ভেলরির বিয়ে এবং... by আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
আমি
হতাশ হওয়ার বান্দা নই। কিন্তু একটু আগে ভেলরি টেইলরের কথা শুনতে শুনতে
আমার মধ্যে হতাশা এসে গেছে। দেখলাম উনি সেই সুদূর ইংল্যান্ড থেকে
বাংলাদেশের অচেনা অজানা অপরিচিত জায়গায় এসে যে মহান অবদান রেখেছেন আমরা
এখানে বাস করে, তাঁর চেয়ে অনেক বেশি পরিচিতি ও প্রভাব নিয়েও তাঁর তুলনায়
কিছুই করতে পারিনি। উনি অন্তত আমার চেয়ে এই সমাজকে বেশি দিয়েছেন। সেইজন্য
আমি তাঁকে অভিনন্দন জানাই।
আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে আজ বিরাট হতাশা। আমি যখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের শাখা খুলতে যাই তখন প্রায়ই লোকেরা বলে: ‘আর জায়গা পেলেন না ভাই, এখানে এসেছেন! শাখা খুলবেন কোনখানে। সব তো এখানে জন্তু-জানোয়ার।’ আমি কিন্তু তাঁদের সাবধানবাণী শুনি না। শাখা খুলে ফেলি।
বছর-পাঁচেক পর সে-শাখা যখন ফুল পাতায় ঝলমলিয়ে ওঠে তখন তাঁদের কাছে গিয়ে বলি: ‘আপনারা তো ‘জানোয়ার’ ‘জানোয়ার’ করেছিলেন কিন্তু দেখুন কত মানুষ আছে এখানে। কেউ খোঁজেননি বলে তাদের পাননি। যারা এদেশে আজ এই জাতির শক্তি ও বিবেককে ধারণ করে আছে, খুঁজলে ঠিকই তাদের পাওয়া যাবে। না-খুঁজলে কী করে পাব?’
আমাদের চারপাশে যে-অসংখ্য অবহেলিত পঙ্গু মানুষেরা অসহায় হয়ে, তিলে তিলে ধুঁকে মরছে, ভালোবেসে তাদের না খুঁজলে কোনোদিন তাদের আমরা দেখতে পাব না। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের জন্য আমাদের ভেতরে ভালোবাসা না জাগবে ততক্ষণ আমরা কেবল ওদের ঐ কুশ্রী চেহারাতেই দেখব। ফরাসি রূপকথায় ‘বিউটি এ্যান্ড দি বিস্ট’ নামে একটা অপূর্ব গল্প আছে। গল্পটাতে আছে: দানবের মতো দেখতে একটা জন্তু বিউটিকে তার প্রাসাদে ধরে নিয়ে যায়। বিউটি খুবই রূপসী। জন্তুটা বিউটিকে খুবই ভালোবাসে, তার জন্য একা ডুকরে ডুকরে কাঁদে, তাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু বিউটির মনে তার জন্য প্রেম জাগে না। ‘ও একটা জানোয়ার। ওকে কী করে ভালোবাসব’, মনে হয় বিউটির। ভালোবাসার যন্ত্রণায়, কষ্টে জন্তুটা ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার মৃত্যুদিন ঘনিয়ে আসে। একদিন প্রাসাদের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বিউটি ঐ মৃত্যুযন্ত্রণাক্লিষ্ট জানোয়ারটার গোঙানি শুনতে পায়। কাছে গিয়ে দেখে কষ্টে বেদনায় সে শেষ হয়ে এসেছে। জন্তুটার কষ্ট দেখে বিউটির চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। তার অমনি ঘটে এক আশ্চর্য ঘটনা। জানোয়ারটা সুদর্শন রাজপুত্র হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। (আসলে জন্তুটা ছিল একজন অভিশপ্ত রাজপুত্র। যার শাপে সে জন্তু হয়েছিল, সে শর্ত দিয়েছিল, তার দুঃখে ব্যথিত হয়ে কেউ যদি কোনোদিন চোখের পানি ফেলে তবে সে আবার তার রাজপুত্রের চেহারা ফিরে পাবে।) গল্পটার ভেতরের মূল কথাটা কি? কথাটা হল: আমাদের চারপাশের দুঃখী পৃথিবীটা অমনি এক সুদর্শন রাজপুত্রের মতো। অপ্রেমের অভিশাপে সে জন্তুর মতো কদাকার হয়ে আছে। যতক্ষণ আমরা তাকে ভালো না বাসি ততক্ষণ সে তার অভিশপ্ত চেহারা নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা সেই রাজপুত্রকে পাই তখনই যখন তার জন্য আমাদের চোখের পানি মাটিতে ঝরে।
পৃথিবীর কুশ্রীতম নিঃস্বতম মানুষের মধ্যেও আছে এই রাজপুত্র। আমাদের প্রেম দিয়ে, বেদনা দিয়ে, অশ্রু দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে সেই রাজপুত্রকে পেতে হয়। ভেলরি টেইলর তাদের পেয়েছেন। তিনি বাংলাদেশকে ভালো বেসেছেন, এখানকার দুঃখী মানুষের জন্য চোখের পানি ফেলেছেন। তাই সুন্দর রাজপুত্রের মতো এই বাংলাদেশ তাঁর চারপাশে আজ দাঁড়িয়ে আছে।
উনি বাংলাদেশের প্রেমে পড়েছেন। আমার ধারণা কেবল প্রেমে পড়েননি, এদেশের সঙ্গে তিনি বিবাহিতও হয়েছেন। না হলে শুধু প্রেমের জন্য এতদিন, দীর্ঘ তিরিশটা বছর কি তিনি কাটাতে পারতেন? প্রেম এত দীর্ঘজীবী নয়। আমি নিশ্চিত এই জাতির সঙ্গে এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে তিনি বাঁধা। কিন্তু কিসের সঙ্গে বাঁধা পড়েছেন? না, এর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বা ভোগলিপ্সার সঙ্গে নয়, আখের গোছানোর সঙ্গে নয়, বাঁধা পড়েছেন তিনি এ জাতির অসহায়তার সঙ্গে, নিঃস্বতার সঙ্গে। এর দুঃখ আর অশ্রুর সঙ্গে। উনি অনুভব করেছেন এই বেদনাগুলো ইউরোপেও আছে, কিন্তু অত স্পষ্ট করে তাদের দেখা যায় না। গেলেও সেই বেদনায় শুশ্রƒষা দেবার মানুষ সেখানে আছে। কিন্তু এখানে কেউ নেই। তাই এই বেদনা এবং দায়িত্ব তিনি নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। আমাদের জাতির এই দুঃখের সঙ্গেই তিনি সত্যিকারভাবে বিবাহিত হয়েছেন।
কিন্তু তাই বলে এই প্রাপ্তিটুকুর জন্য একটা গোটা জীবন দিয়ে দেওয়া এ কি এতই সহজ? আমাদের হতাশা-যন্ত্রণা, দুঃখ-কষ্ট আজ এতটাই দুঃসহ যে বেঁচে থাকার সমস্ত আশা আর আনন্দ মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই বাংলাদেশের তলা থেকে আজ জেগে উঠছে আরেকটা বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশকে আমরা আজো ঠিকমতো দেখিনি, কিন্তু অচিরেই দেখব। সে সুখে আশায় ভরা এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। আজ সে নেই, কিন্তু সংগ্রাম ও দুঃখের মধ্যদিয়ে তাকে বহু মানুষ তিল তিল করে জন্ম দিয়ে চলেছে। আমাদের সংগ্রাম সেই বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য।
হুবহু এক কাজ না করলেও আমাদের সঙ্গে গভীর মিল আছে তাঁর। উনি একধরনের প্রতিবন্ধী শুধু শারীরিক হয় না, মানসিকও হয়Ñআত্মাও হয়। প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন: ‘দেহের মৃত্যুর রেজিস্ট্রি রাখা হয় প্রতিবন্ধিত্বের মতো স্পর্শগ্রাহ্য নয় বলে তা আমাদের চোখে পড়ে না। যদি আত্মার মৃত্যুর রেজিস্ট্রি রাখা হত তাহলে হয়তো দেখা যেত আমাদের তেরো কোটি লোকের মধ্যে ১২ কোটি ৯০ লক্ষ লোক অনেক আগেই মারা গেছে। আমরা সেই মানসিক প্রতিবন্ধিত্বকে সারিয়ে তোলার জন্য অল্পস্বল্প কাজ করছি। কিন্তু শুধু শারীরিক বা মানসিকÑএর যে-কোনো একটিকে আরোগ্য করলেই চলবে না। দুটোকেই আমাদের সারিয়ে তুলতে হবে। আমরা এই দুই প্রতিষ্ঠান থেকে দুই ধরনের প্রতিবন্ধীদের সারিয়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছি। এদিক থেকে আমরা পরিপূরক।
এতক্ষণ ভেলরি টেইলরের কাছ থেকে যে-গল্প আমরা শুনলাম এ কি ব্যর্থতার গল্প? এই-যে অসহায়, আশ্বাস-হারিয়ে-ফেলা পঙ্গু হওয়া মানুষদের নিষ্ফল জীবন থেকে টেনে তুলে আলো-আশায় ভরা একটা স্বনির্ভর জীবনের মধ্যে তিনি বাঁচিয়ে তুলছেন, সম্মান আর মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করছেন, এ কি সোজা কাজ? আলোকিত মানুষের জন্য আন্দোলন কি শুধু আমরাই করি? এটাও কি আলোকিত মানুষেরই আন্দোলন নয়? তাঁর মমতার স্পর্শ পেয়ে পঙ্গু বিকলাঙ্গ মানুষেরা এই যে পৃথিবীকে আবার দেখছে, এখানে নিঃশ্বাস নিচ্ছে কী অসাধারণ কাজ এ? কী আলোকবর্তিকারই প্রজ্বলন নয়? একটা মাত্র জীবনই তো আমরা পাই পৃথিবীতে। সেই জীবন হারিয়ে ফেলার চাইতে যন্ত্রণাময় অন্ধকারময় আর কী হতে পারে? সেই জীবন আবার ফুটে উঠল, একটা নিভে যাওয়া প্রদীপ আবার আলোকিত হলÑএটা যে কতবড় অপার্থিব আনন্দ, এ যে পেয়েছে সে-ই জানে। এমনি হাজার হাজার প্রদীপ জ্বালাতে পেরেছেন বলেই এদেশে তিনি থেকে গেছেন, এখানকার মানুষকে ভালোবেসেছেন বলেই জীবনটা তাদের জন্য দিতে পারছেন।
উনি যখন কথা বলছিলেন আমি তখন তার পবিত্রতামাখা মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নিজেকে অন্যের জন্য বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে পরিতৃপ্তি আর প্রসন্নতায় জ্বলজ্বল করছিল তাঁর মুখ। তাঁর মুখের দীপ্তির মধ্যেই তাঁর ভালোবাসা আমি দেখছিলাম। আমরা অক্ষম। একেকবার একেক ইচ্ছার চাবুক ক্ষতবিক্ষত হই। একবার এটা করি, একবার সেটা। কোনোকিছুতে একাগ্র হতে পারি না। আমার নিজের কথাই বলি। একবার টেলিভিশনে যাই তো একবার করি ডেঙ্গু আন্দোলন। একবার সমাজ, একবার শিল্প; একবার শিক্ষা, একবার সাহিত্য, একবার পরিবেশÑকী এসব! জীবনের সর্বোচ্চকে স্পর্শ করতে চাইলে একটা জায়গায় নতজানু হতে হয়, সেজদা দিয়ে তার ভেতর বিলীন হতে হয়। আমাদের মতো বিশৃঙ্খল, অস্থির, অস্বস্ত মানুষরা এটা পারে না। তাঁকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই এজন্য যে, নিমগ্ন আত্মদানের তিনি এক অনন্য উদাহরণ।
একদিন আমার আমন্ত্রণে ঢাকার স্কুলগুলোর বেশ কিছু হেডমাস্টার এই ঘরে এসেছিলেন। সভা শুরু হলে দেখলাম কয়েকজন ফাদার রয়েছেন তাঁদের মধ্যে। তাঁদের দেখে মনে হল, যে-জ্যাম, জেলি, রুটি, মাখনের জন্য আমাদের মানুষেরা পাগলের মতো দেশ ছেড়ে যায় যায় ইয়োরোপ আমেরিকায়, এঁরা সেসব দেশের সেই সব মোহ ছেড়েই গারো পাহাড়, আসাম আর সুমাত্রার জঙ্গলের মধ্যে জীবন শেষ করে চলেছেন। ভাবলাম, আমরাও কি এই আদর্শের উদাহরণ হতে পারি না? এই ফাদারদের দেখলেও তো বোঝা যায়, কীভাবে মানুষ নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে। আহরণের ভেতর দিয়ে মানুষ টিকে থাকে, কিন্তু বড় হয় দিতে পারার মধ্য দিয়ে। ছোটজীবনকে উৎসর্গ করেই বড়জীবনকে পেতে হয়; পৃথিবীকে উৎসর্গ করে স্বর্গকে। তাহলেই কেবল জীবন ওরকম আনন্দ-জ্যোতিতে ভরে ওঠে। তিনি ঠিক এই কাজটিই করছেন। তিনি এই নিঃস্ব হতশ্রী দেশে এসে আহত আশাহীন মানুষের সেবায় জীবন শেষ করছেন। তাই তাঁর মুখে এই স্বর্গীয় বিভা, এই অবিশ্বাস্য দীপ্তি।
রাশফুকোর বইয়ে আছে: ‘বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চেহারার খুঁতগুলোর সাথে মনের খুঁতগুলোও ধরা পড়ে।’ কিন্তু এটা সবার জন্য সত্য নয়। যে মনে বা চেহারায় খুঁত নেই বয়স সে খুঁত খুঁজে পাবে কী করে? এমন জীবন কি বয়সের সঙ্গে আরও সুন্দর হয়ে উঠবে না? চল্লিশ বছরের রবীন্দ্রনাথের চাইতে আশি বছরের রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশি সুন্দর। কেন? ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’ নামে একটা পর্ব আছে উপনিষদের মধ্যে। সেখানে একটা জায়গায় বলা হয়েছে: ‘চলতে চলতে যে মানুষের বদন শ্রান্ত, সেই শ্রান্ত বদনের চাইতে সুন্দরতর শোভা তুমি কোথায় দেখতে পাবে?’ শ্রমের মধ্যে দিয়ে, আত্মোৎসর্গের মধ্য দিয়ে, যে-মানুষের মুখমন্ডল শ্রান্ত হয়েছে সেই শ্রান্ত মুখমন্ডলের চাইতে সুন্দর আর কিছুই হতে পারে না। তাই তাঁর মুখ অমন জ্যোতিতে ভরা। ঐ বইয়ে এমনি আরও অনেক অনবদ্য কথা আছে। তার একটা বলেই কথা শেষ করব।
একটু ভূমিকা দিয়ে কথাটা বলি। আপনারা জানেন, হিন্দুশাস্ত্রে আছে পৃথিবীতে যুগ চারটি। প্রথমে ছিল সত্য যুগ। তখন মিথ্যা, পাপ, অন্যায়Ñএসব কিছুই ছিল না, গরুর দুধ ছিল একদম খাঁটি। তারপর এল দ্বাপর, তারপর এসেছে ত্রেতা। আর আমরা বাস করছি কলির যুগে। কলির যুগে মানে মিথ্যা পাপ আর অনাচারে ভরা পৃথিবীতে। ঋষি বলছেন এই যুগবিভাগ সঠিক নয়। অন্যভাবে একে দেখতে হবে। আসলে: ‘আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখনই কলিকাল, যখন জাগি তখন ত্রেতা, যখন উঠে দাঁড়াই তখন দ্বাপর এবং যখন চলতে শুরু করি তখনই সত্যযুগ।’ সুতরাং ‘চল চল।’ যতক্ষণ চলছি ততক্ষণই সত্যযুগ। তাঁকে দেখলেই বোঝা যায় উনি রয়েছেন সত্যযুগে, কারণ তিনি কেবলই চলছেন। তাই তিনি এমন স্নিগ্ধ আর উজ্জ্বল। আমার হৃদয়ের সমস্ত অভিনন্দন তাঁর জন্য। আমরা আশা করি আদর্শ, আবেগ, অনুভূতি বা স্বপ্নগতভাবে আমরা ভবিষ্যতেও একসঙ্গে থাকব।
>>>বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ভেলরি টেইলর-এর ভূমিকা শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রদত্ত বক্তৃতা: ২০০১
আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে আজ বিরাট হতাশা। আমি যখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের শাখা খুলতে যাই তখন প্রায়ই লোকেরা বলে: ‘আর জায়গা পেলেন না ভাই, এখানে এসেছেন! শাখা খুলবেন কোনখানে। সব তো এখানে জন্তু-জানোয়ার।’ আমি কিন্তু তাঁদের সাবধানবাণী শুনি না। শাখা খুলে ফেলি।
বছর-পাঁচেক পর সে-শাখা যখন ফুল পাতায় ঝলমলিয়ে ওঠে তখন তাঁদের কাছে গিয়ে বলি: ‘আপনারা তো ‘জানোয়ার’ ‘জানোয়ার’ করেছিলেন কিন্তু দেখুন কত মানুষ আছে এখানে। কেউ খোঁজেননি বলে তাদের পাননি। যারা এদেশে আজ এই জাতির শক্তি ও বিবেককে ধারণ করে আছে, খুঁজলে ঠিকই তাদের পাওয়া যাবে। না-খুঁজলে কী করে পাব?’
আমাদের চারপাশে যে-অসংখ্য অবহেলিত পঙ্গু মানুষেরা অসহায় হয়ে, তিলে তিলে ধুঁকে মরছে, ভালোবেসে তাদের না খুঁজলে কোনোদিন তাদের আমরা দেখতে পাব না। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের জন্য আমাদের ভেতরে ভালোবাসা না জাগবে ততক্ষণ আমরা কেবল ওদের ঐ কুশ্রী চেহারাতেই দেখব। ফরাসি রূপকথায় ‘বিউটি এ্যান্ড দি বিস্ট’ নামে একটা অপূর্ব গল্প আছে। গল্পটাতে আছে: দানবের মতো দেখতে একটা জন্তু বিউটিকে তার প্রাসাদে ধরে নিয়ে যায়। বিউটি খুবই রূপসী। জন্তুটা বিউটিকে খুবই ভালোবাসে, তার জন্য একা ডুকরে ডুকরে কাঁদে, তাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু বিউটির মনে তার জন্য প্রেম জাগে না। ‘ও একটা জানোয়ার। ওকে কী করে ভালোবাসব’, মনে হয় বিউটির। ভালোবাসার যন্ত্রণায়, কষ্টে জন্তুটা ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার মৃত্যুদিন ঘনিয়ে আসে। একদিন প্রাসাদের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বিউটি ঐ মৃত্যুযন্ত্রণাক্লিষ্ট জানোয়ারটার গোঙানি শুনতে পায়। কাছে গিয়ে দেখে কষ্টে বেদনায় সে শেষ হয়ে এসেছে। জন্তুটার কষ্ট দেখে বিউটির চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। তার অমনি ঘটে এক আশ্চর্য ঘটনা। জানোয়ারটা সুদর্শন রাজপুত্র হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। (আসলে জন্তুটা ছিল একজন অভিশপ্ত রাজপুত্র। যার শাপে সে জন্তু হয়েছিল, সে শর্ত দিয়েছিল, তার দুঃখে ব্যথিত হয়ে কেউ যদি কোনোদিন চোখের পানি ফেলে তবে সে আবার তার রাজপুত্রের চেহারা ফিরে পাবে।) গল্পটার ভেতরের মূল কথাটা কি? কথাটা হল: আমাদের চারপাশের দুঃখী পৃথিবীটা অমনি এক সুদর্শন রাজপুত্রের মতো। অপ্রেমের অভিশাপে সে জন্তুর মতো কদাকার হয়ে আছে। যতক্ষণ আমরা তাকে ভালো না বাসি ততক্ষণ সে তার অভিশপ্ত চেহারা নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা সেই রাজপুত্রকে পাই তখনই যখন তার জন্য আমাদের চোখের পানি মাটিতে ঝরে।
পৃথিবীর কুশ্রীতম নিঃস্বতম মানুষের মধ্যেও আছে এই রাজপুত্র। আমাদের প্রেম দিয়ে, বেদনা দিয়ে, অশ্রু দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে সেই রাজপুত্রকে পেতে হয়। ভেলরি টেইলর তাদের পেয়েছেন। তিনি বাংলাদেশকে ভালো বেসেছেন, এখানকার দুঃখী মানুষের জন্য চোখের পানি ফেলেছেন। তাই সুন্দর রাজপুত্রের মতো এই বাংলাদেশ তাঁর চারপাশে আজ দাঁড়িয়ে আছে।
উনি বাংলাদেশের প্রেমে পড়েছেন। আমার ধারণা কেবল প্রেমে পড়েননি, এদেশের সঙ্গে তিনি বিবাহিতও হয়েছেন। না হলে শুধু প্রেমের জন্য এতদিন, দীর্ঘ তিরিশটা বছর কি তিনি কাটাতে পারতেন? প্রেম এত দীর্ঘজীবী নয়। আমি নিশ্চিত এই জাতির সঙ্গে এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে তিনি বাঁধা। কিন্তু কিসের সঙ্গে বাঁধা পড়েছেন? না, এর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বা ভোগলিপ্সার সঙ্গে নয়, আখের গোছানোর সঙ্গে নয়, বাঁধা পড়েছেন তিনি এ জাতির অসহায়তার সঙ্গে, নিঃস্বতার সঙ্গে। এর দুঃখ আর অশ্রুর সঙ্গে। উনি অনুভব করেছেন এই বেদনাগুলো ইউরোপেও আছে, কিন্তু অত স্পষ্ট করে তাদের দেখা যায় না। গেলেও সেই বেদনায় শুশ্রƒষা দেবার মানুষ সেখানে আছে। কিন্তু এখানে কেউ নেই। তাই এই বেদনা এবং দায়িত্ব তিনি নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। আমাদের জাতির এই দুঃখের সঙ্গেই তিনি সত্যিকারভাবে বিবাহিত হয়েছেন।
কিন্তু তাই বলে এই প্রাপ্তিটুকুর জন্য একটা গোটা জীবন দিয়ে দেওয়া এ কি এতই সহজ? আমাদের হতাশা-যন্ত্রণা, দুঃখ-কষ্ট আজ এতটাই দুঃসহ যে বেঁচে থাকার সমস্ত আশা আর আনন্দ মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই বাংলাদেশের তলা থেকে আজ জেগে উঠছে আরেকটা বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশকে আমরা আজো ঠিকমতো দেখিনি, কিন্তু অচিরেই দেখব। সে সুখে আশায় ভরা এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। আজ সে নেই, কিন্তু সংগ্রাম ও দুঃখের মধ্যদিয়ে তাকে বহু মানুষ তিল তিল করে জন্ম দিয়ে চলেছে। আমাদের সংগ্রাম সেই বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য।
হুবহু এক কাজ না করলেও আমাদের সঙ্গে গভীর মিল আছে তাঁর। উনি একধরনের প্রতিবন্ধী শুধু শারীরিক হয় না, মানসিকও হয়Ñআত্মাও হয়। প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন: ‘দেহের মৃত্যুর রেজিস্ট্রি রাখা হয় প্রতিবন্ধিত্বের মতো স্পর্শগ্রাহ্য নয় বলে তা আমাদের চোখে পড়ে না। যদি আত্মার মৃত্যুর রেজিস্ট্রি রাখা হত তাহলে হয়তো দেখা যেত আমাদের তেরো কোটি লোকের মধ্যে ১২ কোটি ৯০ লক্ষ লোক অনেক আগেই মারা গেছে। আমরা সেই মানসিক প্রতিবন্ধিত্বকে সারিয়ে তোলার জন্য অল্পস্বল্প কাজ করছি। কিন্তু শুধু শারীরিক বা মানসিকÑএর যে-কোনো একটিকে আরোগ্য করলেই চলবে না। দুটোকেই আমাদের সারিয়ে তুলতে হবে। আমরা এই দুই প্রতিষ্ঠান থেকে দুই ধরনের প্রতিবন্ধীদের সারিয়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছি। এদিক থেকে আমরা পরিপূরক।
এতক্ষণ ভেলরি টেইলরের কাছ থেকে যে-গল্প আমরা শুনলাম এ কি ব্যর্থতার গল্প? এই-যে অসহায়, আশ্বাস-হারিয়ে-ফেলা পঙ্গু হওয়া মানুষদের নিষ্ফল জীবন থেকে টেনে তুলে আলো-আশায় ভরা একটা স্বনির্ভর জীবনের মধ্যে তিনি বাঁচিয়ে তুলছেন, সম্মান আর মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করছেন, এ কি সোজা কাজ? আলোকিত মানুষের জন্য আন্দোলন কি শুধু আমরাই করি? এটাও কি আলোকিত মানুষেরই আন্দোলন নয়? তাঁর মমতার স্পর্শ পেয়ে পঙ্গু বিকলাঙ্গ মানুষেরা এই যে পৃথিবীকে আবার দেখছে, এখানে নিঃশ্বাস নিচ্ছে কী অসাধারণ কাজ এ? কী আলোকবর্তিকারই প্রজ্বলন নয়? একটা মাত্র জীবনই তো আমরা পাই পৃথিবীতে। সেই জীবন হারিয়ে ফেলার চাইতে যন্ত্রণাময় অন্ধকারময় আর কী হতে পারে? সেই জীবন আবার ফুটে উঠল, একটা নিভে যাওয়া প্রদীপ আবার আলোকিত হলÑএটা যে কতবড় অপার্থিব আনন্দ, এ যে পেয়েছে সে-ই জানে। এমনি হাজার হাজার প্রদীপ জ্বালাতে পেরেছেন বলেই এদেশে তিনি থেকে গেছেন, এখানকার মানুষকে ভালোবেসেছেন বলেই জীবনটা তাদের জন্য দিতে পারছেন।
উনি যখন কথা বলছিলেন আমি তখন তার পবিত্রতামাখা মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নিজেকে অন্যের জন্য বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে পরিতৃপ্তি আর প্রসন্নতায় জ্বলজ্বল করছিল তাঁর মুখ। তাঁর মুখের দীপ্তির মধ্যেই তাঁর ভালোবাসা আমি দেখছিলাম। আমরা অক্ষম। একেকবার একেক ইচ্ছার চাবুক ক্ষতবিক্ষত হই। একবার এটা করি, একবার সেটা। কোনোকিছুতে একাগ্র হতে পারি না। আমার নিজের কথাই বলি। একবার টেলিভিশনে যাই তো একবার করি ডেঙ্গু আন্দোলন। একবার সমাজ, একবার শিল্প; একবার শিক্ষা, একবার সাহিত্য, একবার পরিবেশÑকী এসব! জীবনের সর্বোচ্চকে স্পর্শ করতে চাইলে একটা জায়গায় নতজানু হতে হয়, সেজদা দিয়ে তার ভেতর বিলীন হতে হয়। আমাদের মতো বিশৃঙ্খল, অস্থির, অস্বস্ত মানুষরা এটা পারে না। তাঁকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই এজন্য যে, নিমগ্ন আত্মদানের তিনি এক অনন্য উদাহরণ।
একদিন আমার আমন্ত্রণে ঢাকার স্কুলগুলোর বেশ কিছু হেডমাস্টার এই ঘরে এসেছিলেন। সভা শুরু হলে দেখলাম কয়েকজন ফাদার রয়েছেন তাঁদের মধ্যে। তাঁদের দেখে মনে হল, যে-জ্যাম, জেলি, রুটি, মাখনের জন্য আমাদের মানুষেরা পাগলের মতো দেশ ছেড়ে যায় যায় ইয়োরোপ আমেরিকায়, এঁরা সেসব দেশের সেই সব মোহ ছেড়েই গারো পাহাড়, আসাম আর সুমাত্রার জঙ্গলের মধ্যে জীবন শেষ করে চলেছেন। ভাবলাম, আমরাও কি এই আদর্শের উদাহরণ হতে পারি না? এই ফাদারদের দেখলেও তো বোঝা যায়, কীভাবে মানুষ নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে। আহরণের ভেতর দিয়ে মানুষ টিকে থাকে, কিন্তু বড় হয় দিতে পারার মধ্য দিয়ে। ছোটজীবনকে উৎসর্গ করেই বড়জীবনকে পেতে হয়; পৃথিবীকে উৎসর্গ করে স্বর্গকে। তাহলেই কেবল জীবন ওরকম আনন্দ-জ্যোতিতে ভরে ওঠে। তিনি ঠিক এই কাজটিই করছেন। তিনি এই নিঃস্ব হতশ্রী দেশে এসে আহত আশাহীন মানুষের সেবায় জীবন শেষ করছেন। তাই তাঁর মুখে এই স্বর্গীয় বিভা, এই অবিশ্বাস্য দীপ্তি।
রাশফুকোর বইয়ে আছে: ‘বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চেহারার খুঁতগুলোর সাথে মনের খুঁতগুলোও ধরা পড়ে।’ কিন্তু এটা সবার জন্য সত্য নয়। যে মনে বা চেহারায় খুঁত নেই বয়স সে খুঁত খুঁজে পাবে কী করে? এমন জীবন কি বয়সের সঙ্গে আরও সুন্দর হয়ে উঠবে না? চল্লিশ বছরের রবীন্দ্রনাথের চাইতে আশি বছরের রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশি সুন্দর। কেন? ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’ নামে একটা পর্ব আছে উপনিষদের মধ্যে। সেখানে একটা জায়গায় বলা হয়েছে: ‘চলতে চলতে যে মানুষের বদন শ্রান্ত, সেই শ্রান্ত বদনের চাইতে সুন্দরতর শোভা তুমি কোথায় দেখতে পাবে?’ শ্রমের মধ্যে দিয়ে, আত্মোৎসর্গের মধ্য দিয়ে, যে-মানুষের মুখমন্ডল শ্রান্ত হয়েছে সেই শ্রান্ত মুখমন্ডলের চাইতে সুন্দর আর কিছুই হতে পারে না। তাই তাঁর মুখ অমন জ্যোতিতে ভরা। ঐ বইয়ে এমনি আরও অনেক অনবদ্য কথা আছে। তার একটা বলেই কথা শেষ করব।
একটু ভূমিকা দিয়ে কথাটা বলি। আপনারা জানেন, হিন্দুশাস্ত্রে আছে পৃথিবীতে যুগ চারটি। প্রথমে ছিল সত্য যুগ। তখন মিথ্যা, পাপ, অন্যায়Ñএসব কিছুই ছিল না, গরুর দুধ ছিল একদম খাঁটি। তারপর এল দ্বাপর, তারপর এসেছে ত্রেতা। আর আমরা বাস করছি কলির যুগে। কলির যুগে মানে মিথ্যা পাপ আর অনাচারে ভরা পৃথিবীতে। ঋষি বলছেন এই যুগবিভাগ সঠিক নয়। অন্যভাবে একে দেখতে হবে। আসলে: ‘আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখনই কলিকাল, যখন জাগি তখন ত্রেতা, যখন উঠে দাঁড়াই তখন দ্বাপর এবং যখন চলতে শুরু করি তখনই সত্যযুগ।’ সুতরাং ‘চল চল।’ যতক্ষণ চলছি ততক্ষণই সত্যযুগ। তাঁকে দেখলেই বোঝা যায় উনি রয়েছেন সত্যযুগে, কারণ তিনি কেবলই চলছেন। তাই তিনি এমন স্নিগ্ধ আর উজ্জ্বল। আমার হৃদয়ের সমস্ত অভিনন্দন তাঁর জন্য। আমরা আশা করি আদর্শ, আবেগ, অনুভূতি বা স্বপ্নগতভাবে আমরা ভবিষ্যতেও একসঙ্গে থাকব।
>>>বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ভেলরি টেইলর-এর ভূমিকা শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রদত্ত বক্তৃতা: ২০০১
No comments