স্বস্তিতে নেই খালেদা জিয়া দলে বিশৃঙ্খলা, বড় নেতারাও কোন্দলে by শরীফুল ইসলাম
স্বস্তিতে নেই জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। দলের বিশৃঙ্খলা, সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে না পারা, পারিবারিক দুরবস্থা, শারীরিক অসুস্থতা, নির্দলীয় সরকার নিয়ে অনিশ্চয়তা, বিভিন্ন মামলা, আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে আশানুরূপ সহযোগিতা না পাওয়া এবং দলে ও জোটে যুদ্ধাপরাধী
থাকার কারণেই খালেদা জিয়া চরম অস্বস্তিতে রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ওয়ান ইলেভেন পরিস্থিতির পর শত চেষ্টা করেও খালেদা জিয়া তাঁর দল বিএনপিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারছেন না। দলের সিনিয়র নেতারা গ্রুপিং-কোন্দলে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি হাইকমান্ডকে উপেক্ষা করে নিজেদের ইচ্ছেমতো কাজ করছেন। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারে অংশ নিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব নিয়ে বিএনপি নেতারা মনগড়াভাবে একেকজন একেক রকম কথা বলে দলের নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত ও হতাশ করেছেন। বিশেষ করে এ ইস্যুতে স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে দলের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়। মওদুদের বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন খোদ দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ পরিস্থিতিতে ব্যারিস্টার মওদুদ চরম ক্ষুব্ধ হন। ২৬ আগস্ট বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হলেও এর আগেই মওদুদ আহমদ বিদেশে পাড়ি দেন।
মূল দলের পাশাপাশি এখন বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনেও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ছে। গত ৩ আগস্ট মধ্য রাতে বহু নাটকীয়তার পর ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন করা হলেও অতীতে সংগঠনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী আদুভাইদের নিয়ে কমিটি করায় এ কমিটি মেনে নিতে পারেননি নিয়মিত ছাত্র সংগঠনের এমন নেতাকর্মীরা। এই কমিটি গঠনের লক্ষ্যে খালেদা জিয়া নিজে ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে চারদিনব্যাপী বৈঠক শেষে বলেছিলেন, এবার প্রকৃত মোধাবী ছাত্রদেরই কমিটিতে স্থান দেয়া হবে। কিন্তু খালেদা জিয়া তাঁর আশ্বাস বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তাঁর অজান্তেই ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে ক্যু হয়ে গেছে। জানা যায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও চেয়েছিলেন নিয়মিত ও মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে ভাল একটি কমিটি করতে। কিন্তু খালেদা জিয়া ছাত্রদলের কমিটি করার জন্য বিএনপির যে নেতাদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তারা মির্জা ফখরুলকে দেখিয়েছেন একরকম কমিটি আর মধ্য রাতে খালেদা জিয়ার বাসায় গিয়ে তাঁকে ম্যানেজ করে সেই কমিটিতে অনেকের নামই রদবদল করেছেন। তবে এ কমিটি গঠনের জন্য ছাত্রদলের ত্যাগী ও পদবঞ্চিত নেতারা বিএনপির ২ জন স্থায়ী কমিটির সদস্য, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও ছাত্রদলের সাবেক ২ সভাপতিকে দায়ী করেছে।
দলের বিশৃঙ্খলা দূর করতে না পারার কারণে খালেদা জিয়া ঢাকা মহানগরসহ বিভিন্ন সাংগঠনিক জেলার কমিটি গঠন করতে পারছেন না। আর জেলা কমিটি নিয়ে সমস্যা থাকায় সংশ্লিষ্ট উপজেলা কমিটিতেও সমস্যা রয়ে গেছে। এর ফলে তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটাতে পারছেন না তিনি। জানা যায়, সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলার কারণে সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীরা ঝিমিয়ে পড়েছে। কোন কোন জেল-উপজেলায় দল শক্তিশালী হলেও নেতাদের দ্বিধাবিভক্তির কারণে প্যারালালভাবে পৃথক পৃথক কর্মসূচী পালিত হয়। আর এ নিয়ে প্রায়ই বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় এ দলের নেতাকর্মীরা সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। কখনও কখনও পরস্পরবিরোধী বিএনপি নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে মামলা করতেও দ্বিধা করে না।
খালেদা জিয়া নিজে দীর্ঘদিন আগে থেকে বলে আসছিলেন এ সরকারকে আর সময় দেবেন না। আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচীর মাধ্যমে বর্তমান মহাজোট সরকারের পতন ঘটাবেন। কিন্তু এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১১টি হরতালসহ যে ক’টি আন্দোলন কর্মসূচী দিয়েছেন তার একটিও আশানুরূপ সাড়া ফেলতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে রোজার আগে থেকে ঈদের পর কঠোর কর্মসূচী দেয়ার কথা বললেও সাংগঠনিক দুর্বলতা ও বিভিন্ন মহলের চাপে শেষ পর্যন্ত ২৮ আগস্ট ২ মাসব্যাপী গতানুগতিক কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। তবে এ কর্মসূচীর কারণে বিএনপির তৃনমূল পর্যায়ে চরম হতাশা নেমে আসে।
ওয়ান ইলেভেন পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর থেকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ২ ছেলে ঘরছাড়া। বর্তমানে বড় ছেলে তারেক রহমান সপরিবারে লন্ডন অবস্থান করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারেক রহমানের শারীরিক অবস্থারও খুব বেশি উন্নতি হচ্ছে না। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোও সিঙ্গাপুরে চিকিসাধীন রয়েছেন। তাঁর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। ওয়ান ইলেভেনের আগ পর্যন্ত বাসায় একসঙ্গে থাকলেও এখন ২ ছেলে ও তাঁদের বউ-বাচ্চারা দূরে থাকায় খালেদা জিয়াকে গুলশানের ভাড়া বাড়িতে একাই থাকতে হচ্ছে। প্রয়োজনে কথা বলার জন্য পরিবারের কোন সদস্যকেই তিনি কাছে পাচ্ছেন না। শুক্রবার ছাড়া অন্যান্য দিন গভীর রাত পর্যন্ত গুলশানের দলীয় কার্যালয়ে ব্যস্ত সময় কাটালেও বাসায় বাকি সময় কাটানোর সময় তিনি স্বাস্তি পাচ্ছেন না।
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থাও ভাল নেই দীর্ঘদিন ধরে। তিনি পায়ের ব্যথাসহ বয়সজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। দেশে নিয়মিত চিকিৎসার পাশাপাশি বিদেশেও তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসার জন্য তিনি এ বছর একবার সিঙ্গাপুর ও ২ বার সৌদি আরব গেছেন। পরবর্তীতে তাঁর আমেরিকায় চিকিৎসা নিতে যাওয়ার কথা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
গত বছর ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করার পর থেকেই বিএনপি নির্দলীয় সরকারের দাবিতে একের পর এক বিভিন্ন কর্মসূচী পালনের পাশাপাশি বহির্বিশ্বের ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ ব্যাপারে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল নেন। কিন্তু বিএনপির কোন কৌশলই কাজে আসছে না। কোন মহল থেকেই আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করার আশ্বাস পাচ্ছেন না। তাই আগামী নির্বাচন নিয়ে এখনও খালেদা জিয়া ও তাঁর দলের মধ্যে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
খালেদা জিয়াসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ২৫টি মামলা এখন বিচারাধীন। এর মধ্যে ২৩টি মামলাই বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে করা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একটি করে মামলা হয়েছে। ২৫টি মামলার মধ্যে খালেদা জিয়ার নামে রায়েছে ৫টি, বড় ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৪টি, ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে ৫টি এবং তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের নামে মামলা রয়েছে একটি। বিচারাধীন কোন কোন মামলায় তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানাও রয়েছে। এর বাইরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের মামলা ছাড়াও বর্তমান সরকারের আমলেও মামলা হয়েছে। শত চেষ্টা করেও বিএনপি নেতারা মামলা প্রত্যাহারের সুযোগ পাচ্ছেন না।
ক্ষমতায় যাওয়ার পথ পরিষ্কার করতে গত সাড়ে ৩ বছর ধরে বিএনপি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছে। চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সশরীরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন ও সৌদি আরব সফর করেছেন। এবার তিনি ভারতসহ আরও ক’টি দেশ সফর করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ ছাড়া জি-৯ নামক একটি সংগঠনের মাধ্যমে বিএনপি বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সহযোগিতা নেয়ার চেষ্টা করছে। তবে এখন পর্যন্ত খালেদা জিয়া ও তাঁর দল বিএনপি আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে আশানুরূপ সহযোগিতা পাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
খালেদা জিয়া স্বস্তিতে না থাকার আরেকটি কারণ তাঁর দল বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াতে যুদ্ধাপরাধী থাকা। এ বিষয়টি নিয়ে তিনি দেশের সুশীল সমাজ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বড় ধরনের চাপে রয়েছেন। যে কারণে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় কোন কর্মসূচী দিতে পারছেন না। আবার তাদের একেবারে দূরেও ঠেলে দিতে পারছেন না। দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যেও এ নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, খালেদাসহ জিয়া পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামালা, তাঁর ২ ছেলের বিদেশে থাকা এবং যেভাবে সরকারের তরফ থেকে হয়রানির চেষ্টা হচ্ছে তাতে খালেদা জিয়ার অস্বস্তিতে থাকারই কথা। তবে এটাও ঠিক রাজনীতি করতে হলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। খালেদা জিয়া দল ও দেশের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছেন। একদিন হয়ত সব সমস্যা কেটে যাবে। আর রাজনীতিতে উত্থান-পতন থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
বিএনপির ভাইসচেয়ারম্যান সেলিমা রহমান বলেন, খালেদা জিয়া বিভিন্ন কারণে অস্বস্তিতে রয়েছেন। কারণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তার প্রতি সরকার বৈরী আচরণ করছে। তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তাঁর ছেলেরা দেশে আসতে পারছে না। আর রাজনৈতিক কারণে মামলা দিয়ে খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হয়রানি করা হচ্ছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, খালেদা জিয়া অনেক ঝুঁকি নিয়ে রাজনীতি করছেন। আন্দোলন সংগ্রামে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি ইচ্ছে করলে অনেক সুখের জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু দেশের জনগণের স্বার্থে নানামুখী সমস্যা মোকাবেলা করে রাজনীতি করছেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কিন্তু কোন ষড়যন্ত্রই কাজে আসবে না।
মূল দলের পাশাপাশি এখন বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনেও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ছে। গত ৩ আগস্ট মধ্য রাতে বহু নাটকীয়তার পর ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন করা হলেও অতীতে সংগঠনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী আদুভাইদের নিয়ে কমিটি করায় এ কমিটি মেনে নিতে পারেননি নিয়মিত ছাত্র সংগঠনের এমন নেতাকর্মীরা। এই কমিটি গঠনের লক্ষ্যে খালেদা জিয়া নিজে ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে চারদিনব্যাপী বৈঠক শেষে বলেছিলেন, এবার প্রকৃত মোধাবী ছাত্রদেরই কমিটিতে স্থান দেয়া হবে। কিন্তু খালেদা জিয়া তাঁর আশ্বাস বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তাঁর অজান্তেই ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে ক্যু হয়ে গেছে। জানা যায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও চেয়েছিলেন নিয়মিত ও মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে ভাল একটি কমিটি করতে। কিন্তু খালেদা জিয়া ছাত্রদলের কমিটি করার জন্য বিএনপির যে নেতাদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তারা মির্জা ফখরুলকে দেখিয়েছেন একরকম কমিটি আর মধ্য রাতে খালেদা জিয়ার বাসায় গিয়ে তাঁকে ম্যানেজ করে সেই কমিটিতে অনেকের নামই রদবদল করেছেন। তবে এ কমিটি গঠনের জন্য ছাত্রদলের ত্যাগী ও পদবঞ্চিত নেতারা বিএনপির ২ জন স্থায়ী কমিটির সদস্য, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও ছাত্রদলের সাবেক ২ সভাপতিকে দায়ী করেছে।
দলের বিশৃঙ্খলা দূর করতে না পারার কারণে খালেদা জিয়া ঢাকা মহানগরসহ বিভিন্ন সাংগঠনিক জেলার কমিটি গঠন করতে পারছেন না। আর জেলা কমিটি নিয়ে সমস্যা থাকায় সংশ্লিষ্ট উপজেলা কমিটিতেও সমস্যা রয়ে গেছে। এর ফলে তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটাতে পারছেন না তিনি। জানা যায়, সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলার কারণে সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীরা ঝিমিয়ে পড়েছে। কোন কোন জেল-উপজেলায় দল শক্তিশালী হলেও নেতাদের দ্বিধাবিভক্তির কারণে প্যারালালভাবে পৃথক পৃথক কর্মসূচী পালিত হয়। আর এ নিয়ে প্রায়ই বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় এ দলের নেতাকর্মীরা সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। কখনও কখনও পরস্পরবিরোধী বিএনপি নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে মামলা করতেও দ্বিধা করে না।
খালেদা জিয়া নিজে দীর্ঘদিন আগে থেকে বলে আসছিলেন এ সরকারকে আর সময় দেবেন না। আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচীর মাধ্যমে বর্তমান মহাজোট সরকারের পতন ঘটাবেন। কিন্তু এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১১টি হরতালসহ যে ক’টি আন্দোলন কর্মসূচী দিয়েছেন তার একটিও আশানুরূপ সাড়া ফেলতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে রোজার আগে থেকে ঈদের পর কঠোর কর্মসূচী দেয়ার কথা বললেও সাংগঠনিক দুর্বলতা ও বিভিন্ন মহলের চাপে শেষ পর্যন্ত ২৮ আগস্ট ২ মাসব্যাপী গতানুগতিক কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। তবে এ কর্মসূচীর কারণে বিএনপির তৃনমূল পর্যায়ে চরম হতাশা নেমে আসে।
ওয়ান ইলেভেন পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর থেকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ২ ছেলে ঘরছাড়া। বর্তমানে বড় ছেলে তারেক রহমান সপরিবারে লন্ডন অবস্থান করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারেক রহমানের শারীরিক অবস্থারও খুব বেশি উন্নতি হচ্ছে না। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোও সিঙ্গাপুরে চিকিসাধীন রয়েছেন। তাঁর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। ওয়ান ইলেভেনের আগ পর্যন্ত বাসায় একসঙ্গে থাকলেও এখন ২ ছেলে ও তাঁদের বউ-বাচ্চারা দূরে থাকায় খালেদা জিয়াকে গুলশানের ভাড়া বাড়িতে একাই থাকতে হচ্ছে। প্রয়োজনে কথা বলার জন্য পরিবারের কোন সদস্যকেই তিনি কাছে পাচ্ছেন না। শুক্রবার ছাড়া অন্যান্য দিন গভীর রাত পর্যন্ত গুলশানের দলীয় কার্যালয়ে ব্যস্ত সময় কাটালেও বাসায় বাকি সময় কাটানোর সময় তিনি স্বাস্তি পাচ্ছেন না।
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থাও ভাল নেই দীর্ঘদিন ধরে। তিনি পায়ের ব্যথাসহ বয়সজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। দেশে নিয়মিত চিকিৎসার পাশাপাশি বিদেশেও তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসার জন্য তিনি এ বছর একবার সিঙ্গাপুর ও ২ বার সৌদি আরব গেছেন। পরবর্তীতে তাঁর আমেরিকায় চিকিৎসা নিতে যাওয়ার কথা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
গত বছর ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করার পর থেকেই বিএনপি নির্দলীয় সরকারের দাবিতে একের পর এক বিভিন্ন কর্মসূচী পালনের পাশাপাশি বহির্বিশ্বের ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ ব্যাপারে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল নেন। কিন্তু বিএনপির কোন কৌশলই কাজে আসছে না। কোন মহল থেকেই আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করার আশ্বাস পাচ্ছেন না। তাই আগামী নির্বাচন নিয়ে এখনও খালেদা জিয়া ও তাঁর দলের মধ্যে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
খালেদা জিয়াসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ২৫টি মামলা এখন বিচারাধীন। এর মধ্যে ২৩টি মামলাই বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে করা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একটি করে মামলা হয়েছে। ২৫টি মামলার মধ্যে খালেদা জিয়ার নামে রায়েছে ৫টি, বড় ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৪টি, ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে ৫টি এবং তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের নামে মামলা রয়েছে একটি। বিচারাধীন কোন কোন মামলায় তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানাও রয়েছে। এর বাইরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের মামলা ছাড়াও বর্তমান সরকারের আমলেও মামলা হয়েছে। শত চেষ্টা করেও বিএনপি নেতারা মামলা প্রত্যাহারের সুযোগ পাচ্ছেন না।
ক্ষমতায় যাওয়ার পথ পরিষ্কার করতে গত সাড়ে ৩ বছর ধরে বিএনপি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছে। চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সশরীরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন ও সৌদি আরব সফর করেছেন। এবার তিনি ভারতসহ আরও ক’টি দেশ সফর করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ ছাড়া জি-৯ নামক একটি সংগঠনের মাধ্যমে বিএনপি বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সহযোগিতা নেয়ার চেষ্টা করছে। তবে এখন পর্যন্ত খালেদা জিয়া ও তাঁর দল বিএনপি আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে আশানুরূপ সহযোগিতা পাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
খালেদা জিয়া স্বস্তিতে না থাকার আরেকটি কারণ তাঁর দল বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াতে যুদ্ধাপরাধী থাকা। এ বিষয়টি নিয়ে তিনি দেশের সুশীল সমাজ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বড় ধরনের চাপে রয়েছেন। যে কারণে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় কোন কর্মসূচী দিতে পারছেন না। আবার তাদের একেবারে দূরেও ঠেলে দিতে পারছেন না। দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যেও এ নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, খালেদাসহ জিয়া পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামালা, তাঁর ২ ছেলের বিদেশে থাকা এবং যেভাবে সরকারের তরফ থেকে হয়রানির চেষ্টা হচ্ছে তাতে খালেদা জিয়ার অস্বস্তিতে থাকারই কথা। তবে এটাও ঠিক রাজনীতি করতে হলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। খালেদা জিয়া দল ও দেশের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছেন। একদিন হয়ত সব সমস্যা কেটে যাবে। আর রাজনীতিতে উত্থান-পতন থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
বিএনপির ভাইসচেয়ারম্যান সেলিমা রহমান বলেন, খালেদা জিয়া বিভিন্ন কারণে অস্বস্তিতে রয়েছেন। কারণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তার প্রতি সরকার বৈরী আচরণ করছে। তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তাঁর ছেলেরা দেশে আসতে পারছে না। আর রাজনৈতিক কারণে মামলা দিয়ে খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হয়রানি করা হচ্ছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, খালেদা জিয়া অনেক ঝুঁকি নিয়ে রাজনীতি করছেন। আন্দোলন সংগ্রামে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি ইচ্ছে করলে অনেক সুখের জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু দেশের জনগণের স্বার্থে নানামুখী সমস্যা মোকাবেলা করে রাজনীতি করছেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কিন্তু কোন ষড়যন্ত্রই কাজে আসবে না।
No comments