সমসাময়িকতায় পরিপূর্ণ মানবিক ইত্যাদি

ইত্যাদি সব সময়ই অনন্য, অসাধারণ; নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। টানা তিন যুগ ধরে আলো ছড়ানো ইত্যাদির জৌলুস বেড়ে চলেছে দিনকে দিন। এবারে অনুষ্ঠান ধারণের স্থান বাগেরহাটের মোংলা বন্দর। এবারের ইত্যাদি দেখে একটা অদ্ভুত উপলব্ধি হলো। সেটা হচ্ছে, ইত্যাদি যেন অনিন্দ্য সুন্দর এই বাংলাদেশকে আরও নান্দনিকভাবে তুলে ধরছে দুর্দান্ত মুন্সিয়ানায়। আর এই মুন্সিয়ানার কারিগর তো সেই কিংবদন্তি হানিফ সংকেত। গত প্রায় দেড় দশক থেকে ইত্যাদি যখন চার দেয়াল পেরিয়ে জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়তে থাকলো, তখনই বিভিন্ন জেলা সম্পর্কে আমরা জানতে থাকলাম নতুন করে। নতুনভাবে যেন আমরা জেলাগুলোকে আবিষ্কার করেছি। এবার বাগেরহাট সম্পর্কে যে প্রতিবেদন বা যে নৃত্যগীত পরিবেশিত হয়েছে, তা যেন আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। ইতিহাস-ঐতিহ্য তো ছিলই, ছিল অনেক অজানা তথ্যও। এ যেন পর্যটনবান্ধব এক আয়োজন। প্রতিবেদনও যে কতোটা হৃদয়গ্রাহী, আকর্ষণীয় ও নান্দনিক করে তোলা যায় সেটার প্রমাণ এবারের ইত্যাদি। বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জের রুমিছা বেগমকে নিয়ে করা প্রতিবেদনটি একইসঙ্গে মানবিক, হৃদয়ছোঁয়া ও অনুপ্রেরণামূলক। স্বামী অসুস্থ বলে নিজে দমে যাননি; ইঞ্জিনভ্যান চালিয়ে গড়ে তুলেছেন ভ্রাম্যমাণ মুদির দোকান। বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য গ্রামে গ্রামে ফেরি করে বিক্রি করেন তিনি। একজন নারী হয়ে সংসারের বোঝা কাঁধে নেয়ার এই চিত্র বহু মানুষকে যে অনুপ্রাণিত করবে তাতে সন্দেহ নেই। মোশারফ গাজীকে নিয়ে করা আরেকটি মানবিক প্রতিবেদনও দর্শকদের অশ্রুসিক্ত করে তুলেছে। পেটের তাগিদে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে শেষে কুমিরের আক্রমণে তিনি নিহত হন। বন বিভাগের জারি করা নিষিদ্ধ সময়ে বনে প্রবেশ করায় মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। সংসারের অভাব-অনটন আর স্বামীর সুন্দরবনের যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন মোশারফের স্ত্রী। সুন্দরবন-সংলগ্ন কিছু মানুষের জীবিকার চিত্র উঠে আসার পাশাপাশি নিষিদ্ধ সময়ে বনে প্রবেশের বিষয়ে সতর্কতা বাড়বে বলে আশা করা যায়। সমসাময়িক কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে দুর্দান্ত একটি বিষয় এসেছে এক নাট্যাংশে। বর্তমানে তো বহুল আলোচিত বা চর্চিত একটি শব্দ হলো ‘সংস্কার’। একটি নাট্যাংশে দেখানো হলো যে ‘আত্মসংস্কার’ কতোটা প্রয়োজন। বাস্তবতা হলো, যত ধরনের সংস্কারই করা হোক না কেন, আমরা যদি নিজেকে সংস্কার না করি, নিজের মনের সংস্কার না করি, নিজেরা কাজে-কর্মে বা আচার-আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন না নিয়ে আসি, তাহলে কোনো ভালো ফলই আসবে না। চরম বাস্তব এই বার্তাটি দেয়ার জন্য ইত্যাদিকে বিশেষ ধন্যবাদ দেয়া যেতেই পারে। সমসাময়িক আরও দু’টি আলোচিত বিষয় হলো ‘চুরি’ ও ‘ঘুষ’। এই দুই বিষয়ে দুইজন ‘গবেষক’কে নিয়ে করা দু’টি নাট্যাংশও বেশ প্রশংসার দাবিদার। চুরি ও ঘুষের সেকাল-একাল এবং চোর ও ঘুষখোরের সেকাল-একাল নিয়ে রসাত্মক কিন্তু চরম বিদ্রূপাত্মক নাট্যাংশ দু’টিতে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা উঠে এসেছে। আরেকটি নাট্যাংশে ঋণখেলাপিদের চেয়েও ভিক্ষুকদের জমানো টাকার পরিমাণ বেশি- এমন তুলনা শুধু চরম বাস্তবতার দিকেই কটাক্ষপূর্ণ ইঙ্গিত দেয়। এবার নানি-নাতি পর্বেও সমসাময়িক বিষয় উঠে এসেছে। ‘কালার’ দেয়া, অর্থাৎ কাউকে পছন্দ না হলে কোনো একটা তকমা লাগিয়ে দেয়ার নেতিবাচক বিষয়টি উঠে এসেছে তাদের মজার আলাপচারিতায়। এ ছাড়া দর্শক পর্ব, বিদেশি প্রতিবেদন ও বিশেষ ম্যাজিকও ছিল বেশ উপভোগ্য। সবমিলিয়ে বলা যায়, ইত্যাদি ইত্যাদিই। হানিফ সংকেত হানিফ সংকেতই। তাকে শুধু তিনি নিজেই ছাড়িয়ে যেতে পারেন। ভালো থাকুন আমাদের সকলের প্রাণপ্রিয় এই নান্দনিক কারিগর।
mzamin

No comments

Powered by Blogger.