এক দিন কাজ না পেলে চুলায় ভাত বসে না তাঁদের by পল্লব চক্রবর্তী

আজ শুক্রবার সকাল আটটা। শীতের সকালে ঘন কুয়াশা। পূর্ব আকাশে সূর্য হালকা উঁকি দিচ্ছে। কাজের সন্ধানে জড়ো হচ্ছেন মানুষ। কাজ পেলে এসব মানুষের উনুন জ্বলবে, জুটবে ভাত। না পেলে পরিবার নিয়ে উপোস থাকতে হবে তাঁদের। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে শ্রমিকের সংখ্যাও। কিন্তু শ্রমিক নিতে আসা মালিকের দেখা মেলা ভার। মাঝেমধ্যে কেউ এলে হুমড়ি খেয়ে পড়েন সব শ্রমিক।

আজ এ দৃশ্যের দেখা মেলে নেত্রকোনা শহরের তেরিবাজার এলাকায় প্রধান ডাকঘরের সামনে। শত বছর ধরে প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এখানে বসে দিনমজুরদের হাট। এখানে জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ পাশের ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জের অনেক উপজেলা থেকে তিন শতাধিক শ্রমিক আসেন সারা দিনের জন্য শ্রম বিক্রি করতে। হাট থেকে মালিকেরা দরদাম মিটিয়ে তাঁদের মধ্য থেকে কাউকে নিয়ে যান। আবার কেউ কাজ না পেয়ে বিষণ্ন মনে খালি হাতে ফিরে যান বাড়িতে।

সদর উপজেলার আমতলা ইউনিয়নের দুগিয়া গ্রাম থেকে ষাটোর্ধ্ব আবদুল আজিজ এসেছেন শ্রম বিক্রি করতে। সকাল নয়টা পর্যন্ত তিনি কোনো কাজ না পেয়ে বিষণ্ন মনে বসে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁর বয়স যখন ২০ বছর ছিল তখন থেকেই এ স্থানে এসে শ্রম বিক্রি করেন। ৪০ বছর ধরে তিনি নিয়মিত শ্রম বিক্রি করছেন। এখন প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় কাজ করেন। কিন্তু যে টাকা পান তাতে সংসার চলে না। সবকিছুর দাম বেশি হওয়ায় এই টাকা চাল-ডাল ও সবজি কিনতেই শেষ হয়ে যায়। সপ্তাহে পাতে মাছ মেলানো ভার। অবশ্য বছর ত্রিশেক আগেও ৫০ থেকে ৮০ টাকা রোজ উপার্জন করলে তা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলা যেত বলে জানান তিনি।

আজিজের পাশে থাকা উপজেলার চল্লিশা থেকে শ্রম বিক্রি করতে এসেছেন মো. সাইফুল ইসলাম (৩৭)। আর্থিক অনটনের মধ্যেই তিনি স্নাতক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। ২০১৪ সালে নেত্রকোনা আবু আব্বাছ ডিগ্রি কলেজ থেকে যখন বিএ পরীক্ষা দেন তখন তাঁর বাবা শামছুদ্দিন মারা যান। এর পর থেকে তিনি সংসারের হাল ধরেন। তিনি গাজীপুরে স্কয়ার মাস্টারবাড়ী এলাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি নেন। কিন্তু করোনাকালে চাকরি হারিয়ে বাড়িতে এসে বেকার হন। বিভিন্ন স্থানে ‍ঘুরে কাজের সুযোগ না পেয়ে চার বছর ধরে তিনি নেত্রকোনা তেরিবাজার মোড়ে শ্রম বিক্রি করেন। এই রোজগার দিয়ে চলে তাঁর ছয় সদস্যের সংসার। ঘরে অসুস্থ মা হেলেনা আক্তারের (৬৬) ওষুধ, দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়া ছোট বোন ঋতুর লেখাপড়ার খরচ, তাঁর ছয় ও তিন বছরের দুই ছেলে এবং স্ত্রীর ভরণপোষণ মেটাতে গিয়ে এখন নাভিশ্বাস অবস্থায় আছেন বলে জানান তিনি।

সাইফুল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাই, লেখাপড়া করে কোনো চাকরি পাইলাম না। অনেক জায়গায় ঘুরেছি। অভাবের সংসার, ঘরে ছয়জন মানুষ। তাই মানসম্মান নিয়া বইসা না থাইক্কা কামলার বাজারে আইয়া শ্রম বিক্রি করি। এতে কাজ বুঝে কোনো দিন ৪৫০ টাকা, কোনো দিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পাই। এ দিয়াই কোনোরকমে সংসার চলাই। এক দিন কাম না পাইলে চুলাতে ভাত বসে না। না খেয়ে থাকতে হয়। তাই এক দিনের কামলা যাওয়ার জন্য কত যে মানুষের ব্যাকুলতা, এখানে কেউ না দাঁড়াইলে উপলব্ধি করতে পারত না।’

উলুয়াটি গ্রামের শ্রমিক মো. শামছু মিয়া (৫৯) জানান, তিনি ৪২ বছর ধরে রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। দুই ছেলে, এক মেয়েসহ পরিবারে তাঁর সদস্যসংখ্যা সাতজন। এক দিন কাজ না পেলে সংসার চলে না। প্রতিদিন তেরিবাজারে এসে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি হন তিনি। আগে কাজের জন্য এত হাহাকার ছিল না। হাটে শ্রমিকের সংখ্যাও কম ছিল, তাই তুলনামূলক দামও বেশি ছিল। করোনার পর থেকে শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে গেছে।

পূর্বধলার শ্যামগঞ্জের শ্রমিক জিল্লুর রহমান (৫৫) জানান, ৩৫ বছর ধরে কামলা দিচ্ছেন। আগে নিজের কিছু জমি ছিল, অভাবের কারণে সেগুলো বিক্রি করে দিয়েছেন। কামলা দিয়ে তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে স্কুল–মাদ্রাসায় লেখাপড়া করাচ্ছেন। ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন তিনি। যেদিন যে কাজ পান, সে কাজই করেন। এক দিন কাজ না পেলে ভাত জোটে না তাঁর ঘরে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘বয়সের কারণে কাম করতে কষ্ট হয়। মানুষও আমারে কামে নিতে চায় না বয়স দেইক্খা।’

বর্তমান বাজারদরে প্রাপ্ত মজুরি দিয়ে জীবন কেমন চলছে, জিল্লুরের সঙ্গে যখন কথা চলছিল তখন পাশ থেকে মালনি এলাকার বরকত মিয়া, পুকুরিয়ার বিল্লাল শেখ, মাহমুদপুরের তাজুল ইসলামসহ কয়েকজন বলছিলেন, ‘এক দিন কাম না পাইলে উপবাস থাকতে হয়।’

সাতপাই রেলক্রসিং এলাকার শ্রমিক রহিম উদ্দিনকে দুর্ভাগ্যবশত আজ কেউ নেয়নি। তাই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বাজারে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, আমরার শ্রমের মজুরি কিন্তু বাড়ছে না। বরং কাজ কমছে, কামলা বাড়ছে। সপ্তাহে তিন-চার দিন কাম পাই। তা দিয়াই খুব কষ্টে দিন কাটাই। ১১০ টেহার পাঙাশ মাছ অহন ২০০ টেহায় কিনতে হয়। আগে দুপুরে হোটেলে ৪০ টেহা দিয়া ভাত খাওন যাইত। অহন ডিম দিয়া খাইলেও ৬০ টেহা লাগে।’

এক দিন কাজ না পেলে তাঁদের অনেকের কপালেই খাবার জোটে না। আজ শুক্রবার সকালে নেত্রকোনা শহরের তেরিবাজার মোড় এলাকায়
এক দিন কাজ না পেলে তাঁদের অনেকের কপালেই খাবার জোটে না। আজ শুক্রবার সকালে নেত্রকোনা শহরের তেরিবাজার মোড় এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.