খরা তো বটেই, বড় ভূমিকম্পেরও কারণ হতে পারে টিপাইমুখ by আরিফুজ্জামান তুহিন ও ওবায়দুর রহমান মাসুম

সুরমা ও কুশিয়ারার প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ শুকিয়ে গিয়ে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনায় ধান আগের মতো ফলবে না। বন্ধ হয়ে যাবে হাওর অঞ্চলের একফসলি জমিতে ধানচাষ। শুধু সিলেট ও মৌলভীবাজারেই যথাক্রমে ৩০ হাজার ১২৩ হেক্টর এবং ৫২০ হেক্টর প্লাবনভূমি কমে যাবে। বর্ষায় জলমগ্ন হবে না সুরমা ও কুশিয়ারার উজানের ৭১ শতাংশ এলাকা।


কুশিয়ারার বাম তীরের বরদাল হাওর শুকনো মৌসুমে পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে। কাউয়ার দিঘির হাওর দুই হাজার ৯৭৯ হেক্টর জলাভূমি হারাবে।
দুঃসংবাদ আরো আছে। বরাক নদ থেকে অমলসিধ পয়েন্টে সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা নদীর দিকে পানিপ্রবাহ জুন মাসে ১০ শতাংশ, জুলাইয়ে ২৩ শতাংশ, আগস্টে ১৬ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে ১৫ শতাংশ কমে যাবে। জুলাই মাসের দিকে অমলসিধ স্টেশনে কুশিয়ারা নদীর পানির উচ্চতা কমবে গড়ে এক মিটারেরও বেশি। এ ছাড়া ফেঞ্চুগঞ্জ, শেরপুর ও মারকুলি স্টেশনের দিকে
কমবে যথাক্রমে ২৫ সেন্টিমিটার এবং ৭৫ সেন্টিমিটার করে। একই সময়ে সুরমা নদীর পানির উচ্চতা সিলেট ও কানাইঘাট স্টেশনে ২৫ সেন্টিমিটার এবং ৭৫ সেন্টিমিটার করে কমে যাবে। আর শুকনো মৌসুমে বরাক-সুরমা-কুশিয়ারা থেকে আগস্ট মাসে ১৮ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে ১৭.৫ শতাংশ পানি প্রত্যাহার করবে ভারত।
টিপাইমুখ বাঁধ হলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা ২০০৫ সালে এক গবেষণাপত্রে এভাবেই তুলে ধরে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং। গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, বাঁধ নির্মাণের ফলে প্লাবনভূমির প্লাবনের ধরন, পরিমাণ এবং ঋতুই বদলে যাবে। টিপাইমুখ বাঁধ করার লক্ষ্যে গত ২২ অক্টোবর ভারত সরকার একটি বিনিয়োগ চুক্তি করে বলে জানা গেছে। তবে ভারত এখনো এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে কিছু জানায়নি।
ভূ-বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধের অক্ষটি অবস্থিত সম্ভাব্য ক্রিয়াশীল তাইথু ফল্টের ওপরে। তাই বাঁধের ফলে ভবিষ্যতে যেকোনো ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হতে পারে এ অক্ষটি।
বাংলাদেশ হাওর উন্নয়ন বোর্ড ও নদী গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বর্ষা শুরুর আগে নদীতে যে তলানিপ্রবাহ থাকে, টিপাইমুখ বাঁধ তা আসতে দেবে না। বর্ষার শুরুতেও বৃষ্টির পানি আটকে রাখবে। তাই সুরমা ও কুশিয়ারায় প্রায় এক মাস দেরিতে পানি আসবে। তবে পুরো বর্ষায় ঠিকই নদী পূর্ণ থাকবে। এরপর বর্ষা শেষ হলে জলাধারে ধরে রাখা পানি আস্তে আস্তে ছাড়বে। আগে যেখানে নভেম্বরের দিকে নদীর পানি শুকিয়ে যেত, এখন তা জানুয়ারিতে হবে। ফলে হাওর অঞ্চলের একফসলি জমিগুলোয় ধান চাষ করা যাবে না। মৌসুমে এক হাজার কোটি টাকার বোরো ধানের আবাদ হবে না।'
প্রকৌশলী ইনামুল হক আরো বলেন, 'ফেব্রুয়ারির দিকে জলাধারের পানি কমে গেলে আবার নদীর তলানিপ্রবাহ আটকে দেবে। ফলে শুকনো মৌসুমে নদী দুটি বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি শুকিয়ে যাবে। এ প্রক্রিয়াটা চক্রাকারে চলতেই থাকবে। ফলে ওই দুটি নদী অববাহিকার জনজীবন, মৎস্য সম্পদ, কৃষি সব কিছুই বিপর্যয়ে পড়বে।'
ভূমিকম্প উসকে দেবে বাঁধ : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের যে জায়গায় টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে, সেটি বিশ্বের ছয়টি ভয়ংকর ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার একটি। উত্তর-পূর্ব ভারত ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়া, মেঙ্েিকা, তুরস্ক, তাইওয়ান ও জাপান ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। টিপাইমুখ বাঁধের ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে গত ১০০ বছরের মধ্যে ৭-এর অধিক মাত্রার দু-দুটি ভূমিকম্প হয়েছে। এর একটি হয়েছে ১৯৫৭ সালে টিপাইমুখ থেকে মাত্র ৭৫ কিলোমিটার দূরে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ রকম একটি এলাকায় ১৬৮.২ মিটার উচ্চতার একটি জলাধার নির্মাণ করা মানে (জলাধারের উচ্চতা ১০০ মিটারের বেশি হলে রিভার ইনডিউচড সাইসমিসিটির সম্ভাবনা বেশি থাকে) বাংলাদেশ ও ভারতের পুরো এলাকার জন্য আগ বাড়িয়ে অতিমাত্রায় ভয়াবহ ভূমিকম্প ডেকে আনার শামিল।
এটি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হওয়ার কারণ হলো এটি সুরমা-গ্রুপ শিলাস্তর দ্বারা গঠিত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পুরো বরাক অববাহিকায় রয়েছে অসংখ্য ফাটল আর চ্যুতি, যা আবার ওই এলাকার নদীগুলোর গতিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। তা ছাড়া ভারত ও মিয়ানমার টেকনোটিক প্লেটের সংঘর্ষের জন্য এলাকাটি দুনিয়ার অন্যতম একটি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে।
উচু বাঁধ নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে, তা থেকে জানা যায়, এ ধরনের বাঁধ ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। লণ্ডনের জেড বুকস থেকে ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত প্যাটট্রিক ম্যাককুলির 'সাইলেনস রিভার্স : দি ইকোলজি অ্যান্ড পলিটিঙ্ অব লার্জ ড্যামস' প্রন্থে বলা হয়, অল্প জায়গায় পানির বিপুল পরিমাণ চাপ শিলাস্তরের ফাটলকে দ্রুত সক্রিয় করে তুলতে পারে। এ ছাড়া বাড়তি পানির রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণেও হাইপোসেন্টার সৃষ্টি হয়ে ভূকম্পন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে ভূমিকম্প বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রথম নজরে আসে ১৯৩২ সালে আলজেরিয়ার কুঢে ফড্ডা বাঁধের ক্ষেত্রে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এ ধরনের বাঁধের কারণে ভূমিকম্প বেড়ে যাওয়ার নজির পাওয়া গেছে কমপক্ষে ৭০টি। আর এ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে তীব্র মাত্রার জলাধার প্রভাবিত ভূমিকম্প হয়েছে খোদ ভারতের মহারাষ্ট্রের কয়লা বাঁধের কারণে। ১৯৬৭ সালের ১১ ডিসেম্বর ঘটা ৬.৩ মাত্রার এই ভূমিকম্পটি এমনকি তার কেন্দ্র থেকে ২৩০ কিলোমিটার দূরেও তীব্র আঘাত হেনেছিল।
বাঁধ ভাঙলে কী হবে বাংলাদেশের : বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একটি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বাঁধের জলাধার ভূমিকম্পকে উসকে দেয়। আর বাঁধ থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের সীমান্ত। বন্যা প্রতিরোধ পরিকল্পনা ৬-এর আওতায় ১৯৯২-৯৪ সালে একটি গবেষণা চালানো হয়। ওই গবেষণা তথ্যানুসারে, বাঁধ ভেঙে বন্যা হলে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পানি তার সর্বোচ্চ উচ্চতা ২৫ মিটারে পেঁৗছাবে, যা প্লাবনভূমির উচ্চতার চেয়ে আট মিটার বেশি উঁচু। ফলে বাংলাদেশের পাঁচটি প্লাবনভূমিকে আট মিটার পানির নিচে তলিয়ে রাখবে ১০ দিন বা তার চেয়েও বেশি।
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিপাইমুখে ভারতের একক সিদ্ধান্তে বাঁধ নির্মাণ আন্তর্জাতিক নদী আইনের লঙ্ঘন। যৌথ নদী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হেলসিংকি (১৯৬৬) নীতিমালার ৪ ও ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত দেশ, অভিন্ন নদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্য দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন বিবেচনা করবে। এ জন্য অবশ্যই যেন অন্য দেশের কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে'। একই আইনের ২৯(২) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'একটি রাষ্ট্র নদী অববাহিকার যেখানেই অবস্থান করুক না কেন, তার যেকোনো প্রস্তাবিত অবকাঠামো নির্মাণ এবং ইনস্টলেশনের ব্যাপারে নদী অববাহিকতায় অবস্থিত অন্য যেকোনো রাষ্ট্র, এই কাজের ফলে অববাহিকায় ঘটা পরিবর্তনের কারণে যার স্বার্থহানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাকে এ ব্যাপারে নোটিশ দিতে হবে। নোটিশগ্রহীতা দেশ যেন প্রস্তাবিত পরিবর্তনের সম্ভাব্য ফলাফলের বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি থাকতে হবে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'টিপাইমুখসহ ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন নদীতে কোনো প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তিটিই হচ্ছে দুই দেশের জন্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক আইন। এ চুক্তিতে শুধু গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগির কথা বলা হয়নি, অভিন্ন অন্যান্য নদীর কথাও বলা হয়েছে। চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে 'ন্যায়পরায়ণতা (ইকুইটি), ন্যায্যতা (ফেয়ারনেস) এবং কারো ক্ষতি নয় (নো হার্ম)' এসব নীতির ভিত্তিতে দুই দেশের সরকার অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগির জন্য চুক্তি সম্পাদন করতে একমত হয়েছে। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে, বাংলাদেশের সঙ্গে অবাধ তথ্যবিনিময়, আলোচনা এবং চুক্তি না করে ভারত কর্তৃক অভিন্ন নদীর ওপর এককভাবে প্রকল্প গ্রহণের কোনো বৈধতা নেই। আবার চুক্তিতে উলি্লখিত নো হার্ম নীতি অনুসারে টিপাইমুখের মতো কোনো প্রকল্প নির্মাণ করতে হলে অববাহিকাভিত্তিক যৌথ সমীক্ষা করার দায়দায়িত্ব ভারত কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।'
তিনি আরো বলেন, 'দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ছাড়াও আন্তর্জাতিক কিছু পরিবেশ চুক্তি রয়েছে, যেগুলোর পক্ষরাষ্ট্র বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই। এসব চুক্তি (যেমন ১৯৯২ সালের বায়োডাইভারসিটি কনভেনশন, ১৯৭২ সালের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কনভেনশন, ১৯৭১ সালের ওয়েটল্যান্ড কনভেনশন) অনুসারে, একতরফাভাবে টিপাইমুখের মতো প্রকল্প গ্রহণের অধিকার ভারতের নেই।'
জানা গেছে, বরাক নদে টিপাইমুখ বাঁধ শুধু জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে না। ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি এ প্রকল্প থেকে পানি প্রত্যাহার করবে ভারত। ভারতের পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এ বাঁধের কারণে খোদ আসামের ১৬টি গ্রাম পুরোপুরি ডুবে যাবে, আংশিক ক্ষতিগস্ত করবে ৫১টি গ্রামকে, যার ফলে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষের জীবন-জীবিকা ও ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ধ্বংস হবে। এ কারণে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে আসামের জনগণ।
বরাক নদে ভারতের মণিপুর রাজ্যের কাছার পর্বতে উৎপন্ন হয়ে মণিপুর, আসাম, মিজোরামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রবেশের আগে ভারতের অমলসিধ নামক স্থানে নদটি সুরমা ও কুশিয়ারা-দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ দিয়ে প্রবেশ করেছে। সুরমা ও কুশিয়ারা হবিগঞ্জের মারকুলির কাছে আবার মিলিত হয়ে কালনী নামে প্রবাহিত হয়েছে। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে কালনী ঘোড়াউত্রা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। ভারতে প্রবাহিত বরাক নদের অংশের দৈর্ঘ্য ৪৯৯ কিলোমিটার। আর বাংলাদেশে এর দৈর্ঘ্য ৪০৩ কিলোমিটার। সুরমা ও কুশিয়ারা ৫টি প্লাবনভূমি অতিক্রম করেছে, যার অববাহিকায় বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কৃষিভিত্তিক জনবসতি গড়ে উঠেছে।

No comments

Powered by Blogger.