রক্তাক্ত ঢাকা বিমানবন্দর ভবন by হাজিমে ইশিই
একটি
বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছিল ঢাকা। আতঙ্ক ছড়িয়েছিল জাপানেও। ঘটনা
ঘটিয়েছিল জাপানি লাল ফৌজ। যাকে বলা হয় রেড আর্মি। জাপানের উগ্রপন্থি একটি
গোষ্ঠী। ১৯৭৭ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর। ১৩৭ জন যাত্রী ও ১৪ জন ক্রু নিয়ে
জাপান এয়ারলাইনসের একটি বিমান জঙ্গিরা ছিনতাই করে ঢাকায় জরুরি অবতরণ করে।
চারদিকে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি।
ঘটনার নেপথ্যে ছিল রেড আর্মির ৯ সদস্যের মুক্তি ও ৬০ লাখ মার্কিন ডলার আদায়।
ঘটনা সুরাহায় ঢাকায় এসেছিলেন সে সময়ের জাপান সরকারের পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিই। তাঁর নেতৃত্বে সমঝোতা বৈঠকের সময়ই বাংলাদেশের বিমানবহিনীতে ঘটে নাটকীয় এক অভূত্থান।
হাজিমে ইশিই খুব কাছ থেকে সেই অভূত্থানের নানা ঘটনা অবলোকন করেছেন। মানবজমিন অনলাইন থেকে পাঠকদের জন্য সামরিক অভূত্থানের অজানা কাহিনী তুলে ধরা হলো হাজিমে ইশিই’র বয়ানে-
ঢাকা বিমানবন্দরের টার্মিনাল বিল্ডিং, অর্থাৎ মূল ভবনের ভেতরটা রক্তের সাগরে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। বিদ্রোহী সৈন্যরা সেখানে মোতায়েন বিমানবাহিনীর সেনাদের নির্মমভাবে নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে।
ওকুদাইরার বিনিময়ে যেসব জিম্মিকে উদ্ধার করা হয়, তাদের মধ্যে ১০ জন নারী যাত্রী তখন বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে ঢাকা শহরের একটি হোটেল অভিমুখে রওনা হতে যাচ্ছিলেন। সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে তারা বাইরে যেতে না পেরে আবার বিমানবন্দরে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাসহ বিশেষ বিমানে করে ঢাকায় চলে আসা প্রতিনিধিদলের সদস্যরাও বিমান থেকে বেরোনোর অনুমতি পেয়ে টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে এসে বসে রয়েছেন। অর্থাৎ ঢাকা বিমানবন্দরের মূল ভবনে সেই মুহূর্তে বহু জাপানি নাগরিক অবস্থান করছিলেন।
এমন সময় হঠাৎ গুলিবিনিময় শুরু হলো। তখন টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে ছিলেন পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা হিরোশি তেশিপাওয়ারা। তার স্মৃতিভাষ্য অনুযায়ী, ‘ঝামেলাপূর্ণ অভিবাসন-প্রক্রিয়া শেষে বিমানবন্দর ভবনে যেতে পারলাম। এর আগে বিমানে অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিমান থেকে বের হতে পেরে ভালো লাগছিল। মূল ভবনে আসার পর নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের নিচে লাগোয়া লোহার মই দিয়ে যখন উপরে যাচ্ছিলাম, তখন প্রচ- গুলির আওয়াজ আমার কানে আসে। ভাবলাম, ছিনতাইকারীরা শেষ পর্যন্ত বুঝি আক্রমণ শুরু করেছিল। তখন কেউ আমাকে চিৎকার করে মাথা নিচু করে মেঝেতে শুয়ে পড়তে বলে। যে সৈন্যরা এতক্ষণ আমাকে গাইড করে নিয়ে এসেছিলেন, তারা সবাই দেয়ালে গা লাগিয়ে আক্রমণকারীদের গুলি থেকে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছিলেন। রাত প্রায় শেষ হয়ে এলো। গুলির আওয়াজ অনবরত চলছিল। কাউকে চেঁচিয়ে বলতে শোনা গেল, বিমানবন্দরের সামনে মাতাল পুলিশরা একে অন্যকে লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছে। আবার অন্য কেউ বলছে, না, আর্মির ইউনিটগুলোর মধ্যে ক্রসফায়ার চলছে।
‘লোহার মই থেকে ঝাঁপিয়ে মেঝেতে নেমে অভিবাসন কাউন্টারের দিকে ছুটে গেলাম। জায়গাটা বিশেষ বিমান থেকে নেমে আসা জাপানি নাগরিকে ভর্তি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের সামনে বসে শীতল হাওয়া উপভোগ করতে দেখা গেল। জিজ্ঞাসা করায় তারা বললেন, সম্ভবত কোনো মহড়া চলছে।
‘কিন্তু দেখতে দেখতে গুলিবিনিময়ের আওয়াজ তীব্র হয়ে ওঠে। সেই আওয়াজ এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।’
‘আপনারা এখান থেকে নড়বেন না,’ এ কথা জানিয়ে অভিবাসন বিভাগের কর্মীরা ও বিমানবাহিনীর সৈন্যরা কোথাও মিলিয়ে গেলেন। ফলে সেখানে শুধু রইলো জাপানিরা এবং অভিবাসন কাউন্টারের ওপর ফেলে রাখা অভিবাসন কর্মীর একটি টুপি। কিছুক্ষণ পর রাইফেল হাতে দু’তিনজন সৈন্য আমাদের কাছে চলে এলো। তারা ইশারা-ইঙ্গিতে আমাদের জানালো যে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তারপর তারা পাশের ঘরে ঢুকে গেল। মনে হলো, তারা কী যেন খুঁজছে। কাছে কোনো জায়গায় আবার মেশিনগানের শব্দ হলো। এবার পাঁচ-ছয়জন সৈন্য আমাদের কাছে ছুটে এলো। তাদের একজনের সামরিক পোশাকের পেটের কাছে রক্তের দাগ লক্ষ্য করলাম। তার হাত রক্তপাত বন্ধ করার জন্য ময়লা কাপড় দিয়ে বাঁধা।
সৈন্যদের হাতে থাকা বন্দুকের সেফটি বোল্ট খোলা এবং তাদের আঙুল ট্রিগারের ওপর রাখা। তারা কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমরা যে ঘরে আছি, তার চারদিকে ঘুরে দেখার সময় তারা রাইফেলের মুখ উঁচিয়ে রাখে বলে আমরা ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। সৈন্যরা আমাদের ঘর থেকে বের হয়ে পাশের ঘরে যাওয়া মাত্র সেখান থেকে বিকট আওয়াজ শোনা গেল। শব্দটা শুনে আমরা সবাই মেঝেতে পড়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর গুলিবর্ষণের শব্দ থেমে গেল। সেনাদের পায়ের শব্দও আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে গেল।
কিন্তু একেবারে নিশ্চিন্ত হওয়ার সময় তখনো আসেনি। অন্যদিক থেকে আলাদা এক সেনাদল এসে আমাদের ঘরে প্রবেশ করে আবার বেরিয়ে গেল। অদূর থেকে গুলির শব্দ ও চিৎকার শোনা যাচ্ছিল।
বেশ কয়েকবার এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ততক্ষণে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এজেন্সি জাইকার ঢাকায় নিযুক্ত একজন কর্মী এসে হাজির হন। তার মুখ থেকে পরিস্থিতির বিশদ বিবরণ শুনতে পেলাম। বিমানবন্দরের মূল ভবন এখন বিদ্রোহী সেনাদের নিয়ন্ত্রণে। কম বেতনে অসন্তুষ্ট হয়ে সামরিক বাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈন্য এই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে এবং কিছু সামরিক অফিসারকে হত্যা করেছে বলে আমরা জানতে পারলাম। বিমানবন্দরের সামনে অবস্থিত অফিসারদের ক্লাব, ব্যারাক ও বিমানবন্দরের ভেতরে নাকি গুলিবিনিময় চলছিল।
জাপানিরা মূলত চারটি জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। আমাদের বলা হলো, যে যেখানে আছি, সেখানে থেকে গেলে প্রাণের কোনো ভয় থাকবে না।
এ সময় গুলির আওয়াজ থেমে গেল। আমরা দরজার ফাঁক দিয়ে ভয়ে ভয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম। সেখানে যাত্রী বোঝাই বাস ও রিকশা ছুটে চলছে। স্বাভাবিক, প্রাত্যহিক জীবনের চিত্র সেখানে দেখতে পেলাম। এখানে যা ঘটে যাচ্ছে, তা বাস্তব ঘটনা বলে মনে হয়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মি. হিদেয়াকি উয়েদার সেই ঘটনার কথা মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘সকাল ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে বিমানবন্দরে মোতায়েন বিমানবাহিনীর কয়েকজন সৈন্য বিদ্রোহ করেন এবং মূল ভবনসহ সমস্ত বিমানবন্দর এলাকা দখলে নেন। আতঙ্কগ্রস্ত সামরিক অফিসাররা যাতে তাদের পরিচয় জানা না যায়, সে জন্য কাঁধে লাগানো এমব্লেম ছিঁড়ে পালিয়ে যেতে থাকেন। তবে সেনারা তাদের লক্ষ্য করে গুলি করেন। ভয়ঙ্কর আর্তনাদ ও গুলির শব্দ আমাদের কানে আসতে থাকে।
‘এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদও বিমানবন্দর ছেড়ে চলে গেছেন। এক সময় একতলায় সাত-আটজন সেনা তাকে ঘিরে ধরলেও তিনি সাফল্যের সঙ্গে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন। কিন্তু তার একজন সহযোগী তরুণ সামরিক অফিসার টাওয়ার থেকে বেরোনোর মুখে বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন।
‘বিমানবন্দরে সব জাপানির ওপর সৈন্যরা নিরাপত্তা বিধানের জন্য অনুসন্ধান চালিয়েছেন। বিদেশিদের কখনো ক্ষতি করা হবে না বলে কথা দিয়েছেন তারা। তা শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হলেও আমরা যে যেখানে আছি, সেখান থেকে অন্যত্র যাওয়ার কোনো অনুমতি মেলেনি। ‘বিদ্রোহীরা সকাল সাতটার মধ্যে সমস্ত বিমানবন্দর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং বিদেশি ছাড়া সবাইকে ধরে নিয়ে যায়।’
ঘটনার নেপথ্যে ছিল রেড আর্মির ৯ সদস্যের মুক্তি ও ৬০ লাখ মার্কিন ডলার আদায়।
ঘটনা সুরাহায় ঢাকায় এসেছিলেন সে সময়ের জাপান সরকারের পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিই। তাঁর নেতৃত্বে সমঝোতা বৈঠকের সময়ই বাংলাদেশের বিমানবহিনীতে ঘটে নাটকীয় এক অভূত্থান।
হাজিমে ইশিই খুব কাছ থেকে সেই অভূত্থানের নানা ঘটনা অবলোকন করেছেন। মানবজমিন অনলাইন থেকে পাঠকদের জন্য সামরিক অভূত্থানের অজানা কাহিনী তুলে ধরা হলো হাজিমে ইশিই’র বয়ানে-
ঢাকা বিমানবন্দরের টার্মিনাল বিল্ডিং, অর্থাৎ মূল ভবনের ভেতরটা রক্তের সাগরে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। বিদ্রোহী সৈন্যরা সেখানে মোতায়েন বিমানবাহিনীর সেনাদের নির্মমভাবে নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে।
ওকুদাইরার বিনিময়ে যেসব জিম্মিকে উদ্ধার করা হয়, তাদের মধ্যে ১০ জন নারী যাত্রী তখন বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে ঢাকা শহরের একটি হোটেল অভিমুখে রওনা হতে যাচ্ছিলেন। সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে তারা বাইরে যেতে না পেরে আবার বিমানবন্দরে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাসহ বিশেষ বিমানে করে ঢাকায় চলে আসা প্রতিনিধিদলের সদস্যরাও বিমান থেকে বেরোনোর অনুমতি পেয়ে টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে এসে বসে রয়েছেন। অর্থাৎ ঢাকা বিমানবন্দরের মূল ভবনে সেই মুহূর্তে বহু জাপানি নাগরিক অবস্থান করছিলেন।
এমন সময় হঠাৎ গুলিবিনিময় শুরু হলো। তখন টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে ছিলেন পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা হিরোশি তেশিপাওয়ারা। তার স্মৃতিভাষ্য অনুযায়ী, ‘ঝামেলাপূর্ণ অভিবাসন-প্রক্রিয়া শেষে বিমানবন্দর ভবনে যেতে পারলাম। এর আগে বিমানে অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিমান থেকে বের হতে পেরে ভালো লাগছিল। মূল ভবনে আসার পর নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের নিচে লাগোয়া লোহার মই দিয়ে যখন উপরে যাচ্ছিলাম, তখন প্রচ- গুলির আওয়াজ আমার কানে আসে। ভাবলাম, ছিনতাইকারীরা শেষ পর্যন্ত বুঝি আক্রমণ শুরু করেছিল। তখন কেউ আমাকে চিৎকার করে মাথা নিচু করে মেঝেতে শুয়ে পড়তে বলে। যে সৈন্যরা এতক্ষণ আমাকে গাইড করে নিয়ে এসেছিলেন, তারা সবাই দেয়ালে গা লাগিয়ে আক্রমণকারীদের গুলি থেকে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছিলেন। রাত প্রায় শেষ হয়ে এলো। গুলির আওয়াজ অনবরত চলছিল। কাউকে চেঁচিয়ে বলতে শোনা গেল, বিমানবন্দরের সামনে মাতাল পুলিশরা একে অন্যকে লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছে। আবার অন্য কেউ বলছে, না, আর্মির ইউনিটগুলোর মধ্যে ক্রসফায়ার চলছে।
‘লোহার মই থেকে ঝাঁপিয়ে মেঝেতে নেমে অভিবাসন কাউন্টারের দিকে ছুটে গেলাম। জায়গাটা বিশেষ বিমান থেকে নেমে আসা জাপানি নাগরিকে ভর্তি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের সামনে বসে শীতল হাওয়া উপভোগ করতে দেখা গেল। জিজ্ঞাসা করায় তারা বললেন, সম্ভবত কোনো মহড়া চলছে।
‘কিন্তু দেখতে দেখতে গুলিবিনিময়ের আওয়াজ তীব্র হয়ে ওঠে। সেই আওয়াজ এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।’
‘আপনারা এখান থেকে নড়বেন না,’ এ কথা জানিয়ে অভিবাসন বিভাগের কর্মীরা ও বিমানবাহিনীর সৈন্যরা কোথাও মিলিয়ে গেলেন। ফলে সেখানে শুধু রইলো জাপানিরা এবং অভিবাসন কাউন্টারের ওপর ফেলে রাখা অভিবাসন কর্মীর একটি টুপি। কিছুক্ষণ পর রাইফেল হাতে দু’তিনজন সৈন্য আমাদের কাছে চলে এলো। তারা ইশারা-ইঙ্গিতে আমাদের জানালো যে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তারপর তারা পাশের ঘরে ঢুকে গেল। মনে হলো, তারা কী যেন খুঁজছে। কাছে কোনো জায়গায় আবার মেশিনগানের শব্দ হলো। এবার পাঁচ-ছয়জন সৈন্য আমাদের কাছে ছুটে এলো। তাদের একজনের সামরিক পোশাকের পেটের কাছে রক্তের দাগ লক্ষ্য করলাম। তার হাত রক্তপাত বন্ধ করার জন্য ময়লা কাপড় দিয়ে বাঁধা।
সৈন্যদের হাতে থাকা বন্দুকের সেফটি বোল্ট খোলা এবং তাদের আঙুল ট্রিগারের ওপর রাখা। তারা কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমরা যে ঘরে আছি, তার চারদিকে ঘুরে দেখার সময় তারা রাইফেলের মুখ উঁচিয়ে রাখে বলে আমরা ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। সৈন্যরা আমাদের ঘর থেকে বের হয়ে পাশের ঘরে যাওয়া মাত্র সেখান থেকে বিকট আওয়াজ শোনা গেল। শব্দটা শুনে আমরা সবাই মেঝেতে পড়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর গুলিবর্ষণের শব্দ থেমে গেল। সেনাদের পায়ের শব্দও আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে গেল।
কিন্তু একেবারে নিশ্চিন্ত হওয়ার সময় তখনো আসেনি। অন্যদিক থেকে আলাদা এক সেনাদল এসে আমাদের ঘরে প্রবেশ করে আবার বেরিয়ে গেল। অদূর থেকে গুলির শব্দ ও চিৎকার শোনা যাচ্ছিল।
বেশ কয়েকবার এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ততক্ষণে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এজেন্সি জাইকার ঢাকায় নিযুক্ত একজন কর্মী এসে হাজির হন। তার মুখ থেকে পরিস্থিতির বিশদ বিবরণ শুনতে পেলাম। বিমানবন্দরের মূল ভবন এখন বিদ্রোহী সেনাদের নিয়ন্ত্রণে। কম বেতনে অসন্তুষ্ট হয়ে সামরিক বাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈন্য এই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে এবং কিছু সামরিক অফিসারকে হত্যা করেছে বলে আমরা জানতে পারলাম। বিমানবন্দরের সামনে অবস্থিত অফিসারদের ক্লাব, ব্যারাক ও বিমানবন্দরের ভেতরে নাকি গুলিবিনিময় চলছিল।
জাপানিরা মূলত চারটি জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। আমাদের বলা হলো, যে যেখানে আছি, সেখানে থেকে গেলে প্রাণের কোনো ভয় থাকবে না।
এ সময় গুলির আওয়াজ থেমে গেল। আমরা দরজার ফাঁক দিয়ে ভয়ে ভয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম। সেখানে যাত্রী বোঝাই বাস ও রিকশা ছুটে চলছে। স্বাভাবিক, প্রাত্যহিক জীবনের চিত্র সেখানে দেখতে পেলাম। এখানে যা ঘটে যাচ্ছে, তা বাস্তব ঘটনা বলে মনে হয়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মি. হিদেয়াকি উয়েদার সেই ঘটনার কথা মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘সকাল ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে বিমানবন্দরে মোতায়েন বিমানবাহিনীর কয়েকজন সৈন্য বিদ্রোহ করেন এবং মূল ভবনসহ সমস্ত বিমানবন্দর এলাকা দখলে নেন। আতঙ্কগ্রস্ত সামরিক অফিসাররা যাতে তাদের পরিচয় জানা না যায়, সে জন্য কাঁধে লাগানো এমব্লেম ছিঁড়ে পালিয়ে যেতে থাকেন। তবে সেনারা তাদের লক্ষ্য করে গুলি করেন। ভয়ঙ্কর আর্তনাদ ও গুলির শব্দ আমাদের কানে আসতে থাকে।
‘এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদও বিমানবন্দর ছেড়ে চলে গেছেন। এক সময় একতলায় সাত-আটজন সেনা তাকে ঘিরে ধরলেও তিনি সাফল্যের সঙ্গে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন। কিন্তু তার একজন সহযোগী তরুণ সামরিক অফিসার টাওয়ার থেকে বেরোনোর মুখে বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন।
‘বিমানবন্দরে সব জাপানির ওপর সৈন্যরা নিরাপত্তা বিধানের জন্য অনুসন্ধান চালিয়েছেন। বিদেশিদের কখনো ক্ষতি করা হবে না বলে কথা দিয়েছেন তারা। তা শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হলেও আমরা যে যেখানে আছি, সেখান থেকে অন্যত্র যাওয়ার কোনো অনুমতি মেলেনি। ‘বিদ্রোহীরা সকাল সাতটার মধ্যে সমস্ত বিমানবন্দর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং বিদেশি ছাড়া সবাইকে ধরে নিয়ে যায়।’
No comments