জবরদস্তির পরিবহন ধর্মঘট
বিরোধী দলের হরতাল শেষ হতে না-হতেই ঢাকাবাসী উপহার পেলেন সরকার-সমর্থিত শ্রমিক সংগঠনের পরিবহন ধর্মঘট। সবাই যদি দাবি আদায়ে জনগণকে একইভাবে কষ্ট দেয়, তাহলে দায়িত্বশীলতা আর জোরজুলুমের মধ্যে পার্থক্য কী থাকল? সরকারে থেকে যাঁরা বিরোধী দলের হরতালের বিরোধিতা করেন, তাঁরাই আবার কীভাবে ধর্মঘট ডেকে একই আচরণ করেন? এই স্ববিরোধিতার কারণেই তো বাংলাদেশে কোনো নিয়ম, মূল্যবোধ, নীতি প্রতিষ্ঠিত হয় না। সরকার-সমর্থিত পরিবহন মালিক সমিতি নেতা খায়রুল আলম মোল্লা দুষ্কৃতকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। তিনি যাত্রাবাড়ী-ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সায়েদাবাদ আন্তজেলা পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। নিহতের পরিবারের ভাষ্যমতে, সায়েদাবাদ আন্তজেলা বাস টার্মিনালের টোল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধের কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পরপরই তাঁর সংগঠন তথা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি গাবতলী ও সায়েদাবাদ টার্মিনালসহ সারা ঢাকায় পরিবহন ধর্মঘট ডাকে। অবশ্য পরে গতকাল দুপুর ১২টার পর ধর্মঘট প্রত্যাহারও করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আইন-আদালত থাকতে কেন হত্যার প্রতিবাদে ধর্মঘট ডাকতে হবে?
এমন নয় যে, হত্যার বিরুদ্ধে মামলা করা যাচ্ছে না। অথবা মামলা হয়েছে কিন্তু পুলিশ তদন্ত করছে না; এমনও নয় ঘটনাটি। অভিজ্ঞতা বলে, সরকারি দলের নেতার হত্যার বেলায় পুলিশের গাফিলতির সুযোগ কম, যদি না হত্যাকারীরা একই দলের আরও ঊর্ধ্বতন কেউ হন। এ ক্ষেত্রে তেমন আলামতও দেখা যায়নি। তাহলে একটি খুনের দায়ে ঢাকার জনগণকে শাস্তি দেওয়া কেন? এর সঙ্গে ঢাকার মধ্যে এবং ঢাকা থেকে ঢাকার বাইরে চলাচলকারী যাত্রীদের কী সম্পর্ক? এভাবে যুক্তিহীনভাবে, স্বীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে দাপট দেখানোর কারণেই দেশটা দিন দিন রসাতলে ধাবিত হচ্ছে। এ ধরনের আচরণ করে কীভাবে জনগণকে বড় বড় নীতিকথা শোনানো যায়? বাংলাদেশে যাঁদের হাতেই সংগঠন রয়েছে, যাঁরা কিছু না কিছু প্রভাব বা ক্ষমতা রাখেন, তাঁরা মনে হয় তাঁদের সেই ক্ষমতা প্রয়োগের সময় সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করেন না। অনেক সময় যে দল তাঁরা করেন, সেই দলের অবস্থানও তাঁদের কর্মসূচিতে প্রতিফলিত হয় না।
একেই বলে ক্ষমতার নৈরাজ্যকর ব্যবহার। এতে যে সব সময় তাঁদের লাভ হয় তা নয়। ক্ষমতার স্বভাবই হলো তা কারও না কারও ওপর প্রযুক্ত হতে চায়। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরীহ ও প্রতিরোধহীন মানুষের ওপরই তা চেপে বসে। সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় পরিবহন ধর্মঘটের মধ্যে এ বাস্তবতাই দেখা গেল। যদি জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকত, তাহলে হরতাল বা ধর্মঘটের অগণতান্ত্রিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিষেধকও তৈরি হতো। দুঃখের বিষয়, সরকার বা বিরোধী দল কিংবা তাদের প্রভাবিত কোনো সংগঠনই এসব বিবেচনার তোয়াক্কা করে না। আক্ষেপের সঙ্গেই তাই বলতে হয়, আমরা আর কবে ‘স্বাভাবিক’ হব?
No comments