কেমন আছেন চা শ্রমিকরা ২ ॥ চিকিৎসা সুবিধাও নেই, কাজ করতে হয় ঝুঁকি নিয়ে- স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থাকলেও ডাক্তারের দেখা পাওয়া যায় না ॥ খাবার পানির তীব্র সঙ্কট
নরেশ গোয়ালা। চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের একজন সর্দার। বংশপরম্পরায় তিনি চা বাগানে কাজ করছেন। তাঁর অধীনে কাজ করেন আরও ১২ জন নারী-পুরুষ। বাগানে নানা পোকামাকড় থাকে, ধুলাবালির কথা তো বলাই বাহুল্য।
শ্রমিকদের কাজ করার জন্য পোশাকের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু যাদের অবস্থা ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ তাদের পক্ষে এসব পোশাক সংগ্রহ করা এক প্রকার অসাধ্যই। তাই স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হয় তাদের। শ্রম শোষণের এক মারাত্মক চিত্র পরিলক্ষিত হয় মৌলভীবাজারের চা বাগানগুলোতে। সরেজমিন চা বাগান প্রদক্ষিণে দেখা যায়, সেখানে নেই ন্যূনতম প্রাথমিক চিকিৎসা-সুবিধা। চা বাগান মালিকরা কোন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা হেলথ ক্লিনিক খোলার পক্ষপাতী নন। সম্প্রতি ইউনিসেফের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) আয়োজিত ‘শিশু ও নারী উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম (চতুর্থ পর্যায়) প্রকল্পে’র আওতায় সরেজমিন ভ্রমণে এমন চিত্র উঠে আসে।পুরো জেলার ৯২টি চা বাগানের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক বাগানে রয়েছে নামমাত্র স্বাস্থ্যসেবা। প্রেমনগর চা বাগানে গিয়ে দেখা যায়, এখানে একটি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু কোন ডাক্তারের দেখা পাওয়া গেল না। সেবা কেন্দ্রের দায়িত্বে আছেন শ্যামল দেব। তিনি একজন আরএমপি। তিনি জানান, এখানে কেবল সাময়িক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়। তাঁর রেজিস্ট্রার খাতা দেখে জানা গেল, প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০ জন স্বাস্থ্যসেবার জন্য এখানে আসছেন। কিন্তু ওষুধ হিসেবে তাঁর প্রেসক্রিপশন শুধু প্যারাসিটামল, মেট্রোজির, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স আর মাঝে মধ্যে স্যালাইন। সব রোগের জন্যই একই ধরনের পথ্য দেয়া হচ্ছে। শ্যামল দেব বলেন, মাঝে মধ্যে অনেক কঠিন রোগী আসেন এখানে। তাদের জেলা সদরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এর খরচ কে বহন করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চা বাগানের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হয়।
কিন্তু বাগানের অপর এক সর্দার গোপাল যাদব বলেন, সহযোগিতা আর কি? সদর হাসপাতালে তো সরকারী চিকিৎসাই। চা বাগান কর্তৃপক্ষ সে সময় অল্প কিছু সাহায্য করেন। কিন্তু মারাত্মক কোন অসুবিধায় পড়লে পিছপা হয়ে যান তাঁরা।
অপুষ্টি, রক্ত স্বল্পতা, এ্যানিমিয়া, সাধারণ সর্দি-কাশি, জ্বর ও বক্ষব্যাধি এসব শ্রমিকদের নিত্যসঙ্গী। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে শ্রমিকরা চা বাগানে কাজ করেন তাদের বরাবরই শিকার হতে হয় শোষণ আর বঞ্চনার। এত সব সমস্যা মাথায় নিয়েও কাজ করে যান তাঁরা। স্বপ্ন দেখে যান সুন্দর ভবিষ্যতের। কিন্তু সেসব স্বপ্নের বাস্তবায়ন কখনই হয় না।
এদিকে, মায়েরা কাজে যাওয়ার সময় শিশুদের রেখে যাওয়ার জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার ছিল। সেগুলোর একেবারেই বেহাল দশা। এ ধরনের সংস্কৃতি প্রায় উঠেই যাচ্ছে। অধিকাংশ চা বাগানের ডে-কেয়ার সেন্টারগুলো অকেজো। দেয়াল ধসে পড়েছে, কিংবা যেগুলো টিকে আছে সেখানে শিশুদের দেখাশোনা করারও কেউ নেই।
একই অবস্থা স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রগুলোর। এখানে ডাক্তারের পাশাপাশি নেই কোন উন্নত যন্ত্রপাতি। বিছানাগুলো দেখেই বোঝা যায়, এগুলো ব্যবহৃত হয় না অনেক দিন যাবত। অপরিচ্ছন্ন এ ঘরগুলো দেখলেই যেন মনে হয়, এখানে রোগী আসলে তার অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। নারীদের প্রসূতি সেবার নেই আদৌ কোন ব্যবস্থা।
চা বাগানের শ্রমিকদের বেতন ক্ষেত্রবিশেষে ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা রোজ। সপ্তাহান্তে একবার তারা টাকা উত্তোলন করতে পারেন। টাকার বেশিরভাগই ব্যয় হয় খাবারের পেছনে। তাছাড়া চা বাগানের বাসিন্দারা অনেকেই বিভিন্ন মাদকে আসক্ত। তাদের উপার্জিত অর্থের সিংহভাগ তারা এই সর্বনাশা মাদকের পেছনে ঢেলে দেন।
মূল সমস্যা পানি ॥ চা বাগানে পানির সমস্যা সবচেয়ে বেশি। বিশাল অঞ্চলজুড়ে কেবল উঁচু-নিচু টিলা যেখানে চা চাষ করা হয়। এই বিশাল এলাকায় সুপেয় পানির দেখা পাওয়া যায় না। যেখানে শ্রমিকরা বসবাস করেন সেখানেও পুরো এলাকায় একটি-দুটি নলকূপের দেখা মেলে। সেখানে পানি পাওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়। এ ছাড়া বেশিরভাগ নলকূপই আর্সেনিক দূষণের শিকার। সেসব কলের পানি নিরাপদ নয় জেনেও অনেকে তা ব্যবহারে বাধ্য হন। ফলে তাদের নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হয়। চা বাগানে কর্মরত এক সর্দার শ্যামল মোদি বলেন, এখানে আমরা কাজ করার সময় পানির সবচেয়ে অভাব বোধ করি। এমনও হয়, সারাদিন কাজ করার পরও খাবার পানি পাওয়া যায় না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মৌলভীবাজার পৌরসভার ওয়াটার সাপ্লাই সেকশনের সুপারিনটেনডেন্ট বিজয় কৃষ্ণ দেব বলেন, বিভিন্ন এনজিওর সহায়তায় চা বাগানগুলোতে ৮৯ টি নলকূপ বসানো হয়েছে। এর কার্যক্রম এখনও চলছে। বর্তমানে কেবল ৩৫ শতাংশ মানুষকে সুপেয় পানির আওতায় আনা যাচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষ এ জন্য নানা সমস্যায় ভুগে থাকে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে। মনু নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এ সমস্যার অনকটা নিরসন করা সম্ভব হবে।
No comments