দিল্লির চিঠি- মোদিকে নিয়ে মাতামাতি by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
মাস খানেক আগে এক নিবন্ধে নরেন্দ্র মোদি ও রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক আচার-আচরণের মিল-অমিলের কিছুটা তুলনা চলে এসেছিল।
প্রথম
আলোর সজাগ পাঠকদের কয়েকজনের প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলাম। মোদি বা রাহুল কাউকেই
তাঁরা ভারতের ভবিষ্যৎ হিসেবে উপযুক্ত মনে করেননি। মোদিকে তাঁরা দাঙ্গাবাজ
মনে করেন, ভারতের মতো বিশাল ধর্মনিরপেক্ষ দেশের পক্ষে যা বিপজ্জনক বলে
তাঁদের ধারণা। আর রাহুলকে তাঁরা পরিবারতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বলে চিহ্নিত
করেছেন। অনভিজ্ঞও। একজন আমার উদ্দেশে যা বলেছিলেন, তার নির্যাস, এঁদের
তোল্লা না দেওয়াই শ্রেয়। যত কম লেখালেখি করা যায়, ততই মঙ্গল।
কিন্তু কীই-বা করা যাবে? কথায় বলে না, যেমন প্রজা তেমন রাজা? ভারতের এখনকার রাজনীতিও ক্রমশ যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে এদের উপেক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। এটা দুর্ভাগ্য হলেও সত্য। রাহুল বনাম মোদি লড়াইটা অবশ্য শুরুই হলো না। দ্বৈরথের আগেই মোদি কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছেন। কংগ্রেসের হাল খুবই খারাপ। একটা সময় তারা বিজেপিকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিল প্রধানমন্ত্রী পদে তাদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করতে। কংগ্রেস ভেবেছিল, দলীয় কোন্দল যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে বিজেপি কাউকে বেছে নিতে পারবে না; মোদি তো দূর অস্ত। কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বিজেপিকে বাধ্য করল মোদির নাম ঘোষণায়। সেই থেকে কংগ্রেসও শামুকের মতো গুটিয়ে গেল। অনিচ্ছুক রাহুলকে তুলে ধরা তো দূরের কথা, তৃতীয়বার সরকার গড়লে মনমোহন সিংই যে আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন কিংবা হবেন না, জোর দিয়ে তা বলতেও পারছে না। ভারতীয় মিডিয়াগুলোতে মাসে মাসে যেসব সমীক্ষা বেরোচ্ছে, তাতে প্রধানমন্ত্রী পদের লড়াইয়ে মোদির ধারেকাছেও আপাতত কেউ নেই। মাস দুয়েক আগে একটি সর্বভারতীয় অর্থনৈতিক দৈনিকের সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশের সেরা কোম্পানিগুলোর সিইওদের মধ্যে ৯৩ শতাংশ মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের ওপর ভরসা রাখছেন। এসব সমীক্ষা মোদির ছাতা আরও চওড়া করছে।
মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ার পরও জ্যোতি বসু নয় বছর বেঁচে ছিলেন এবং দলের প্রচারে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। ওই সময়ে তিনি বলেছিলেন, তাঁর দল কথায় কথায় বড় বেশি মমতাবিরোধিতা করছে। কথায় কথায় মমতার সমালোচনা আর কিছু না হোক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই অহেতুক গুরুত্ব দিয়ে প্রাসঙ্গিক করে তুলছে। জ্যোতিবাবু বেঠিক কিছু যে বলেননি, মমতার উত্থান ও বাম ফ্রন্টের পতনই তার প্রমাণ। মোদির ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই লক্ষ করা যাচ্ছে। এমনিতে মোদি-মিশন সফল করতে বিজেপি ও সংঘ পরিবারের চেষ্টার অন্ত নেই। তার ওপর কংগ্রেস ও অন্য অ-বিজেপি দলগুলো নিত্যদিন নিয়ম করে এমন মোদি-বিরোধিতা শুরু করেছে যে গোটা দেশের রাজনীতিই প্রকারান্তরে মোদিময় হয়ে গেছে। মোদি একটা করে মন্তব্য করছেন, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হচ্ছে বিরোধিতা এবং পাল্টা বিরোধিতা। দিন কয়েক সেই নিয়ে চলার পর ফের নতুন কোনো বিষয়ের অবতারণা।
পশ্চিমবঙ্গের শেষ কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় বলেছিলেন, রাজনীতিবিদদের সব সময় প্রচারের আলোয় থাকা দরকার। এমনকি সেই প্রচার নেতিবাচক হলেও। কথাটা মোদির কাছে আপ্তবাক্য হয়ে গেছে। কিছু বিতর্ক তিনি নিজে সৃষ্টি করছেন, কিছু বিরোধীরা সৃষ্টি করে তাঁকে প্রচারের আলোয় থাকতে সাহায্য করছেন। এই যেমন কিছুদিন আগে তিনি বললেন, গ্রামে গ্রামে দেবালয় তৈরির আগে শৌচালয় তৈরি বেশি জরুরি। এ কথাই কংগ্রেসের জয়রাম রমেশ মাস কয়েক আগে বলেছিলেন, বিতর্ক বা আলোচনার বুদ্বুদ পর্যন্ত ওঠেনি। কিন্তু মোদি বলায় উঠল। শৌচালয়ের প্রয়োজনীয়তা বহু বছর আগে মহাত্মা গান্ধী উপলব্ধি করেছিলেন। স্বাস্থ্যই সম্পদ। শৌচালয় সেই সম্পদকে সুরক্ষিত করবে। সোয়া শ বছর আগে বাঙালিকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী দেখতে আরেক বাঙালি স্বামী বিবেকানন্দ যুবকদের উপদেশ দিয়েছিলেন গীতা পাঠ না করে ফুটবল খেলতে। কাজেই হইচই ফেলার মতো মোদি এমন কিছু বলেননি। কিন্তু বেজায় হইচই হলো।
কথায় বলে, রাজনীতিকেরা কথা বেচে খান। তাঁরা স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। যিনি যত ভালো কথা বলবেন, যত ভালো ভাষণ দেবেন, যত অনায়াসে স্বপ্ন ফেরি করতে পারবেন, তিনি তত সফল। তাঁর প্রতিযোগীদের তুলনায় মোদির কথাবার্তা বেশ ভালো। তাঁর ভাষণের মধ্যে এমন একটা সম্মোহনী শক্তি আছে, আপনার পছন্দ হোক না-হোক, শুনতে হবে। দেশের সাধারণ মানুষ, যাঁরা অত পরিসংখ্যান বোঝেন না, সত্য-মিথ্যা যাচাই করার ক্ষমতা যাঁদের কম, যাঁরা সহজেই বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন, মোদির প্রতিটি বাক্যকে তাঁরা ধ্রুব সত্য বলে বিশ্বাস করতে ভালোবাসছেন। মোদি তাঁর স্বপ্নকে বেশ ভালোই ফেরি করছেন।
ভোটের এত আগে (অন্তত পাঁচ মাস বাকি) এতটা এগিয়ে যাওয়ার অন্য একটা বিপদও অবশ্য আছে। ইংরেজিতে যাকে বলে অতি দ্রুত ‘পিক’-এ পৌঁছে যাওয়া। প্রচারের তীব্রতা এত তাড়াতাড়ি এত উঁচুতে পৌঁছে গেলে আসল সময়ে ধুপ করে ধসে যাওয়ার একটা আশঙ্কা থাকে। মোদির ক্ষেত্রেও যে তা ঘটবে না, বলা যায় না। ভোট যত এগোবে, ততই নতুন ধরনের রাজনৈতিক সমীকরণও ঘটতে থাকবে। এই যেমন বামপন্থীদের উদ্যোগে (প্রধানত সিপিএম) দিল্লিতে একটা সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সম্মেলন হয়ে গেল। মাঝারি মাপের ১৪টি রাজনৈতিক দল তাতে অংশ নিল। এদের মধ্যে এমন দলও রয়েছে, যারা একদা বিজেপির ঘর করে এখন নির্জোট অবস্থানে। যেমন জয়ললিতার এআইএডিএমকে, নবীন পট্টনায়েকের বিজু জনতা দল ও অসমের অসম গণপরিষদ। আবার শারদ পাওয়ারের এনসিপি-ও সম্মেলনে যোগ দেয়, যারা এখনো কেন্দ্রে ইউপিএর শরিক। এদের প্রতিটির ভোট-পরবর্তী অবস্থান কী হবে, কেউ জানে না। আপাতত এদের লক্ষ্য, মোদিকে ঠেকাও। তারপর সম্ভব হলে ভোটের পর কংগ্রেস ও বিজেপিকে বাইরে রেখে একটা জোট করো, যাকে কংগ্রেস বাইরে থেকে সমর্থন দেবে।
বিজেপি এসব সমীকরণ ও হিসাবকে আমলই দিচ্ছে না। তাদের আত্মবিশ্বাস এতটাই তুঙ্গে যে তারা নিজেরাই ২০০+ আসন পাবে বলে ধরে নিয়ে বাকি হিসাব কষছে। ওদের ধারণা, মোদি-মাহাত্ম্যে গোটা দেশ দিনে দিনে আপ্লুত হচ্ছে। দেশের যুবসম্প্রদায় মোদির ক্যারিশমায় মোহিত। সাধারণ মানুষ কংগ্রেসের ‘অপশাসনে’ বীতশ্রদ্ধ। মোদির মধ্যে তারা বিকল্পের খোঁজ পেয়ে গেছে।
আমি জ্যোতিষী সাজতে রাজি নই। শুধু দেখতে চাইছি, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কংগ্রেসের তুলনায় ভিন্ন কোনো নীতি বা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা মোদি বলছেন কি না। যেমন কোষাগার ঘাটতি ও কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট কমাতে মোদির দাওয়াই কী, এখনো পর্যন্ত তা আমরা জানি না। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প দেশের কোথাও সেই অর্থে স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি করতে পারেনি। এই প্রকল্প তিনি কি বন্ধ করে দেবেন? জানি না। খাদ্যনিরাপত্তা আইন নিয়ে বিজেপি যথেষ্ট সন্দিহান। তার অভিমত কী, মোদি স্পষ্ট করেননি। সরকারের খরচের বহর কমানোর দাওয়াই কী, সে কথাও তাঁর ভাষণে একবারও ঘুরেফিরে আসেনি। দেশের শিল্পবন্ধু তিনি। জাতে গুজরাটি। ইউরোপ-আমেরিকায় ওয়াল-মার্টদের রমরমা সত্ত্বেও মহল্লায় মহল্লায় গুজরাটি ভাইবোনদের ছোট দোকানগুলো যে চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে, তা তাঁর অজানা নয়। ব্যক্তিগতভাবে তিনিও খুচরা ব্যবসায় বহুজাতিক বিদেশি পুঁজির পক্ষে। অথচ দল বিরোধিতায় নেমেছে। কী হবে তাঁর ভূমিকা? জানা নেই। বিদেশনীতিতে তাঁর দলের সরকার কোন ভূমিকা নেবে? বিশেষ করে পাকিস্তান, চীন, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে? সংঘাত, নাকি বন্ধুতা? পারমাণবিক চুক্তি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বিতর্ক যাঁকে ঘিরে, সেই ক্ষতিপূরণের বিষয়টিতে তাঁর মনোভাব নিয়ে এখনো রা কাড়েননি তিনি। দুর্নীতি নিয়ে অনেক কথা তাঁর মুখ থেকে শোনা গেছে। অথচ তাঁর নিজের রাজ্যে লোকায়ুক্ত নিয়োগের যে বিল তিনি এনেছেন, তা কী করে সারা দেশের মডেল হতে পারে, বোঝা দুষ্কর।
নরেন্দ্র মোদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কতটা বজায় থাকবে, সে বিষয়ে প্রশ্নচিহ্ন উঠতে শুরু করেছে। তাঁকে কেন্দ্র করে দেশে হিন্দু মেরুকরণ ঘটলে এবং হিন্দু মৌলবাদ মাথাচাড়া দিলে মুসলিম মৌলবাদীরাও বসে থাকবে না। তার ঢেউ বাংলাদেশেও আছড়ে পড়বে। মোদিকে নিয়ে মাতামাতির মধ্যে অশনিসংকেত লুকিয়ে রয়েছে। কী করে তাঁকে উপেক্ষা করি?
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লীর প্রতিনিধি।
No comments