লেওনার্ড কোহেন : অতলের অনুবাদক by আনিস পারভেজ
বোধের
অনুবাদ করতে কবি ধ্বনিকে শব্দে গাঁথেন। এর উল্টো যাত্রায় শব্দ ধ্বনি হয়ে
অস্তিত্বের অতল স্পর্শ করে। লেওনার্ড কোহেন কবি ও সঙ্গীতকার, যিনি সুরে ও
কথায় আমাদের অতলকে অনুবাদ করেছেন।
বাবার মৃত্যুতে শিশু কোহেন তার অনুপস্থিতি কতটা টের পেয়েছে? বড়রা কাঁদছে, প্রার্থনা করছে। ইহুদি যাজক মৃতদেহের সৎকার করেছে মন্ট্রিয়লের গোরস্তানে। বাড়িতে শীতের বাতাস শরীর ভেদ করে যায়। সমস্ত উচ্চারণ হিম হয়ে আছে। এই স্তব্ধতার ভেতর কোহেন বাবার বো টাই-এ কিছু একটা লিখে বাবাকে গোর দেয়ার মতো বাড়ির সামনে বরফ সরিয়ে মাটির ভেতর পুঁতে দেয়। সেদিন কী লিখেছিল কোহেন—বড় হয়ে স্মৃতিতে তা আর কোনো ভাবেই ধরা দেয় না। কোহেন জীবনভর অবিরত স্মৃতির ধোঁয়াশা হাতড়েছে সেই লিপি খুঁজে পেতে, জানতে চেয়েছে সে কী লিখেছিল। জানা হয়নি। কিন্তু তার খোঁড়াখুঁড়িতে আমরা পেয়েছি গান ও কবিতা, আমরা পেয়েছি আমাদের অতলের স্পর্শ।
১৯৩৪ এর ২১ সেপ্টেম্বর লেওনার্ড নরমেন কোহেনের জন্ম মন্ট্রিয়লে একটি অভিবাসী ইহুদি পরিবারে। নাথান ও মাশা কোহেন তার বাবা মা। অভিবাসনের বেদনা থাকে, থাকে গল্প, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে একটি নদীর মতো বয়ে চলে। সেই নদীতে মাশা কোহেনকে স্নান করিয়েছে, স্নানের জল ঝরেছে কোহেনের কথা ও সুরে। তাই প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসী না হলেও তার সৃষ্টি পুষ্টি নিয়েছে ইহুদি গাঁথা থেকে।
১৯৪৯-এর গ্রীষ্মে পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কোহেন গার্সিয়া লোরকার কবিতার বই কেনে। ইহুদি গাঁথার উষ্ণতা নিয়ে যেন একটি প্রবাল দ্বীপে এসে পৌঁছে কোহেন—ডুবে থাকে লোরকায়। ঠিক সেসময় বাসার পাশে বিকেলের পার্কে দেখা হয় এক অচেনা যুবকের সাথে। হিস্পানিক যুবক গীটারে সুর ভাজছিল। প্রবাল দ্বীপে অন্যরকম বাতাস বয়ে গেলো। পরিচয়য়েই সখ্য, কোহেন যুবকটির কাছে গীটারে লেসন নিচ্ছিল। ক’দিন থেকে হিস্পানিক যুবকটির দেখা নেই। খোঁজ নিয়ে জানতে পেলো, গীটার বাজানো হিস্পানিক যুবক গলায় দড়ি দিয়েছে। মৃত্যু, লোরকা এবং ইহুদি গাঁথা লেওনার্ড কোহেনের অবচেতনে শুদ্ধতম টোকা, যার প্রতিধ্বনি তার পরবর্তী জীবনের সমস্ত উচ্চারণ ও নীরবতা।
ম্যাকগ্রিলে ছাত্রাবস্থায় লেওনার্ড কোহেনের কবিতা বেরিয়েছে মুদ্রিত হয়ে। আড্ডায় ও বৈঠকে তার স্বকণ্ঠ কবিতা পাঠ। কবিতায় কোহেন অধরাকে ধরতে চেয়েছে, যেমন তার উদগ্রীবতা চোখের সামনে যে মানুষটিকে দেখি, দেখি তার বাইরের রূপ, তার ভেতরের অদেখাকে দেখা। জগতকে দেখতে চাই সম্মোহন। এক বন্ধুর বাবার কাছ থেকে সম্মোহনের পাঠ নিয়ে বাসার পরিচারিকাকে সম্মোহিত করে বিবস্ত্র করে কোহেন বুঝতে পারে অজানার অতল অনেক দূর। চাই একটা পরিব্রাজকের জীবন—লোকালয় থেকে লোকালয়ে, নারী থেকে নারীতে।
শুরু হল পথের জীবন—নিউইয়র্কের গ্রিনউইচ ভিলেজ, নাশভিল হয়ে লন্ডনে। ইতিমধ্যে বেরিয়েছে কাব্যগ্রন্থ, জুটেছে স্বীকৃতি—পুরস্কার, এবং নারীর ভালোবাসা। পোশাক খুলে শরীরের ভেতরে ঢুকেছে কোহেন, পরিপূর্ণ শরীরকে বিশুদ্ধ মন দিয়ে ছুঁয়েছে। কিন্তু অতল রয়েছে অধরা।
১৯৬০-এর মার্চ, লন্ডনের বৃষ্টি ভেজা বিকেল, আত্মায় শূন্যতা বয়ে কোহেন গন্তব্যহীন হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে Bank of Greece-এ এক আগন্তুকের সাথে দেখা, সে গল্প বলছে গ্রিসের অ্যাজিয়ান দ্বীপের। মুহূর্তেই একটা গন্তব্য পেয়ে গেল কোহেন—গ্রিসের হাইড্রা। হাইড্রায় অতলের তল একটু একটু করে উঁকি দিল। নাবিককেও হতে হয় ডুবুরি, ডুবুরিকে নাবিক। নাবিক পৌঁছে গন্তব্যে, ডুবুরি অতলে। মানুষকে নাবিক আর ডুবুরি দুটোই হতে হয়। অন্তর্গত এ বোধের অনুবাদে কোহেন বলে:
And Jesus was a sailor
When he walked upon the water
And he spent a long time watching
From his lonely wooden tower
And when he knew for certain
Only drowning men could see him
He said "All men will be sailors then
Until the sea shall free them”
ভূমধ্যসাগরের জল দখিনের হাওয়ায় উড়ে এসে হাইড্রাকে ভিজিয়ে দেয়। ছোট্ট একটি দ্বীপ, ধুলো উড়িয়ে যায় গাধা টানা গাড়ি। সময় এখানে মন্থর। সারাদিন লিখে বিকেলে কোহেনের আড্ডা একটি পানশালায়, সেখানে দেখা মারিয়ান্নে ইহলেনের সাথে। মারিয়ান্নের স্বামীর সাথে কোহেনের বন্ধুত্ব, সেই বন্ধুত্বের সেতু পার হয়ে মারিয়ান্নের সাথে গড়ে ওঠে প্রণয়। অতলের সন্ধানে কোহেন অনুভূতির সব রঙে নিজেকে রাঙায়। রঙ উঠে আসে তার লেখায় ও সুরে। কোহেনের প্রথম এলবাম Songs of Leonard Cohen বের হয় ১৯৬৭-তে। আপাত মেলানকোলিক স্বর কিন্তু গভীরতায় বিমূর্ত প্রার্থনার চাইতেও বিশুদ্ধ ব্যালার্ড তার সঙ্গীত। একই ধারায় এলো আরও কিছু এলবাম।
১৯৮৮-এর I’m Your Man ভিন্ন ধারা নিয়ে এলো, কি-বোর্ড আর ইলেকট্রনিক সঙ্গীতে প্রার্থনা ও অনুসন্ধানের ভাষা চিরায়ত আবেদনের পাশাপাশি সমসাময়িক ব্যঞ্জনা পেলো। নন্দিত সাধক জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। ৯০ দশকের মাঝামাঝি সাধক খুঁজলো নীরবতা, নিজেকে আড়াল করলো জেন বৌদ্ধ সাধনাগারে। ধ্যানমগ্ন কোহেনের শরীরে মন্দিরের ভেজানো জানালা দিয়ে আলো আসে, অজানার কিরণ তার শরীর কেটে অস্তিত্বের ভেতরে ঢুকে পড়ে, যেন মাখনে চাকু—তেমনি অনায়াস কিরণের ছটা। সেই কিরণে লেওনার্ড কোহেন বিস্মৃত হয়, কোনো শব্দ শোনে না, কেনো না অতলের জগত তো শব্দহীন, আদিতে কোনো নাম নেই। কোহেন সুরের ভাঁজে ভাঁজে গেঁথে দেয় অতলের উচ্চারণ:
The light came through the window
Straight from the sun above
And so inside my little room
There plunged the rays of love
In streams of light I clearly saw
The dust you seldom see
Out of which the nameless makes
A name for one like me
কিছুকাল জেন ধ্যানাগারে থেকে নাগরিক জীবনে ফিরে আসে কোহেন। জানতে পারে তার ৫ মিলিয়ন ডলার বেহাত হয়ে গেছে ম্যানেজারের কারসাজিতে। নিমিষেই কপর্দকশূন্য ষাটোর্ধ্ব কোহেন বিমুঢ়তা কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় আবারও পথে নামতে হবে—কথা ও সুর তার পুঁজি।
কোহেন তো সবসময়ই জানতো, I was born like this, I had no choice, I was born with the gift of a golden voice; তাই সোনালি কণ্ঠ আর অতলের স্বর নিয়ে নতুন পাঁচটি এলবাম ও দুই শতাধিক কনসার্ট নিয়ে ৮২ বছর বয়স পর্যন্ত কোহেন দেশ দেশান্তরে। শেষ পনেরো বছরে তরুণদের কাছে তার আবেদন হয়ে উঠেছে কল্পনাতীত যারা তাঁকে সাধারণত এড়িয়ে যেত বিষাদের নবী বলে। তৃতীয় পর্বের সঙ্গীতে কোহেন বিষাদের পোশাকের ভেতর মানুষের আত্মার মুক্তিকে তুলে এনেছে। মুক্তিতে প্রশান্তি আছে, এবং আছে উৎসব। উৎসব, প্রশান্তি ও বিষাদের যুগলবন্দী শেষ পাঁচটি এলবাম।
জগত ধোঁয়াশা, কিন্তু একটা সময়ে মানুষের হয়তো দৃষ্টি খুলে যায়। আশির্বাদপুষ্টরা বুঝতে পারে মিশন পূর্ণ হয়েছে, এবার ঘরে ফেরার পালা। ২১ অক্টোবর ২০১৬ লেওনার্ড কোহেনের শেষ এলবাম বের হয়—You Want It Darker, যেখানে কোহেন জানিয়ে দেয় “Hineni, hineni; I’m ready, my lord”। নিজেকে উৎসর্গ করার ক্ষুধা মানুষের অন্তরতর, যদিও আমরা জানি না উৎসর্গ কখন ও কাকে। সহসাই একটি মুহূর্ত উপস্থিত হয়, মানুষ জেনে যায় সময় এসেছে উৎসর্গের। “Hineni, hineni” অর্থাৎ আমি হাজির, ঘোষণা দেয়ার তিন সপ্তাহ পর লেওনার্ড কোহেন ৭ নভেম্বর ২০১৬ ফিরে যান আদিতে, জন্মের মাধ্যমে যেখান থেকে মানুষের বিচ্ছেদ এবং মৃত্যুই আবার সেখানে ফিরিয়ে আনে। মাঝখানের সময়টাতেই কেবল আমরা অতল খুঁজে বেড়াই।
অতল খুঁজতে খুঁজতে আমাদের উপলব্ধি হয় সৃষ্টি নিজেকে ভেঙে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে আছে। আমাদের কাজ অংশগুলোকে আবারও সমগ্রে ফিরিয়ে আনা। লেওনার্ড কোহেন তার শব্দ ও সুরে সেই সমগ্রকেই গেঁথেছেন। আমরা যারা এখনও অংশগুলো জোড়া দিচ্ছি এবং এখনও সমগ্রে বিলীন হওয়ার অপেক্ষায় আছি, আমাদের কাজ ও আমাদের অপেক্ষা অন্তর্দৃষ্টি পায় কোহেনের সঙ্গীতে।
বাবার মৃত্যুতে শিশু কোহেন তার অনুপস্থিতি কতটা টের পেয়েছে? বড়রা কাঁদছে, প্রার্থনা করছে। ইহুদি যাজক মৃতদেহের সৎকার করেছে মন্ট্রিয়লের গোরস্তানে। বাড়িতে শীতের বাতাস শরীর ভেদ করে যায়। সমস্ত উচ্চারণ হিম হয়ে আছে। এই স্তব্ধতার ভেতর কোহেন বাবার বো টাই-এ কিছু একটা লিখে বাবাকে গোর দেয়ার মতো বাড়ির সামনে বরফ সরিয়ে মাটির ভেতর পুঁতে দেয়। সেদিন কী লিখেছিল কোহেন—বড় হয়ে স্মৃতিতে তা আর কোনো ভাবেই ধরা দেয় না। কোহেন জীবনভর অবিরত স্মৃতির ধোঁয়াশা হাতড়েছে সেই লিপি খুঁজে পেতে, জানতে চেয়েছে সে কী লিখেছিল। জানা হয়নি। কিন্তু তার খোঁড়াখুঁড়িতে আমরা পেয়েছি গান ও কবিতা, আমরা পেয়েছি আমাদের অতলের স্পর্শ।
১৯৩৪ এর ২১ সেপ্টেম্বর লেওনার্ড নরমেন কোহেনের জন্ম মন্ট্রিয়লে একটি অভিবাসী ইহুদি পরিবারে। নাথান ও মাশা কোহেন তার বাবা মা। অভিবাসনের বেদনা থাকে, থাকে গল্প, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে একটি নদীর মতো বয়ে চলে। সেই নদীতে মাশা কোহেনকে স্নান করিয়েছে, স্নানের জল ঝরেছে কোহেনের কথা ও সুরে। তাই প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসী না হলেও তার সৃষ্টি পুষ্টি নিয়েছে ইহুদি গাঁথা থেকে।
১৯৪৯-এর গ্রীষ্মে পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কোহেন গার্সিয়া লোরকার কবিতার বই কেনে। ইহুদি গাঁথার উষ্ণতা নিয়ে যেন একটি প্রবাল দ্বীপে এসে পৌঁছে কোহেন—ডুবে থাকে লোরকায়। ঠিক সেসময় বাসার পাশে বিকেলের পার্কে দেখা হয় এক অচেনা যুবকের সাথে। হিস্পানিক যুবক গীটারে সুর ভাজছিল। প্রবাল দ্বীপে অন্যরকম বাতাস বয়ে গেলো। পরিচয়য়েই সখ্য, কোহেন যুবকটির কাছে গীটারে লেসন নিচ্ছিল। ক’দিন থেকে হিস্পানিক যুবকটির দেখা নেই। খোঁজ নিয়ে জানতে পেলো, গীটার বাজানো হিস্পানিক যুবক গলায় দড়ি দিয়েছে। মৃত্যু, লোরকা এবং ইহুদি গাঁথা লেওনার্ড কোহেনের অবচেতনে শুদ্ধতম টোকা, যার প্রতিধ্বনি তার পরবর্তী জীবনের সমস্ত উচ্চারণ ও নীরবতা।
ম্যাকগ্রিলে ছাত্রাবস্থায় লেওনার্ড কোহেনের কবিতা বেরিয়েছে মুদ্রিত হয়ে। আড্ডায় ও বৈঠকে তার স্বকণ্ঠ কবিতা পাঠ। কবিতায় কোহেন অধরাকে ধরতে চেয়েছে, যেমন তার উদগ্রীবতা চোখের সামনে যে মানুষটিকে দেখি, দেখি তার বাইরের রূপ, তার ভেতরের অদেখাকে দেখা। জগতকে দেখতে চাই সম্মোহন। এক বন্ধুর বাবার কাছ থেকে সম্মোহনের পাঠ নিয়ে বাসার পরিচারিকাকে সম্মোহিত করে বিবস্ত্র করে কোহেন বুঝতে পারে অজানার অতল অনেক দূর। চাই একটা পরিব্রাজকের জীবন—লোকালয় থেকে লোকালয়ে, নারী থেকে নারীতে।
শুরু হল পথের জীবন—নিউইয়র্কের গ্রিনউইচ ভিলেজ, নাশভিল হয়ে লন্ডনে। ইতিমধ্যে বেরিয়েছে কাব্যগ্রন্থ, জুটেছে স্বীকৃতি—পুরস্কার, এবং নারীর ভালোবাসা। পোশাক খুলে শরীরের ভেতরে ঢুকেছে কোহেন, পরিপূর্ণ শরীরকে বিশুদ্ধ মন দিয়ে ছুঁয়েছে। কিন্তু অতল রয়েছে অধরা।
১৯৬০-এর মার্চ, লন্ডনের বৃষ্টি ভেজা বিকেল, আত্মায় শূন্যতা বয়ে কোহেন গন্তব্যহীন হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে Bank of Greece-এ এক আগন্তুকের সাথে দেখা, সে গল্প বলছে গ্রিসের অ্যাজিয়ান দ্বীপের। মুহূর্তেই একটা গন্তব্য পেয়ে গেল কোহেন—গ্রিসের হাইড্রা। হাইড্রায় অতলের তল একটু একটু করে উঁকি দিল। নাবিককেও হতে হয় ডুবুরি, ডুবুরিকে নাবিক। নাবিক পৌঁছে গন্তব্যে, ডুবুরি অতলে। মানুষকে নাবিক আর ডুবুরি দুটোই হতে হয়। অন্তর্গত এ বোধের অনুবাদে কোহেন বলে:
And Jesus was a sailor
When he walked upon the water
And he spent a long time watching
From his lonely wooden tower
And when he knew for certain
Only drowning men could see him
He said "All men will be sailors then
Until the sea shall free them”
ভূমধ্যসাগরের জল দখিনের হাওয়ায় উড়ে এসে হাইড্রাকে ভিজিয়ে দেয়। ছোট্ট একটি দ্বীপ, ধুলো উড়িয়ে যায় গাধা টানা গাড়ি। সময় এখানে মন্থর। সারাদিন লিখে বিকেলে কোহেনের আড্ডা একটি পানশালায়, সেখানে দেখা মারিয়ান্নে ইহলেনের সাথে। মারিয়ান্নের স্বামীর সাথে কোহেনের বন্ধুত্ব, সেই বন্ধুত্বের সেতু পার হয়ে মারিয়ান্নের সাথে গড়ে ওঠে প্রণয়। অতলের সন্ধানে কোহেন অনুভূতির সব রঙে নিজেকে রাঙায়। রঙ উঠে আসে তার লেখায় ও সুরে। কোহেনের প্রথম এলবাম Songs of Leonard Cohen বের হয় ১৯৬৭-তে। আপাত মেলানকোলিক স্বর কিন্তু গভীরতায় বিমূর্ত প্রার্থনার চাইতেও বিশুদ্ধ ব্যালার্ড তার সঙ্গীত। একই ধারায় এলো আরও কিছু এলবাম।
১৯৮৮-এর I’m Your Man ভিন্ন ধারা নিয়ে এলো, কি-বোর্ড আর ইলেকট্রনিক সঙ্গীতে প্রার্থনা ও অনুসন্ধানের ভাষা চিরায়ত আবেদনের পাশাপাশি সমসাময়িক ব্যঞ্জনা পেলো। নন্দিত সাধক জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। ৯০ দশকের মাঝামাঝি সাধক খুঁজলো নীরবতা, নিজেকে আড়াল করলো জেন বৌদ্ধ সাধনাগারে। ধ্যানমগ্ন কোহেনের শরীরে মন্দিরের ভেজানো জানালা দিয়ে আলো আসে, অজানার কিরণ তার শরীর কেটে অস্তিত্বের ভেতরে ঢুকে পড়ে, যেন মাখনে চাকু—তেমনি অনায়াস কিরণের ছটা। সেই কিরণে লেওনার্ড কোহেন বিস্মৃত হয়, কোনো শব্দ শোনে না, কেনো না অতলের জগত তো শব্দহীন, আদিতে কোনো নাম নেই। কোহেন সুরের ভাঁজে ভাঁজে গেঁথে দেয় অতলের উচ্চারণ:
The light came through the window
Straight from the sun above
And so inside my little room
There plunged the rays of love
In streams of light I clearly saw
The dust you seldom see
Out of which the nameless makes
A name for one like me
কিছুকাল জেন ধ্যানাগারে থেকে নাগরিক জীবনে ফিরে আসে কোহেন। জানতে পারে তার ৫ মিলিয়ন ডলার বেহাত হয়ে গেছে ম্যানেজারের কারসাজিতে। নিমিষেই কপর্দকশূন্য ষাটোর্ধ্ব কোহেন বিমুঢ়তা কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় আবারও পথে নামতে হবে—কথা ও সুর তার পুঁজি।
কোহেন তো সবসময়ই জানতো, I was born like this, I had no choice, I was born with the gift of a golden voice; তাই সোনালি কণ্ঠ আর অতলের স্বর নিয়ে নতুন পাঁচটি এলবাম ও দুই শতাধিক কনসার্ট নিয়ে ৮২ বছর বয়স পর্যন্ত কোহেন দেশ দেশান্তরে। শেষ পনেরো বছরে তরুণদের কাছে তার আবেদন হয়ে উঠেছে কল্পনাতীত যারা তাঁকে সাধারণত এড়িয়ে যেত বিষাদের নবী বলে। তৃতীয় পর্বের সঙ্গীতে কোহেন বিষাদের পোশাকের ভেতর মানুষের আত্মার মুক্তিকে তুলে এনেছে। মুক্তিতে প্রশান্তি আছে, এবং আছে উৎসব। উৎসব, প্রশান্তি ও বিষাদের যুগলবন্দী শেষ পাঁচটি এলবাম।
জগত ধোঁয়াশা, কিন্তু একটা সময়ে মানুষের হয়তো দৃষ্টি খুলে যায়। আশির্বাদপুষ্টরা বুঝতে পারে মিশন পূর্ণ হয়েছে, এবার ঘরে ফেরার পালা। ২১ অক্টোবর ২০১৬ লেওনার্ড কোহেনের শেষ এলবাম বের হয়—You Want It Darker, যেখানে কোহেন জানিয়ে দেয় “Hineni, hineni; I’m ready, my lord”। নিজেকে উৎসর্গ করার ক্ষুধা মানুষের অন্তরতর, যদিও আমরা জানি না উৎসর্গ কখন ও কাকে। সহসাই একটি মুহূর্ত উপস্থিত হয়, মানুষ জেনে যায় সময় এসেছে উৎসর্গের। “Hineni, hineni” অর্থাৎ আমি হাজির, ঘোষণা দেয়ার তিন সপ্তাহ পর লেওনার্ড কোহেন ৭ নভেম্বর ২০১৬ ফিরে যান আদিতে, জন্মের মাধ্যমে যেখান থেকে মানুষের বিচ্ছেদ এবং মৃত্যুই আবার সেখানে ফিরিয়ে আনে। মাঝখানের সময়টাতেই কেবল আমরা অতল খুঁজে বেড়াই।
অতল খুঁজতে খুঁজতে আমাদের উপলব্ধি হয় সৃষ্টি নিজেকে ভেঙে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে আছে। আমাদের কাজ অংশগুলোকে আবারও সমগ্রে ফিরিয়ে আনা। লেওনার্ড কোহেন তার শব্দ ও সুরে সেই সমগ্রকেই গেঁথেছেন। আমরা যারা এখনও অংশগুলো জোড়া দিচ্ছি এবং এখনও সমগ্রে বিলীন হওয়ার অপেক্ষায় আছি, আমাদের কাজ ও আমাদের অপেক্ষা অন্তর্দৃষ্টি পায় কোহেনের সঙ্গীতে।
No comments