ইউক্রেনে পশ্চিমা যুদ্ধ-পর্যটকদের ভিড় বাড়ছে

স্প্যানিশ পর্যটক আলবার্তো ব্লাসকো ভেন্তাস ইউক্রেনের ধ্বংস হয়ে যাওয়া ইরপিন সেতুর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ২০২২ সালে রুশ সেনাদের ঠেকাতে সেতুটি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। জায়গাটি এখন রোমাঞ্চপিয়াসী পর্যটকদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়।

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম দিকে রুশ সেনারা এই সেতুটি পার হয়ে রাজধানী কিয়েভ দখলের পরিকল্পনা করেছিলেন। ক্রমে রুশ বাহিনী কয়েক শ কিলোমিটার দূরে সরে যায়। কিন্তু এখনো প্রায় প্রতিদিনই কিয়েভে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে তারা। ছুটি কাটানোর জন্য ব্লাসকো ভেন্তাস ইউক্রেনের রাজধানীকেই বেছে নিয়েছেন।

২৩ বছর বয়সী এই সফটওয়্যার প্রকৌশলী বলেন, ‘এই প্রথম কোনো যুদ্ধাঞ্চলে এলাম। মিথ্যা কথা বলব না, আমার কাছে একটু ভয়ই করছে, কারণ কী ঘটবে কেউ জানে না।’

ব্লাসকো ভেন্তাস এক ‘কালো পর্যটন’–এ শামিল হয়ে ইউক্রেন ঘুরছেন। দেশটির ডজনখানেক কোম্পানি এই তকমা দিয়ে পর্যটকদের শোকাবহ ঘটনাস্থলগুলো ঘুরে দেখানোর ব্যবস্থা করছে। এই বিশেষায়িত খাতটি নিতান্ত ছোট। তবে এটা বড় হচ্ছে।

পরিবারের সদস্যদের উদ্বেগের তোয়াক্কা না করে ইউক্রেন সফরে বের হন ব্লাসকো। প্রথমে তিনি উড়োজাহাজে মলদোভা যান। সেখান থেকে ১৮ ঘণ্টার রেলযাত্রা করে ইউক্রেনে পৌঁছান।

ব্লাসকো ভেন্তাসের একটি ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। চ্যানেলটির গ্রাহক (সাবসক্রাইবার) ১ লাখ ১৫ হাজার। ইনফ্লুয়েন্সার হতে উদ্‌গ্রীব ব্লাসকো তাঁর ট্যুরের প্রতিটি মুহূর্ত ভিডিও করেছেন। এই ভিডিও পরে ইউটিউব চ্যানেলে পোস্ট করবেন। চ্যানেলটিতে ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সবচেয়ে ভয়ংকর মানসিক হাসপাতাল’ এবং বিশ্বের ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক সীমান্ত’ হিসেবে চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যবর্তী সীমান্ত নিয়ে আধেয় (কনটেন্ট) প্রকাশ করেছেন তিনি।

‘টিকার মতো’

যুদ্ধের আগে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক ইউক্রেনের চেরনোবিল ভ্রমণে যেতেন। ১৯৮৬ সালে চেরনোবিলে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক বিপর্যয় ঘটে।

ওয়ার ট্যুর নামের একটি কোম্পানি ব্লাসকো ভেন্তাসের ইউক্রেন ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছে। তারা জানিয়েছে, গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৩০ জন পর্যটক পেয়েছে। এই পর্যটকদের বেশির ভাগই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। আর এই ভ্রমণের জন্য জনপ্রতি ১৫৭ ডলার থেকে ২৬২ ডলার খরচ করতে হয়েছে তাঁদের।

ওয়ার ট্যুরের সহপ্রতিষ্ঠাতা দিমিত্রি নিকিফরোভ বলেন, তাঁদের লভ্যাংশের একটি অংশ সেনাবাহিনীকে দেন তাঁরা। তিনি বলেন, ‘বিষয়টা টাকা আয়ের নয়। এটা হচ্ছে যুদ্ধের স্মারক ধরে রাখার ব্যাপার।’

কিয়েভের আরেকটি পর্যটন কোম্পানির ব্যবস্থাপক ভিতোজার মইসেইভ বলেন, এ ধরনের পর্যটনে আর্থিক লাভ যৎসামান্যই। কিন্তু লাভের বিষয় তত গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং এর একটি শিক্ষাগত মূল্য রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এটি একটি টিকার মতো, যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।

সাধারণত কিয়েভ ও এর শহরতলির আশপাশ ঘিরেই এ ধরনের ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়। ২০২২ সালের শুরুর দিকে রুশ সেনারা সেখানে গণহত্যা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

তবে কিছু কিছু কোম্পানি যুদ্ধক্ষেত্রের আরেকটু কাছাকাছি ভ্রমণের ব্যবস্থা করছে। এর মধ্যে দক্ষিণ ইউক্রেনের মতো জায়গা রয়েছে। সেখানে কয়েক দিনের ভ্রমণের জন্য জনপ্রতি খরচ ৩ হাজার ৩০০ ইউরো।

যতটুকু যা পাওয়া যায়

অনেক পর্যটক আছেন, যাঁরা কিয়েভ ছাড়িয়ে ইউক্রেনের আরও ভেতরে যেতে চান। তাঁদের একজন নিক তান। তিনি নিউইয়র্কের একটি প্রযুক্তি কোম্পানিতে কাজ করেন।

নিক তান গত জুলাই মাসে খারকিভ সফর করেন। এটি ইউক্রেনের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ শহর। রাজধানী কিয়েভ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শহরটিতে অনবরত বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে রুশ বাহিনী।

৩৪ বছর বয়সী আমেরিকান এই পর্যটক বলেন, ‘আমি এটি (খারকিভ) ঘুরে দেখতে চেয়েছিলাম কারণ আমি মনে করি পশ্চিমে আমাদের জীবন খুব আরামদায়ক ও সহজ।’

নিক তান আরও বলেন, তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের আরও কাছাকাছি যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাঁর গাইড রাজি হননি।

নিজেকে একজন রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষ বলে মনে করেন নিক তান। তিনি ইতিমধ্যে স্কাইডাইভিং করেছেন। নিয়মিত বক্সিং ক্লাস এবং মন পাল্টে দেওয়া মাদকের উদ্দাম পার্টিতে যান। তাঁর জানার ইচ্ছা বিধ্বস্ত ইরপিন শহরতলির কিছু বাসিন্দাকে বিস্মিত করেছিল। সেখানকার বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত রুশ বিমান হামলার হুমকি নিয়ে বসবাস করেন।

ইরপিন শহরের একজন বাসিন্দা রুসলাম সাভচুক (৫২)। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি আমার বাড়ি থেকে ৩০০ মিটার দূরে একটি শাহেদ ড্রোন আছড়ে পড়ে। এ ধরনের অভিজ্ঞতার পর আমার আর এখানে থাকতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু কেউ যদি নিজের কাঁধে এমন সব বিপদ টেনে নিতে চান, সেটা তাঁর অধিকার।’

সাভচুক একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ইরপিনকে পর্যটন সম্পর্কে পরামর্শ দেন। পর্যটকেরা স্থানীয়দের জন্য দরকারি আয়ের উৎস হতে পারেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের মতো কঠিন বিষয়ও ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে।’

‘আমাদের দুঃখ-বেদনা দেখুন’

মিখাইলিনা বলেন, স্থানীয় মানুষজনকে এমন অভিযোগও করতে শুনেছেন- ‘কেন আপনারা এখানে আসছেন? কেন আপনারা আমাদের দুঃখ-বেদনা দেখতে চান?’

ইরপিনের স্থানীয় কাউন্সিলর ও বুচা শহরের সাবেক ডেপুটি মেয়র মিখাইলিনা স্করিক স্কারিভস্কা বলেন, সেখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দার ‘কালো পর্যটন’ নিয়ে আপত্তি নেই। তবে কেউ কেউ মনে করেন মানুষের রক্ত মাড়িয়ে এই মুনাফা অর্জন করা হচ্ছে।

ন্যাশনাল এজেন্সি ফর ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্টের প্রধান মারিয়ানা ওলেস্কিভ বলেন, যুদ্ধ–পর্যটনের বিকাশ অনেক নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। কিন্তু এটির বাজার বাড়তে বাধ্য। তাঁর এজেন্সি গাইডদের জন্য নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কিয়েভ অঞ্চলে স্মারক সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

মারিয়ানা ওলেস্কিভ বলেন, গত বছর ৪০ লাখ বিদেশি পর্যটক ইউক্রেন ভ্রমণ করেছেন। এই সংখ্যা ২০২২ সালের তুলনায় দ্বিগুণ, তবে এঁরা প্রধানত ব্যবসায়িক কাজে আসা মানুষ।

কিয়েভের অদূরে একটি বিধ্বস্ত ট্যাংক দেখছেন আলবার্তো ব্লাসকো
কিয়েভের অদূরে একটি বিধ্বস্ত ট্যাংক দেখছেন আলবার্তো ব্লাসকো। ছবি: এএফপি

No comments

Powered by Blogger.