দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থী সমাচার by ধীরাজ কুমার নাথ
কয়েক
দিন আগে একটি বড় রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে দলের কর্মীদের দশম জাতীয় সংসদ
নির্বাচনে দলের মনোনীত প্রার্থীকেই সমর্থন দেয়ার অনুরোধ করা হয়। সব দেশেই
দলের মনোনীত প্রার্থীকেই সমর্থন দেয়ার নিয়ম রয়েছে। বলা যায়, এটাই হচ্ছে
অনুসৃত সংস্কৃতি, যা প্রতিপালন করতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে। এটাই বহুদলীয়
সংসদীয় গণতন্ত্রের পদ্ধতি। দলের পক্ষ থেকে দলীয় প্রার্থীকে সমর্থন করার
অনুরোধ না করা হলেও এটাই হচ্ছে দলীয় নেতাদের প্রত্যাশা, দলের মধ্যে শৃংখলার
নির্দশন। এ ধরনের দলীয় রীতিনীতি থাকা সত্ত্বেও কেন এমন আবেদন করা হল। কারণ
হচ্ছে, আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী
প্রার্থীর আবির্ভাব ঘটে। দলের নিয়ম-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করে
বিদ্রোহী প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেন এবং ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে নিজ
দলের প্রার্থীকে হেয়প্রতিপন্ন করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এমনটি পৃথিবীর বৃহৎ
গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় ভাবাই যায় না। যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া,
নিউজিল্যান্ড ও ভারতসহ যেসব দেশে ওয়েস্টমিন্স্টার পদ্ধতির সরকার ও
গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বহাল আছে, সেখানে এ ধরনের বিদ্রোহী প্রার্থীর আবির্ভাব
বিরল ঘটনা। এ ধরনের গৃহতল অতিক্রম (Floor crossing) করার অর্থ হচ্ছে দলের
প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করা, যা দলীয় রাজনীতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পথে প্রধান
অন্তরায়। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এমন ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। তাই অনেকে মনে
করছেন, সঠিক প্রার্থী মনোনয়ন দিতে না পারলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে
প্রায় সব দলের মধ্য থেকে বিদ্রোহী প্রার্থীর আবির্ভাব ঘটতে পারে, যা দলীয়
রাজনীতির জন্য সৃষ্টি করবে সংকট এবং দলীয় ভাবমূর্তি রক্ষার ক্ষেত্রে ঘটবে
মহাবিপর্যয়।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এমন ঘটনার উদাহরণ বিরল হলেও এখানে দলীয় মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। প্রশ্ন হল, বাংলাদেশে এমনটি হচ্ছে কেন? এ ব্যাপারে প্রধানত দুটি কারণ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। প্রথম কারণ হচ্ছে, গৃহতল অতিক্রম করার জন্য কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেই। পক্ষান্তরে নির্বাচনে জয় লাভ করলে বিদ্রোহী প্রার্থীকে নিজেদের প্রার্থী বা সমর্থক বলে অভিনন্দিত করা হয়। কারণ হিসেবে ধরা হয়, বিদ্রোহী প্রার্থীর অনেক সমর্থক আছে, তারা অসন্তুষ্ট হবে। অথচ কোনো প্রার্থী বিদ্রোহ করলে নিয়ম হচ্ছে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা এবং তার কাছ থেকে দলীয় সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাহার এবং অসহযোগিতা প্রদানসহ সব ধরনের দলীয় ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
মার্কস ও লেনিনবাদী রাজনৈতিক দলের পদ্ধতি হচ্ছে, এমন অবাধ্যতার জন্য প্রার্থীকে দল থেকে বহিষ্কারসহ হরেক রকম শাস্তি প্রদান। তাই কমিউনিস্ট বিশ্বে মতভিন্নতার কারণে অনেকে দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় থাকে না এবং বিদ্রোহ করারও সাহস পায় না। দলীয় শৃংখলা প্রতিপালন করা হয় অত্যন্ত কঠোরভাবে। নিউজিল্যান্ডে নির্বাচনে ভোটিং পদ্ধতিতে এমএমপি (Mixed Member Proportionality) বা আনুপাতিক হারে সদস্যের হিসাব হয়। সেখানে দলচ্যুত হওয়া বা দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা দলকে পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করার শামিল।
বাংলাদেশে অনেক সময় দেখা যায়, প্রার্থী কখনো দল করেনি বা দলের জন্য এক টাকাও চাঁদা দেয়নি অথচ দল যখন ক্ষমতায় আসে তখন রাতারাতি সে দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে যায়। বিশাল বাজিকরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে টেন্ডারবাজি করতে শুরু করে এবং বিরোধীদলীয় দু-একজন নিরীহ লোককে রাস্তায় মারধর করে নিজেকে দলের আত্মনিবেদিত কর্মী হিসেবে জাহির করে। ঠিক এমনিভাবেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর অনেক তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধার আবির্ভাব ঘটেছিল। তারা স্বাধীনতা যুদ্ধের খবরও রাখেনি। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর থেকে রাতারাতি বনে যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা। তারাই জেনেভা ক্যাম্পে গিয়ে আক্রমণ করেছিল। অনেক সম্মানিত ব্যক্তির বাড়িতে হানা দিয়ে তাদের স্বাধীনতাবিরোধী আখ্যা দিয়ে সম্পত্তি দখল ও লুটপাট করতে শুরু করেছিল। আমরা তখন তাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ১৬তম ডিভিশন (16 Division FF) বলে আখ্যায়িত করেছিলাম। তাদের অনেকে আবার অত্যন্ত যতœসহকারে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে এবং এখনও নিচ্ছে। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও তাদের অনেকের পুত্র ও পৌত্রদের নাম মুক্তিযোদ্ধাদের ডিজিটাল তালিকায় সন্নিবেশিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় অনেক উদার ও মহৎ!
এসব ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে লাভ নেই। দলীয় আবেদন বা অনুশাসন না মানার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে দলের আদর্শ, লক্ষ্য বা মেনিফেস্টোর প্রতি অগাধ বিশ্বাস বা তা থেকে জনসেবার প্রতি আগ্রহ বা অনুপ্রেরণা লাভের ঘাটতি। সত্যি কথা বলতে কী, বাংলাদেশে বর্তমানে আদর্শভিত্তিক রাজনীতির বড় আকাল পড়েছে। মহারাজ ত্রৈলক্যনাথ চক্রবর্তী অথবা কমরেড মুজাফফর আহমদের মতো রাজনীতিক আর হবেন বলে মনে হয় না। এখন লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া বা টিকে থাকা। তাই নির্বাচনের আগে প্রতিশ্র“তিভিত্তিক মেনিফেস্টো তৈরি হয়, যা উন্নয়নের রাজনীতি বা বদলে দেয়ার অর্থনীতি নিয়ে দার্শনিক ভাবনায় ভরপুর। অবশ্য জনগণ তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে ভোট কেন্দ্রে যায়। কয়েক বছর যেতে না যেতে তারাই আবার ‘রাবিশ’ ও ‘বোগাস’ বলে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
আসল বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনে মনোনয়নের প্রাক্কালে প্রার্থীর যোগ্যতা যাচাই। বাংলাদেশে ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে যখন সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হচ্ছিল, তখন টাকা-পয়সার লেনদেন নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক রসালো খবর প্রকাশিত হয়েছিল। নবম সংসদ নির্বাচনেও বিত্তবান বণিক শ্রেণীর প্রার্থীরাই প্রাধান্য পেয়েছিলেন এবং সংসদে দলীয় নিবেদিত কর্মীদের পরিবর্তে বণিক শ্রেণীর সম্মানিত ব্যক্তিরাই অধিক প্রতিনিধিত্ব লাভ করেছেন। অনেকে মনে করছেন, দশম জাতীয় সংসদও ব্যতিক্রম কিছু হবে না। শেরে বাংলা নগরের সুবিশাল সংসদ ভবনে বিতর্কে অংশ নেবেন অনেক বণিক প্রতিনিধি, যাদের ছবি সরাসরি টেলিভিশনে দেখা যাবে। তারা লম্বা কাগজে একটি প্রশ্ন টাইপ করে নিয়ে গিয়ে তা সংসদে অনেক কষ্টে উপস্থাপন করবেন। প্রয়োজনে সংসদে খিস্তি খেউড় করবেন। তাতে কীবা আসে যায়! কথায় কথায় কেউ বলবেন, এমন উন্নয়ন কখনো হয়নি। অপর দল বলবে, এমন দুর্নীতি কেউ কখনো চোখে দেখেনি।
এসব কারণেই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দলীয় অনুশাসন, রীতিনীতি অনুসরণ করার প্রতি মনোযোগ নেই। কোনোভাবে মনোনয়ন পেলেই হল। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের তালিকায় নাম উঠে যাবে অনেক ওপরে। তাই তারা মনোনয়ন প্রাপ্তির জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতেও প্রস্তুত। এটাই আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের দুর্বলতম দিক। তবে একথাও সত্য, জনগণ ভোট দেয় বিচার-বিশ্লেষণ করে, একটি আদর্শকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। যেমন ১৯৫৬ সালে জনগণ তদানীন্তন পাকিস্তানে হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্টকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল গণতন্ত্র ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। প্রার্থীর পরিচয়ও জানতে চায়নি জনগণ। ভোট দিয়েছে মার্কা দেখে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে বাঙালি জনগণের সমৃদ্ধির আশায় এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচণ্ড আবেগে, যা রূপ লাভ করেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। এমনকি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জনগণ ভোট দিয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এবং বদলে দেয়ার রাজনীতি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশায়। তাই জনগণের ভরসা, এবারও যদি নতুন ধারার রাজনীতি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্র“তি কেউ দিতে পারে অথবা অর্থবহ ও বাস্তবধর্মী অগ্রগতির সঠিক নির্দেশনার পথ দেখাতে পারে, তবেই জনগণ ভোট কেন্দ্রে যাবে।
বহুদলীয় ও বহুমতের সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে এবং একে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে হলে অবশ্যই দলীয় রাজনীতিকে ইতিবাচক পথে পরিচালিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে জীবন উৎসর্গ করার মতো শিক্ষিত সমাজকর্মী, প্রকৃত জনগণের প্রতিনিধি। দলকে বণিকদের হাতে বিসর্জন দিলে দলে বাজিকরদের উপদ্রব এবং জনগণকে প্রতারিত করার প্রবণতা বাড়বে। তাই মনোনয়ন দেয়ার প্রাক্কালে দলীয় নেতারা যদি আর্থিক লেনদেনের চিন্তা বাদ দেন, তাহলে দলে বিদ্রোহী প্রার্থীর উপদ্রব হ্রাস পাবে। তখন আর দলের মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য অনুরোধ করার প্রয়োজন হবে না। একই সঙ্গে দলের মধ্যে শৃংখলা বিধান বা নির্দেশ প্রতিপালনের সংস্কৃতি তৈরি হবে। তবেই সংসদীয় ও দলীয় রাজনীতি হবে অর্থবহ। এমনটি না হলে দলীয় প্রার্থীকে ভোট দেয়ার আবেদন ফলপ্রসূ নাও হতে পারে।
ধীরাজ কুমার নাথ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এমন ঘটনার উদাহরণ বিরল হলেও এখানে দলীয় মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। প্রশ্ন হল, বাংলাদেশে এমনটি হচ্ছে কেন? এ ব্যাপারে প্রধানত দুটি কারণ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। প্রথম কারণ হচ্ছে, গৃহতল অতিক্রম করার জন্য কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেই। পক্ষান্তরে নির্বাচনে জয় লাভ করলে বিদ্রোহী প্রার্থীকে নিজেদের প্রার্থী বা সমর্থক বলে অভিনন্দিত করা হয়। কারণ হিসেবে ধরা হয়, বিদ্রোহী প্রার্থীর অনেক সমর্থক আছে, তারা অসন্তুষ্ট হবে। অথচ কোনো প্রার্থী বিদ্রোহ করলে নিয়ম হচ্ছে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা এবং তার কাছ থেকে দলীয় সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাহার এবং অসহযোগিতা প্রদানসহ সব ধরনের দলীয় ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
মার্কস ও লেনিনবাদী রাজনৈতিক দলের পদ্ধতি হচ্ছে, এমন অবাধ্যতার জন্য প্রার্থীকে দল থেকে বহিষ্কারসহ হরেক রকম শাস্তি প্রদান। তাই কমিউনিস্ট বিশ্বে মতভিন্নতার কারণে অনেকে দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় থাকে না এবং বিদ্রোহ করারও সাহস পায় না। দলীয় শৃংখলা প্রতিপালন করা হয় অত্যন্ত কঠোরভাবে। নিউজিল্যান্ডে নির্বাচনে ভোটিং পদ্ধতিতে এমএমপি (Mixed Member Proportionality) বা আনুপাতিক হারে সদস্যের হিসাব হয়। সেখানে দলচ্যুত হওয়া বা দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা দলকে পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করার শামিল।
বাংলাদেশে অনেক সময় দেখা যায়, প্রার্থী কখনো দল করেনি বা দলের জন্য এক টাকাও চাঁদা দেয়নি অথচ দল যখন ক্ষমতায় আসে তখন রাতারাতি সে দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে যায়। বিশাল বাজিকরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে টেন্ডারবাজি করতে শুরু করে এবং বিরোধীদলীয় দু-একজন নিরীহ লোককে রাস্তায় মারধর করে নিজেকে দলের আত্মনিবেদিত কর্মী হিসেবে জাহির করে। ঠিক এমনিভাবেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর অনেক তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধার আবির্ভাব ঘটেছিল। তারা স্বাধীনতা যুদ্ধের খবরও রাখেনি। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর থেকে রাতারাতি বনে যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা। তারাই জেনেভা ক্যাম্পে গিয়ে আক্রমণ করেছিল। অনেক সম্মানিত ব্যক্তির বাড়িতে হানা দিয়ে তাদের স্বাধীনতাবিরোধী আখ্যা দিয়ে সম্পত্তি দখল ও লুটপাট করতে শুরু করেছিল। আমরা তখন তাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ১৬তম ডিভিশন (16 Division FF) বলে আখ্যায়িত করেছিলাম। তাদের অনেকে আবার অত্যন্ত যতœসহকারে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে এবং এখনও নিচ্ছে। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও তাদের অনেকের পুত্র ও পৌত্রদের নাম মুক্তিযোদ্ধাদের ডিজিটাল তালিকায় সন্নিবেশিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় অনেক উদার ও মহৎ!
এসব ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে লাভ নেই। দলীয় আবেদন বা অনুশাসন না মানার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে দলের আদর্শ, লক্ষ্য বা মেনিফেস্টোর প্রতি অগাধ বিশ্বাস বা তা থেকে জনসেবার প্রতি আগ্রহ বা অনুপ্রেরণা লাভের ঘাটতি। সত্যি কথা বলতে কী, বাংলাদেশে বর্তমানে আদর্শভিত্তিক রাজনীতির বড় আকাল পড়েছে। মহারাজ ত্রৈলক্যনাথ চক্রবর্তী অথবা কমরেড মুজাফফর আহমদের মতো রাজনীতিক আর হবেন বলে মনে হয় না। এখন লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া বা টিকে থাকা। তাই নির্বাচনের আগে প্রতিশ্র“তিভিত্তিক মেনিফেস্টো তৈরি হয়, যা উন্নয়নের রাজনীতি বা বদলে দেয়ার অর্থনীতি নিয়ে দার্শনিক ভাবনায় ভরপুর। অবশ্য জনগণ তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে ভোট কেন্দ্রে যায়। কয়েক বছর যেতে না যেতে তারাই আবার ‘রাবিশ’ ও ‘বোগাস’ বলে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
আসল বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনে মনোনয়নের প্রাক্কালে প্রার্থীর যোগ্যতা যাচাই। বাংলাদেশে ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে যখন সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হচ্ছিল, তখন টাকা-পয়সার লেনদেন নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক রসালো খবর প্রকাশিত হয়েছিল। নবম সংসদ নির্বাচনেও বিত্তবান বণিক শ্রেণীর প্রার্থীরাই প্রাধান্য পেয়েছিলেন এবং সংসদে দলীয় নিবেদিত কর্মীদের পরিবর্তে বণিক শ্রেণীর সম্মানিত ব্যক্তিরাই অধিক প্রতিনিধিত্ব লাভ করেছেন। অনেকে মনে করছেন, দশম জাতীয় সংসদও ব্যতিক্রম কিছু হবে না। শেরে বাংলা নগরের সুবিশাল সংসদ ভবনে বিতর্কে অংশ নেবেন অনেক বণিক প্রতিনিধি, যাদের ছবি সরাসরি টেলিভিশনে দেখা যাবে। তারা লম্বা কাগজে একটি প্রশ্ন টাইপ করে নিয়ে গিয়ে তা সংসদে অনেক কষ্টে উপস্থাপন করবেন। প্রয়োজনে সংসদে খিস্তি খেউড় করবেন। তাতে কীবা আসে যায়! কথায় কথায় কেউ বলবেন, এমন উন্নয়ন কখনো হয়নি। অপর দল বলবে, এমন দুর্নীতি কেউ কখনো চোখে দেখেনি।
এসব কারণেই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দলীয় অনুশাসন, রীতিনীতি অনুসরণ করার প্রতি মনোযোগ নেই। কোনোভাবে মনোনয়ন পেলেই হল। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের তালিকায় নাম উঠে যাবে অনেক ওপরে। তাই তারা মনোনয়ন প্রাপ্তির জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতেও প্রস্তুত। এটাই আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের দুর্বলতম দিক। তবে একথাও সত্য, জনগণ ভোট দেয় বিচার-বিশ্লেষণ করে, একটি আদর্শকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। যেমন ১৯৫৬ সালে জনগণ তদানীন্তন পাকিস্তানে হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্টকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল গণতন্ত্র ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। প্রার্থীর পরিচয়ও জানতে চায়নি জনগণ। ভোট দিয়েছে মার্কা দেখে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে বাঙালি জনগণের সমৃদ্ধির আশায় এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচণ্ড আবেগে, যা রূপ লাভ করেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। এমনকি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জনগণ ভোট দিয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এবং বদলে দেয়ার রাজনীতি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশায়। তাই জনগণের ভরসা, এবারও যদি নতুন ধারার রাজনীতি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্র“তি কেউ দিতে পারে অথবা অর্থবহ ও বাস্তবধর্মী অগ্রগতির সঠিক নির্দেশনার পথ দেখাতে পারে, তবেই জনগণ ভোট কেন্দ্রে যাবে।
বহুদলীয় ও বহুমতের সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে এবং একে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে হলে অবশ্যই দলীয় রাজনীতিকে ইতিবাচক পথে পরিচালিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে জীবন উৎসর্গ করার মতো শিক্ষিত সমাজকর্মী, প্রকৃত জনগণের প্রতিনিধি। দলকে বণিকদের হাতে বিসর্জন দিলে দলে বাজিকরদের উপদ্রব এবং জনগণকে প্রতারিত করার প্রবণতা বাড়বে। তাই মনোনয়ন দেয়ার প্রাক্কালে দলীয় নেতারা যদি আর্থিক লেনদেনের চিন্তা বাদ দেন, তাহলে দলে বিদ্রোহী প্রার্থীর উপদ্রব হ্রাস পাবে। তখন আর দলের মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য অনুরোধ করার প্রয়োজন হবে না। একই সঙ্গে দলের মধ্যে শৃংখলা বিধান বা নির্দেশ প্রতিপালনের সংস্কৃতি তৈরি হবে। তবেই সংসদীয় ও দলীয় রাজনীতি হবে অর্থবহ। এমনটি না হলে দলীয় প্রার্থীকে ভোট দেয়ার আবেদন ফলপ্রসূ নাও হতে পারে।
ধীরাজ কুমার নাথ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব
No comments