নির্বাচন ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী

বাংলাদেশের সংবিধান সরকারি কর্মচারীদের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নামে আখ্যায়িত করেছে। কিন্তু বাস্তব সব অর্থে তাঁরা সরকারি কর্মচারী। কর্মকর্তাদের নিয়োগ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সুপারিশে হলেও তাঁদের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতিসহ প্রায় সব বিষয় সরকারের ইচ্ছাতেই হয়। কর্মচারীদের তো নিয়োগ থেকে বরখাস্ত পর্যন্ত সব ক্ষমতাই সরকারের হাতে। কর্মকর্তা আর কর্মচারীনির্বিশেষে চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পুরো হলে ১৯৭৪ সালের গণকর্মচারী অবসর আইনের বিধান অনুসারে কোনো কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে যে কাউকে অবসরে পাঠানো যায়। সুতরাং সংবিধানপ্রণেতাদের সদিচ্ছার সঙ্গে বাস্তবের ফারাক অনেক। তাই সরকার তাঁদের বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। আর এর অনেক কিছুই বেআইনি। তবে সরকার পরিবর্তন হলেও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ঘটে না। তাই সরকারের তল্পিবাহকের অপবাদটি তাঁদের বহন করতে হচ্ছে। এর ব্যাপ্তি গোটা বেসামরিক প্রশাসন। পরিসর সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন। এর ফলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা আইনানুগভাবে তাঁদের দায়িত্ব সম্পাদনে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন বেশ কিছু ক্ষেত্রে। উল্লেখ্য, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর সংজ্ঞায় বেসামরিক কাজে নিযুক্ত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ধরে নেওয়া হয়েছে। নির্বাচন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অতি প্রয়োজনীয় একটি কার্যক্রম। সেটা জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচন যা-ই হোক, সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
নির্বাচন পরিচালনার মূল দায়িত্বে থাকে নির্বাচন কমিশন। সংবিধান অনুসারে কমিশন একটি স্বাধীন সংস্থা। এ বিধানটিও সংবিধানপ্রণেতারা সচেতনভাবে সংযোজন করেছেন। নিশ্চয়ই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগে কোনো বাধার সম্মুখীন হবেন না। সক্ষম হবেন পছন্দমতো তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচনে। তবে একটি নির্বাচন পরিচালনায় বিপুলসংখ্যক জনবলের প্রয়োজনীয়তা থাকে। শুধু কমিশনের নিয়মিত জনবল দিয়ে তা সম্ভব নয়। তদুপরি আবশ্যক উপযুক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা। নিরাপত্তার মূল দায়িত্ব পুলিশের। সহায়তা দেয় র‌্যাব, বিজিবি ও আনসার। প্রয়োজনকালে কমিশন সামরিক বাহিনীকেও তলব করে। তবে তারা মূলত স্ট্রাইকিং ফোর্সের কাজে ব্যবহূত হয়। প্রকৃতপক্ষে মাঠপর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয় স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকে। এ ক্ষেত্রেও সংবিধানপ্রণেতারা বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁরা কমিশনের কাছে এসব কর্মচারীকে নির্বাচনকালীন ন্যস্ত করার বিধান রেখেছেন। আইনে রয়েছে, নির্বাচন সময়কালে তাঁরা কমিশনের কর্মচারী। তাঁদের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ তখন কমিশনের হাতে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কিছু বলে। সাম্প্রতিক সময়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন চলছে। জানুয়ারির শুরুতে গেল জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনটিতে প্রধান প্রধান কয়েকটি দলের অংশগ্রহণ ছিল না। তাই এর ফলাফল জনমতের প্রতিধ্বনি কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলার সুযোগ নেই। উল্লেখ্য, অর্ধেকের বেশি আসনে প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। জনপ্রিয়তার মাপকাঠি যার যেটুকু থাকুক, সেই নির্বাচনটিতে ভোটারদের অংশগ্রহণ তেমন কিছু ছিল না বললে অত্যুক্তি হবে না। কমিশন প্রকাশিত ফলাফলে অবশ্য ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে।
উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, এ ধরনের চিত্র আমরা অতীতেও দেখে অভ্যস্ত। যা-ই হোক, সংসদ নির্বাচনের পরপরই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হলো। নির্বাচনটি নির্দলীয় হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। আইনের বিধান ভিন্নরূপ হলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচন বেশ আগে থেকেই রাজনৈতিক রূপ পেয়েছে। এবার হয়তো বা একটু বেশি মাত্রায়। কমিশন নির্লিপ্ত। মনে হচ্ছে, তারা এটাকে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্য বলে ধরে নিয়েছে। তবে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ঘিরে শুরু হয় ব্যাপক রাজনৈতিক তৎপরতা। জনগণের অংশগ্রহণও হতে থাকে পর্যাপ্ত। আশা করা হয়েছিল, বিগত জাতীয় নির্বাচনের ঘাটতি কিছুটা হলেও এখানে পুষিয়ে যাবে। কিন্তু সব সময়ে যা হওয়া উচিত তা হয় না, অন্তত আমাদের দেশে। পাঁচটি পর্বে ভাগ করে এ নির্বাচন হচ্ছে। তিন পর্ব শেষ হলো। সন্ত্রাস, কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপারে গণহারে সিল মারা—এজাতীয় অনিয়ম ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলছে। বাড়ছে আচরণবিধি ভঙ্গের ঘটনা। স্থানীয় একটি ইংরেজি দৈনিক উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে ১৪ মার্চ একটি খবরের শিরোনাম করেছে ‘নির্বাচন কমিশন সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণে নেই। স্থানীয় প্রশাসন, ক্ষমতাসীন দল সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে বাধা’। খবরটির মূল প্রতিপাদ্য স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুসারে অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করছে না। বরং তাদের কার্যক্রম স্থানীয় আইনপ্রণেতা ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নির্দেশেই পরিচালিত হচ্ছে। মন্ত্রী, সাংসদদের অযাচিত হস্তক্ষেপ এই নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশকে ব্যাহত করছে বলেও খবরে উল্লেখ রয়েছে। নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের ঘটনা ক্রমবর্ধমান প্রতিদিনই খবরের কাগজে আসছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোনো বিষয়ে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ কমিশন কিংবা তাদের পক্ষে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নিয়েছেন, এমনটা জানা যায় না। বরং এজাতীয় একটি ক্ষেত্রে নড়াইলের লোহাগড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অসম্মানজনকভাবে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন বলে খবরের কাগজে দেখা যায়।
জানা যায়, তাঁর ‘এই হঠকারী’ কার্যক্রমের জন্য অনেক ঘাট মেনে রেহাই পেয়েছেন সরকারি দলের নেতাদের কাছ থেকে। অথচ তিনি আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বলেই গণমাধ্যমে জানা যায়। এ পরিস্থিতিতে কমিশন ও সেই জেলার ডিসি ও এসপি কী করলেন, তা জানার কৌতূহল অনেকের। তবে যেটা কাউকে বলে দিতে হবে না যে, এ ধরনের পদক্ষেপ সহসা নিতে আর কোনো কর্মকর্তার সাহসী হওয়ার কথা নয়। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা আজ এজাতীয় অনেক ক্ষেত্রেই অসহায় অংশীদার। ক্ষেত্রবিশেষে তাঁদের কেউ কেউ এ ধরনের অনিয়মে সক্রিয় থাকেন বটে। জনগণ কিন্তু নির্বিঘ্নে তাঁদের পছন্দমতো ব্যক্তিকে ভোটটি দিতে চান। আর চান সেই ভোটের গণনায় প্রকৃত পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটবে। নির্বাচন কমিশনের আওতায় কর্মরত প্রজাতন্ত্রের সব কর্মচারীর দায়িত্ব এটা নিশ্চিত করা। কমিশনের কাছেও প্রত্যাশা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সদিচ্ছার পাশাপাশি দৃঢ়তা। আর অবশ্যই এ কাজটা করবে তাদের আওতাধীন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা। প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী কমিশন। আর এই ক্ষমতার যথার্থ প্রয়োগ পরবর্তী অনিয়ম হ্রাসে সহায়ক হতে পারে। আলোচনা প্রাসঙ্গিক যে, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের মাঝপথে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দেড় মাস ছুটি ও বিদেশ গমন নানা প্রশ্নের অবতারণা করেছে। এ ধরনের একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে তাঁর উপস্থিতি আবশ্যক ছিল। কাজ আটকে থাকবে না, তবে নির্বাচনটি শেষ করার পর তিনি ‘ক্লান্তি দূর করতে বিশ্রামে যেতে পারতেন’। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা এই দায়িত্ব পালনে অক্ষম নন, তা দেখা গেছে ১৯৯১, ১৯৯৬-এর জুন, ২০০১ আর ২০০৮-এর নির্বাচনে। আবার সেই কর্মচারীদের অক্ষমতাই দেখতে পাওয়া গেছে গত দুই দশকের একাধিক নির্বাচনে।
এর আগেও দুই ধরনের চিত্রই দেখেছেন দেশবাসী। দুই দশকের সাফল্য যেখানে সেটা হতে পারে তখনকার নির্দলীয় সরকারের অঙ্গীকারের ফল। পঞ্চদশ সংশোধনী জাতীয় নির্বাচনকালে সে ধরনের সরকারব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়েছে। সুতরাং গণতন্ত্রকে কার্যকর রাখতে হলে জাতীয় নির্বাচনকালে এখন ক্ষমতাসীন সরকারকেই নির্দলীয় সরকারের মতো আচরণ করতে হবে। তা করতে হবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকালেও। বর্তমান সাংবিধানিক ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশনকে অনেক বেশি সক্রিয় হওয়ার আবশ্যকতাও আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। দেশের সুদূরপ্রসারী বৃহত্তর স্বার্থকে বিবেচনায় না নেওয়া হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা অমূলক বলা যাবে না। আমাদের স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। ওই চেতনা সবাইকে ধারণ করা উচিত। এ বিষয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করবে না। তবে সেই চেতনা বহুমাত্রিক। আর এর একটি অবশ্যই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা কর্মসূচি আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রস্তুতি পর্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সেই ছয় দফার প্রথম দফাতেই সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার অঙ্গীকার রয়েছে। একে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। আর সর্বজনীন ভোটাধিকার নিশ্চিত করতেই স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থা। পাশাপাশি তার এত ক্ষমতা। তবে অতি অবশ্যই এখানে সরকারের সদিচ্ছা অতি প্রয়োজনীয় একটি দিক। এটা থাকলে দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা এমনিতেই নিরপেক্ষ হবেন। ব্যতিক্রমগুলোকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতাও কমিশনের রয়েছে। তবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরাই নির্বাচন কমিশনের মূল হাতিয়ার। আর সুষ্ঠু নির্বাচন করার সক্ষমতা তাঁদের রয়েছে। ব্যর্থতার ইতিহাসও একেবারে কম নয়। কারণও সবার জানা। বিষয়টি প্রমাণিতও হয়েছে বারবার। ব্যর্থ কেউ হতে চায় না। আমাদেরও ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। তাই প্রয়োজন সাফল্যের পথে চলার দৃঢ় প্রত্যয়।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.