পারস্পরিক সহযোগিতার সুযোগ বেড়েছে
দেশে ঝটিকা সফর করে গেলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। সফরটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, যার একটি দিক হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা। তাঁর সফরে এই বিষয়টিই সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে। ইএমকে সেন্টারে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেছেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে একত্রে কাজ করবে। বাংলাদেশ সব সময় বলে আসছে, এখানকার সন্ত্রাসীরা হোম গ্রোন বা দেশে বেড়ে ওঠা। তবে জন কেরি বলেছেন, দেশে বেড়ে ওঠা জঙ্গিদের সঙ্গে আইএসের যোগাযোগ আছে। আসলে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় মার্কিন দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রটি অনেক বড়। কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ তো নিজের মতো সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই জঙ্গিরা কারা, কোথাকার, সেটা বড় বিষয় নয়। এখানে আদর্শটাই বড় কথা। সিরিয়ার আইএস ও বাংলাদেশের নব্য জেএমবি বা আনসার আল-ইসলামের আদর্শ কিন্তু একই। আজকের যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। তথ্যপ্রযুক্তি বা ইন্টারনেটের কল্যাণে এই আদর্শ আজ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে এটার আর শুদ্ধ দেশজ চরিত্র নেই। সন্ত্রাসবাদ যেমন আঞ্চলিক, তেমনি আন্তর্জাতিক চরিত্রও আছে। এ ব্যাপারটা আমাদের বোঝা দরকার। আমরা না হয় নিজ দেশে কী হচ্ছে না হচ্ছে সে খবর পাচ্ছি। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কী হচ্ছে, সে খবর আমরা কোত্থেকে পাব।
নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে। এ কাজে বাংলাদেশের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে বিভিন্ন পর্যায়ে সাহায্য করছে। ফলে এখন আমরা সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় আরও কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নিতেই পারি। যেমন, ইন্টারনেটের মাধ্যমেই যেহেতু এই আদর্শ বিস্তৃত হচ্ছে, সে কারণে আমাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথ্যপ্রযুক্তিতে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। ফলে আমাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে তার সহযোগিতা নেওয়া যেতেই পারে। আমি মনে করি, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার প্রশ্নে আমাদের একদম ধরাবাঁধা অবস্থান না নিয়ে উন্মুক্ত হওয়া দরকার। বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবে দেখে যখন যা করা দরকার, তখন সেটাই করা উচিত। যেটা আমরা করতে পারব না, সেটার জন্য তার দ্বারস্থ হওয়াই যায়। তবে এটা আমাদেরই ঠিক করতে হবে, কোন কোন ক্ষেত্রে সহযোগিতা নেওয়া যায়। সন্ত্রাসী হামলার কিছুটা দৃশ্যমান, আর কিছুটা অদৃশ্য। আমরা কিছুটা জানি, আবার কিছুটা জানি না। কেন তরুণেরা সন্ত্রাসবাদের দিকে ঝুঁকছেন, তার অবশ্যই সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। মূলত হতাশা থেকেই তাঁরা এ দিকে যাচ্ছেন বলে ধারণা করা হয়। তাঁদের এই হতাশা দূর করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এই হতাশা দূর করতে সুশাসন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা দরকার। সুশাসন মানুষের অধিকার বাস্তবায়নের সুযোগ সৃষ্টি করে। এটা থাকলে অনেক কিছুই মোকাবিলা করা যায়। সে কারণে এখন রাজনৈতিক গবেষকেরা সুশাসনের ওপর জোর দিয়ে থাকেন।
আইনের শাসন না থাকলে অনেক কিছুই ঘটতে পারে, যা আমাদের কাঙ্ক্ষিত নয়। একটা সমাজে এগুলো না থাকার অর্থ হলো, সেই সমাজে মানুষের সমতার অভাব রয়েছে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে গণতন্ত্রের ঘাটতি রয়েছে। সেটা হলে বঞ্চিত মানুষের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়। যে হতাশা মানুষকে অন্ধকার পথে নিয়ে যেতে পারে। তাই গণতন্ত্র খুব জরুরি বিষয়। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে গণতন্ত্র সমুন্নত রেখে সন্ত্রাস দমনে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছে, তার সঙ্গে দ্বিমত করার কিছু নেই। জন কেরির সফরে রাজনৈতিক পর্যায়ে যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে তার ইতিবাচক দিক রয়েছে। কারণ, একটা বিষয় খেয়াল করার মতো, জন কেরি দেশে খুব অল্প সময়ের জন্য থাকলেও প্রায় সব শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে তিনি মতবিনিময় করেছেন। তিনি যেমন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, তেমনি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। আবার তিনি নাগরিক সমাজ, তরুণ ও সাংবাদিকদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেছেন। অর্থাৎ তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর কথা শুনেছেন। সামগ্রিকভাবে দেশের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করেছেন, যেটা আমাদেরও করা উচিত। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বছর জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে জন কেরিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, সুযোগ পেলেই আসবেন। তিনি এলেনও। ফলে এই সফরটি খুবই ইতিবাচক। আর সরকার সার্বিকভাবে এই সফরের সফলতা দাবি করতেই পারে।
এম হুমায়ুন কবির: সাবেক রাষ্ট্রদূত।
এম হুমায়ুন কবির: সাবেক রাষ্ট্রদূত।
No comments