইনের মাধ্যমে একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন করা উচিত, সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়নের দায়িত্ব হবে সেই কমিশনের। কমিশন সম্প্রচারমাধ্যমের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা-পরামর্শ করে এমন একটি সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করবে, যেটি হবে সম্প্রচারমাধ্যম বিকাশের সহায়ক, উল্টোটা নয়, নিয়ন্ত্রণমূলক নয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে, সেই নীতিমালার আলোকে একটি সম্প্রচার আইন প্রণীত হবে, যার লক্ষ্য হবে সম্প্রচারমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাকে সুরক্ষা দেওয়া। সম্প্রচার আইনটিকে হতে হবে এমন, যা সম্প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে, তা কোনোভাবে খর্ব করবে না বা সম্প্রচারমাধ্যমের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করবে না। বরং সরকার বা যেকোনো পক্ষ সম্প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা করলে সম্প্রচার আইন তার স্বাধীনতা রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।
প্রথম আলোঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মাহ্ফুজ আনামঃ আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments