প্রফেসর অনুপম সেন: মানুষের অধিকার আদায়ের অগ্রসৈনিক by ড. আতিউর রহমান
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন
বর্তমান সময়ের এক বিরল মেধাবী শিক্ষক, গবেষক এবং সমাজ পরিবর্তনের সক্রিয়
পণ্ডিত ব্যক্তি। ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রফেসর সেনকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জানি এ
দাবি আমি করবো না। তবে বেশ কয়েকবার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। কথাও হয়েছে। কিন্তু
তাঁর লেখালেখির সাথে আমি পরিচিত। সমাজতত্ত্ব ও সাহিত্য-শিল্পকলার নানা দিক
নিয়ে তাঁর মৌলিক লেখা আমি পড়েছি। বিশেষ করে বিশ্ববিখ্যাত প্রকাশনী সংস্থা
রৌটলেজ (জড়ঁঃষবফমব) থেকে তাঁর পিএইচডি থিসিস নির্ভর গ্রন্থটি গভীর মনোযোগের
সাথে পড়েছি। ভারতীয় রাষ্ট্র, শিল্পায়ন ও শ্রেণিসংগঠন বিষয়ে তাঁর এই
গবেষণাধর্মী বইটি মার্ক্সীয় ধারার গবেষকদের জন্য একটি আকর গ্রন্থ বললে ভুল
হবে না। আমিও মার্ক্সীয় অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচডি থিসিস লিখেছি। সেই থিসিস
লন্ডনের জেড বুকস থেকে ‘পেজেন্টস অ্যান্ড ক্লাসেস’ নামে প্রকাশিত হয়েছে।
তাই আমি তাঁর এই গবেষণার মর্ম কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। প্রফেসর সেন পরবর্তী
সময়ে অন্য যেসব প্রকাশনা ও বক্তৃতা করেছেন সেগুলো ঐ মৌলিক গবেষণার সূত্র
ধরেই এগিয়েছে। তাঁর দেয়া গণবক্তৃতাগুলো একদিকে যেমন ঐতিহাসিক
শ্রেণি-প্রেক্ষাপটে লেখা, অন্যদিকে সমসাময়িক অর্থনীতি ও সমাজের সাথে
সম্পর্কিত করার এক আন্তরিক প্রচেষ্টার ফসল। ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ’
বিষয়ে তাঁর বইটিও এই প্রেক্ষাপটেই লেখা। আমি মূলত এই তিনটি বইয়ের আলোকেই
তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান বিষয়ে কিছু বলার চেষ্টা করবো। ব্যক্তিগত
স্মৃতিচারণের চেয়ে তাঁর লেখালেখি বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমেই তাঁর পঞ্চাশ বছরের
বুদ্ধিবৃত্তিক অবদানের জন্য শ্রদ্ধা জানানো বেশি প্রাসঙ্গিক হবে বলে আমার
বিশ্বাস। তাঁর ‘ঞযব ঝঃধঃব, ওহফঁংঃৎরধষরুধঃরড়হ ধহফ ঈষধংং ঋড়ৎসধঃরড়হ রহ
ওহফরধ’ বইটি মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা হলেও এতে নয়া-মার্ক্সবাদী ভাবনার
সংযোজন বেশ স্পষ্ট। তবে বুদ্ধিবৃত্তিক পাটাতনটি তিনি ধ্রুপদী মার্ক্সীয়
ভাবনাতেই উপস্থাপন করেছেন। এর ওপর যে কাঠামো গড়েছেন তাতে সমকালীন
নয়া-মার্ক্সবাদীদের ভাবনা বেশ মুন্সিয়ানার সাথেই তিনি সংযোজন করেছেন।
এক সময় ভারত বৃটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সম্পদশালী উপনিবেশ ছিল। স্বাধীন ভারত গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক পথের দিশা দেয়ার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। দেশটি দীর্ঘ দিন দারিদ্র্য ও স্থবিরতার প্রতীকে পরিণত হয়। অবশ্যি, সম্প্রতি ভারতের অর্থনীতি পুঁজিবাদী পথে হাঁটতে শুরু করেছে। তবে দারিদ্র্য ও সামাজিক বঞ্চনা এখনো তীব্র। বৈষম্যও প্রকট। অনেকেই ভারতের এই স্বাধীনতা-উত্তর স্থবিরতাকে তার সংস্কৃতির বন্ধ্যত্বের মাঝে খুঁজছেন। কিন্তু ড. অনুপম সেন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মার্ক্সীয় ধ্যাণধারণা থেকে এ বিষয়টি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। শ্রেণি বিন্যাসের আলোকে তিনি দেখিয়েছেন যে ভারতে পরম্পর স্বার্থবিরোধী শ্রেণিগুলোর পূর্ণ বিকাশ বা দখল সম্ভব হয়নি। এর প্রভাব ভারতীয় রাষ্ট্রের চরিত্রের ওপর পড়েছে। এশীয় উৎপাদন পদ্ধতির রেশ স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে এখনো বজায় রয়েছে। ফলে ভারতে সামাজিক রূপান্তর সেভাবে গতিময় হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে দেশটিতে ইউরোপের মতো ধ্রুপদী বুর্জোয়া রূপান্তর ঘটেনি। কিছু কিছু রাজ্যে (যেমন পাঞ্জাব ও হরিয়ানায়) আধুনিক কৃষির উদ্ভব ঘটলেও সারা দেশে তার বিস্তার সেভাবে ঘটেনি। শিল্পায়নও এতটা ঘটেনি যে গ্রামীণ মানুষগুলো শিল্পাঞ্চলে কাজের সন্ধানে যাবেন। সে কারণে ভারতের অনেক রাজ্যেই দারিদ্র্য খুবই প্রকট। তা ছাড়া, ভারতে এমন কোনো সমাজ বিপ্লবও ঘটেনি যে শহরের খেটে খাওয়া মানুষগুলো গ্রামের শ্রমজীবী মানুষের সাথে জোট বেঁধে সংগ্রাম করে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে পেরেছেন।
ভারতীয় সমাজের এই স্থবিরতা কেন ঘটেছিল সে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন মার্ক্স ও এঙ্গেলস তাঁদের মৌলিক লেখায়। ড. সেন সেসব কথার সূত্র ধরেই বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছেন। তবে সেখানেই থেমে যাননি তিনি। আধুনিক কালের মার্ক্সীয় চিন্তকদের বিশ্লেষণও তিনি একই সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। পুরো আলোচনায় এই মেধাবী সমাজতাত্ত্বি¡ক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত শ্রেণিগুলোর আধিপত্য বিস্তারের ফসল হিসেবে কোন ধাঁচের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে তার ইঙ্গিত করেছেন। সেই আলোকেই তিনি কেন নেহেরুর স্বাধীনতা-উত্তর ভারত স্থবিরতার শিকার হলো তার ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যদিকে জার্মানিতে বিসমার্কের শাসনামলে শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের সহযোগিতায় পুঁজিবাদী সামাজিক বিবর্তনের ফলে শিল্পায়ন কি করে ঘটল সে ব্যাখ্যাও যুক্তিপূর্ণভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর গবেষণার সৌন্দর্য এই যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ফেলে যে কোনো দেশের আর্থসামাজিক বিকাশের ধারাটি বোঝা সম্ভব। বিশ্লেষণের এই সর্বজনীন কাঠামোর কারণেই তিনি প্রশংসার দাবিদার।
এই ধারাবাহিকতায় ড. সেনের এই মৌলিক গ্রন্থে ভারতীয় রাষ্ট্রের চরিত্র এবং এ অঞ্চলের অর্থনীতি তথা শিল্পায়নের ধারাকে কীভাবে সেই রাষ্ট্র প্রভাবাম্বিত করেছে তার সন্ধানও মেলে। ড. সেন যথার্থই বলেছেন যে, সদা পরিবর্তনশীল সামাজিক প্রক্রিয়া অথবা উৎপাদন পদ্ধতির গভীরতা/স্থিতিশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ণিত হয়। উৎপাদন শক্তি ও সম্পর্কের উন্নয়নের ওপর অনেকাংশেই নির্ভর করে শ্রেণির গঠন ও বিন্যাস। আর এসবই একেক সমাজে একেক রকম হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক ও মানবিক কারণেই এই হেরফের হয়ে থাকে। তাই সমাজ ভেদে রাষ্ট্রের ধরনও বদলে যেতে পারে। মার্ক্সীয় ধারায় তাই রাষ্ট্র শুধু রাজনৈতিক একটি বিষয় নয়। এটি সামাজিকও বটে। সেই আলোকেই ড. সেন ভারতীয় রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ণয়ের সময় উৎপাদনের উপায়গুলোর রূপান্তরের ঐতিহাসিক ধারাকে ধরবার চেষ্টা করেছেন। এঙ্গেলস মনে করতেন সমাজে শ্রম বিভক্তি যেমন থাকে তেমনি যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাঁদের ভেতরও বিভাজন থাকে। তাঁদের স্বার্থ আর যাঁরা তাঁদের রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে বসিয়েছেন তাঁদের স্বার্থ এক নাও হতে পারে। এভাবেই রাষ্ট্র তার স্বাধীন সত্তা নির্মাণ করে। এভাবেই দুটো শক্তির মাঝে সংঘর্ষের উৎপত্তি হয়। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা এই সাংঘর্ষিক পরিবেশে ব্যাহত হতে পারে। উভয়ের স্বার্থ এক হলে অর্থনৈতিক উন্নতি দ্রুতও হতে পারে। কোনো কোনো দেশে অর্থনীতি যারা চালায় তারাই নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রের পরিচালকদের। যেমন শুরুতে ব্রিটেনে টোরি বা অভিজাত শ্রেণি বুর্জোয়াদের স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিল বলে তিনি লিখেছেন। তবে রাষ্ট্র বরাবরই আরো স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করে। বাস্তবে কতটা স্বাধীনতা ভোগ করে রাষ্ট্র তা নির্ভর করে উৎপাদন পদ্ধতির বিকাশ ও সামাজিক গঠন প্রক্রিয়ার ওপর।
ভারতের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এক সময় বরং বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ব বাজারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে রাষ্ট্র স্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করেনি। ফলে ভারতে পুঁজিবাদী উন্নয়ন পদ্ধতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। পুরনো এশীয় উৎপাদন পদ্ধতিকে পুরোপুরি কাবু করে ভারতের পক্ষে নয়া উৎপাদন পদ্ধতি স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। মার্ক্স ও এঙ্গেলস যে ধারার বিপ্লবাত্মক রূপান্তরের কথা বলতেন ভারতে সেটি সম্ভব হয়নি। সেই অর্থে মার্ক্সীয় তত্ত্বের আলোকে সকল সমাজ একই ধারায় রূপান্তরিত হবে সেটি আশা করা ঠিক নয়। রাষ্ট্র ও অর্থনীতির সম্পর্ক বহুমুখী ও দ্বান্দ্বিক হতেই পারে। তাই বলে এটা ঠিক হবে না যে অর্থনৈতিক ক্ষমতা থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎপত্তি হয়। বরং রাজনৈতিক ক্ষমতার ওপর ভর করেই অর্থনীতির বিকাশ ঘটে। আর সে কারণেই মার্ক্সীয় তত্ত্বে রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক ক্ষমতা তীব্র শ্রেণি দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে পরিণত হয়ে থাকে।
ড. সেনের গবেষণায় ধরা পড়েছে যে ভারতের রাষ্ট্র এশীয় উৎপাদন পদ্ধতির ফসল। ফলে বুর্জোয়াদের বিকাশের পথে এই রাষ্ট্র বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সতেরো ও আঠারো শতকে যে বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশ দ্রুত ঘটছিল তা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের কারণে বুর্জোয়াদের আধিপত্যে নিশ্চিত করা যায়নি। ভারতের পুঁজিবাদী রূপান্তরও সে কারণে বাধাগ্রস্থ হয়। ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের সমাজ আংশিক এশীয়, আংশিক সামন্ততান্ত্রিক এবং আংশিক পুঁজিবাদী হওয়ায় রাষ্ট্র অনায়াসে ভারত থেকে ঔপনিবেশবাদী কেন্দ্রে (লন্ডন, ম্যানচেস্টার) সম্পদ স্থানান্তর করতে পেরেছিল। ফলে ভারতের অর্থনীতি উন্নত হতে পারেনি। তার শ্রমের উৎপাদিকা শক্তিও তাই বিকশিত হয়নি। অন্যদিকে স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র তার স্বাধীনতা রক্ষার তাগিদ থেকে ব্যক্তি খাতের ওপর প্রবল নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। ফলে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে যে শিল্পায়ন গড়ে ওঠে তার সহযোগী হয় ক্ষুদে শিল্প ও কারিগরবৃন্দ। কৃষিতেও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার সব অঞ্চলে বাড়েনি। ফলে পুঁজিবাদী বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশ সেভাবে ঘটেনি। অসম উন্নয়নের এই ধারা চলার ফলে অর্থনীতি তার স্বাভাবিক গতিময়তা হারিয়ে ফেলে। তাই অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দেয় এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ দরিদ্রই থেকে যান। পরবর্তী সময়ে অবশ্যি অর্থনৈতিক সংস্কার ঘটিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গতি আনতে সক্ষম হয়েছে দেশটি। এর প্রভাবে দারিদ্র্যও কমেছে ভারতের অনেক রাজ্যে।
ড. সেন এখানেই থেমে যাননি। তিনি এরপর রাল্ফ মিলিবান্ড ও নিকোলাস পোলানৎজার ভাবনার আলোকে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ রক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকা বিষয়ে গবেষণা করেছেন। ড. সেন লিখেছেন যে নয়া-মার্ক্সবাদী রালফ্ মিলিবান্ড মনে করেন যে আধুনিক রাষ্ট্র শ্রেণি শাসনের এক নির্মম/আদর্শিক হাতিয়ার। আমলাতন্ত্র, পুলিশ, বিচার বিভাগ, সেনাবাহিনী ইত্যাদি এই রাষ্ট্রকে চালায়। এরা ব্যক্তি পুঁজিরও অধ:স্তন সমর্থক। পোলানৎজা মনে করেন রাষ্ট্রের প্রধান কাজই হলো পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখা। অর্থনৈতিকভাবে অধিপতি শ্রেণির আকাক্সক্ষা মতোই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়ে থাকে। তবে রাষ্ট্রের আবার অধিপতি শ্রেণিগুলো থেকে স্বাধীনতারও প্রয়োজন হয় তার ঐক্য রক্ষার জন্য। পুঁজিবাদী শ্রেণির সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যই রাষ্ট্র এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
হামজা আলাভী উপনিবেশ-উত্তর সমাজের রাষ্ট্র নিয়ে গবেষণা করেছেন। ড. সেন নয়া-মার্ক্সবাদী হিসেবে তাঁর ভাবনাগুলো নিয়েও নাড়াচাড়া করেছেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্র নিয়ে আলাভী কাজ করলেও মাঝেমধ্যে ভারতীয় রাষ্ট্রের কথাও তিনি বলেছেন। ঔপনিবেশিক পর্বে আলাভীর মতে রাষ্ট্র অতি-উন্নত ছিল। স্থানীয় শ্রেণিসমূহের চেয়ে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকারী সামরিক ও বেসামরিক আমলারা অনেক বেশি ক্ষমতাশীন ছিল। উপনিবেশ-উত্তর পর্বেও তাঁর মতে রাষ্ট্রের এই চরিত্র খুব একটা বদলায়নি। রাষ্ট্র স্বাধীনই রয়ে গেছে। কোনো একক শ্রেণি এই অতি-উন্নত রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারেনি। আলাভীর এই রাষ্ট্রভাবনাকে ড. সেন খুবই প্রাসঙ্গিক মনে করেছেন তাঁর গবেষণাক্ষেত্রে। ধ্রুপদী মার্ক্সীয় ভাবনায় অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ওপর রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক উপরিকাঠামো স্থান করে নেয়। কিন্তু উপনিবেশ-উত্তর সমাজে রাষ্ট্র বা উপরিকাঠামো অতি-উন্নত। অর্থনৈতিক পাটাতন ততোটা উন্নত না হলেও রাষ্ট্রের অবস্থান বেশ মজবুত। দেশীয় বুর্জোয়ার এই অস্বাভাবিক বিকাশের সাথে অনুন্নত অর্থনৈতিক অবকাঠামোর গভীর সম্পর্ক নেই। এখানে ঔপনিবেশিক শক্তির বিদায়ের পর কোনো একক শ্রেণি আধিপত্য বিস্তার করে উঠতে পারেনি। ফলে রাষ্ট্র পরিকল্পিত অর্থনীতি গড়বার নামে প্রচুর অর্থনৈতিক উদ্বৃত্তের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ড. সেন মনে করেন আলাভীর এই মতো অনেকাংশেই সত্যি। ভারতীয় উপনিবেশ-উত্তর রাষ্ট্রের চরিত্র বিশ্লেষণের সময় ড. সেন এই সত্যি খুঁজে পেয়েছেন। পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতের রাষ্ট্রের এই চরিত্রের মিল খুঁজে পেলেও ড. সেন তৃতীয় বিশ্বের সব রাষ্ট্র ঔপনিবেশিক আমলে অতি-উন্নত ছিল সে কথাটি মানতে নারাজ। অনেক দেশের উদাহরণ দিয়ে ড. সেন দেখিয়েছেন যে তৃতীয় বিশ্বের প্রায় রাষ্ট্রই বরং অনুন্নত। সামাজিক বিপ্লব ঘটেনি বলে এসব দেশের দেশজ শ্রেণিগুলো রাষ্ট্রের ওপর সেভাবে আধিপত্য স্থাপন করতে পারেনি। তার কারণ হিসেবে আলাভী দাবি করেন যে রাষ্ট্রই বরং এসব শ্রেণিকে দাবিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অবশ্যি, ড. সেন মনে করেন যে ভারতীয় উপ-মহাদেশের শ্রেণি সংগঠন ঐতিহাসিকভাবেই ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা বা রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত। অনেকের ধারণা ঔপনিবেশিক শক্তির উপস্থিতি দেশজ-ভূ-স্বামী ও পুঁজিপতিদের শক্তিকে ঠেকিয়ে একটা ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করেছে। ড. সেন মনে করেন এ ধারণারও কোনো বাস্তব প্রমাণ মেলে না। তিনি বরং আলাভীর সাথে একমত যে দেশজ সামাজিক শ্রেণিগুলোর দুর্বল অবস্থানের কারণেই রাষ্ট্র তার স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনের কারণেই সামাজিক শ্রেণিগুলোর এই অনুন্নয়নের কারণ বলে তিনি মনে করেন। এই ধারণার সাথে অন্য আরো কয়েকজন নয়া-মার্ক্সবাদী যথা সামির আমিন, অর্সিরি ইমানুয়েলের ভাবনার সাথে যথেষ্টই মিল খুঁজে পেয়েছেন তিনি। এ দেশগুলো বিশ্বপুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হবার কারণেই ঐ শ্রেণিগুলোর উন্নয়ন বা উত্তরণ ঘটেনি। তবে ড. সেন এদের ভাবনার প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও পুরোপুরি একমত হতে পারেননি। বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাফল্য যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর দেশজ শ্রেণিগুলোর অনুন্নয়নের কারণেই সম্ভব হয়েছে সে কথাটি এই নয়া-মার্ক্সবাদীরা তেমন স্পষ্ট করে বলেননি বলে ড. সেন দাবি করেছেন তাঁর গবেষণায়।
তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ তথা ভারতের অভ্যন্তরীণ শ্রেণিগুলোর সাথে বাইরের পুঁজির সংযোগের ফলে দেশটির উৎপাদন ব্যবস্থা, শ্রেণি বিন্যাস ও রাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্ক কীভাবে রূপান্তরিত হলো সেই আলোচনাটি উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ দিয়ে ড. সেন তাঁর গবেষণায় তুলে ধরেছেন। সকল অর্থেই তাঁর এই গবেষণাটি মৌলিক এবং তৃতীয় বিশ্বের যে কোনো দেশের সমাজকে বুঝতে চাইলে তাঁর এই ভাবনাগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হবে। প্রাক-ব্রিটিশ ভারতের উৎপাদন ব্যবস্থা ও শ্রেণি সংগঠন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপের ফলে ভারতের সামাজিক শ্রেণির বিন্যাসের রূপান্তর, ভারতীয় সমাজতন্ত্র তথা সমাজ ও অর্থনীতির ওপর রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তার, ভারতের কারিগর ও ক্ষুদে শিল্পের বিন্যাস ও রাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্ক, রাষ্ট্র ও সরকারি-বেসরকারি খাতের সম্পর্ক, ভারতীয় শিল্পের বিকাশে কৃষির সামাজিক অর্থনীতির প্রভাবসহ প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ের অবতারণা করেছেন ড. সেন এই বইতে। যে কোনো বিচারেই ড. সেনের এই বইটি তাঁর অনন্য মেধা, কঠিন পরিশ্রম এবং প্রগতিশীল অন্তর্দৃষ্টির ফসল। এমন একটি গবেষণা উপহার দিয়ে তিনি শুধু গবেষকদের নয় তাঁর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী ও আমার মতো গুণগ্রাহীদের অশেষ কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন।
এই বইটির পর তিনি যদি আর কিছুই না লিখতেন তবুও ড. অনুপম সেন বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে এক অনন্য উচ্চতায় রয়ে যেতেন।
কিন্তু আমাদের বড়ই সৌভাগ্য যে তাঁর এই মৌল গবেষণার পাটাতনের ওপর আরও অনেক লেখাই তিনি লিখেছেন। অনেক গণবক্তৃতাও করেছেন। এসবের পূর্ণ পর্যালোচনা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়। তবুও ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ’ এবং ‘বাঙালি মনন, বাঙালি-সংস্কৃতি: সাতটি বক্তৃতা’- এই দুটোর চুম্বক পর্যালোচনার মাধ্যম ড. সেনের গভীর মনন ও অনুসন্ধিতার অনুসন্ধান করতে চাই। প্রথম বইটির প্রথম প্রবন্ধটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখা। ‘বাংলাদেশ-সংগ্রামের সামাজিক পটভূমি’ নামের এই প্রবন্ধে ড. সেন ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক সময়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির বিশ্লেষণ করেছেন। পাকিস্তানের জন্ম এবং সেই রাষ্ট্রের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের চাপে পূর্ব-বাংলার অর্থনীতির ওপর শোষণের জাঁতাকলে এ অঞ্চলের সমাজ কীভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল তার বিশ্লেষণ করেছেন। মূলত পাঞ্জাবের অভিজন শ্রেণির স্বার্থ দেখতে গিয়ে কীভাবে পাকিস্তানের নির্মম রাষ্ট্রটি বাংলাদেশের মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধ্য করেছিল তার পটভূমি তিনি তুলে ধরেছেন। যে বাংলাদেশ ঐ সময় জন্ম নিতে যাচ্ছে তাতে যেন সকল মানুষের সমঅধিকার নিশ্চিত হয় সে আশাও ড. সেন করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘সর্বশ্রেণির মানুষের ত্যাগ ও তিতিক্ষার ফলে যে পূণ্যভূমির সৃষ্টি হচ্ছে সেই পূণ্যভূমির কল্যাণেই কেবল নয়, তার প্রাপ্তিতেও যেন সর্বশ্রেণির মানুষের সমঅধিকার থাকে।’
এর পরের প্রবন্ধে তিনি ‘স্বাধিকার চেতনা ও একুশের আন্দোলন’ বিষয়ে আলোচনার সময় ফরাসি বিপ্লবের অনুরূপ একুশের চেতনার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা লিখেছেন। একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ যেন ফরাসি বিপ্লবের অমর সঙ্গীত মেহনতি মানুষের বিজয়গাথারই অনুরূপ। বাঙালি জাতির বীজই শুধু বপন করেনি একুশে, সাম্যের অঙ্গীকারেও সম্পৃক্ত করেছিল সকল বাঙালিকে। ‘আমলাতন্ত্র ও আর্থসামাজিক মুক্তি’ প্রবন্ধে তিনি সমাজ জীবনে রাষ্ট্রের অপরিসীম ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন। ঐ রাষ্ট্রের প্রশাসন-ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি। তারই উত্তরাধিকারী যে আমলাতন্ত্র বাংলাদেশ কুক্ষিগত করেছে তারাই আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নেতৃত্ব দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এই আমলাতন্ত্রের সে যোগ্যতা নেই। শ্রেণি নেতৃত্ব না থাকায় আমলাতন্ত্রের এই নেতৃত্বের সুযোগ মিলেছে। সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন না আনা গেলে এমনটিই ঘটবে বলে ড. সেন মনে করেন।
এরপর তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শ্রেণি বৈষম্য’ নিয়ে। তিনি যথার্থই লিখেছেন যে, ‘বাংলাদেশ একটি ক্ষীয়মান এশীয়, বিকৃত সামন্ততান্ত্রিক ও বিকৃত ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার যৌগিক সমাহার। এই সমাজের শিক্ষাব্যবস্থাও তাই স্বাভাবিকভাবে বিকৃত, পরভৃত, গণবিরোধী ও শ্রেণিবৈষম্য-দুষ্ট।
উন্নত বিশ্বে শ্রেণি-বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও সেখানে শিক্ষাব্যবস্থা মোটামুটি সার্বজনীন। শিক্ষাখাতে তারা ব্যাপক হারে সরকারি অর্থ খরচ করেন সামাজিক বিনিয়োগ হিসেবে। এর ফলে ব্যক্তির শ্রমের দক্ষতা বাড়ে এবং পুঁজির ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে যেহেতু স্বাভাবিক ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটেনি তাই সেই মানের শিক্ষা ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা যায়নি। সংখ্যায় বাড়লেও মান বাড়েনি শিক্ষা ব্যবস্থায়। তাই ড. সেন মনে করেন এই শিক্ষা আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির হাতিয়ার হতে পারছে না।
শিক্ষা ব্যবস্থা বিষয়ক প্রবন্ধটির পর পরই তিনি ‘সামাজিক চাহিদা ও বিশ্ববিদ্যালয়-পাঠ্যসূচি’ বিষয়ে এক জ্ঞান-গর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন। এই প্রবন্ধেও তিনি দাবি করেছেন যে ‘মনুষ্যত্বের উদ্বোধিত’ করার মতো উচ্চ শিক্ষা আমরা দিতে পারছি না। পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির ক্রমবিকাশ ও উন্নয়ন তার আর্থসামাজিক প্রক্রিয়ার প্রয়োজনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হলেও আমাদের আর্থসামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন সেভাবে ঘটেনি। ফলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা উপযুক্ত মানুষ তৈরিতে কাক্সিক্ষত ভূমিকা রাখতে পারছে না। ‘বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের উত্তরাধিকার’ প্রবন্ধে ড. সেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশে সাম্যের গুরুত্ব একুশ ও একাত্তরের চেতনায় সিক্ত হতে পারেনি। তাই জনগণের সৃজনশীল ক্ষমতা ও শ্রমকে সংগঠিত করে তাদের বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকের আসনে বসানো সম্ভব হয়নি বলে তিনি উপসংহার টেনেছেন। এর ফলে স্বাধীনতার মূল তাৎপর্য বিঘ্নিত হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বিশ শতকের শেষ দিকে লিখেছেন ‘আগামী শতকের বাংলাদেশ’ প্রসঙ্গে। তিনি তাঁর মূল পিএইচডি গবেষণালব্ধ জ্ঞানের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন এই প্রবন্ধে। যে বাংলা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী অঞ্চল তার নিঃস্বকরণের প্রক্রিয়া নানা তথ্য দিয়ে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন এই প্রবন্ধে। লুম্পেন প্রলেতারিয়েতের অভিশাপ থেকে বাঁচার জন্য তিনি নব্য ঔপনিবেশিক প্রভাব ছিন্ন করে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণের পথে অগ্রসর হওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন এই প্রবন্ধের উপসংহারে।
সবশেষের প্রবন্ধে তিনি বিশ শতকের শেষ দশকের বাংলাদেশ কোন দিকে যাচ্ছে সেই বিষয়টির অবতারণা করেছেন। সমাজতন্ত্রের পক্ষে নৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় রেখেই তিনি স্বীকার করেছেন ‘এককেন্দ্রিক বিশ্বের বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পক্ষে সে পথে চলা বর্তমানে সম্ভব নয়।’ তাই বলে স্বদেশের স্থবিরতাও তাঁর কাম্য নয়। ধনতন্ত্রের গতিময়তার বিষয়টিও তাঁর জানা আছে। আর তাই তিনি মনে করেছেন যে, ‘এই মুহূর্তে জাতীয় বুর্জোয়া বিকাশের বিভিন্ন পন্থার সঙ্গে সমাজতন্ত্রের মানুষের অধিকারের সীমা বাড়ানোর যেসব পথ নির্দেশ রয়েছে তার সম্মিলন ঘটিয়ে চলাই বাংলাদেশের কাম্য বলে আমার মনে হয়।’ এই সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেই সমাজ পরিবর্তন ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে মানুষকে সংগঠিত করে অনুন্নয়নের শৃঙ্খল ভাঙার আহ্বান জানিয়েছেন ড. সেন।
আজীবন তিনি স্বপ্ন দেখেছেন সমাজতন্ত্র ও সাম্যের। তাই তাঁর এই আহ্বান মোটেও কথার কথা নয়। তাঁর এই গভীরতম চাওয়ার প্রতিফলন ঘটেছে ‘সাতটি বক্তৃতা’ গ্রন্থে। বাঙালির মনন ও সংস্কৃতির এসব বক্তৃতায় তিনি যে কথাগুলো বলতে চেয়েছেন তার নির্যাস হলো : হাজার বছর ধরে বিকশিত বাঙালির সংস্কৃতি নতুন সহস্রাব্দে আরো ঐশ্বর্যে পরিস্ফুট হবে। ‘আদি-অন্ত বাঙালি’, ‘রেনেসাঁস ও স্বাধীনতা-চিন্তা’, ‘ব্যক্তি ও রাষ্ট্র’, ‘সমাজ-দর্শনের আলোকে’… ‘সুফিয়া কামাল,’ ‘বালাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শ্রেণিবৈষম্য’, ‘বিশ্ববিদ্যালয়-পাঠ্যসূচি’, ‘হাজার বছরের হিসাব-নিকাশ’ শিরোনোমের বক্তৃতাগুলোতে তাঁর মৌলিক গবেষণাধর্মী পিএইচডি থিসিস ভিত্তিক বইটির ব্যাপক প্রভাব চোখে পড়ে। যে সমাজবিন্যাসের আলোকে তিনি গণবক্তৃতাগুলো দিয়েছেন সেসবের বুদ্ধিবৃত্তিক জমিন ঐ বইতেই তিনি কষে রেখেছিলেন। হাজার বছরের পুরনো বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশের কথা বলতে গিয়ে ড. সেন খুব স্বাভাবিকভাবেই মুখ্যত গ্রামীণ সংস্কৃতির স্নিগ্ধ ও গভীর পটভূমির সন্ধান দিয়েছেন। বাঙালি সংস্কৃতি যে হাজার বছর ধরে নানা ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও প্রস্ফুটিত হয়েছে এবং বিশ্ব সংস্কৃতির সাথে সংযোগ রক্ষা করে চলেছে তার নানামাত্রিক বিশ্লেষণ এই বইতে তুলে ধরেছেন ড. সেন। চলিত সময়ের সাথে কীভাবে আমাদের জীবন চলা, চিন্তা, মনন, সৃজনশীলতার পরিবর্তন হয়েছে, সমাজ-বিন্যাসের পরিবর্তন ও জগৎসভার সাথে তার সংযোগের আলোকে বাঙালির চলা ও বলার যে পরিবর্তন ঘটেছে সেসবই নানাভাবে তাঁর বক্তৃতায় ফুটে উঠেছে।
বক্তৃতাগুলোর উপসংহার মূলত আগের দুটো বইয়ের পর্যালোচনার মধ্যেই পড়ে বলে আলাদা আলাদা করে আর বিশ্লেষণ করলাম না।
ড. সেন এক বিরল প্রতিভা। এখনো তিনি আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর মেধার দ্যুতি ছড়িয়ে চলেছেন। পঞ্চাশ বছর ধরেই তিনি তা করছেন। পাশাপাশি তার মৌলিক ভাবনাগুলো গুছিয়ে লিখে বই আকারে আমাদের উপহার দিয়েছেন। আর সুযোগ পেলেই গণবক্তৃতা দিয়ে আমাদের এই নষ্ট ভ্রষ্ট সমাজকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন। শুধু পাণ্ডিত্য ও গবেষণার মাঝেই নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেননি। যখন এ দেশের সমাজ ও রাজনীতি অপশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে তখনই তিনি তাঁর বৃদ্ধিবৃত্তিক সরব উপস্থিতির মাধ্যমে প্রগতিশীল ও উদারনৈতিক শক্তিকে সাহস জুগিয়েছেন। সেই সুবাদেই তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হয়েছেন। আওয়ামী লীগ প্রকাশিত ‘গণতন্ত্রের বহ্নিশিখা : শেখ হাসিনা’ (২০১৬) লেখাটি পড়লেই তাঁর সমকালীন প্রগতিশীল ভূমিকার ইঙ্গিত মেলে। দুর্দিনে সুদিনে তিনি দলের প্রধান বঙ্গবন্ধু কন্যাকে সুপরামর্শ দিয়ে চলেছেন। আর চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার পাশাপাশি ঐ অঞ্চলের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে গতিময় রাখার জন্য সাধ্যমতো সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রত্যাশা করি আরো অনেক বছর তিনি তাঁর এই মেধা, মনন, দেশপ্রেম বাঙালির সামাজিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে আগের মতোই অকাতরে দান করে যাবেন। গত ৫ আগস্ট ছিল ড. অনুপম সেনের জন্মদিন। আপনি দীর্ঘজীবী হোন। সুস্থ থাকুন।
এক সময় ভারত বৃটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সম্পদশালী উপনিবেশ ছিল। স্বাধীন ভারত গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক পথের দিশা দেয়ার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। দেশটি দীর্ঘ দিন দারিদ্র্য ও স্থবিরতার প্রতীকে পরিণত হয়। অবশ্যি, সম্প্রতি ভারতের অর্থনীতি পুঁজিবাদী পথে হাঁটতে শুরু করেছে। তবে দারিদ্র্য ও সামাজিক বঞ্চনা এখনো তীব্র। বৈষম্যও প্রকট। অনেকেই ভারতের এই স্বাধীনতা-উত্তর স্থবিরতাকে তার সংস্কৃতির বন্ধ্যত্বের মাঝে খুঁজছেন। কিন্তু ড. অনুপম সেন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মার্ক্সীয় ধ্যাণধারণা থেকে এ বিষয়টি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। শ্রেণি বিন্যাসের আলোকে তিনি দেখিয়েছেন যে ভারতে পরম্পর স্বার্থবিরোধী শ্রেণিগুলোর পূর্ণ বিকাশ বা দখল সম্ভব হয়নি। এর প্রভাব ভারতীয় রাষ্ট্রের চরিত্রের ওপর পড়েছে। এশীয় উৎপাদন পদ্ধতির রেশ স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে এখনো বজায় রয়েছে। ফলে ভারতে সামাজিক রূপান্তর সেভাবে গতিময় হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে দেশটিতে ইউরোপের মতো ধ্রুপদী বুর্জোয়া রূপান্তর ঘটেনি। কিছু কিছু রাজ্যে (যেমন পাঞ্জাব ও হরিয়ানায়) আধুনিক কৃষির উদ্ভব ঘটলেও সারা দেশে তার বিস্তার সেভাবে ঘটেনি। শিল্পায়নও এতটা ঘটেনি যে গ্রামীণ মানুষগুলো শিল্পাঞ্চলে কাজের সন্ধানে যাবেন। সে কারণে ভারতের অনেক রাজ্যেই দারিদ্র্য খুবই প্রকট। তা ছাড়া, ভারতে এমন কোনো সমাজ বিপ্লবও ঘটেনি যে শহরের খেটে খাওয়া মানুষগুলো গ্রামের শ্রমজীবী মানুষের সাথে জোট বেঁধে সংগ্রাম করে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে পেরেছেন।
ভারতীয় সমাজের এই স্থবিরতা কেন ঘটেছিল সে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন মার্ক্স ও এঙ্গেলস তাঁদের মৌলিক লেখায়। ড. সেন সেসব কথার সূত্র ধরেই বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছেন। তবে সেখানেই থেমে যাননি তিনি। আধুনিক কালের মার্ক্সীয় চিন্তকদের বিশ্লেষণও তিনি একই সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। পুরো আলোচনায় এই মেধাবী সমাজতাত্ত্বি¡ক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত শ্রেণিগুলোর আধিপত্য বিস্তারের ফসল হিসেবে কোন ধাঁচের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে তার ইঙ্গিত করেছেন। সেই আলোকেই তিনি কেন নেহেরুর স্বাধীনতা-উত্তর ভারত স্থবিরতার শিকার হলো তার ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যদিকে জার্মানিতে বিসমার্কের শাসনামলে শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের সহযোগিতায় পুঁজিবাদী সামাজিক বিবর্তনের ফলে শিল্পায়ন কি করে ঘটল সে ব্যাখ্যাও যুক্তিপূর্ণভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর গবেষণার সৌন্দর্য এই যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ফেলে যে কোনো দেশের আর্থসামাজিক বিকাশের ধারাটি বোঝা সম্ভব। বিশ্লেষণের এই সর্বজনীন কাঠামোর কারণেই তিনি প্রশংসার দাবিদার।
এই ধারাবাহিকতায় ড. সেনের এই মৌলিক গ্রন্থে ভারতীয় রাষ্ট্রের চরিত্র এবং এ অঞ্চলের অর্থনীতি তথা শিল্পায়নের ধারাকে কীভাবে সেই রাষ্ট্র প্রভাবাম্বিত করেছে তার সন্ধানও মেলে। ড. সেন যথার্থই বলেছেন যে, সদা পরিবর্তনশীল সামাজিক প্রক্রিয়া অথবা উৎপাদন পদ্ধতির গভীরতা/স্থিতিশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ণিত হয়। উৎপাদন শক্তি ও সম্পর্কের উন্নয়নের ওপর অনেকাংশেই নির্ভর করে শ্রেণির গঠন ও বিন্যাস। আর এসবই একেক সমাজে একেক রকম হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক ও মানবিক কারণেই এই হেরফের হয়ে থাকে। তাই সমাজ ভেদে রাষ্ট্রের ধরনও বদলে যেতে পারে। মার্ক্সীয় ধারায় তাই রাষ্ট্র শুধু রাজনৈতিক একটি বিষয় নয়। এটি সামাজিকও বটে। সেই আলোকেই ড. সেন ভারতীয় রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ণয়ের সময় উৎপাদনের উপায়গুলোর রূপান্তরের ঐতিহাসিক ধারাকে ধরবার চেষ্টা করেছেন। এঙ্গেলস মনে করতেন সমাজে শ্রম বিভক্তি যেমন থাকে তেমনি যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাঁদের ভেতরও বিভাজন থাকে। তাঁদের স্বার্থ আর যাঁরা তাঁদের রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে বসিয়েছেন তাঁদের স্বার্থ এক নাও হতে পারে। এভাবেই রাষ্ট্র তার স্বাধীন সত্তা নির্মাণ করে। এভাবেই দুটো শক্তির মাঝে সংঘর্ষের উৎপত্তি হয়। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা এই সাংঘর্ষিক পরিবেশে ব্যাহত হতে পারে। উভয়ের স্বার্থ এক হলে অর্থনৈতিক উন্নতি দ্রুতও হতে পারে। কোনো কোনো দেশে অর্থনীতি যারা চালায় তারাই নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রের পরিচালকদের। যেমন শুরুতে ব্রিটেনে টোরি বা অভিজাত শ্রেণি বুর্জোয়াদের স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিল বলে তিনি লিখেছেন। তবে রাষ্ট্র বরাবরই আরো স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করে। বাস্তবে কতটা স্বাধীনতা ভোগ করে রাষ্ট্র তা নির্ভর করে উৎপাদন পদ্ধতির বিকাশ ও সামাজিক গঠন প্রক্রিয়ার ওপর।
ভারতের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এক সময় বরং বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ব বাজারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে রাষ্ট্র স্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করেনি। ফলে ভারতে পুঁজিবাদী উন্নয়ন পদ্ধতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। পুরনো এশীয় উৎপাদন পদ্ধতিকে পুরোপুরি কাবু করে ভারতের পক্ষে নয়া উৎপাদন পদ্ধতি স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। মার্ক্স ও এঙ্গেলস যে ধারার বিপ্লবাত্মক রূপান্তরের কথা বলতেন ভারতে সেটি সম্ভব হয়নি। সেই অর্থে মার্ক্সীয় তত্ত্বের আলোকে সকল সমাজ একই ধারায় রূপান্তরিত হবে সেটি আশা করা ঠিক নয়। রাষ্ট্র ও অর্থনীতির সম্পর্ক বহুমুখী ও দ্বান্দ্বিক হতেই পারে। তাই বলে এটা ঠিক হবে না যে অর্থনৈতিক ক্ষমতা থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎপত্তি হয়। বরং রাজনৈতিক ক্ষমতার ওপর ভর করেই অর্থনীতির বিকাশ ঘটে। আর সে কারণেই মার্ক্সীয় তত্ত্বে রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক ক্ষমতা তীব্র শ্রেণি দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে পরিণত হয়ে থাকে।
ড. সেনের গবেষণায় ধরা পড়েছে যে ভারতের রাষ্ট্র এশীয় উৎপাদন পদ্ধতির ফসল। ফলে বুর্জোয়াদের বিকাশের পথে এই রাষ্ট্র বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সতেরো ও আঠারো শতকে যে বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশ দ্রুত ঘটছিল তা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের কারণে বুর্জোয়াদের আধিপত্যে নিশ্চিত করা যায়নি। ভারতের পুঁজিবাদী রূপান্তরও সে কারণে বাধাগ্রস্থ হয়। ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের সমাজ আংশিক এশীয়, আংশিক সামন্ততান্ত্রিক এবং আংশিক পুঁজিবাদী হওয়ায় রাষ্ট্র অনায়াসে ভারত থেকে ঔপনিবেশবাদী কেন্দ্রে (লন্ডন, ম্যানচেস্টার) সম্পদ স্থানান্তর করতে পেরেছিল। ফলে ভারতের অর্থনীতি উন্নত হতে পারেনি। তার শ্রমের উৎপাদিকা শক্তিও তাই বিকশিত হয়নি। অন্যদিকে স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র তার স্বাধীনতা রক্ষার তাগিদ থেকে ব্যক্তি খাতের ওপর প্রবল নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। ফলে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে যে শিল্পায়ন গড়ে ওঠে তার সহযোগী হয় ক্ষুদে শিল্প ও কারিগরবৃন্দ। কৃষিতেও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার সব অঞ্চলে বাড়েনি। ফলে পুঁজিবাদী বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশ সেভাবে ঘটেনি। অসম উন্নয়নের এই ধারা চলার ফলে অর্থনীতি তার স্বাভাবিক গতিময়তা হারিয়ে ফেলে। তাই অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দেয় এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ দরিদ্রই থেকে যান। পরবর্তী সময়ে অবশ্যি অর্থনৈতিক সংস্কার ঘটিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গতি আনতে সক্ষম হয়েছে দেশটি। এর প্রভাবে দারিদ্র্যও কমেছে ভারতের অনেক রাজ্যে।
ড. সেন এখানেই থেমে যাননি। তিনি এরপর রাল্ফ মিলিবান্ড ও নিকোলাস পোলানৎজার ভাবনার আলোকে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ রক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকা বিষয়ে গবেষণা করেছেন। ড. সেন লিখেছেন যে নয়া-মার্ক্সবাদী রালফ্ মিলিবান্ড মনে করেন যে আধুনিক রাষ্ট্র শ্রেণি শাসনের এক নির্মম/আদর্শিক হাতিয়ার। আমলাতন্ত্র, পুলিশ, বিচার বিভাগ, সেনাবাহিনী ইত্যাদি এই রাষ্ট্রকে চালায়। এরা ব্যক্তি পুঁজিরও অধ:স্তন সমর্থক। পোলানৎজা মনে করেন রাষ্ট্রের প্রধান কাজই হলো পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখা। অর্থনৈতিকভাবে অধিপতি শ্রেণির আকাক্সক্ষা মতোই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়ে থাকে। তবে রাষ্ট্রের আবার অধিপতি শ্রেণিগুলো থেকে স্বাধীনতারও প্রয়োজন হয় তার ঐক্য রক্ষার জন্য। পুঁজিবাদী শ্রেণির সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যই রাষ্ট্র এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
হামজা আলাভী উপনিবেশ-উত্তর সমাজের রাষ্ট্র নিয়ে গবেষণা করেছেন। ড. সেন নয়া-মার্ক্সবাদী হিসেবে তাঁর ভাবনাগুলো নিয়েও নাড়াচাড়া করেছেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্র নিয়ে আলাভী কাজ করলেও মাঝেমধ্যে ভারতীয় রাষ্ট্রের কথাও তিনি বলেছেন। ঔপনিবেশিক পর্বে আলাভীর মতে রাষ্ট্র অতি-উন্নত ছিল। স্থানীয় শ্রেণিসমূহের চেয়ে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকারী সামরিক ও বেসামরিক আমলারা অনেক বেশি ক্ষমতাশীন ছিল। উপনিবেশ-উত্তর পর্বেও তাঁর মতে রাষ্ট্রের এই চরিত্র খুব একটা বদলায়নি। রাষ্ট্র স্বাধীনই রয়ে গেছে। কোনো একক শ্রেণি এই অতি-উন্নত রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারেনি। আলাভীর এই রাষ্ট্রভাবনাকে ড. সেন খুবই প্রাসঙ্গিক মনে করেছেন তাঁর গবেষণাক্ষেত্রে। ধ্রুপদী মার্ক্সীয় ভাবনায় অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ওপর রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক উপরিকাঠামো স্থান করে নেয়। কিন্তু উপনিবেশ-উত্তর সমাজে রাষ্ট্র বা উপরিকাঠামো অতি-উন্নত। অর্থনৈতিক পাটাতন ততোটা উন্নত না হলেও রাষ্ট্রের অবস্থান বেশ মজবুত। দেশীয় বুর্জোয়ার এই অস্বাভাবিক বিকাশের সাথে অনুন্নত অর্থনৈতিক অবকাঠামোর গভীর সম্পর্ক নেই। এখানে ঔপনিবেশিক শক্তির বিদায়ের পর কোনো একক শ্রেণি আধিপত্য বিস্তার করে উঠতে পারেনি। ফলে রাষ্ট্র পরিকল্পিত অর্থনীতি গড়বার নামে প্রচুর অর্থনৈতিক উদ্বৃত্তের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ড. সেন মনে করেন আলাভীর এই মতো অনেকাংশেই সত্যি। ভারতীয় উপনিবেশ-উত্তর রাষ্ট্রের চরিত্র বিশ্লেষণের সময় ড. সেন এই সত্যি খুঁজে পেয়েছেন। পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতের রাষ্ট্রের এই চরিত্রের মিল খুঁজে পেলেও ড. সেন তৃতীয় বিশ্বের সব রাষ্ট্র ঔপনিবেশিক আমলে অতি-উন্নত ছিল সে কথাটি মানতে নারাজ। অনেক দেশের উদাহরণ দিয়ে ড. সেন দেখিয়েছেন যে তৃতীয় বিশ্বের প্রায় রাষ্ট্রই বরং অনুন্নত। সামাজিক বিপ্লব ঘটেনি বলে এসব দেশের দেশজ শ্রেণিগুলো রাষ্ট্রের ওপর সেভাবে আধিপত্য স্থাপন করতে পারেনি। তার কারণ হিসেবে আলাভী দাবি করেন যে রাষ্ট্রই বরং এসব শ্রেণিকে দাবিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অবশ্যি, ড. সেন মনে করেন যে ভারতীয় উপ-মহাদেশের শ্রেণি সংগঠন ঐতিহাসিকভাবেই ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা বা রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত। অনেকের ধারণা ঔপনিবেশিক শক্তির উপস্থিতি দেশজ-ভূ-স্বামী ও পুঁজিপতিদের শক্তিকে ঠেকিয়ে একটা ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করেছে। ড. সেন মনে করেন এ ধারণারও কোনো বাস্তব প্রমাণ মেলে না। তিনি বরং আলাভীর সাথে একমত যে দেশজ সামাজিক শ্রেণিগুলোর দুর্বল অবস্থানের কারণেই রাষ্ট্র তার স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনের কারণেই সামাজিক শ্রেণিগুলোর এই অনুন্নয়নের কারণ বলে তিনি মনে করেন। এই ধারণার সাথে অন্য আরো কয়েকজন নয়া-মার্ক্সবাদী যথা সামির আমিন, অর্সিরি ইমানুয়েলের ভাবনার সাথে যথেষ্টই মিল খুঁজে পেয়েছেন তিনি। এ দেশগুলো বিশ্বপুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হবার কারণেই ঐ শ্রেণিগুলোর উন্নয়ন বা উত্তরণ ঘটেনি। তবে ড. সেন এদের ভাবনার প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও পুরোপুরি একমত হতে পারেননি। বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাফল্য যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর দেশজ শ্রেণিগুলোর অনুন্নয়নের কারণেই সম্ভব হয়েছে সে কথাটি এই নয়া-মার্ক্সবাদীরা তেমন স্পষ্ট করে বলেননি বলে ড. সেন দাবি করেছেন তাঁর গবেষণায়।
তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ তথা ভারতের অভ্যন্তরীণ শ্রেণিগুলোর সাথে বাইরের পুঁজির সংযোগের ফলে দেশটির উৎপাদন ব্যবস্থা, শ্রেণি বিন্যাস ও রাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্ক কীভাবে রূপান্তরিত হলো সেই আলোচনাটি উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ দিয়ে ড. সেন তাঁর গবেষণায় তুলে ধরেছেন। সকল অর্থেই তাঁর এই গবেষণাটি মৌলিক এবং তৃতীয় বিশ্বের যে কোনো দেশের সমাজকে বুঝতে চাইলে তাঁর এই ভাবনাগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হবে। প্রাক-ব্রিটিশ ভারতের উৎপাদন ব্যবস্থা ও শ্রেণি সংগঠন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপের ফলে ভারতের সামাজিক শ্রেণির বিন্যাসের রূপান্তর, ভারতীয় সমাজতন্ত্র তথা সমাজ ও অর্থনীতির ওপর রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তার, ভারতের কারিগর ও ক্ষুদে শিল্পের বিন্যাস ও রাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্ক, রাষ্ট্র ও সরকারি-বেসরকারি খাতের সম্পর্ক, ভারতীয় শিল্পের বিকাশে কৃষির সামাজিক অর্থনীতির প্রভাবসহ প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ের অবতারণা করেছেন ড. সেন এই বইতে। যে কোনো বিচারেই ড. সেনের এই বইটি তাঁর অনন্য মেধা, কঠিন পরিশ্রম এবং প্রগতিশীল অন্তর্দৃষ্টির ফসল। এমন একটি গবেষণা উপহার দিয়ে তিনি শুধু গবেষকদের নয় তাঁর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী ও আমার মতো গুণগ্রাহীদের অশেষ কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন।
এই বইটির পর তিনি যদি আর কিছুই না লিখতেন তবুও ড. অনুপম সেন বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে এক অনন্য উচ্চতায় রয়ে যেতেন।
কিন্তু আমাদের বড়ই সৌভাগ্য যে তাঁর এই মৌল গবেষণার পাটাতনের ওপর আরও অনেক লেখাই তিনি লিখেছেন। অনেক গণবক্তৃতাও করেছেন। এসবের পূর্ণ পর্যালোচনা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়। তবুও ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ’ এবং ‘বাঙালি মনন, বাঙালি-সংস্কৃতি: সাতটি বক্তৃতা’- এই দুটোর চুম্বক পর্যালোচনার মাধ্যম ড. সেনের গভীর মনন ও অনুসন্ধিতার অনুসন্ধান করতে চাই। প্রথম বইটির প্রথম প্রবন্ধটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখা। ‘বাংলাদেশ-সংগ্রামের সামাজিক পটভূমি’ নামের এই প্রবন্ধে ড. সেন ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক সময়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির বিশ্লেষণ করেছেন। পাকিস্তানের জন্ম এবং সেই রাষ্ট্রের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের চাপে পূর্ব-বাংলার অর্থনীতির ওপর শোষণের জাঁতাকলে এ অঞ্চলের সমাজ কীভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল তার বিশ্লেষণ করেছেন। মূলত পাঞ্জাবের অভিজন শ্রেণির স্বার্থ দেখতে গিয়ে কীভাবে পাকিস্তানের নির্মম রাষ্ট্রটি বাংলাদেশের মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধ্য করেছিল তার পটভূমি তিনি তুলে ধরেছেন। যে বাংলাদেশ ঐ সময় জন্ম নিতে যাচ্ছে তাতে যেন সকল মানুষের সমঅধিকার নিশ্চিত হয় সে আশাও ড. সেন করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘সর্বশ্রেণির মানুষের ত্যাগ ও তিতিক্ষার ফলে যে পূণ্যভূমির সৃষ্টি হচ্ছে সেই পূণ্যভূমির কল্যাণেই কেবল নয়, তার প্রাপ্তিতেও যেন সর্বশ্রেণির মানুষের সমঅধিকার থাকে।’
এর পরের প্রবন্ধে তিনি ‘স্বাধিকার চেতনা ও একুশের আন্দোলন’ বিষয়ে আলোচনার সময় ফরাসি বিপ্লবের অনুরূপ একুশের চেতনার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা লিখেছেন। একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ যেন ফরাসি বিপ্লবের অমর সঙ্গীত মেহনতি মানুষের বিজয়গাথারই অনুরূপ। বাঙালি জাতির বীজই শুধু বপন করেনি একুশে, সাম্যের অঙ্গীকারেও সম্পৃক্ত করেছিল সকল বাঙালিকে। ‘আমলাতন্ত্র ও আর্থসামাজিক মুক্তি’ প্রবন্ধে তিনি সমাজ জীবনে রাষ্ট্রের অপরিসীম ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন। ঐ রাষ্ট্রের প্রশাসন-ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি। তারই উত্তরাধিকারী যে আমলাতন্ত্র বাংলাদেশ কুক্ষিগত করেছে তারাই আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নেতৃত্ব দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এই আমলাতন্ত্রের সে যোগ্যতা নেই। শ্রেণি নেতৃত্ব না থাকায় আমলাতন্ত্রের এই নেতৃত্বের সুযোগ মিলেছে। সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন না আনা গেলে এমনটিই ঘটবে বলে ড. সেন মনে করেন।
এরপর তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শ্রেণি বৈষম্য’ নিয়ে। তিনি যথার্থই লিখেছেন যে, ‘বাংলাদেশ একটি ক্ষীয়মান এশীয়, বিকৃত সামন্ততান্ত্রিক ও বিকৃত ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার যৌগিক সমাহার। এই সমাজের শিক্ষাব্যবস্থাও তাই স্বাভাবিকভাবে বিকৃত, পরভৃত, গণবিরোধী ও শ্রেণিবৈষম্য-দুষ্ট।
উন্নত বিশ্বে শ্রেণি-বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও সেখানে শিক্ষাব্যবস্থা মোটামুটি সার্বজনীন। শিক্ষাখাতে তারা ব্যাপক হারে সরকারি অর্থ খরচ করেন সামাজিক বিনিয়োগ হিসেবে। এর ফলে ব্যক্তির শ্রমের দক্ষতা বাড়ে এবং পুঁজির ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে যেহেতু স্বাভাবিক ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটেনি তাই সেই মানের শিক্ষা ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা যায়নি। সংখ্যায় বাড়লেও মান বাড়েনি শিক্ষা ব্যবস্থায়। তাই ড. সেন মনে করেন এই শিক্ষা আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির হাতিয়ার হতে পারছে না।
শিক্ষা ব্যবস্থা বিষয়ক প্রবন্ধটির পর পরই তিনি ‘সামাজিক চাহিদা ও বিশ্ববিদ্যালয়-পাঠ্যসূচি’ বিষয়ে এক জ্ঞান-গর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন। এই প্রবন্ধেও তিনি দাবি করেছেন যে ‘মনুষ্যত্বের উদ্বোধিত’ করার মতো উচ্চ শিক্ষা আমরা দিতে পারছি না। পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির ক্রমবিকাশ ও উন্নয়ন তার আর্থসামাজিক প্রক্রিয়ার প্রয়োজনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হলেও আমাদের আর্থসামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন সেভাবে ঘটেনি। ফলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা উপযুক্ত মানুষ তৈরিতে কাক্সিক্ষত ভূমিকা রাখতে পারছে না। ‘বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের উত্তরাধিকার’ প্রবন্ধে ড. সেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশে সাম্যের গুরুত্ব একুশ ও একাত্তরের চেতনায় সিক্ত হতে পারেনি। তাই জনগণের সৃজনশীল ক্ষমতা ও শ্রমকে সংগঠিত করে তাদের বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকের আসনে বসানো সম্ভব হয়নি বলে তিনি উপসংহার টেনেছেন। এর ফলে স্বাধীনতার মূল তাৎপর্য বিঘ্নিত হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বিশ শতকের শেষ দিকে লিখেছেন ‘আগামী শতকের বাংলাদেশ’ প্রসঙ্গে। তিনি তাঁর মূল পিএইচডি গবেষণালব্ধ জ্ঞানের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন এই প্রবন্ধে। যে বাংলা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী অঞ্চল তার নিঃস্বকরণের প্রক্রিয়া নানা তথ্য দিয়ে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন এই প্রবন্ধে। লুম্পেন প্রলেতারিয়েতের অভিশাপ থেকে বাঁচার জন্য তিনি নব্য ঔপনিবেশিক প্রভাব ছিন্ন করে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণের পথে অগ্রসর হওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন এই প্রবন্ধের উপসংহারে।
সবশেষের প্রবন্ধে তিনি বিশ শতকের শেষ দশকের বাংলাদেশ কোন দিকে যাচ্ছে সেই বিষয়টির অবতারণা করেছেন। সমাজতন্ত্রের পক্ষে নৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় রেখেই তিনি স্বীকার করেছেন ‘এককেন্দ্রিক বিশ্বের বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পক্ষে সে পথে চলা বর্তমানে সম্ভব নয়।’ তাই বলে স্বদেশের স্থবিরতাও তাঁর কাম্য নয়। ধনতন্ত্রের গতিময়তার বিষয়টিও তাঁর জানা আছে। আর তাই তিনি মনে করেছেন যে, ‘এই মুহূর্তে জাতীয় বুর্জোয়া বিকাশের বিভিন্ন পন্থার সঙ্গে সমাজতন্ত্রের মানুষের অধিকারের সীমা বাড়ানোর যেসব পথ নির্দেশ রয়েছে তার সম্মিলন ঘটিয়ে চলাই বাংলাদেশের কাম্য বলে আমার মনে হয়।’ এই সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেই সমাজ পরিবর্তন ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে মানুষকে সংগঠিত করে অনুন্নয়নের শৃঙ্খল ভাঙার আহ্বান জানিয়েছেন ড. সেন।
আজীবন তিনি স্বপ্ন দেখেছেন সমাজতন্ত্র ও সাম্যের। তাই তাঁর এই আহ্বান মোটেও কথার কথা নয়। তাঁর এই গভীরতম চাওয়ার প্রতিফলন ঘটেছে ‘সাতটি বক্তৃতা’ গ্রন্থে। বাঙালির মনন ও সংস্কৃতির এসব বক্তৃতায় তিনি যে কথাগুলো বলতে চেয়েছেন তার নির্যাস হলো : হাজার বছর ধরে বিকশিত বাঙালির সংস্কৃতি নতুন সহস্রাব্দে আরো ঐশ্বর্যে পরিস্ফুট হবে। ‘আদি-অন্ত বাঙালি’, ‘রেনেসাঁস ও স্বাধীনতা-চিন্তা’, ‘ব্যক্তি ও রাষ্ট্র’, ‘সমাজ-দর্শনের আলোকে’… ‘সুফিয়া কামাল,’ ‘বালাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শ্রেণিবৈষম্য’, ‘বিশ্ববিদ্যালয়-পাঠ্যসূচি’, ‘হাজার বছরের হিসাব-নিকাশ’ শিরোনোমের বক্তৃতাগুলোতে তাঁর মৌলিক গবেষণাধর্মী পিএইচডি থিসিস ভিত্তিক বইটির ব্যাপক প্রভাব চোখে পড়ে। যে সমাজবিন্যাসের আলোকে তিনি গণবক্তৃতাগুলো দিয়েছেন সেসবের বুদ্ধিবৃত্তিক জমিন ঐ বইতেই তিনি কষে রেখেছিলেন। হাজার বছরের পুরনো বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশের কথা বলতে গিয়ে ড. সেন খুব স্বাভাবিকভাবেই মুখ্যত গ্রামীণ সংস্কৃতির স্নিগ্ধ ও গভীর পটভূমির সন্ধান দিয়েছেন। বাঙালি সংস্কৃতি যে হাজার বছর ধরে নানা ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও প্রস্ফুটিত হয়েছে এবং বিশ্ব সংস্কৃতির সাথে সংযোগ রক্ষা করে চলেছে তার নানামাত্রিক বিশ্লেষণ এই বইতে তুলে ধরেছেন ড. সেন। চলিত সময়ের সাথে কীভাবে আমাদের জীবন চলা, চিন্তা, মনন, সৃজনশীলতার পরিবর্তন হয়েছে, সমাজ-বিন্যাসের পরিবর্তন ও জগৎসভার সাথে তার সংযোগের আলোকে বাঙালির চলা ও বলার যে পরিবর্তন ঘটেছে সেসবই নানাভাবে তাঁর বক্তৃতায় ফুটে উঠেছে।
বক্তৃতাগুলোর উপসংহার মূলত আগের দুটো বইয়ের পর্যালোচনার মধ্যেই পড়ে বলে আলাদা আলাদা করে আর বিশ্লেষণ করলাম না।
ড. সেন এক বিরল প্রতিভা। এখনো তিনি আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর মেধার দ্যুতি ছড়িয়ে চলেছেন। পঞ্চাশ বছর ধরেই তিনি তা করছেন। পাশাপাশি তার মৌলিক ভাবনাগুলো গুছিয়ে লিখে বই আকারে আমাদের উপহার দিয়েছেন। আর সুযোগ পেলেই গণবক্তৃতা দিয়ে আমাদের এই নষ্ট ভ্রষ্ট সমাজকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন। শুধু পাণ্ডিত্য ও গবেষণার মাঝেই নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেননি। যখন এ দেশের সমাজ ও রাজনীতি অপশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে তখনই তিনি তাঁর বৃদ্ধিবৃত্তিক সরব উপস্থিতির মাধ্যমে প্রগতিশীল ও উদারনৈতিক শক্তিকে সাহস জুগিয়েছেন। সেই সুবাদেই তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হয়েছেন। আওয়ামী লীগ প্রকাশিত ‘গণতন্ত্রের বহ্নিশিখা : শেখ হাসিনা’ (২০১৬) লেখাটি পড়লেই তাঁর সমকালীন প্রগতিশীল ভূমিকার ইঙ্গিত মেলে। দুর্দিনে সুদিনে তিনি দলের প্রধান বঙ্গবন্ধু কন্যাকে সুপরামর্শ দিয়ে চলেছেন। আর চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার পাশাপাশি ঐ অঞ্চলের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে গতিময় রাখার জন্য সাধ্যমতো সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রত্যাশা করি আরো অনেক বছর তিনি তাঁর এই মেধা, মনন, দেশপ্রেম বাঙালির সামাজিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে আগের মতোই অকাতরে দান করে যাবেন। গত ৫ আগস্ট ছিল ড. অনুপম সেনের জন্মদিন। আপনি দীর্ঘজীবী হোন। সুস্থ থাকুন।
No comments