জলবায়ু বিপর্যয় রোধে একটি বিকল্প কৌশলপত্ by আব্দুল কাইয়ুম
জলবায়ু-বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণে এ পর্যন্ত যেসব চিন্তাভাবনা ও প্রযুক্তির প্রবর্তন করা হচ্ছে, তা সবই একমুখী। অর্থাত্ কার্বন নিঃসরণ কমাও, তাহলে উষ্ণায়ন সীমিত রাখা যাবে। এ জন্য বনায়ন বৃদ্ধি ও কয়লা-গ্যাস পোড়ানো হ্রাস বা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা। এটা ঠিকই আছে। কিন্তু এসব প্রচেষ্টা একমাত্রিক না হয়ে বহুমাত্রিক হওয়া উচিত। যেমন কার্বন নিঃসরণ কমালেও বায়ুমণ্ডলে ইতিমধ্যে বেড়ে ওঠা কার্বন গ্যাস কমানো যায় কি না? যদি এমন কোনো প্রযুক্তি বের করা যায়, যা বাতাসের কার্বন শুষে নিয়ে অক্সিজেন বাতাসে ফিরিয়ে দেবে, তাহলে তো চিন্তা থাকে না। সবুজ গাছ আসলে এ কাজটিই করছে। কিন্তু জনসংখ্যা যত বাড়ছে, বনায়ন ততই কমছে এবং এটা কমতেই থাকবে। সুতরাং গাছের কাজটা ল্যাবরেটরিতে স্বল্প স্থানে করা যায় কি না?
এ ব্যাপারে গবেষণা চালানোর একটি প্রস্তাব আমি সম্প্রতি কোপেনহেগেন সম্মেলনে উপস্থিত করলে সমবেত বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কারণ, এযাবত্ এ ধরনের প্রস্তাব প্রায় অনালোচিত ছিল। এডিটারস ব্রেকফাস্ট অনুষ্ঠানে বিষয়টি উত্থাপন করি। একজন প্যানেল আলোচক ভারতের রিচি আহুজা ওই প্রস্তাব প্রসঙ্গে বললেন, ল্যাবরেটরিতে সমাধান অসম্ভব। জার্মানির পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফান রামসটরফ আমার পাশে বসে ছিলেন। তিনি প্রথমে বলেন, এটা অসম্ভব। আমিও নাছোরবান্দা। কিছু যুক্তিতর্কের পর তিনি বলেন প্রস্তাবটা ভেবে দেখার মতো।
পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফান বলেন, গাছের কাজ আপনি ল্যাবরেটরিতে কীভাবে করবেন? আমি বললাম, এটা গবেষণার বিষয়। যদি উদ্ভিদের স্টেমসেল বিকশিত করে শুধু ক্লোরোফিল উত্পাদনের প্রত্যঙ্গটি তৈরির উপায় বের করা যায়, তাহলে এটা সম্ভব। সায়েন্স ডেইলিতে (জানুয়ারি ২, ২০০৬) প্রকাশিত এক নিবন্ধে উদ্ভিদের কোন স্টেমসেল কীভাবে বিভিন্ন অঙ্গ তৈরি করে, সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। উদ্ভিদের স্টেমসেল নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। সুতরাং একদিন হয়তো ল্যাবরেটরিতে গাছ ছাড়াই তার ক্লোরোফিল তৈরি করা সম্ভব হবে। ওই ক্লোরোফিল হবে এমন যে সূর্যালোকে রাখলে তা বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে অক্সিজেন মুক্ত করবে। স্টিফান বললেন, অক্সিজেন তো বাতাসে ফিরে যাবে, কিন্তু অবশিষ্ট কার্বন দিয়ে কী করবে? আমি বললাম, গাছ কী করে? আমরাও তাই করব। তিনি বললেন, গাছ তো কাঠ বানায়। আমি বললাম, তাহলে তো আরও ভালো, ল্যাবরেটরিতে জৈবিক কাঠও তৈরি হবে। তিনি বললেন, এত কাঠ রাখবে কোথায়? এটা একটা অবাস্তব ও অদক্ষ প্রকল্প। আমি বললাম, এখানেই তো বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগাতে হবে।
আমি পরে যোগ করলাম, যদি আর কিছু না করা যায়, তাহলে অবমুক্ত কার্বন জড়ো করে সমুদ্রের তলদেশে জমিয়ে রাখা যাবে। আসলে এ রকম একটা চিন্তার কথা বছর দুয়েক আগে আমি দি ইকোনমিস্টের সায়েন্স বিভাগে পড়েছি। অবশ্য বিজ্ঞানী স্টিফান বললেন, সেটা আরও ক্ষতি করবে, সমুদ্রের তলদেশ ভরাট হয়ে আরও বিরাট বিপর্যয় দেখা দেবে।
জলবায়ু বিপর্যয় রোধে এটাই আমার বিকল্প কৌশলপত্র। তার মানে এই নয় যে বনায়ন বা সৌরবিদ্যুত্ ব্যবহারের পথ বাদ দিয়ে ওদিকে যেতে হবে। আমার কথা হলো, বহুমাত্রিক সমাধানের কথা চিন্তা করা দরকার। একে বিকল্প প্রস্তাব বলছি এ জন্য যে এযাবত্ অন্যান্য প্রকল্প মূলত কার্বন নিঃসরণ কমাতে সাহায্য করবে, আর নতুন প্রস্তাবটি বাতাসের কার্বন হ্রাসে সাহায্য করবে। দ্বিমুখী উদ্যোগ আসন্ন জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে বেশি সহায়ক হবে।
কেন বিকল্প সন্ধান দরকার সেটা বোঝার জন্য আমরা দেখব কার্বন নিঃসরণ কমাতে বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলো কেন অনাগ্রহী। সম্প্রতি ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতি থেকে বাঁচার উপায় নিয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের বিভিন্ন আলোচনায় এ রকম আশঙ্কা ব্যক্ত হয়েছে, যে উন্নত দেশগুলো হয়তো জলবায়ু পরিবর্তন রোধে একটি চুক্তিতে আসতে ব্যর্থ হতে পারে। সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় ১৯০ দেশের সম্পাদক, গণমাধ্যম নেতারা ও বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীরা আসন্ন জলবায়ু-অপঘাত থেকে কীভাবে পৃথিবীকে রক্ষা করা যায়, এর উপায় নিয়ে কথা বলেছেন। আগামী ডিসেম্বরে ওখানে শীর্ষ সম্মেলন হতে যাচ্ছে। সম্পাদকদের সম্মেলনটি ছিল তারই এক প্রস্তুতি পর্ব। জলবায়ু-রূপান্তর যে পৃথিবীর জন্য কত বড় অভিশাপ ডেকে আনতে পারে, সে সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি করাই ছিল সম্পাদকদের এ সম্মেলনের একটি উদ্দেশ্য। সেটা কিছুটা হয়েছে। কিন্তু আসল কাজটিই বোধ হয় বাকি রয়ে গেছে। সেটা হলো, বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলো এই সম্ভাব্য বিপর্যয় রোধে গ্রিন হাউস গ্যাস তথা কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে রাজি হবে কি না, সবাই মিলে কোপেনহেগেন শীর্ষ সম্মেলনে (কপ-১৫) এ ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করবে কি না। এটা অনেকটাই অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
সবার আশঙ্কা, আমেরিকা হয়তো কার্বন গ্যাস নিঃসরণ প্রয়োজনীয় মাত্রায় কমাতে রাজি হবে না। চীন ও ভারতও ইতস্তত করছে। কারণ হলো, কার্বন কমানো মানে তেল-গ্যাস-কয়লা (জীবাশ্ম জ্বালানি) ও বিদ্যুতের ব্যবহার কমানো। আর সেটা যদি কমাতে হয়, তাহলে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কমে যাবে। সোজা কথায় ধনী দেশগুলোর উত্পাদন বাড়িয়ে আরও ধনী হওয়ার গতিতে লাগাম টেনে ধরতে হবে। এতে অবশ্য সামগ্রিকভাবেই সারা বিশ্বের প্রবৃদ্ধি কমবে। এর ধাক্কা আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশের ওপরও পড়বে। কারণ, শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিনিয়োগ, বৈদেশিক সহযোগিতা ইত্যাদি কমে যাবে।
বাতাসে কার্বন গ্যাস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে যদি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ধরে রাখা যায়, তাহলে এই পৃথিবী মানুষের বসবাসযোগ্য থাকবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। সেটা কীভাবে সম্ভব, তা নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে। সবচেয়ে ভালো মাঝারি ও কম-ভালো সমাধান বের করার জন্য তিনজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীসহ পাঁচজন জলবায়ু অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ নিয়ে গঠিত একটি কমিটি হিসাব করে দেখেছে যে, যদি সেই ঈপ্সিত ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে উষ্ণায়ন সীমিত রাখতে হয়, তাহলে ২১০০ সালে বিশ্বের মোট দেশজ উত্পাদন (জিডিপি) প্রায় ১২ দশমিক ৯ শতাংশ বা ৪০ ট্রিলিয়ন (৪০ লাখ কোটি) ডলার কমে যাবে। জলবায়ু-ক্ষতির চেয়ে এটা হবে ৫০ গুণ বেশি ক্ষতি। আর যদি কার্বন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা না যায়, তাহলে এই ক্ষতি আরও ১০ বা ১০০ গুণ বেশি হবে।
এ অবস্থায় চীন বলছে, তারা কার্বন নিঃসরণ কমাবে কিন্তু প্রবৃদ্ধি ঠিক রেখেই। কীভাবে? তারা এমন প্রযুক্তি বের করবে যেন আগের চেয়ে কম কয়লা পুড়িয়ে বেশি শক্তি পাওয়া যায়। অর্থাত্ আরও দক্ষভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার, পানি বিদ্যুত্, সৌর বিদ্যুত্ প্রভৃতি বেশি করে ব্যবহার ইত্যাদি। ডেনমার্ক ইতিমধ্যেই ‘ক্লিন এনার্জি’ বা ‘গ্রিন এনার্জি’ ব্যবহার বাড়াচ্ছে, এর অন্যতম হলো বায়ু-বিদ্যুত্।
এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে ও প্রতিষ্ঠান থেকে নানা প্রস্তাব আসছে। এদের অন্যতম হলো ‘জলবায়ু-প্রকৌশলী-প্রযুক্তি’ (ক্লাইমেট-ইঞ্জিনিয়ারিং-টেকনোলজি)। যেমন— জাহাজ থেকে সমুদ্রের পানি আকাশে এমনভাবে ছিটিয়ে দেওয়া হবে, যেন তা আকাশে মেঘের আস্তরণ সৃষ্টি করে। এই পানির আবরণে সূর্যের কিছু আলো প্রতিফলিত হয়ে মহাকাশে ফিরে যাবে এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমাবে। ডেনমার্কে নতুন প্রযুক্তির ‘লো-এনার্জি হাউজিং’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যার সাহায্যে কম বিদ্যুত্ ব্যবহার করে বাসার সব কাজ করা যায়।
এসব উদ্যোগের পাশাপাশি যদি বিকল্প কৌশল হিসেবে বাতাসের কার্বন শুষে নেওয়ার অব্যর্থ একটি প্রযুক্তি আবিষ্কার করা যায়, তাহলে জলবায়ু বিপর্যয় রোধ অনেক সহজ হবে। কোপেনহেগেন গ্লোবাল এডিটরস ফোরামে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জোসেফ স্টিগলিত্জ বলেছেন, এ বিশ্ব জগতে যদি মানুষের বসবাসযোগ্য আরও দু-তিনটা গ্রহ থাকত, তাহলে চিন্তা ছিল না, জলবায়ু-অভিশাপ এড়াতে মানুষ এ পৃথিবী ছেড়ে ওই সব গ্রহে চলে যেত। কিন্তু পৃথিবী তো একটাই, বসবাসযোগ্য অন্য কোনো গ্রহ তো নেই। তাই এই পৃথিবীকে বাঁচাতেই হবে।
বিশ্বের প্রতি ৪৫ জনের মধ্যে একজন এবং বাংলাদেশের প্রতি সাতজনের একজন জলবায়ু বিপর্যয়ের শিকারে পরিণত হতে পারে। সুতরাং এখনই তত্পর হতে হবে। অপেক্ষার কোনো সুযোগ নেই।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
এ ব্যাপারে গবেষণা চালানোর একটি প্রস্তাব আমি সম্প্রতি কোপেনহেগেন সম্মেলনে উপস্থিত করলে সমবেত বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কারণ, এযাবত্ এ ধরনের প্রস্তাব প্রায় অনালোচিত ছিল। এডিটারস ব্রেকফাস্ট অনুষ্ঠানে বিষয়টি উত্থাপন করি। একজন প্যানেল আলোচক ভারতের রিচি আহুজা ওই প্রস্তাব প্রসঙ্গে বললেন, ল্যাবরেটরিতে সমাধান অসম্ভব। জার্মানির পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফান রামসটরফ আমার পাশে বসে ছিলেন। তিনি প্রথমে বলেন, এটা অসম্ভব। আমিও নাছোরবান্দা। কিছু যুক্তিতর্কের পর তিনি বলেন প্রস্তাবটা ভেবে দেখার মতো।
পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফান বলেন, গাছের কাজ আপনি ল্যাবরেটরিতে কীভাবে করবেন? আমি বললাম, এটা গবেষণার বিষয়। যদি উদ্ভিদের স্টেমসেল বিকশিত করে শুধু ক্লোরোফিল উত্পাদনের প্রত্যঙ্গটি তৈরির উপায় বের করা যায়, তাহলে এটা সম্ভব। সায়েন্স ডেইলিতে (জানুয়ারি ২, ২০০৬) প্রকাশিত এক নিবন্ধে উদ্ভিদের কোন স্টেমসেল কীভাবে বিভিন্ন অঙ্গ তৈরি করে, সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। উদ্ভিদের স্টেমসেল নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। সুতরাং একদিন হয়তো ল্যাবরেটরিতে গাছ ছাড়াই তার ক্লোরোফিল তৈরি করা সম্ভব হবে। ওই ক্লোরোফিল হবে এমন যে সূর্যালোকে রাখলে তা বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে অক্সিজেন মুক্ত করবে। স্টিফান বললেন, অক্সিজেন তো বাতাসে ফিরে যাবে, কিন্তু অবশিষ্ট কার্বন দিয়ে কী করবে? আমি বললাম, গাছ কী করে? আমরাও তাই করব। তিনি বললেন, গাছ তো কাঠ বানায়। আমি বললাম, তাহলে তো আরও ভালো, ল্যাবরেটরিতে জৈবিক কাঠও তৈরি হবে। তিনি বললেন, এত কাঠ রাখবে কোথায়? এটা একটা অবাস্তব ও অদক্ষ প্রকল্প। আমি বললাম, এখানেই তো বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগাতে হবে।
আমি পরে যোগ করলাম, যদি আর কিছু না করা যায়, তাহলে অবমুক্ত কার্বন জড়ো করে সমুদ্রের তলদেশে জমিয়ে রাখা যাবে। আসলে এ রকম একটা চিন্তার কথা বছর দুয়েক আগে আমি দি ইকোনমিস্টের সায়েন্স বিভাগে পড়েছি। অবশ্য বিজ্ঞানী স্টিফান বললেন, সেটা আরও ক্ষতি করবে, সমুদ্রের তলদেশ ভরাট হয়ে আরও বিরাট বিপর্যয় দেখা দেবে।
জলবায়ু বিপর্যয় রোধে এটাই আমার বিকল্প কৌশলপত্র। তার মানে এই নয় যে বনায়ন বা সৌরবিদ্যুত্ ব্যবহারের পথ বাদ দিয়ে ওদিকে যেতে হবে। আমার কথা হলো, বহুমাত্রিক সমাধানের কথা চিন্তা করা দরকার। একে বিকল্প প্রস্তাব বলছি এ জন্য যে এযাবত্ অন্যান্য প্রকল্প মূলত কার্বন নিঃসরণ কমাতে সাহায্য করবে, আর নতুন প্রস্তাবটি বাতাসের কার্বন হ্রাসে সাহায্য করবে। দ্বিমুখী উদ্যোগ আসন্ন জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে বেশি সহায়ক হবে।
কেন বিকল্প সন্ধান দরকার সেটা বোঝার জন্য আমরা দেখব কার্বন নিঃসরণ কমাতে বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলো কেন অনাগ্রহী। সম্প্রতি ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতি থেকে বাঁচার উপায় নিয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের বিভিন্ন আলোচনায় এ রকম আশঙ্কা ব্যক্ত হয়েছে, যে উন্নত দেশগুলো হয়তো জলবায়ু পরিবর্তন রোধে একটি চুক্তিতে আসতে ব্যর্থ হতে পারে। সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় ১৯০ দেশের সম্পাদক, গণমাধ্যম নেতারা ও বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীরা আসন্ন জলবায়ু-অপঘাত থেকে কীভাবে পৃথিবীকে রক্ষা করা যায়, এর উপায় নিয়ে কথা বলেছেন। আগামী ডিসেম্বরে ওখানে শীর্ষ সম্মেলন হতে যাচ্ছে। সম্পাদকদের সম্মেলনটি ছিল তারই এক প্রস্তুতি পর্ব। জলবায়ু-রূপান্তর যে পৃথিবীর জন্য কত বড় অভিশাপ ডেকে আনতে পারে, সে সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি করাই ছিল সম্পাদকদের এ সম্মেলনের একটি উদ্দেশ্য। সেটা কিছুটা হয়েছে। কিন্তু আসল কাজটিই বোধ হয় বাকি রয়ে গেছে। সেটা হলো, বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলো এই সম্ভাব্য বিপর্যয় রোধে গ্রিন হাউস গ্যাস তথা কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে রাজি হবে কি না, সবাই মিলে কোপেনহেগেন শীর্ষ সম্মেলনে (কপ-১৫) এ ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করবে কি না। এটা অনেকটাই অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
সবার আশঙ্কা, আমেরিকা হয়তো কার্বন গ্যাস নিঃসরণ প্রয়োজনীয় মাত্রায় কমাতে রাজি হবে না। চীন ও ভারতও ইতস্তত করছে। কারণ হলো, কার্বন কমানো মানে তেল-গ্যাস-কয়লা (জীবাশ্ম জ্বালানি) ও বিদ্যুতের ব্যবহার কমানো। আর সেটা যদি কমাতে হয়, তাহলে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কমে যাবে। সোজা কথায় ধনী দেশগুলোর উত্পাদন বাড়িয়ে আরও ধনী হওয়ার গতিতে লাগাম টেনে ধরতে হবে। এতে অবশ্য সামগ্রিকভাবেই সারা বিশ্বের প্রবৃদ্ধি কমবে। এর ধাক্কা আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশের ওপরও পড়বে। কারণ, শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিনিয়োগ, বৈদেশিক সহযোগিতা ইত্যাদি কমে যাবে।
বাতাসে কার্বন গ্যাস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে যদি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ধরে রাখা যায়, তাহলে এই পৃথিবী মানুষের বসবাসযোগ্য থাকবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। সেটা কীভাবে সম্ভব, তা নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে। সবচেয়ে ভালো মাঝারি ও কম-ভালো সমাধান বের করার জন্য তিনজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীসহ পাঁচজন জলবায়ু অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ নিয়ে গঠিত একটি কমিটি হিসাব করে দেখেছে যে, যদি সেই ঈপ্সিত ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে উষ্ণায়ন সীমিত রাখতে হয়, তাহলে ২১০০ সালে বিশ্বের মোট দেশজ উত্পাদন (জিডিপি) প্রায় ১২ দশমিক ৯ শতাংশ বা ৪০ ট্রিলিয়ন (৪০ লাখ কোটি) ডলার কমে যাবে। জলবায়ু-ক্ষতির চেয়ে এটা হবে ৫০ গুণ বেশি ক্ষতি। আর যদি কার্বন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা না যায়, তাহলে এই ক্ষতি আরও ১০ বা ১০০ গুণ বেশি হবে।
এ অবস্থায় চীন বলছে, তারা কার্বন নিঃসরণ কমাবে কিন্তু প্রবৃদ্ধি ঠিক রেখেই। কীভাবে? তারা এমন প্রযুক্তি বের করবে যেন আগের চেয়ে কম কয়লা পুড়িয়ে বেশি শক্তি পাওয়া যায়। অর্থাত্ আরও দক্ষভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার, পানি বিদ্যুত্, সৌর বিদ্যুত্ প্রভৃতি বেশি করে ব্যবহার ইত্যাদি। ডেনমার্ক ইতিমধ্যেই ‘ক্লিন এনার্জি’ বা ‘গ্রিন এনার্জি’ ব্যবহার বাড়াচ্ছে, এর অন্যতম হলো বায়ু-বিদ্যুত্।
এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে ও প্রতিষ্ঠান থেকে নানা প্রস্তাব আসছে। এদের অন্যতম হলো ‘জলবায়ু-প্রকৌশলী-প্রযুক্তি’ (ক্লাইমেট-ইঞ্জিনিয়ারিং-টেকনোলজি)। যেমন— জাহাজ থেকে সমুদ্রের পানি আকাশে এমনভাবে ছিটিয়ে দেওয়া হবে, যেন তা আকাশে মেঘের আস্তরণ সৃষ্টি করে। এই পানির আবরণে সূর্যের কিছু আলো প্রতিফলিত হয়ে মহাকাশে ফিরে যাবে এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমাবে। ডেনমার্কে নতুন প্রযুক্তির ‘লো-এনার্জি হাউজিং’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যার সাহায্যে কম বিদ্যুত্ ব্যবহার করে বাসার সব কাজ করা যায়।
এসব উদ্যোগের পাশাপাশি যদি বিকল্প কৌশল হিসেবে বাতাসের কার্বন শুষে নেওয়ার অব্যর্থ একটি প্রযুক্তি আবিষ্কার করা যায়, তাহলে জলবায়ু বিপর্যয় রোধ অনেক সহজ হবে। কোপেনহেগেন গ্লোবাল এডিটরস ফোরামে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জোসেফ স্টিগলিত্জ বলেছেন, এ বিশ্ব জগতে যদি মানুষের বসবাসযোগ্য আরও দু-তিনটা গ্রহ থাকত, তাহলে চিন্তা ছিল না, জলবায়ু-অভিশাপ এড়াতে মানুষ এ পৃথিবী ছেড়ে ওই সব গ্রহে চলে যেত। কিন্তু পৃথিবী তো একটাই, বসবাসযোগ্য অন্য কোনো গ্রহ তো নেই। তাই এই পৃথিবীকে বাঁচাতেই হবে।
বিশ্বের প্রতি ৪৫ জনের মধ্যে একজন এবং বাংলাদেশের প্রতি সাতজনের একজন জলবায়ু বিপর্যয়ের শিকারে পরিণত হতে পারে। সুতরাং এখনই তত্পর হতে হবে। অপেক্ষার কোনো সুযোগ নেই।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
No comments