মোদি সরকারের এক বছর by শশী থারুর
এ
মাসে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারের এক বছর পূর্ণ
হবে। তাদের সামগ্রিক কার্যক্রম মূল্যায়নের এটা উপযুক্ত সময় নয়। কিন্তু সারা
ভারতেই সরকারের প্রথম বছর নিয়ে ব্যাপক হতাশা রয়েছে।
অগণিত প্রত্যাশার ভেলায় ভর করে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল, তার আগে ১০ বছর তারা মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকারের জমানায় বিরোধী দল ছিল (আমি নিজেও ইউপিএ সরকারের সদস্য ছিলাম)। বিজেপির এত বিপুল মানুষের সমর্থন ছিল যে তারা ৩০ বছরের মধ্যে প্রথম দল হিসেবে লোকসভায় (ভারতীয় সংসদের নিম্নসভা) একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়।
বিজেপি সরকারের ব্যাপারে মানুষের উচ্ছ্বাসের কারণ ছিল আগের সরকারের সঙ্গে তার পার্থক্যের দিকগুলো, যদিও এই ব্যাপারটা ছিল অনুমিত, অর্থাৎ ধারণা। যাক, অবশেষে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত একটি দল ক্ষমতায় এসেছে, যার নেতৃত্বে আছেন একজন ‘কাজের মানুষ’। ভঙ্গুর এক জোটের সরকারের চেয়ে তো ভালো, যে সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন অশীতিপর স্বল্পভাষী মানুষ। যাঁকে আবার কখনো কখনো অন্যায্যভাবে ব্যঙ্গ করে বলা হতো, তিনি একজন দোদুল্যমান ও অনিশ্চিত মানুষ।
চাতুরীপূর্ণ প্রচারণার মধ্য দিয়ে মোদিকে ভোটারদের কাছে বাজারজাত করা হয়েছে। প্রচারণায় বলা হয়েছে, তিনি একজন ব্যবসাবান্ধব মানুষ, যিনি গুজরাটকে উন্নয়নের ধ্রুবতারায় পরিণত করেছেন। আর নির্বাচিত হলে সারা দেশকেই তিনি একইভাবে উন্নত করে ফেলবেন। তিনি তরুণদের ভোট আকৃষ্ট করেছেন চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে, বয়স্কদের ভোট টেনেছেন সংস্কার ও প্রবৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে। আর তিনি যেভাবে নির্বাচিত হন, তাতে দেশের জনমত যাচাইকারীরাও বোকা বনে যান। আর কংগ্রেসও ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ ফলাফল করে।
নির্বাচনের পর মোদি বিশ্বদরবারে বুক ফুলিয়ে হেঁটেছেন, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগান দিয়ে তিনি বিনিয়োগকারীদের ভারতে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করেছেন। যদিও তাঁর বিদেশ সফর থেকে খুব সামান্যই লাভ হয়েছে। বড়জোর এতে তাঁর ভাবমূর্তি উন্নত হয়েছে। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় ২০০২ সালে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় কয়েক হাজার মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনায় তিনি উদাসীন ছিলেন, এই অভিযোগে তাঁর ভাবমূর্তি ফুটো হয়ে গিয়েছিল।
ঘরের মধ্যে আবার মোদির পারফরম্যান্স তেমন একটা ছাপ ফেলতে পারেনি। যদিও তাঁর হিন্দি বক্তৃতার ভক্তরা তাঁর বাগ্মিতায় মুগ্ধ হয়েই চলেছে, বাগাড়ম্বর ও বাস্তবতার মধ্যকার ফাঁক দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
আবার সহিষ্ণুতা ও সহনশীলতা নিয়ে অনেক কথা বললেও মোদির দলের মন্ত্রী ও সাংসদেরা যে ঘৃণা ছড়িয়ে চলেছেন, সে ব্যাপার তিনি নিশ্চুপ। এঁদের এসব বক্তৃতাবাজি ভারতের অহিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে একঘরে করে ফেলছে। বিজেপি ধর্ম প্রচারের মতো উন্নয়নের ফেরি করে বেড়াচ্ছে, কিন্তু আদতে দলটি অন্ধত্ব ছড়াচ্ছে। যে শক্তিগুলোর তাঁকে নির্বাচনে জিততে সহায়তা করেছে, তাদের ত্যাজ্য করে তিনি এ বৈপরীত্যের সমাধান করতে পারেন।
অন্যদিকে মোদি যে ‘ন্যূনতম সরকার, সর্বোচ্চ সুশাসনের’ কথা দিয়েছিলেন, সেটাও তিনি রাখতে পারেননি। বরং তিনি খুবই এককেন্দ্রিক, ওপর-নিচ, আমলাতন্ত্র পরিচালিত, ব্যক্তিপূজাভিত্তিক কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থা চালু করেছেন, ১৯৭০-এর দশকের ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার পর এমন পরিস্থিতি দেখা যায়নি। যাঁরা মোদির গণতান্ত্রিক, আলোচনাশীল ও মতৈক্যপ্রত্যাশী পূর্বসূরিদের ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণে পক্ষাঘাতের’ সমালোচনা করেছিলেন, তাঁরা এখন নতুন পক্ষাঘাতের সম্মুখীন হয়েছেন। কারণ, মোদির কার্যালয়ে ফাইলের স্তূপ সৃষ্টি হচ্ছে, আর সিদ্ধান্তও শুধু সেই এক জায়গাতেই হয়।
সরকারের ঊর্ধ্বতন পদ খালি পড়ে আছে। এমনকি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অপরিহার্য তিনটি পদের মধ্যেও দুটি পদ খালি। ফলে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকঠাক কাজ করতে পারছে না। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিয়ে অনেক কথা বললেও মোদি কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনার, ভিজিলেন্স কমিশনার ও লোকপাল (ন্যায়পাল, যিনি সাংসদ ও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তাসহ সবার দুর্নীতির তদন্ত করতে পারেন) নিয়োগ করতে পারেননি।
মোদি এতই ব্যস্ত যে এসব ঘাঁটাঘাঁটি করার সময় তাঁর নেই। আর তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সরকারের পালে হাওয়া লাগাতে পারেন। কিছু ক্ষেত্রে সরকার খোলাখুলিভাবে বৈপরীত্যমূলক মনোভঙ্গি নিয়ে কাজ করছে।
অর্থনৈতিক নীতির কথাই ভাবুন। যদিও মোদি ঘোষণা করেছেন, ‘ব্যবসা–বাণিজ্য সরকারের কাজ নয়’, এয়ারলাইন ও হোটেলে সরকারি মালিকানার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি এর সদুত্তর দিতে পারেননি। যদিও রাষ্ট্রায়ত্ত মহিরুহ প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারীকরণের কথা এখন আর বলাই হয় না।
তদুপরি, একসময় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে শ্রমবাজারের উদারীকরণ অপরিহার্য মনে করা হতো, সে বিষয়টিও এখন আর আলোচনায় নেই। সংস্কার নিয়ে যে আশাবাদী কথাবার্তা হতো, তার জায়গায় এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ক্রমিক উন্নতির’ কথা বলা হচ্ছে।
একইভাবে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি একসময় ‘কর সন্ত্রাস’ নিয়ে উপহাস করলেও কর সংগ্রাহকদের নতুন করদাতাদের ওপর লেলিয়ে দিয়েছেন। এমনকি এর মধ্যে বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও বাদ নেই, মোদি যাঁদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন। ফলে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের বেলুন যে ফুটো হয়ে যাচ্ছে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। যদিও মোদির প্রচারণার সময় তা অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছিল।
মোদির সরকার মহিরুহ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তাতে অর্থায়ন করতে না পারার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আরও খারাপ ব্যাপার হচ্ছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্যানিটেশন, নারীর নিরাপত্তা—এসবই বাদ দেওয়া হয়েছে, যদিও মোদির নির্বাচনী প্রচারণায় এসব বলা হয়েছিল।
এগুলোর কোনো কিছুই মানুষের অজানা নয়। যেমন, ভারতের কৃষকেরা গর্জে উঠেছেন। কারণ, আগের সরকার যে ভূমি অধিগ্রহণ আইন পাস করেছিল, তা ফিয়াটের চাপানো নানা সংশোধনীর মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছে (যদিও এগুলো এখন আইনি প্রতিরোধের মুখে পড়তে যাচ্ছে)।
আরও সাধারণভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় মোদি যে চা-ওয়ালা হিসেবে নিজের পরিচিতি দিয়েছিলেন, সেখান থেকে তাঁর এই পরিবর্তন মানুষের মাঝে ছাপ ফেলেনি। মোদি জাতিকে সেবা করার ঘরোয়া আশীর্বাদ বিসর্জন দিয়ে জমকালো পোশাক পরে সেলিব্রিটির মতো অন্য গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সামাজিকতা করে বেড়াচ্ছেন। গত জানুয়ারিতে তিনি এর অধোবিন্দুতে পৌঁছে যান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে তিনি ‘আমার বন্ধু ওবামা’ বলে ডেকেছেন। সেদিন তিনি প্রিন্স স্ট্রাইপ স্যুট পরেছিলেন, এর প্রতিটি স্ট্রাইপে তাঁর নাম সোনা দিয়ে খচিত করা ছিল। এই প্রদর্শনীতে মানুষ যারপরনাই বিরক্ত হয়ে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। অথচ গত বছর বিজেপি দিল্লিতে প্রায় জিতেই গিয়েছিল।
এক অর্থে এটা মোদির সৌভাগ্য যে সরকারের ব্যর্থতা তাঁর জামানার শুরুর দিকেই ধরা পড়েছে, ফলে তিনি সেগুলো শুধরে নিতে পারেন। তিনি সেই প্রিন্স স্ট্রাইপ স্যুট নিলামে বিক্রি করে দেখিয়েছেন, তিনি সঠিক শিক্ষা নিতে পারেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তাঁর অন্য ভুলগুলো এত সহজে শোধরানো যাবে না।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন ; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর: ভারতের রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের সাংসদ ও লেখক।
অগণিত প্রত্যাশার ভেলায় ভর করে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল, তার আগে ১০ বছর তারা মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকারের জমানায় বিরোধী দল ছিল (আমি নিজেও ইউপিএ সরকারের সদস্য ছিলাম)। বিজেপির এত বিপুল মানুষের সমর্থন ছিল যে তারা ৩০ বছরের মধ্যে প্রথম দল হিসেবে লোকসভায় (ভারতীয় সংসদের নিম্নসভা) একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়।
বিজেপি সরকারের ব্যাপারে মানুষের উচ্ছ্বাসের কারণ ছিল আগের সরকারের সঙ্গে তার পার্থক্যের দিকগুলো, যদিও এই ব্যাপারটা ছিল অনুমিত, অর্থাৎ ধারণা। যাক, অবশেষে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত একটি দল ক্ষমতায় এসেছে, যার নেতৃত্বে আছেন একজন ‘কাজের মানুষ’। ভঙ্গুর এক জোটের সরকারের চেয়ে তো ভালো, যে সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন অশীতিপর স্বল্পভাষী মানুষ। যাঁকে আবার কখনো কখনো অন্যায্যভাবে ব্যঙ্গ করে বলা হতো, তিনি একজন দোদুল্যমান ও অনিশ্চিত মানুষ।
চাতুরীপূর্ণ প্রচারণার মধ্য দিয়ে মোদিকে ভোটারদের কাছে বাজারজাত করা হয়েছে। প্রচারণায় বলা হয়েছে, তিনি একজন ব্যবসাবান্ধব মানুষ, যিনি গুজরাটকে উন্নয়নের ধ্রুবতারায় পরিণত করেছেন। আর নির্বাচিত হলে সারা দেশকেই তিনি একইভাবে উন্নত করে ফেলবেন। তিনি তরুণদের ভোট আকৃষ্ট করেছেন চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে, বয়স্কদের ভোট টেনেছেন সংস্কার ও প্রবৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে। আর তিনি যেভাবে নির্বাচিত হন, তাতে দেশের জনমত যাচাইকারীরাও বোকা বনে যান। আর কংগ্রেসও ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ ফলাফল করে।
নির্বাচনের পর মোদি বিশ্বদরবারে বুক ফুলিয়ে হেঁটেছেন, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগান দিয়ে তিনি বিনিয়োগকারীদের ভারতে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করেছেন। যদিও তাঁর বিদেশ সফর থেকে খুব সামান্যই লাভ হয়েছে। বড়জোর এতে তাঁর ভাবমূর্তি উন্নত হয়েছে। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় ২০০২ সালে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় কয়েক হাজার মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনায় তিনি উদাসীন ছিলেন, এই অভিযোগে তাঁর ভাবমূর্তি ফুটো হয়ে গিয়েছিল।
ঘরের মধ্যে আবার মোদির পারফরম্যান্স তেমন একটা ছাপ ফেলতে পারেনি। যদিও তাঁর হিন্দি বক্তৃতার ভক্তরা তাঁর বাগ্মিতায় মুগ্ধ হয়েই চলেছে, বাগাড়ম্বর ও বাস্তবতার মধ্যকার ফাঁক দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
আবার সহিষ্ণুতা ও সহনশীলতা নিয়ে অনেক কথা বললেও মোদির দলের মন্ত্রী ও সাংসদেরা যে ঘৃণা ছড়িয়ে চলেছেন, সে ব্যাপার তিনি নিশ্চুপ। এঁদের এসব বক্তৃতাবাজি ভারতের অহিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে একঘরে করে ফেলছে। বিজেপি ধর্ম প্রচারের মতো উন্নয়নের ফেরি করে বেড়াচ্ছে, কিন্তু আদতে দলটি অন্ধত্ব ছড়াচ্ছে। যে শক্তিগুলোর তাঁকে নির্বাচনে জিততে সহায়তা করেছে, তাদের ত্যাজ্য করে তিনি এ বৈপরীত্যের সমাধান করতে পারেন।
অন্যদিকে মোদি যে ‘ন্যূনতম সরকার, সর্বোচ্চ সুশাসনের’ কথা দিয়েছিলেন, সেটাও তিনি রাখতে পারেননি। বরং তিনি খুবই এককেন্দ্রিক, ওপর-নিচ, আমলাতন্ত্র পরিচালিত, ব্যক্তিপূজাভিত্তিক কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থা চালু করেছেন, ১৯৭০-এর দশকের ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার পর এমন পরিস্থিতি দেখা যায়নি। যাঁরা মোদির গণতান্ত্রিক, আলোচনাশীল ও মতৈক্যপ্রত্যাশী পূর্বসূরিদের ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণে পক্ষাঘাতের’ সমালোচনা করেছিলেন, তাঁরা এখন নতুন পক্ষাঘাতের সম্মুখীন হয়েছেন। কারণ, মোদির কার্যালয়ে ফাইলের স্তূপ সৃষ্টি হচ্ছে, আর সিদ্ধান্তও শুধু সেই এক জায়গাতেই হয়।
সরকারের ঊর্ধ্বতন পদ খালি পড়ে আছে। এমনকি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অপরিহার্য তিনটি পদের মধ্যেও দুটি পদ খালি। ফলে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকঠাক কাজ করতে পারছে না। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিয়ে অনেক কথা বললেও মোদি কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনার, ভিজিলেন্স কমিশনার ও লোকপাল (ন্যায়পাল, যিনি সাংসদ ও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তাসহ সবার দুর্নীতির তদন্ত করতে পারেন) নিয়োগ করতে পারেননি।
মোদি এতই ব্যস্ত যে এসব ঘাঁটাঘাঁটি করার সময় তাঁর নেই। আর তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সরকারের পালে হাওয়া লাগাতে পারেন। কিছু ক্ষেত্রে সরকার খোলাখুলিভাবে বৈপরীত্যমূলক মনোভঙ্গি নিয়ে কাজ করছে।
অর্থনৈতিক নীতির কথাই ভাবুন। যদিও মোদি ঘোষণা করেছেন, ‘ব্যবসা–বাণিজ্য সরকারের কাজ নয়’, এয়ারলাইন ও হোটেলে সরকারি মালিকানার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি এর সদুত্তর দিতে পারেননি। যদিও রাষ্ট্রায়ত্ত মহিরুহ প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারীকরণের কথা এখন আর বলাই হয় না।
তদুপরি, একসময় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে শ্রমবাজারের উদারীকরণ অপরিহার্য মনে করা হতো, সে বিষয়টিও এখন আর আলোচনায় নেই। সংস্কার নিয়ে যে আশাবাদী কথাবার্তা হতো, তার জায়গায় এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ক্রমিক উন্নতির’ কথা বলা হচ্ছে।
একইভাবে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি একসময় ‘কর সন্ত্রাস’ নিয়ে উপহাস করলেও কর সংগ্রাহকদের নতুন করদাতাদের ওপর লেলিয়ে দিয়েছেন। এমনকি এর মধ্যে বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও বাদ নেই, মোদি যাঁদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন। ফলে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের বেলুন যে ফুটো হয়ে যাচ্ছে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। যদিও মোদির প্রচারণার সময় তা অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছিল।
মোদির সরকার মহিরুহ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তাতে অর্থায়ন করতে না পারার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আরও খারাপ ব্যাপার হচ্ছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্যানিটেশন, নারীর নিরাপত্তা—এসবই বাদ দেওয়া হয়েছে, যদিও মোদির নির্বাচনী প্রচারণায় এসব বলা হয়েছিল।
এগুলোর কোনো কিছুই মানুষের অজানা নয়। যেমন, ভারতের কৃষকেরা গর্জে উঠেছেন। কারণ, আগের সরকার যে ভূমি অধিগ্রহণ আইন পাস করেছিল, তা ফিয়াটের চাপানো নানা সংশোধনীর মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছে (যদিও এগুলো এখন আইনি প্রতিরোধের মুখে পড়তে যাচ্ছে)।
আরও সাধারণভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় মোদি যে চা-ওয়ালা হিসেবে নিজের পরিচিতি দিয়েছিলেন, সেখান থেকে তাঁর এই পরিবর্তন মানুষের মাঝে ছাপ ফেলেনি। মোদি জাতিকে সেবা করার ঘরোয়া আশীর্বাদ বিসর্জন দিয়ে জমকালো পোশাক পরে সেলিব্রিটির মতো অন্য গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সামাজিকতা করে বেড়াচ্ছেন। গত জানুয়ারিতে তিনি এর অধোবিন্দুতে পৌঁছে যান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে তিনি ‘আমার বন্ধু ওবামা’ বলে ডেকেছেন। সেদিন তিনি প্রিন্স স্ট্রাইপ স্যুট পরেছিলেন, এর প্রতিটি স্ট্রাইপে তাঁর নাম সোনা দিয়ে খচিত করা ছিল। এই প্রদর্শনীতে মানুষ যারপরনাই বিরক্ত হয়ে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। অথচ গত বছর বিজেপি দিল্লিতে প্রায় জিতেই গিয়েছিল।
এক অর্থে এটা মোদির সৌভাগ্য যে সরকারের ব্যর্থতা তাঁর জামানার শুরুর দিকেই ধরা পড়েছে, ফলে তিনি সেগুলো শুধরে নিতে পারেন। তিনি সেই প্রিন্স স্ট্রাইপ স্যুট নিলামে বিক্রি করে দেখিয়েছেন, তিনি সঠিক শিক্ষা নিতে পারেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তাঁর অন্য ভুলগুলো এত সহজে শোধরানো যাবে না।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন ; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর: ভারতের রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের সাংসদ ও লেখক।
No comments