চার দফা পরিকল্পনা স্টারমারের: ৩ দিনের ধুন্ধুমার কূটনীতি জেলেনস্কি
এতে বলা হয়, ইউক্রেন নিয়ে বৃটেনের রাজধানী লন্ডনে যে সম্মেলন হয়েছে সেখানে এসব কথা বলেছেন স্টারমার। তার সঙ্গে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরাও উপস্থিত ছিলেন। ওই সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন জোরালো সমর্থন অনুভব করছে। লন্ডনে যে সম্মেলনটি হলো তা ইউরোপীয় নেতাদের শীর্ষ নেতাদের ঐক্যের প্রতীক হয়ে ফুটে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরেই এমনটি দেখা যায় না।
শুক্রবার হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের পর লন্ডনে ইউরোপিয়ান নেতাদের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। সেখানে ইউরোপের নেতাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন জেলেনস্কি। বলেছেন, শান্তিচুক্তি এবং নিরাপত্তার গ্যারিন্টি পেতে আমেরিকার সমর্থন আদায়ে আমরা সকলে ইউরোপের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করছি।
ওই সম্মেলনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে স্টারমার বলেছেন, তারা চার দফা পরিকল্পনার বিষয়ে একমত হয়েছেন। সেগুলো হলো- ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা জারি রাখা এবং রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করা। যেকোনো স্থায়ী শান্তির জন্য ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং যেকোনো শান্তি আলোচনায় ইউক্রেনকে উপস্থিত রাখতে হবে। শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে, ভবিষ্যতে যেকোনো হামলা রোধ করতে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামূলক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। ইউক্রেনে শান্তি চুক্তির নিশ্চয়তার জন্য স্বেচ্ছাসেবী একটি জোট গড়ে তুলতে হবে।
এ সকল দফা বাস্তবায়নে ইতিমধ্যেই ইউক্রেনের জন্য প্রতিরক্ষা সহায়তার জন্য ঋণ ঘোষণা করেছেন স্টারমার। তিনি ২০০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৫ হাজার আকাশ প্রতিরক্ষা মিসাইল রয়েছে। রাশিয়ার জব্দকৃত সম্পদের লভ্যাংশও ওই ঋণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। স্টারমার বলেছেন, অতীতের ভুল থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। আমরা এমন কোনো দুর্বল চুক্তি মেনে নেবো না যা রাশিয়া চাইলেই লঙ্ঘন করতে পারে। এর বিপরীতে প্রতিটি চুক্তিই হতে হবে শক্তিশালী।
কোন কোন দেশ নিয়ে স্বেচ্ছা জোট গড়ে তোলা হবে তা স্পষ্ট করেননি বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী। তবে তিনি উল্লেখ করেছেন, যারা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তারাই জরুরিভাবে এগিয়ে আসবেন। ইউক্রেনের মাটি এবং আকাশ সুরক্ষায় বৃটেন নিজের অঙ্গীকার পূর্ণ করবে বলে মন্তব্য করেছেন স্টারমার।
৩ দিনের ধুন্ধুমার কূটনীতি জেলেনস্কি
তিন দিনের ধুন্ধুমার কূটনৈতিক মিশন। এ সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর ব্যক্তির সামনেও মাথা নত করেননি। যুদ্ধের ভেতর থাকা একজন যোদ্ধা প্রেসিডেন্টের মতো মাথা উঁচু করে বিশ্ববাসীর সামনে এক নতুন নজির স্থাপন করলেন। অথচ তার ক্যারিয়ার রাজনীতি দিয়ে শুরু নয়। তিনি একজন কৌতুক অভিনেতা। কিন্তু নিজের জনপ্রিয়তা, প্রজ্ঞার জোরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ভলোদিমির জেলেনস্কি। যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের অপমানে দৃশ্যত পরাজিত হয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। কিন্তু নৈতিকতার কাছে তিনি পরাজিত হননি। তিনি সাহস দেখিয়েছেন সত্য বলার। নিজের দেশবাসীকে অন্ধকারে রেখে তিনি মাথা নিচু করে থাকেননি। একজন বীরের মতো কথা বলেছেন। এক পর্যায়ে তাকে হোয়াইট হাউস থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তবু কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছেন। ইউরোপিয়ানদের ঐক্যের প্রশংসা করেছেন। ২৮শে ফেব্রুয়ারি ওভাল অফিসের উত্তেজনাকর কথোপকথন এখন সারাবিশ্বের টক অব দ্য টাউন। এরপর শনিবারই তিনি লন্ডনে ফিরে আসেন। রোববার লন্ডনের ল্যাঙ্কাস্টার হাউসে ইউরোপিয়ান নেতাদের বৈঠকে যোগ দেন। জেলেনস্কির পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার। ওই বৈঠকে ইউক্রেনের শান্তির নিরাপত্তায় চার দফা পরিকল্পনা ঘোষণা করেন তিনি।
ওই চার দফায় বলা হয়-
১. ইউক্রেনে সামরিক সহায়তার প্রবাহ অব্যাহত রাখতে হবে এবং রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করতে হবে।
২. যেকোনো রকম শান্তি আলোচনায় ইউক্রেনকে অবশ্যই রাখতে হবে। যেকোনো টেকসই শান্তিতে অবশ্যই ওই দেশটির সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।
৩. শান্তিচুক্তিতে ভবিষ্যতের যেকোনো আগ্রাসনকে বানচাল করে দিতে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং
৪. ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা চুক্তি রক্ষা করতে এবং পরে শান্তি নিশ্চিত করতে ‘স্বেচ্চায় একটি জোট’ গঠন করতে হবে।
পরে রোববার রাতে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন লা ফিগারো পত্রিকাকে বলেছেন, আকাশ, সমুদ্র এবং জ্বালানি অবকাঠামোতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি এক মাসের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করতে চায় প্যারিস ও লন্ডন। ওদিকে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে গেলেন জেলেনস্কি। তিনি এ সময় বলেন, যেকোনো শান্তিচুক্তিতে ইউক্রেনের নিরাপত্তার গ্যারান্টি নিশ্চিত করতে হবে। লন্ডন ত্যাগের আগে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খনিজ চুক্তি করার জন্য তিনি প্রস্তুত। বিভিন্ন মিডিয়ায় এ নিয়ে নানা রকম রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। অনলাইন বিবিসি লিখেছে, রোববারের সম্মেলনে ইউক্রেনের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে। স্টারমার যে চার দফা দিয়েছেন, তাতে এ বিষয়টি স্পষ্ট।
ইমানুয়েল ম্যাক্রন লা ফিগারো পত্রিকাকে যে পরিকল্পনা দিয়েছেন তাতে তিনি পরিষ্কার করেছেন যে, পুরো ইউরোপ মহাদেশে সামরিক ব্যয় অবশ্যই বৃদ্ধি করা উচিত ইউরোপের। এক্ষেত্রে ইউরোপে জব্দ করা রাশিয়ার সম্পদ ব্যবহার করা যেতে পারে। কোনো কিছুর খরচ মেটানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দেয় সহায়তার পরিবর্তে এই অর্থ ব্যবহার হতে পারে। তবে ম্যাক্রনের প্রস্তাবিত পরিকল্পনার বিষয়ে বৃটেন এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মন্তব্য করেনি। ওদিকে ইউক্রেনে শান্তির পথ নিয়ে বিবিসি’র পলিটিক্যাল এডিটর ক্রিস ম্যাসন বলেন, ইউক্রেনের জন্য শান্তির পথ খুব সোজা বা সহজ হবে না।
যদিও ইউরোপিয়ানরা রোববার ল্যাঙ্কাস্টার হাউজে মিলিত হয়েছিলেন এবং এটা ছিল ওভাল অফিসের উত্তেজনার আগেই পরিকল্পনা করা, কিন্তু এটাকে কেউ ওভাল অফিসের পাল্টা হিসেবে দেখতে পারেন। বিশেষ করে রাশিয়া একে ট্রাম্পবিরোধী সম্মেলন হিসেবে দেখতে পারে। তবে স্যার কিয়ের স্টারমার ও অন্যরা তেমন কিছুই নন। ওই সামিটে যা অনুভূত হয়েছে তা হলো, ইউরোপের জন্য একটি শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে চেষ্টা করছে ইউরোপ।
ইউক্রেন এরই মধ্যে প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে যে, এই যুদ্ধ স্থায়ীভাবে বন্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আস্থাকে আমলে নেয়া উচিত ইউরোপের। যদি শান্তিচুক্তি করা যায় তাহলে এর বড় রকম প্রভাব পড়বে বৃটেনের অনেক পরিবারে। সম্ভবত সেনাদের মোতায়েন করতে হবে। অস্ত্রধারী পুরুষ এবং নারীদের মোতায়েন করতে হবে ইউক্রেনে। এই দায়িত্ব পালন করতে হবে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে, যেখানে কয়েক দশক ধরে পরিকল্পনা করেছে রাশিয়া। ইউক্রেনে মোতায়েন করা ওইসব ব্যক্তির ভূমিকা হবে শান্তিরক্ষীর। কিন্তু অনেকেই তাদেরকে দেখতে পারেন সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে। এ জন্য এখনো কূটনৈতিক অনেক কাজ বাকি। এ জন্য অনেক সময় প্রয়োজন।
No comments