আঙুলবিহীন হাতেই এইচএসসি জয়
সেই ছোট বেলায় আগুনে পুড়ে দু’হাতের সবক’টি আঙুল হারায় শাহ আলম। কিন্তু মনোবল হারায়নি কখনোই। তাই শিক্ষা অর্জনের বাসনায় আঙুলবিহীন হাত নিয়েই স্থানীয় এক ব্র্যাক স্কুলে ভর্তি হয়। তবে পাড়া-প্রতিবেশী থেকে শুরু করে পরিবারের লোকজনও ভেবেছিলেন, পড়তে গেলে লিখতেও হয়। যেহেতু তার দু’হাতের একটিও আঙুল নেই, সেহেতু পড়ালেখায় খুব বেশি এগোতে পারবে না এ শারীরিক প্রতিবন্ধী। কিন্তু সবার জল্পনা-কল্পনা উড়িয়ে দিয়ে দু’হাতের কব্জির সাহায্যেই অ-আ, ১-২ লিখতে থাকে সে। একপর্যায়ে সেই লেখা হয়ে ওঠে আর দশজন শিক্ষার্থীর মতোই সুন্দর। আর তাই প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে জেএসসি ও এসএসসি জয়ের পর এবার সেই শাহ আলমই অভাবনীয় সাফল্য এনেছে এইচএসসির ফলেও। রোববার প্রকাশিত ফলে যেখানে অনেক কলেজেরই কম-বেশি শিক্ষার্থী ফেল করেছে। সেখানে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার অদম্য মেধাবী শাহ আলমের আঙুলবিহীন হাতের এ সাফল্য সত্যিই গর্বিত করে তুলেছে পরিবারসহ পাড়া-প্রতিবেশীদেরও। তার বাড়ি উপজেলার পূর্ব বিছনদই গ্রামে। হাতীবান্ধা আলিমুদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে এইচএসসি বাণিজ্য বিভাগ থেকে এ বছর পরীক্ষায় অংশ নেয় সে। শাহ আলমের কয়েকজন বন্ধু জানিয়েছে, আঙুলবিহীন হাতে খুব দ্রুত লিখতে পারে শাহ আলম। এতে তার লেখা আর দশজন শিক্ষার্থীর চেয়েও অনেক সুন্দর। শুধু তাই নয়, শাহ আলম তার দু’হাতের কব্জি ও পায়ের সাহায্যে জ্যামিতি আঁকতে বেশ পারদর্শী। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলায় বেশ আগ্রহ তার। আঙুল না থাকলেও কব্জির সাহায্যেই যেমন ক্রিকেটের বল করতে পারে, তেমনি ব্যাট ধরেও ভালো রান তুলতে পারে বলে জানায় শাহ আলমের সহপাঠীরা। জানা যায়, উপজেলার পূর্ব বিছনদই গ্রামের একরামুল-মরিয়ম দম্পতির ছেলে শাহ আলম। বাবা বর্গাচাষী। মা গৃহিণী। ৫ ভাই-বোনের মধ্যে সে চতুর্থ। শিশুকালে তার দু’হাতের কবজি পর্যন্ত আগুনে পুড়ে যায়। দরিদ্র বাবা-মা চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে না পারায় শেষ পর্যন্ত দুই হাতের সবগুলো আঙুলই হারাতে হয় শাহ আলমকে। কিন্তু ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার অদম্য ইচ্ছা ছিল তার।
স্থানীয় একটি ব্র্যাক স্কুলে লেখাপড়া শুরু। এরপর সমাপনী পরীক্ষায় ভালো ফল করায় পড়ালেখার সেই ইচ্ছে শক্তি আরও বেড়ে যায়। তবে পরিবারের অভাব-অনটন প্রায় সময় বাদ সাধলেও থেমে যায়নি শাহ আলম। খেয়ে না খেয়ে পড়াশোনা চালিয়ে পিইসি, জেএসসি ও এসএসসিতে ভালো ফল করে এবার এইচএসসিতে ৩.৪২ পেয়ে বেশ কৃত্বিতের সঙ্গে পাস করেছে। শাহ আলম জানায়, শারীরিক প্রতিবন্ধকতার চেয়েও সংসারের অভাব-অনটনই তার পড়ালেখায় সবচেয়ে বেশি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে সব বাধা পেরিয়ে ভবিষ্যতে ব্যাংকার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে অদম্য মেধাবী শাহ আলম। জানতে চাইলে শাহ আলমের মা মরিয়ম বেগম বলেন, এক বছর বয়সে হঠাৎ একদিন হামাগুড়ি দেয়ার সময় উঠানের ভুসির আগুনে পড়েছিল শাহ আলম। টাকার অভাবে ওই সময় ভালো চিকিৎসা করতে না পারায় তার সবগুলো আঙুল হারাতে হয়। তবে ৫ বছর বয়সে দু’হাতের আঙুল হারানো শাহ আলম পড়ালেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। তাই সন্তানের ইচ্ছা মেটাতেই বাধ্য হয়ে স্কুলে ভর্তি করে দেই। আজ সেই ছেলে আমার এইচএসসি পাস করেছে। এতে আমার কি যে ভালো লাগছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না বলে জানান মা মরিয়ম বেগম। বাবা একরামুল বলেন, তার ছেলে আগুনে দুটো হাতের সবগুলো আঙুল হারালেও মনোবল হারায়নি কখনও। আর তাই সে এখন লেখাপড়া করে ব্যাংকে চাকরি করবে বলে স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু সাত সদস্যের অভাব-অনটনের সংসারে চাহিদা মেটাতে গিয়ে ছেলের সেই স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত পূরণ হবে কিনা- এমন শঙ্কা বাবা একরামুলের। হাতীবান্ধা আলিমুদ্দিন কলেজের অধ্যক্ষ সরওয়ার হায়াত খান যুগান্তরকে বলেন, শারীরিক আর সাংসারিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেই শাহ আলম কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেছে। সমাজের বিত্তবানরা তার পাশে দাঁড়ালে ভবিষ্যতে শাহ আলম আরও ভালো করবে বলে জানান তিনি।
No comments