নির্বাচনী খরচ by জামান সরদার

সন্দেহ নেই, নির্বাচন আমার দেশে বড় উৎসব। আদালতের পরিবেশবাদী ভূমিকা এবং নির্বাচন কমিশনের কড়া পদক্ষেপের ফলে কয়েক বছর ধরে অবশ্য পোস্টার, দেয়াল লিখন, অহোরাত্রি মাইকিং, মিছিল-মিটিং কমেছে। কিন্তু উৎসবের খামতি কি হয়েছে? সীমিত পরিসরেই যা হয় সে তুলনায় ইউরোপের নির্বাচন ম্যাড়মেড়েই।


জার্মান প্রবাসী এক বাঙালি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, নির্বাচন কোন দিক দিয়ে এসে কোনদিকে চলে যায়, তিনি বুঝতেই পারেন না। গলিতে গলা না ফাটিয়ে, চায়ের টেবিল না চাপড়িয়ে ভোট দিতে যাওয়া আর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
আটলান্টিকের অপর পাড়ের, আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের চিত্র অবশ্য ভিন্ন। আমাদের মতো পোস্টার সাঁটা, ছেঁড়া, মিছিল, রঙ মাখামাখি চার আনাও নেই বটে; দলীয় ও নাগরিক সভার নামে প্রার্থী ও তার সমর্থকরা যা করে, তা উৎসবের বাকি বারো আনা ছাড়িয়ে যায়। তবে মূল খেলা জমে টেলিভিশন এবং হালের অনলাইনে। প্রার্থীদের মুখোমুখি টিভি বিতর্কের কথা বলছি না। আমাদের নেতা-নেত্রীরা পরস্পরের বক্তব্যের জবাব যে দ্রততায় সাংবাদিকদের কাছে দিয়ে দেন এবং তা যেভাবে পাশাপাশি প্রচার হয়; তাতে করে বিতর্কের দুধের স্বাদ পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের ঘোলে মিটে যায়। টক শোওয়ালাদের আধা পক্ষপাতদুষ্ট বিশ্লেষণ তো বেসরকারি চ্যানেলের কল্যাণে আমাদের দেশেও এখন সচরাচর। আমেরিকান নির্বাচনের বিশেষত্ব হচ্ছে প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারিত বিজ্ঞাপন তরঙ্গ। আর বিজ্ঞাপনের অর্থ জোগানোই হচ্ছে ধনী দেশটির ততোধিক ধনী প্রার্থীদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। যে কারণে সেখানকার নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর প্রার্থীর ভোটের সংকটই কেবল স্পষ্ট হয় না, ভাতের চিন্তাও বড় হয়ে দেখা দেয়।
প্রার্থী ও তার সমর্থকদের হার-জিতের বিষয়টি ঝুলে থাকে যদিও ভোট গণনা পর্যন্ত; আমেরিকান মিডিয়ার জিত কিন্তু নির্বাচনী মৌসুমের শুরু থেকেই। চলতি সংখ্যার ইকোনমিস্টে এ নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ হয়েছে। তাতে বলা হচ্ছে, শিশুরা যেমন ক্রিসমাসের জন্য বছরভর অপেক্ষা করে থাকে (আমাদের দেশে বস্ত্র ব্যবসায়ীরা যেমন ঈদ বা পূজার বাজারের জন্য অপেক্ষা করে); আমেরিকান মিডিয়া অপেক্ষা করে নির্বাচনের জন্য। হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে আমরা কেবল ওবামা-রমনিদের যুদ্ধই দেখি। বাস্তবে নির্বাচন মানে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ, সিনেট, গভর্নর এবং স্থানীয় সরকারের অসংখ্য পদে নির্বাচনের ব্যাপার। প্রেসিডেন্টের মেয়াদ চার বছর। কিন্তু অন্যান্য পদের নির্বাচন হয় দুই কিস্তিতে। দু'বছর পরপর। ফলে মিডিয়াকে নির্বাচনী মৌসুমের জন্য চার বছর অপেক্ষা করতে হয় না।
ইকোনমিস্ট হিসাব কষে দেখিয়েছে, ২০০৮ সালে বারাক ওবামা ৪২০ কোটি ডলার নির্বাচনী তহবিল জোগাড় করেছিলেন। এবার তাকে আরও ২৩ শতাংশ বাড়াতে হবে। কারণ বিজ্ঞাপন প্রচারকারী মিডিয়ার সংখ্যা বেড়েছে! আবার ২০১০ সালে সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছেন যে, নির্বাচনী বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যয়ের কোনো সীমা থাকবে না। যার যত খুশি!
আমাদের দেশে অবশ্য নির্বাচনী ব্যয়ের সীমা নির্ধারিত। প্রার্থীদের অর্থ যতই থাকুক, প্রকাশ্যে বাড়তি খরচের উপায় নেই। অপ্রকাশ্যে কত গুণ খরচ, 'ভুক্তভোগী' ছাড়া কারও জানার উপায় নেই। কিন্তু সেই খরচ আর যাই হোক টিভি বা সংবাদপত্র বিজ্ঞাপনের পেছনে ব্যয় করার উপায় নেই। আমাদের অনেকের কপালই খারাপ!
 

No comments

Powered by Blogger.