আলোচনা- 'হাইকোর্টের রায় এবং আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রসঙ্গে' by শক্তিপদ ত্রিপুরা

বাংলাদেশ বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু ধর্মের দেশ। বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও পাহাড় ও সমতল অঞ্চল মিলে ৪৫টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বাস করে।

স্মরণাতীতকাল থেকে তারা এ অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। এ অঞ্চলের ভূমিকে বাসযোগ্য ও চাষযোগ্য করার ক্ষেত্রে আদিবাসীদের রয়েছে বিশেষ অবদান। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসকগোষ্ঠী ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে এ দেশ থেকে বিতাড়নে আদিবাসীদের রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা।
কিন্তু যে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী এ অঞ্চলের ভূমিকে চাষ ও বাসযোগ্য করে তুলেছে, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে বিতাড়িত করে এ দেশ স্বাধীন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, সেই আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃতি পেল না, এর চেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা আদিবাসীদের আর কী হতে পারে। উল্লেখ্য, সংবিধানে বাঙালি ছাড়া এ দেশের অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে নাগরিক হিসেবে স্বীকার করা হয়নি। আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আদিবাসী-বাঙালি নির্বিশেষে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়ন চালায়। এ শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলার জনগণ সংগ্রাম গড়ে তোলে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেন, তখন সে ডাকে সাড়া দিয়ে আদিবাসীরাও এ যুদ্ধে অংশ নেয়। যুদ্ধে অনেক আদিবাসী শহীদ হন। আদিবাসীরা আশা করেছিল, দেশ স্বাধীন হলে এ নতুন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। প্রতিষ্ঠা পাবে শোষণহীন এক অসাম্প্রদায়িক সমাজ, যে সমাজে নিপীড়ন-নির্যাতন ও শোষণ-বঞ্চনা থাকবে না, থাকবে না দ্বেষ-হিংসা-হানাহানি। এ ধরনের সমাজে আদিবাসীরাও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, সংসৃ্কতি ও অধিকার নিয়ে মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে_এই ছিল তাদের স্বপ্ন। কিন্তু ১৯৭২ সালে যখন নতুন দেশের সংবিধান রচনা করা হলো, তখন আদিবাসীদের স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। যে নতুন সংবিধানের জন্য আদিবাসীরাও রক্ত দিল, জীবন দিল, সেই নতুন সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি মিলল না; সত্যিই তা আদিবাসীদের জন্য হৃদয়বিদারক ঘটনা বৈ কি! ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য আদিবাসী তথা মেহনতি মানুষের বন্ধু এম এন লারমা জাতীয় সংসদে সংবিধানের ওপর দীর্ঘক্ষণ বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি আদিবাসীদের পরিচয়ের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার এবং দেশের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সংবিধানে সুদৃঢ়ভাবে স্থাপনের দাবি জানিয়েছিলেন। সম্প্রতি সংবিধান বিষয়ে হাইকোর্টের রায় আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। হাইকোর্ট সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছেন। হাইকোর্টের রায় বিবেচনায় রেখে মহাজোট সরকার সংবিধান সংশোধনের কথা ভাবছে। সরকার চাইলে সংবিধান সংশোধন করে যেকোনো সময় আদিবাসীদের জাতীয় পরিচয়, তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে পারে এবং সে সুযোগ বর্তমান সরকারের রয়েছে।
আদিবাসী কারা? এ নিয়ে অনেকের মাঝে বিভ্রান্তি লক্ষ করা যায়। খোদ রাষ্ট্রের বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরাও নাকি প্রশ্ন তোলেন, 'আপনারা উপজাতিরা এ দেশের আদিবাসী হলে আমরা কারা? আমরাও তো এ দেশের আদিবাসী।' কিন্তু 'আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী' নির্ধারণে কে আদি বাসিন্দা বা কে আদি বাসিন্দা নয়, তা মুখ্য বিষয় নয়। আদিবাসী হলো তারাই_১. বর্তমানের রাষ্ট্রশাসন প্রক্রিয়ায় যাদের একেবারেই প্রান্তিক ভূমিকা; ২. আধুনিক রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাদের অসম্পৃক্ততা বা প্রান্তিক সম্পৃক্ততা; ৩. যারা রাষ্ট্রীয় আইনের চেয়ে প্রথাগত আইনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তি করে থাকে; ৪. প্রথাগত আইন কার্যকর করার জন্য যাদের ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং ৫. যাদের একটি বিশেষ ভূমির সঙ্গে আ@ি@@@ক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। এসব বৈশিষ্ট্য যাদের রয়েছে তাদেরই 'আদিবাসী' হিসেবে অভিহিত করা হয়। তাত্তি্বক দিক থেকে এসব বৈশিষ্ট্যের আলোকে এ দেশের আদিবাসীদের নির্দ্বিধায় 'আদিবাসী' হিসেবে অভিহিত করা যায়, সরকার বা অন্য কারো এ ক্ষেত্রে দ্বিধা থাকা সমীচীন নয়। বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি না থাকলেও এ দেশের আদিবাসীরা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইন, প্রজ্ঞাপন, নির্দেশনা, পলিসি, স্মারক, নথি ইত্যাদিতে এ দেশের আদিবাসীদের 'আদিবাসী' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া আছে।
১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, ১৯৯৫ সালের অর্থ আইন, আদালতের রায়, রাজস্ব বোর্ডের একাধিক স্মারক ও নথিতে 'ইন্ডিজিনাস হিলম্যান' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সরকারপ্রধান থাকাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তাঁদের বাণীতে এ দেশের আদিবাসীদের 'আদিবাসী' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। মহাজোট সরকারের প্রধান শরিক দল আওয়ামী লীগসহ বেশ কয়েকটি দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে 'আদিবাসী' শব্দ ব্যবহার করেছে। এ ছাড়া 'দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র', ২০০৯ সালের জাতীয় বাজেট ও জাতীয় শিক্ষানীতিতে 'আদিবাসী' ও 'ইন্ডিজিনাস পিপল' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৫০ সালের 'পূর্ববঙ্গ জমিদারি দখল ও প্রজাস্বত্ব আইনে' এ দেশের আদিবাসীদের 'এবরোজিনাল কাস্ট অ্যান্ড ট্রাইবস' বলা হয়েছে। এ আইনটি সংবিধানে সনি্নবেশিত আছে। সর্বশেষ ২০১০ সালের 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনে'ও 'আদিবাসী' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন, পলিসি, প্রজ্ঞাপন, আদালতের রায়, স্মারক ও নথিতে আদিবাসীদের স্বীকৃতি আছে। ২০১০ সালের ১০ এপ্রিল 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন' প্রণীত হওয়ার পর এ দেশের আদিবাসীদের 'উপজাতি' বলার যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। সর্বশেষ আইন অনুসারে এ দেশের আদিবাসীদের হয় 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী' অথবা 'আদিবাসী' বলা উচিত। তথাপি সরকারের কোনো কোনো মহল আদিবাসীদের 'উপজাতি' বলার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নাগরিকের সাংবিধানিক স্বীকৃতির অধিকারই মানবাধিকার। এটি নাগরিকের একটি ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক অধিকার। আদিবাসীরা এ দেশের নাগরিক। এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আদিবাসীরা রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে। সুতরাং এই আদিবাসীদের নিজের দেশের সংবিধানে স্বীকৃতি থাকবে না কেন? এশিয়ার বিভিন্ন দেশ_ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় আদিবাসীরা হয় সাংবিধানিকভাবে অথবা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। এশিয়ার এসব দেশে প্রথাগত ভূমির অধিকারসহ আদিবাসীরা বহু পরিমাণে রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করে থাকে।
আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য প্রস্তাবনা : প্রথমত, বাংলাদেশ এক বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু ধর্মের দেশ। এ বিষয়টি বাংলাদেশের সংবিধানে সনি্নবেশ করা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সংবিধানে তিন ধরনের মালিকানা_১. রাষ্ট্রীয় মালিকানা, ২. সমবায় মালিকানা ও ৩. ব্যক্তিমালিকানার কথা উল্লেখ আছে। আদিবাসীদের 'সমষ্টিগত মালিকানা' সংবিধানে স্বীকৃত নয়। তাই সংবিধানে 'সমষ্টিগত মালিকানা' সনি্নবেশ করা। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও বহু আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বাস করে। দেশের সব আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে সংবিধানে স্বীকৃতি প্রদান করা। চতুর্থত, সংবিধানে আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকার যথাযথভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা। পঞ্চমত, আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি, প্রথা ও ঐতিহ্যের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা। ষষ্ঠত, জাতীয় সংসদে আদিবাসীদের জন্য আসন সংরক্ষণের বিষয়টির সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা। আদিবাসীদের জন্য শিক্ষা, চাকরি, উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ অধিকার প্রদানের বিষয়টিও সংবিধানে সনি্নবেশ করা। এসব ক্ষেত্রে আদিবাসী নারী ও অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ অধিকারের বিষয়টি সংবিধানে স্বীকৃতি প্রদান করা। সপ্তমত, পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা। অষ্টমত, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং এ চুক্তির আলোকে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা। নবমত, সংশোধনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা। দশমত, আদিবাসীবিষয়ক সংবিধানের কোনো ধারা পরিবর্তন করতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং সমগ্র অঞ্চলের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে সংশোধন করা_এই ধারা সংবিধানে সনি্নবেশ করা।
========================
আলোচনা- 'আইন'-এর শাসন বনাম 'অহং'-এর শাসন' by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী  খবর- কজাহাজভাঙা শিল্পে সংকটমোচন  আলোচনা- 'বাংলাদেশের সংবিধানের দর্শনের গল্পসল্প' by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী  রাজনৈতিক আলোচনা- 'মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ ও পঙ্কিল রাজনীতি  রাজনৈতিক আলোচনা- 'মুক্ত বাতাসে সু চি' by রফিকুল রঞ্জু  বিশ্ব অর্থনীতি 'জি-২০ সম্মেলনে ধাক্কা খেল আমেরিকা'  ভ্রমণ- 'রেলগাড়িতে চড়ে' by মঈনুস সুলতান  'উৎসবের আমেজ সময়ের সংস্কৃতির' by শামসুজ্জামান খান  গল্প- 'কাজল রানীর হারেম' by পাপড়ি রহমান  রাজনৈতিক আলোচনা- 'এক-এগারোর প্রেতাত্মা চারপাশেই ঘুরছে by আবেদ খান  খবর- মহাজোট আছে মহাজোট নেই!' by পার্থ প্রতীম ভট্টাচায্য  আলোচনা- 'বাঙ্গালির বদলে যাওয়া' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম  খবর- আফগানিস্তান শান্তি কত দূর?' by তৌহিদ আজিজ  গল্প- 'ঝল্সে ওঠে জরিণ ফিতা' by রফিকুর রশীদ  ফিচার- ‘আক্রান্ত' by জাফর তালুকদার  স্মরণ- 'একজন বিস্মৃতপ্রায় বুদ্ধিজীবী' by আহমাদ মাযহার  গল্প- 'অলৌকিক উপাখ্যান' by হাসান মোস্তাফিজুর রহমান  গল্প- 'জয়মন্টপের জায়াজননী' by জামাল উদ্দীন  আলোচনা- 'তুর্গিয়েনেফ প্রসাদাৎ' by হায়াৎ মামুদ  গল্প- 'একটাই জীবন' by হাজেরা নজরুল  ফিচার- 'এটি একটি সংখ্যামাত্র' by রণজিৎ বিশ্বাস


কালের কণ্ঠ এর সৌজন্য
লেখকঃ শক্তিপদ ত্রিপুরা
রাজনৈতিক নেতা ও কলামিস্ট

এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.