স্বাধীনতার জন্য মুজিব নিজেকে ও জনগণকে প্রস্তুত করেন by প্রণব মুখার্জি
সম্প্রতি ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা প্রণব মুখার্জির বই ‘দি ড্রামেটিক ডিকেড দি ইন্দিরা গান্ধী ইয়ার্স প্রকাশ করেছে দিল্লির রুপা পাবলিকেশন্স। এ বইয়ের একটি অধ্যায় ‘মুক্তিযুদ্ধ: দি মেকিং অব বাংলাদেশ’-এর অবিকল তরজমা...
(চতুর্থ কিস্তি)
১৯৫৪
সালে পূর্ব পাকিস্তানে লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির নির্বাচন ঘোষণা করা হলো।
বাংলার তিন বিশিষ্ট নেতা সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে
গঠিত হলো যুক্তফ্রন্ট। আওয়ামী লীগ, ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি
(কেপিপি), নিজাম -ই-ইসলাম এবং আরও অল্প কয়েকটি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত
হল। যুক্তফ্রন্ট এই নির্বাচনে ব্যাপক সাফল্য লাভ করলো। ৩০৯ আসনের মধ্যে
ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ পেলো কেবল ৯টি আসন। এবং পূর্ব পাকিস্তানের
মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনসহ মুসলিম লীগের সকল বিশিষ্ট নেতা পরাজিত হলেন।
মুসলিম লীগের এই ফলাফল ছিল ১৯৪৬ সালের নির্বাচনী ফলাফলের চরম বিপরীত। কারণ
ওই নির্বাচনে মুসলিম লীগ সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল। সিদ্ধান্ত নেয়া
হয়েছিল যে ফজলুল হক সরকার গঠন করবেন, যা তিনি প্রথমে করেছিলেন চার সদস্য
নিয়ে। পরে তিনি মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে আওয়ামী লীগ ও অন্য কয়েকটি
দলকে আন্তর্ভুক্ত করেন। আওয়ামী লীগ থেকে তার মন্ত্রিসভায় এলেন আতাউর রহমান
খান, আবুল মনসুর আহমেদ, আবদুস সালাম খান, হাশিমউদ্দিন আহমেদ ও মুজিবুর
রহমান।
মুজিবুর রহমান তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, নিজেদের চিন্তা ও অনুভূতি পরীক্ষা এবং সংশোধনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ তাদের সংশ্লিষ্ট এলাকা ত্যাগ করলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে তারা তৎপর হলেন। তাদের লক্ষ্য হলো, কি করে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটানো যায়।
পশ্চিম পাকিস্তানে উন্নয়ন কাজ পুরোদমে চলল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ থেকে আসা ব্যাপকভিত্তিক সাহায্যের ভিত্তিতে সেখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কৃষি উন্নয়নে প্রভূত উন্নতি সাধন ঘটল। এর বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সামান্যই মনোযোগ দেয়া হল। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য কাঁচামাল সরবরাহকারী এবং পশ্চিম পাকিস্তানের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত হল। মার্কিন কূটনীতিক অর্চার কে. ব্লাড তার ক্রয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ বইয়ে লিখেছেন,
‘স্বাধীনতা থেকেই পাকিস্তানের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ সামরিক বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় এবং গুটি কয়েক ধনাঢ্য শিল্পপতির হাতে চলে গেল। এই তিনটি গোষ্ঠীই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্ব অকার্যকর হল কারণ সংসদীয় গণতন্ত্র ভারতের মতো শেকড় গাড়তে ব্যর্থ হল। পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত ও কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার কাঠামোর মধ্যে বিদেশী সহায়তা ও অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন তহবিলের উল্লেখযোগ্য অংশ পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে নিয়েছে।’ (অর্চার কে ব্লাড, দি ক্রয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ ( বাংলাদেশ, ২০১৩)
উন্নয়নের ঘাটতি, অগণতান্ত্রিক অনুশীলন এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির যথেষ্ট অপব্যবহারের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিদ্রোহ করে বসল। মুজিবুর রহমান এই বিপ্লবের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। কেউ যদি তার (মুজিবের) এই সময়ের ঘটনাবহুল জীবন অধ্যায়ন করেন , তাহলে তিনি বুঝতে পারবেন যে, বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম হিসেবে রূপ দিতে তিনি নিজকে এবং তার জনগণকে কিভাবে পর্যায়ক্রমে প্রস্তুত করেছিলেন।
১৯৫৫ সালের ৫ই জুন তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলেন। এর কিছু দিন পরেই ১৭ই জুনে ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় একটি স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ২১ দফা ঘোষণা করা হল। ২৩শে জুন আওয়ামী লীগের নির্বাহী কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নিলো যে, যদি স্বায়ত্তশাসনের দাবি বিবেচনা না করা হয় তাহলে আওয়ামী লীগের সকল সদস্য গণপরিষদ থেকে পদত্যাগ করবেন। ২৫ আগস্ট গণপরিষদে দেয়া এক বক্তৃতায় মুজিবুর রহমান বলেন:
‘স্যার, আপনি লক্ষ্য করবেন যে, তারা ‘পূর্ব বাংলার’ পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করেছে। অথচ আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে, পাকিস্তান শব্দের পরিবর্তে যাতে বেঙ্গল ব্যবহার করা হয়। বেঙ্গল শব্দের একটি ইতিহাস ও নিজস্ব ঐতিহ্য আছে। আপনি এটা জনগণের সঙ্গে আলোচনা করার পরে পরিবর্তন আনতে পারেন। আপনারা যদি এটা পরিবর্তন করতে চান, তাহলে আমাকে বাংলায় ফিরে যেতে হবে এবং তাদের কাছ থেকে জেনে নেব যে, তারা এই পরিবর্তনকে গ্রহণ করবেন কিনা। এক ইউনিটের বিষয়ে বলতে পারি, এটা সংবিধানে আসতে পারে। আপনারা কেন এখন এই বিষয়টি তুলতে চাইছেন? রাষ্ট্র ভাষা বাংলার কি হবে? যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর কি হবে? স্বায়ত্তশাসনের কি হবে? পূর্ববঙ্গের মানুষ এসব বিষয়সহ এক ইউনিট বিবেচনায় নিতে প্রস্তুত থাকবে। সুতরাং [বেঞ্চের] অপর পাশের বন্ধুদের প্রতি আমি আবেদন জানাই যে, গণভোট বা অন্য কোন উপায়ে যাতে জনগণকে রায় দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়।’
রাষ্ট্র ভাষা থেকে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা পর্যন্ত এই ছিল বাংলার মানুষের মূল দাবি।
১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবরে গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা প্রধানমন্ত্রী মালিক স্যার ফিরোজ খান নুনের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে ভেঙে দিলেন। ঘোষিত হল সামরিক আইন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করা হল। এর অল্প পরেই জেনারেল আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জাকে পদত্যাগে এবং নির্বাসনে যেতে বাধ্য করলেন। ১৯৫৮ সালের ২৭শে অক্টোবর সমগ্র পাকিস্তানের উপর তিনি নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। তার অধীনেই সামরিক শাসন ১৯৬২ সালের জুন পর্যন্ত চললো, যখন তিনি তার প্রবর্তিত ‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ মাধ্যমে একটি বেসামরিক শাসনের সূচনা করলেন। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে মুজিবুর রহমানসহ বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিকদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে দূরে রাখলেন। (১৯৫৮ সালের ১১ই অক্টাবরে ফিরোজ খান নুন দ্বারা সামরিক আইন ঘোষণার চার দিনের মধ্যে মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হল এবং ১৯৬২ সালের ১৮ই জুন পর্যন্ত তাকে একাধিকবার কারাগার থেকে মুক্তি ও পুনর্বার গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটল)
‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ নীতিসমূহের ভিত্তিতে জেনারেল আইয়ুব খান ফাতেমা জিন্নাহ (মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন) কে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে পকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন।
১৯৬৪ সালের ২৪শে জানুয়ারি আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত (সামরিক আইনের অধীনে দলটি নিষিদ্ধ ছিল) হল এবং তারা অবিলম্বে সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা দাবি করলো। মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও মুজিবুর রহমান যথাক্রমে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। জাতীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক্কালে মুজিবুর রহমানকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হল কিন্তু তিনি ছাড়া পেয়েই পুনরায় আন্দোলনে ব্রতী হলেন। ১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলের এক জাতীয় সম্মেলনে মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ঐতিহাসিক ছয় দফা উপস্থাপন করেন। ১৯৬৬ সালের ১লা মার্চ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। এবং ছয় দফার পক্ষে জনমত গঠনে তিনি ব্যাপকভিত্তিক প্রচারণায় সামিল হন। ১৯৬৮ সালের ৩রা জানুয়ারি পাকিস্তানি সরকার কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করলেন। ভারতীয় এজেন্টদের সঙ্গে আঁতাত করে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার চেষ্টার দায়ে মুজিবুর রহমান ও ৩৪ জন বাঙালি বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করা হল। অভিযোগ আনা হল যে, তাদের লক্ষ্য হল পাকিস্তানকে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে তারা পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হল। এবং এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে, তার মুক্তি এবং ওই মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একটি প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তোলে। এবং জনমতের চাপে ১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সরকার মামলা প্রত্যাহার এবং মুজিবুর রহমানসহ গ্রেপ্তারকৃতদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো।
২৩শে ফেব্রুয়ারি মুজিবুর রহমানকে রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষ দিলেন এক ব্যাপক গণসংবর্ধনা এবং তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হলো। ১০ই মার্চে তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান আয়োজিত সর্বদলীয় গোল টেবিল বৈঠকে অংশ নেন এবং সেখানে তিনি তার দাবি মেনে নিতে চাপ দেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের দাবি অবিলম্বে মেনে নেয়া না হলে বিক্ষোভ ও জনরোষ প্রতিহত করা যাবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে তার দাবি-দাওয়া প্রত্যাখ্যানের মুখে তিনি ১৪ই মার্চে ঢাকায় ফিরে এলেন।
গোল টেবিল সম্মেলন ব্যর্থ হওয়ার পর আইয়ুব খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন। ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তান আবারও সামরিক শাসনে ফিরে গেল।
ইয়াহিয়া খান যদিও জনমতকে দমন করতে সচেষ্ট হলেন, কিন্তু তার সামনে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবন ও নির্বাচন দেয়া ছাড়া অন্য কোন বিকল্প ছিল না। এ রকম একটি দৃশ্যপটে রাজনৈতিকভাবে গোলযোগপূর্ণ পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বরে প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
মুজিবুর রহমান তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, নিজেদের চিন্তা ও অনুভূতি পরীক্ষা এবং সংশোধনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ তাদের সংশ্লিষ্ট এলাকা ত্যাগ করলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে তারা তৎপর হলেন। তাদের লক্ষ্য হলো, কি করে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটানো যায়।
পশ্চিম পাকিস্তানে উন্নয়ন কাজ পুরোদমে চলল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ থেকে আসা ব্যাপকভিত্তিক সাহায্যের ভিত্তিতে সেখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কৃষি উন্নয়নে প্রভূত উন্নতি সাধন ঘটল। এর বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সামান্যই মনোযোগ দেয়া হল। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য কাঁচামাল সরবরাহকারী এবং পশ্চিম পাকিস্তানের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত হল। মার্কিন কূটনীতিক অর্চার কে. ব্লাড তার ক্রয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ বইয়ে লিখেছেন,
‘স্বাধীনতা থেকেই পাকিস্তানের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ সামরিক বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় এবং গুটি কয়েক ধনাঢ্য শিল্পপতির হাতে চলে গেল। এই তিনটি গোষ্ঠীই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্ব অকার্যকর হল কারণ সংসদীয় গণতন্ত্র ভারতের মতো শেকড় গাড়তে ব্যর্থ হল। পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত ও কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার কাঠামোর মধ্যে বিদেশী সহায়তা ও অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন তহবিলের উল্লেখযোগ্য অংশ পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে নিয়েছে।’ (অর্চার কে ব্লাড, দি ক্রয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ ( বাংলাদেশ, ২০১৩)
উন্নয়নের ঘাটতি, অগণতান্ত্রিক অনুশীলন এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির যথেষ্ট অপব্যবহারের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিদ্রোহ করে বসল। মুজিবুর রহমান এই বিপ্লবের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। কেউ যদি তার (মুজিবের) এই সময়ের ঘটনাবহুল জীবন অধ্যায়ন করেন , তাহলে তিনি বুঝতে পারবেন যে, বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম হিসেবে রূপ দিতে তিনি নিজকে এবং তার জনগণকে কিভাবে পর্যায়ক্রমে প্রস্তুত করেছিলেন।
১৯৫৫ সালের ৫ই জুন তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলেন। এর কিছু দিন পরেই ১৭ই জুনে ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় একটি স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ২১ দফা ঘোষণা করা হল। ২৩শে জুন আওয়ামী লীগের নির্বাহী কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নিলো যে, যদি স্বায়ত্তশাসনের দাবি বিবেচনা না করা হয় তাহলে আওয়ামী লীগের সকল সদস্য গণপরিষদ থেকে পদত্যাগ করবেন। ২৫ আগস্ট গণপরিষদে দেয়া এক বক্তৃতায় মুজিবুর রহমান বলেন:
‘স্যার, আপনি লক্ষ্য করবেন যে, তারা ‘পূর্ব বাংলার’ পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করেছে। অথচ আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে, পাকিস্তান শব্দের পরিবর্তে যাতে বেঙ্গল ব্যবহার করা হয়। বেঙ্গল শব্দের একটি ইতিহাস ও নিজস্ব ঐতিহ্য আছে। আপনি এটা জনগণের সঙ্গে আলোচনা করার পরে পরিবর্তন আনতে পারেন। আপনারা যদি এটা পরিবর্তন করতে চান, তাহলে আমাকে বাংলায় ফিরে যেতে হবে এবং তাদের কাছ থেকে জেনে নেব যে, তারা এই পরিবর্তনকে গ্রহণ করবেন কিনা। এক ইউনিটের বিষয়ে বলতে পারি, এটা সংবিধানে আসতে পারে। আপনারা কেন এখন এই বিষয়টি তুলতে চাইছেন? রাষ্ট্র ভাষা বাংলার কি হবে? যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর কি হবে? স্বায়ত্তশাসনের কি হবে? পূর্ববঙ্গের মানুষ এসব বিষয়সহ এক ইউনিট বিবেচনায় নিতে প্রস্তুত থাকবে। সুতরাং [বেঞ্চের] অপর পাশের বন্ধুদের প্রতি আমি আবেদন জানাই যে, গণভোট বা অন্য কোন উপায়ে যাতে জনগণকে রায় দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়।’
রাষ্ট্র ভাষা থেকে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা পর্যন্ত এই ছিল বাংলার মানুষের মূল দাবি।
১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবরে গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা প্রধানমন্ত্রী মালিক স্যার ফিরোজ খান নুনের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে ভেঙে দিলেন। ঘোষিত হল সামরিক আইন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করা হল। এর অল্প পরেই জেনারেল আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জাকে পদত্যাগে এবং নির্বাসনে যেতে বাধ্য করলেন। ১৯৫৮ সালের ২৭শে অক্টোবর সমগ্র পাকিস্তানের উপর তিনি নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। তার অধীনেই সামরিক শাসন ১৯৬২ সালের জুন পর্যন্ত চললো, যখন তিনি তার প্রবর্তিত ‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ মাধ্যমে একটি বেসামরিক শাসনের সূচনা করলেন। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে মুজিবুর রহমানসহ বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিকদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে দূরে রাখলেন। (১৯৫৮ সালের ১১ই অক্টাবরে ফিরোজ খান নুন দ্বারা সামরিক আইন ঘোষণার চার দিনের মধ্যে মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হল এবং ১৯৬২ সালের ১৮ই জুন পর্যন্ত তাকে একাধিকবার কারাগার থেকে মুক্তি ও পুনর্বার গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটল)
‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ নীতিসমূহের ভিত্তিতে জেনারেল আইয়ুব খান ফাতেমা জিন্নাহ (মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন) কে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে পকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন।
১৯৬৪ সালের ২৪শে জানুয়ারি আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত (সামরিক আইনের অধীনে দলটি নিষিদ্ধ ছিল) হল এবং তারা অবিলম্বে সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা দাবি করলো। মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও মুজিবুর রহমান যথাক্রমে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। জাতীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক্কালে মুজিবুর রহমানকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হল কিন্তু তিনি ছাড়া পেয়েই পুনরায় আন্দোলনে ব্রতী হলেন। ১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলের এক জাতীয় সম্মেলনে মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ঐতিহাসিক ছয় দফা উপস্থাপন করেন। ১৯৬৬ সালের ১লা মার্চ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। এবং ছয় দফার পক্ষে জনমত গঠনে তিনি ব্যাপকভিত্তিক প্রচারণায় সামিল হন। ১৯৬৮ সালের ৩রা জানুয়ারি পাকিস্তানি সরকার কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করলেন। ভারতীয় এজেন্টদের সঙ্গে আঁতাত করে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার চেষ্টার দায়ে মুজিবুর রহমান ও ৩৪ জন বাঙালি বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করা হল। অভিযোগ আনা হল যে, তাদের লক্ষ্য হল পাকিস্তানকে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে তারা পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হল। এবং এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে, তার মুক্তি এবং ওই মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একটি প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তোলে। এবং জনমতের চাপে ১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সরকার মামলা প্রত্যাহার এবং মুজিবুর রহমানসহ গ্রেপ্তারকৃতদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো।
২৩শে ফেব্রুয়ারি মুজিবুর রহমানকে রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষ দিলেন এক ব্যাপক গণসংবর্ধনা এবং তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হলো। ১০ই মার্চে তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান আয়োজিত সর্বদলীয় গোল টেবিল বৈঠকে অংশ নেন এবং সেখানে তিনি তার দাবি মেনে নিতে চাপ দেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের দাবি অবিলম্বে মেনে নেয়া না হলে বিক্ষোভ ও জনরোষ প্রতিহত করা যাবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে তার দাবি-দাওয়া প্রত্যাখ্যানের মুখে তিনি ১৪ই মার্চে ঢাকায় ফিরে এলেন।
গোল টেবিল সম্মেলন ব্যর্থ হওয়ার পর আইয়ুব খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন। ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তান আবারও সামরিক শাসনে ফিরে গেল।
ইয়াহিয়া খান যদিও জনমতকে দমন করতে সচেষ্ট হলেন, কিন্তু তার সামনে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবন ও নির্বাচন দেয়া ছাড়া অন্য কোন বিকল্প ছিল না। এ রকম একটি দৃশ্যপটে রাজনৈতিকভাবে গোলযোগপূর্ণ পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বরে প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
(সম্প্রতি
ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত কংগ্রেসের প্রবীণ
নেতা প্রণব মুখার্জির বই ‘দি ড্রামেটিক ডিকেড দি ইন্দিরা গান্ধী ইয়ার্স
প্রকাশ করেছে দিল্লির রুপা পাবলিকেশন্স। এ বইয়ের একটি অধ্যায় ‘মুক্তিযুদ্ধ:
দি মেকিং অব বাংলাদেশ’ এর অবিকল তরজমা)
No comments